মুঘল সম্রাট শাহজাহানের আমলে উত্তরাধিকার যুদ্ধ প্রসঙ্গে ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে দারার চক্রান্ত, দ্বারাকে মিত্রহীন করা, সুজা ও মুরাদের অবিবেচক কাজ, তিন ভ্রাতার চুক্তি, মুরাদের সঙ্গে গোপন চুক্তি, সুজার পরাজয়, ঔরঙ্গজেবের জয়, সম্রাটের সুস্থতা, সামুগড়ের যুদ্ধ, বন্দী দারাশিকো, মুরাদের হত্যা ও দারাশিকোর হত্যা সম্পর্কে জানবো।
মুঘল সম্রাট শাহজাহানের আমলে উত্তরাধিকার যুদ্ধ
বিষয় | শাহজাহানের আমলে উত্তরাধিকার যুদ্ধ |
সম্রাট | শাহজাহান |
বাহাদুরপুরের যুদ্ধ | ১৬৫৩ খ্রি: |
সামুগড়ের যুদ্ধ | ১৬৫৮ খ্রি: |
আলমগীর | ঔরঙ্গজেব |
ভূমিকা :- শাহজাহানের অসুস্থতার ফলে সম্রাটের প্রতিনিধি হিসেবে দারা শাসনভার পরিচালনা করেন। শাহজাহানের তখন ৬৫ বৎসর বয়স। তাঁর স্বাস্থ্য বয়স অনুপাতে বেশী ভেঙে পড়েছিল।
দারাশিকো কর্তৃক রাজধানী আসার পথ রুদ্ধ
দারা ক্ষমতা হাতে নিয়ে বাংলা, গুজরাট দক্ষিণের রাজপথ রুদ্ধ করে দেন। রাজধানীতে অন্য তিন ভ্রাতার এজেন্ট ও গুপ্তচরদের বন্দী করে খবর পাঠাবার ব্যবস্থা রুদ্ধ করেন। এর ফলে তাঁর তিন ভ্রাতা রাজধানীর সংবাদ হতে বঞ্চিত হন এবং তাদের রাজধানী আসার পথ রুদ্ধ হয়।
সম্রাট শাহ্জাহানের মৃত্যু সম্পর্কে গুজব
ইতিমধ্যে গুজব রটতে থাকে যে, সম্রাটের দেহান্ত হয়েছে, ফলে হিন্দুস্থানের সর্বত্র থমথমে ভাব দেখা যায়।
উত্তরাধিকার যুদ্ধে ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে দারার চক্রান্ত
দারা তার ভ্রাতাদের মধ্যে ঔরঙ্গজেবকেই বিশেষ ভয় করতেন। তাকে ক্ষমতাহীন করার জন্য তিনি অনেক আগে থেকেই চক্রান্ত করেন। যেমন –
- (১) দক্ষিণে বিজাপুর যুদ্ধের সময় ঔরঙ্গজেবের অধীনে যে সকল যোগ্য সেনাপতি ও কর্মচারী ছিল তাদের বদলী করে উত্তরে নিয়ে চলে আসেন। এর ফলে ঔরঙ্গজেবের ক্ষমতা কমে যায়।
- (২) ঔরঙ্গজেব গোলকুণ্ডা ও বিজাপুর অধিকারে উদ্যত হলে তিনি সম্রাটের মাধ্যমে ঔরঙ্গজেবকে নিরস্ত করেন। কারণ দারা আশঙ্কা করেন যে, যদি ঔরঙ্গজেব সফল হন তবে তার মর্যাদা দারুণ বাড়বে। এই দুই রাজ্যের ধন-সম্পদ দখল করে তিনি ক্ষমতা বাড়াবেন। এইভাবে দারা তাঁর পিতার আমলেই ঔরঙ্গজেবকে কোণঠাসা করে রেখেছিলেন।
উত্তরাধিকার যুদ্ধে দারাকে মিত্রহীন করা
দারার হাতে শাসনভার স্থাপন এবং সম্রাটের অসুস্থতার সঠিক খবর ঔরঙ্গজেব তাঁর ভগিনী রোশনারার মারফৎ পান। সঙ্গে সঙ্গে তিনি কর্মপন্থা স্থির করেন। তিনি সুজার সঙ্গে আগেই দারার বিরুদ্ধে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন। এখন তিনি মুরাদকে এই চুক্তির অন্তর্ভুক্ত করে দারাকে মিত্রহীন করেন।
উত্তরাধিকার যুদ্ধের সময় সুজা ও মুরাদের অবিবেচক কাজ
বুদ্ধিহীন সুজা ও মুরাদ নিজ নিজ অঞ্চলে যথা বাংলা ও গুজরাটে নিজেদের সম্রাট বলে ঘোষণা করেন ও নিজ নামে খুৎবা পড়েন। একমাত্র ঔরঙ্গজেব এরূপ অবিবেচক কাজ করা থেকে বিরত থাকেন। কারণ তিনি জানতেন যে, তার পিতা তখনও জীবিত। যদি তিনি একাজ করেন তবে জনমত তাঁর বিপক্ষে যাবে।
উত্তরাধিকার যুদ্ধের সময় তিন ভ্রাতার চুক্তি
সুজা ও মুরাদকে নিজ পক্ষে এনে দারাকে ধ্বংস করার জন্য ঔরঙ্গজেব তিন ভ্রাতার চুক্তি করেন। এই চুক্তিতে স্থির হয় যে, এই তিন ভ্রাতার মধ্যে কেউ দারার দ্বারা আক্রান্ত হলে অপর দুজন তার সাহায্যে আসবেন। দারার বিরুদ্ধে তারা একত্রে অভিযান করবেন।
উত্তরাধিকার যুদ্ধের সময় মুরাদের সঙ্গে গোপন চুক্তি
ইতিমধ্যে সুজা দিল্লী অভিমুখে যাত্রা করেছেন সংবাদ পেয়ে, ঔরঙ্গজেব নর্মদা পার হয়ে মুরাদের বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হন। চতুর ঔরঙ্গজেব সরল প্রাণ মুরাদের সঙ্গে এক চুক্তি করেন। যার ফলে,
- (১) দারাকে কাফের বলে ধ্বংস করার সঙ্কল্প নেওয়া হয়।
- (২) পাঞ্জাব, আফগানিস্থান, কাশ্মীর ও সিন্ধু মুরাদকে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
- (৩) সাম্রাজ্য-এর বাকি অংশ ঔরঙ্গজেব পাবেন ঠিক হয়। মুরাদ ও ঔরঙ্গজেবের যুক্ত বাহিনী দিল্লীর দিকে এগোতে থাকে।
উত্তরাধিকার যুদ্ধে সুজার পরাজয়
দারা এই অবস্থায় সুজার বিরুদ্ধে তাঁর পুত্র সুলেমানের নেতৃত্বে এক বাহিনী পাঠান। বারাণসীর কাছে বাহাদুরপুরের যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে (১৬৫৩ খ্রি) সুজা বাংলার দিকে পালান। রাজা জয়সিংহ তার পিছু নেন।
উত্তরাধিকার যুদ্ধে ঔরঙ্গজেবের জয়
যশোবন্ত সিংহ ও কাশেম খাঁর নেতৃত্বে এক বাহিনী ঔরঙ্গজেব ও মুরাদের বিরুদ্ধে পাঠান হয়। ধর্মাটের যুদ্ধে ঔরঙ্গজেব যশোবন্ত সিংহ ও কাশেম খাঁকে পরাস্ত করেন। উভয় সেনাপতির ঝগড়ার ফলে এবং রাজা যশোবন্তের সেনাদলের দুর্বলতার জন্যই এই পরাজয় ঘটে।
সম্রাটের শাহজাহানের সুস্থতা
ইতিমধ্যে সম্রাট শাহজাহান সুস্থ হয়েছিলেন। তিনি যদি এই সময় বলিষ্ঠ হস্তক্ষেপ করতেন তবে তখনও গৃহযুদ্ধ নিবারণ করা যেত। কিন্তু দারার প্রতি তাঁর পক্ষপাতের জন্য তিনি তাঁর অন্য পুত্রদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা থেকে বিরত থাকেন। ফলে ঔরঙ্গজেব তাঁর প্রতিজ্ঞায় অটল হন।
উত্তরাধিকার যুদ্ধের সময় সামুগড়ের যুদ্ধ
- (১) এর পর ঔরঙ্গজেব-মুরাদের যুক্ত বাহিনী আগ্ৰার উপকণ্ঠে সামুগড়ে পৌঁছায়। দারা ৫০ হাজার সেনাসহ সামুগড়ে ঔরঙ্গজেব ও মুরাদকে বাধা দিতে আসেন। দারা নিজে অভিযান পরিচালনা করেন।
- (২) রাজপুত সেনারা তাঁর জন্য দেহের রক্ত ঢেলে দেয়। কিন্তু রণকৌশলে ঔরঙ্গজেব ছিলেন নিপুণ। ঔরঙ্গজেবের পক্ষেও রাজপুত ও মুসলিম সেনা ছিল। সামুগড়ের যুদ্ধে (১৬৫৮ খ্রি) দারার পরাজয় ঘটে।
উত্তরাধিকার যুদ্ধে বন্দী দারাশিকো
দারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আগ্রার দিকে পালান। ঔরঙ্গজেব আগ্রায় ঢুকে সম্রাটকে আগ্রা দুর্গে বন্দী করেন। এই স্থানে প্রায় ৮ বছর শাহজাহান বন্দী দশায় কাটান। আগ্রা জয়ের পর ঔরঙ্গজেব দিল্লী যাত্রা করেন।
উত্তরাধিকার যুদ্ধে মুরাদের হত্যা
ঔরঙ্গজেবের সাফল্য মুরাদের ঈর্ষার উদ্রেক করে এবং ঔরঙ্গজেব তা বুঝতে পেরে কৌশলে মুরাদকে বন্দী করেন এবং গোয়ালিয়র দুর্গে তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে নিজের সিংহাসন লাভের পথ নিষ্কণ্টক করেন।
উত্তরাধিকার যুদ্ধে জয়ী ঔরঙ্গজেবের নিজেকে সম্রাট রূপে ঘোষণা
ঔরঙ্গজেব ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীতে পৌঁছে ২১শে জুলাই নিজেকে সম্রাটরূপে ঘোষণা করেন এবং আলমগীর (বিশ্ব বিজেতা) উপাধি নেন।
উত্তরাধিকার যুদ্ধে দারাশিকোর হত্যা
- (১) দারা পাঞ্জাবের দিকে পালালে ঔরঙ্গজেব তাঁর পিছু নেন। দারা দিক বদলে গুজরাটে আসেন এবং এখানে এক সেনাদল গড়েন। মারওয়াড়ের রাজা যশোবন্ত সিংহ দারাকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেন, কিন্তু সেনাপতি জয় সিংহের দৌত্যের ফলে যশোবন্ত শেষ পর্যন্ত ঔরঙ্গজেবের পক্ষ নেন।
- (২) দেওরাইয়ের যুদ্ধে দারা পরাস্ত হয়ে দাদারের পথে পালাবার চেষ্টা করলে মালিক জাওয়ান খাঁ নামে এক পাঠান বিশ্বাসঘাতকতা করে তাকে বন্দী করেন এবং ঔরঙ্গজেবের সেনাপতির হাতে ফিরিয়ে দেন।
- (৩) দারাকে বন্দী অবস্থায় দিল্লীতে আনা হয় এবং তাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে তিনি বিধর্মী। দারার পুত্র সুলেমান সুকোকেও বন্দী করে গোয়ালিয়র দুর্গে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়।
উপসংহার :- যুবরাজ সুজা বাংলায় ঔরঙ্গজেবের বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হয়ে আরাকানে পালান। এখানে মগ দস্যুদের আক্রমণে তিনি নিহত হন। ঔরঙ্গজেবের সিংহাসন নিষ্কণ্টক হয়।
(FAQ) মুঘল সম্রাট শাহজাহানের আমলে উত্তরাধিকার যুদ্ধ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
শাহজাহান।
দারাশিকো, সুজা, ঔরঙ্গজেব ও মুরাদ।
ঔরঙ্গজেব।
১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে।