ওয়ারেন হেস্টিংসের ভূমিরাজস্ব নীতি প্রসঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষার যুগ, দ্বৈত শাসনের অবসান, নায়েব-দেওয়ান পদ বিলোপ, কোষাগার স্থানান্তর, রাজস্ব বোর্ড গঠন, ভ্রাম্যমাণ কমিটি গঠন, পাঁচশালা বন্দোবস্ত ও তার ত্রুটি, একশালা বন্দোবস্ত, রাজস্ব কমিটি গঠন, প্রাদেশিক কাউন্সিল গঠন, আমিনি কমিশন গঠন এবং তার ভূমি রাজস্ব নীতির ফলাফল সম্পর্কে জানবো।
বাংলার গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসের ভূমি রাজস্ব নীতি প্রসঙ্গে ভারতের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে পরীক্ষা নিরীক্ষা, ওয়ারেন হেস্টিংস কর্তৃক দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার অবসান, ওয়ারেন হেস্টিংসের পাঁচশালা বন্দোবস্ত, ইজারাদারদের জমি বন্দোবস্ত, ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে রাজস্ব বোর্ড গঠন, ওয়ারেন হেস্টিংসের পাঁচশালা বন্দোবস্তের ত্রুটি, ওয়ারেন হেস্টিংসের একশালা বন্দোবস্ত, ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে আমিনি কমিশন গঠন ও ওয়ারেন হেস্টিংসের ভূমি রাজস্ব নীতির ফলাফল সম্পর্কে জানব।
ওয়ারেন হেস্টিংসের ভূমিরাজস্ব নীতি (Land Revenue Policy of Warren Hastings)
ঐতিহাসিক ঘটনা | ওয়ারেন হেস্টিংসের ভূমিরাজস্ব নীতি |
সময়কাল | ১৭৭২-১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দ |
দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার অবসান | ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দ |
পাঁচশালা বন্দোবস্ত | ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দ |
একশালা বন্দোবস্ত | ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দ |
ভূমিকা :- ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে এক অতি সংকটময় মুহূর্তে ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলার গভর্নর পদে নিযুক্ত হন (১৭৭২-৮৫ খ্রিঃ)। সে যুগে কোনও বিদেশির পক্ষে ভারতীয় ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা, তার সমস্যাবলী ও সমাধানের পথ নির্ণয় করা সহজ ছিল না।
হেস্টিংসের আমল পরীক্ষা-নিরীক্ষার যুগ
ওয়ারেন হেস্টিংসের সম্পূর্ণ শাসনকালটিই হল ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে পরীক্ষা-নিরীক্ষার যুগ। এই সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তিনি সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে ছিলেন মাত্র—সমাধানে পৌঁছতে পারেন নি।
হেস্টিংস কর্তৃক দ্বৈত শাসনের অবসান
বাংলার শাসনভার হাতে পেয়ে তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তৃপক্ষের নির্দেশানুসারে প্রথমেই তিনি দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটান (এপ্রিল, ১৭৭২ খ্রিঃ) এবং রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব সরাসরি কোম্পানি গ্রহণ করে।
হেস্টিংস কর্তৃক নায়েব দেওয়ান পদ বিলুপ্ত
নায়েব-দেওয়ান রেজা খাঁ ও সিতাব রায় পদচ্যুত হন এবং এই পদ দু’টি বিলোপ করা হয়।
হেস্টিংসের আমলে কোষাগার স্থানান্তর
সরকারি কোষাগার মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় স্থানান্তরিত করা হয়।
হেস্টিংসের আমলে রাজস্ব বোর্ড গঠন
গভর্নর ও তাঁর কাউন্সিলের সদস্যদের নিয়ে একটি রাজস্ব বোর্ড বা ‘বোর্ড অব রেভিনিউ’ (Boardof Revenue) গঠিত হয়। এই রাজস্ব বোর্ডের ওপর দেওয়ানি সংক্রান্ত সকল বিষয়ের দায়িত্ব অর্পিত হয়।
হেস্টিংসের আমলে ভ্রাম্যমাণ কমিটি গঠন
রাজস্ব আদায়ের জন্য গভর্নর ও তাঁর কাউন্সিলের চারজন সদস্যকে নিয়ে একটি ভ্রাম্যমান কমিটি (Committee of Circuit) গঠিত হয়। এই কমিটি জেলায় জেলায় ঘুরে ইজারাদারদের নিলামে জমি বন্দোবস্ত দেয়।
হেস্টিংসের পাঁচশালা বন্দোবস্ত
যে ইজারাদার কোম্পানিকে সর্বোচ্চ কর দিতে রাজি হয় তাকে পাঁচ বছরের জন্য জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। এই ব্যবস্থা ‘ইজারাদারি ব্যবস্থা’ বা ‘পাঁচসালা বন্দোবস্তু (১৭৭২-৭৭ খ্রিঃ) নামে পরিচিত।
হেস্টিংসের আমলে কালেক্টর নিয়োগ
ইতিপূর্বে ‘সুপারভাইজার’ নামক ইংরেজ কর্মচারীরা জেলায় কোম্পানির রাজস্ব-সংক্রান্ত বিষয় তদারক করত। হেস্টিংস এদের নতুন নামকরণ করেন ‘কালেক্টর’। এই সব ইংরেজ কর্মচারী জেলায় রাজস্ব আদায় এবং বিচার ও শাসন পরিচালনার দায়িত্ব পায়। তাকে সাহায্য করত একজন ভারতীয় দেওয়ান।
পাঁচসালা বন্দোবস্তের ত্রুটি
পাঁচসালা বন্দোবস্তের নানা অসুবিধা দেখা দেয়। যেমন –
- (১) অসাধু ইজারাদাররা বহুক্ষেত্রে বেশি রাজস্ব আদায়ের জন্য প্রজাদের ওপর অত্যাচার চালাত।
- (২) নিলামের মাধ্যমে জমি ইজারা দেওয়ার ফলে চিরাচরিত জমিদাররা অনেকেই জমিদারিচ্যুত হন এবং তাঁদের স্থান দখল করে একদল ভূঁইফোড় ইজারাদার।
- (৩) বহুক্ষেত্রে কোম্পানির কর্মচারীরা নিজেরা বেনামে জমিদারি ইজারা বন্দোবস্ত নিত।
- (৪) নবনিযুক্ত ইজারাদাররা বহুক্ষেত্রেই কোম্পানিকে ঠিক মতো রাজস্ব দিত না। এর ফলে কোম্পানির আয় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
- (৫) জমিতে ইজারাদারদের স্বত্ব অনিশ্চিত হওয়ায় তারা জমি ও কৃষকের উন্নতির দিকে নজর দিত না।
হেস্টিংসের একসালা বন্দোবস্ত
পাঁচশালা বন্দোবস্তের ত্রুটি গুলি দূর করার উদ্দেশ্যে হেস্টিংস ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে ‘একসালা বন্দোবস্ত’ চালু করেন। এই ব্যবস্থারপ্রতি বছর নিলামের মাধ্যমে জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হত। এই ব্যবস্থাও প্রজার পক্ষে মঙ্গলজনক হয় নি।
হেস্টিংসের আমলে রাজস্ব কমিটি গঠন
১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে হেস্টিংস নতুন কিছু সংস্কারের কাজে হাত দেন। রাজস্ব বোর্ডের দু’জন সদস্য এবং কোম্পানির তিনজন উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে নিয়ে একটি রাজস্ব কমিটি (Committee of Revenue) গঠন করেন।
হেস্টিংসের আমলে প্রাদেশিক কাউন্সিল গঠন
১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যাকে ছয়টি অংশে ভাগ করে প্রত্যেক অংশে একটি করে ‘প্রাদেশিক কাউন্সিল’ (Provincial Council) গঠন করেন। প্রত্যেক কাউন্সিলে একজন করে ভারতীয় দেওয়ান নিয়োগ করা হয়।
হেস্টিংসের আমলে কালেক্টর পদ বিলুপ্ত
এই সময় কালেক্টররা অত্যন্ত দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে পড়েছিল তাই কালেক্টর পদ তুলে দেওয়া হয়।
হেস্টিংসের আমলে আমিনি কমিশন গঠন
১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে রাজস্ব-সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহের জন্য তিনি ‘আমিনি কমিশন’ (Amini Commission) গঠন করেন। এই কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী প্রাদেশিক কাউন্সিলগুলি বিলোপ করে পুনরায় কালেক্টর পদ চালু করে তাদের হাতে জেলা প্রশাসনের সকল দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।
হেস্টিংসের ভূমিরাজস্ব নীতির ফলাফল
- (১) হেস্টিংসের রাজস্ব সংস্কার কোনওভাবেই সাফল্যমণ্ডিত হয় নি। আসলে এটা ছিল পরীক্ষা-নিরীক্ষার যুগ—সাফল্যের যুগ নয়।
- (২) তাঁর সংস্কারের দ্বারা প্রজাবর্গের কোনও মঙ্গল হয় নি, বরং তাদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে এবং রাজস্ব সংক্রান্ত জটিলতাই বৃদ্ধি পায়।
- (২) একদিকে জমিদারের ওপর রাজস্বআদায়কারী এবং অন্যদিকে কৃষকের ওপর জমিদারের অত্যাচার বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়াও জমির মালিকানা অনিশ্চিত হওয়ায় জমির উন্নয়ন ব্যাহত হয়।
- (৩) ডঃ তারা চাঁদ বলেন যে, হেস্টিংসের রাজস্ব সংস্কার ভারতের গ্রামীণ অর্থনৈতিক কাঠামোর ওপর চরম আঘাত হানে।
- (৪) ফিলিপ ফ্রান্সিস (Philip Francis) বলেন যে, হেস্টিংসের রাজস্ব নীতির ফলে বাংলার প্রাচীন জমিদারদের অধিকাংশই ধ্বংস হয়ে যায় এবং রাজস্ব আদায়ের জন্য সরকার মেধাহীন নিম্নশ্রেণীর মানুষদের নিয়োগ করতে বাধ্য হয়।
উপসংহার :- রমেশচন্দ্র দত্ত বলেন যে, বাৎসরিক বন্দোবস্ত, নিয়ত খাজনা বৃদ্ধি এবং তা আদায়ের ব্যাপারে কঠোরতা প্রভৃতি কারণে বাংলার প্রায় সব বৃহৎ ও প্রাচীন জমিদার পরিবারগুলির বিপর্যয় ঘটে।
(FAQ) ওয়ারেন হেস্টিংসের ভূমিরাজস্ব নীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে।
ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দ।
ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে।