ওয়াল্টার হুইটম্যান

ওয়াল্টার হুইটম্যান (১৮১৯–১৮৯২) ছিলেন একজন প্রভাবশালী আমেরিকান কবি, প্রাবন্ধিক এবং সাংবাদিক, যিনি আধুনিক আমেরিকান কবিতার অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচিত। তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ “লিভস অব গ্রাস” (Leaves of Grass) ব্যক্তিস্বাধীনতা, প্রকৃতি এবং গণতন্ত্রের উদযাপন করে। হুইটম্যানের লেখায় আমেরিকার গণতান্ত্রিক চেতনা এবং সাধারণ মানুষের জীবনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ পায়। তার উদার মানবিকতা, মুক্তচিন্তা এবং লেখনশৈলী পরবর্তী সাহিত্য প্রজন্মের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।

কবি ওয়াল্টার হুইটম্যান

ঐতিহাসিক চরিত্রওয়াল্টার হুইটম্যান
জন্ম৩১ মে, ১৮১৯ খ্রি
জন্মস্থানওয়েস্ট হিলস, হান্টিংটন, নিউ ইয়র্ক, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র
পেশাকবি, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক
বিখ্যাত কাজ“Leaves of Grass”
সাহিত্য ধারাট্রান্সসেন্ডেন্টালিজম, বাস্তববাদ
প্রভাবিতআমেরিকান কবিতা এবং সাহিত্য
জীবন দর্শনব্যক্তিস্বাধীনতা, মানবতাবাদ, প্রকৃতি ও গণতন্ত্র
মৃত্যু২৬ মার্চ, ১৮৯২ খ্রি
ওয়াল্টার হুইটম্যান

ভূমিকা :- মূলতঃ কবি হিসেবে খ্যাত হলেও প্রবন্ধকার ও সাংবাদিক হিসেবেও ওয়াল্টার হুইটম্যানের অবদান নগণ্য ছিল না। সমগ্র কৃতিত্বের বিচারে হুইটম্যান ছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর আমেরিকার সাহিত্যের অন্যতম উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। কেবল সাহিত্যের ক্ষেত্রেই তাঁর অবদান সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি ছিলেন সমাজ সংস্কারক এবং নবজাগরণ-এর অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব।

ওয়াল্টার হুইটম্যানের জন্ম

১৮১৯ খ্রিস্টাব্দের ৩১শে মে লং আইল্যান্ডের ওয়েস্ট হিলে এক দরিদ্র জুতোর মিস্ত্রীর পরিবারে জন্মেছিলেন ওয়াল্টার হুইটম্যান। দুটি বংশধারার রক্তের সংমিশ্রণ ঘটেছিল তাঁর মধ্যে। পিতা ছিলেন খাঁটি ইংরাজ। মা ছিলেন নেদারল্যান্ড বা হল্যান্ডের মেয়ে। পিতা ও মাতা উভয়ের বংশধারারই বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটেছিল তাঁর মধ্যে।

কবি ওয়াল্টার হুইটম্যানের শৈশব জীবন

আয়-রোজগার বাড়াবার উদ্দেশ্যে হুইটম্যানের পিতা ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে লং আইল্যান্ড ছেড়ে চলে আসেন ব্রুকলিনে। এখানেই তাঁরা স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। জীবনযুদ্ধে অসফল পিতার সন্তান হিসেবে শৈশব জীবন থেকেই হুইটম্যানকে দারিদ্র্য ও নানাবিধ কৃচ্ছতার মধ্যে কাটাতে হয়েছে। পিতার সান্নিধ্য বিশেষ পান নি তিনি। মায়ের স্নেহ-ছায়াতে থেকেই বড় হয়ে উঠেছেন। তাই মা-ই ছিলেন তাঁর জীবনের প্রধান অবলম্বন।

ওয়াল্টার হুইটম্যানের শিক্ষা ও কর্ম

প্রাথমিক স্কুলের পড়া শেষ করেই হুইটম্যানকে ছাপার কাজের শিক্ষানবিসী করতে হয়। মাত্র ১১ বছর বয়সেই, ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে জীবিকা অর্জনের জন্য তাঁকে পাড়ি দিতে হয় নিউইয়র্ক শহরে। কিন্তু অপরিচিত পরিবেশে কেবলমাত্র ছাপার কাজ অবলম্বন করে টিকে থাকা খুবই কষ্টকর হয়েছিল তাঁর পক্ষে। একবছর পরেই পেশা বদল করে গ্রহণ করলেন শিক্ষকতার কাজ। ব্রুকলিন শহরেই জীবনের প্রথম অধ্যায়টি কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছিল তাঁর।

ব্রুকলিন শহরের প্রতি ওয়াল্টার হুইটম্যানের আকর্ষণ

শহরের বিচিত্র পরিবেশ তাঁর শৈশব জীবনকে খুবই প্রভাবিত করেছিল তাই ব্রুকলিন শহরের প্রতি বরাবরই তিনি আকর্ষণ বোধ করতেন। এই শহরের জীবনের স্মৃতি, প্রকৃতির লীলাবৈচিত্র্য বারবার তিনি তাঁর কবিতার মধ্য দিয়ে স্মরণ করেছেন।

হুইটম্যানের গভীর জ্ঞান অর্জন

প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত হবার সুযোগ না পেলেও জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় গভীর জ্ঞান অর্জন করেছিলেন হুইটম্যান। তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত মানুষ। বিভিন্ন সময়ে লব্ধ অভিজ্ঞতাই ছিল তাঁর জীবন-পথের পাথেয়। জ্ঞানার্জনের প্রতি গভীর আগ্রহ তাঁর ছিল বরাবর। তাই সুযোগ পেলেই বিভিন্ন বিষয়ের বই সংগ্রহ করে পড়তেন।এভাবেই বৃহত্তর জগতের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন তিনি। দিনে দিনে সেই পরিচয় গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে।

পত্রিকার সম্পাদক ওয়াল্টার হুইটম্যান

১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে কুড়ি বছরের যুবক হুইটম্যানের জীবন নতুন পথে মোড় নিল। শিক্ষকতার কাজ ছেড়ে নিজের সম্পাদনায় একটা পত্রিকা প্রকাশ করার পরিকল্পনা নিলেন। প্রস্তুতি হিসেবে, প্রথমেই কিনলেন একটা প্রেস। তারপর একদিন সেই প্রেস থেকে ছাপা হয়ে লং আইল্যান্ডার নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ লাভ করল। ছাপার কাজ ছেলেবেলাতেই তিনি রপ্ত করে নিয়েছিলেন। পত্রিকা প্রকাশের আনুষঙ্গিক অন্যান্য কাজকর্মও একাই করতে লাগলেন তিনি। প্রবল উৎসাহ নিয়ে লং আইল্যান্ডার প্রকাশ করলেও সেই উৎসাহ বেশি দিন বজায় রাখা সম্ভব হল না। নতুন পত্রিকা আশানুরূপ সাড়া জাগাতে পারল না। ফলে কোনওরকমে বছরখানেক টিকে থাকল কাগজটি। তারপর প্রকাশ বন্ধ হয়ে গেল। ছোট্ট প্রেসটিও বিক্রি করে দিলেন তিনি।

ওয়াল্টার হুইটম্যানের সম্পাদকের চাকরি গ্রহণ

লং আইল্যান্ডার মাত্র এক বছর পরমায়ু পেলেও হুইটম্যানের জীবনে তার প্রভাব হয়েছিল সুদূর প্রসারী। সাংবাদিকতার জীবনে আকর্ষণ তাঁকে আরো বৃহত্তর ক্ষেত্রে অগ্রসর হতে সাহায্য করল। তিনি নিউইয়র্কের একটি দৈনিক পত্রিকা আরোরা এবং একটি সান্ধ্য পত্রিকায় সম্পাদকের চাকরি নিলেন এবং যোগ্যতার সঙ্গে দুই বছর এই দায়িত্ব পালন করলেন। সম্পাদনা ও সাংবাদিকতার কাজে এতটাই সাফল্য পেয়েছিলেন হুইটম্যান যে এক সময়ে দৈনিক সাপ্তাহিক মিলিয়ে ছয় ছয়টি কাগজের সম্পাদনা কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন তিনি।

ব্রুকলিন শহরে হুইটম্যানের প্রত্যাবর্তন

শৈশবের ব্রুকলিন শহর যেন নিঃশব্দে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। অন্তরে সেই আহ্বান যেন শুনতে পেতেন হুইটম্যান। তাই নিউইয়র্ক ছেড়ে ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে ফিরে এলেন ব্রুকলিনে। স্থানীয় কাগজ লং আইল্যান্ড স্টার-এ নিয়মিত লিখতে শুরু করলেন। মাত্র এক বছর সময়ের মধ্যেই বিচক্ষণ সাংবাদিক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। এই খ্যাতি এক অভাবিত পুরস্কার নিয়ে এলো হুইটম্যানের জীবনে। এলো বৃহত্তর কর্মক্ষেত্রের আহ্বান। ব্রুকলিনের বিখ্যাত দৈনিক পত্রিকা ব্রুকলিন ডেইলি ঈগল-এর সম্পাদকের চাকরি পেলেন তিনি। সেই সময়ে তাঁর বয়স মাত্র ২৭ বছর।

পাঠকমহলে হুইটম্যানের পরিচিতি

সম্পাদকের কাজের সঙ্গে যুক্ত হলেও দৈনিক পত্রিকায় কেবল সংবাদ নিয়েই পড়ে থাকেন নি তিনি। পাশাপাশি সাহিত্যচর্চা করতেন নিয়মিত। দু বছর ব্রুকলিন ডেইলি ঈগল-এর কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন হুইটম্যান। এই সময়ের মধ্যে গদ্য ও পদ্য সাহিত্যেও যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করলেন তিনি। নিয়মিত লিখতে আরম্ভ করলেন গল্প ও কবিতা। ফলে বৃহত্তর পাঠকমহলে বাড়তে লাগল তাঁর পরিচিতি।

ওয়াল্টার হুইটম্যানের অদ্ভুত জীবন

অদ্ভুত এক জীবন ছিল হুইটম্যানের। প্রকৃতির রূপ বদলের মতোই এই প্রতিভাধর মানুষটির ব্যক্তিজীবন ও কর্মজীবনে ঘন ঘন পরিবর্তন ঘটেছে। সাংবাদিকতা দিয়ে জীবন শুরু করেছিলেন, সেই কাজ ছেড়ে মৌলিক রচনা ধরেছেন। পাশাপাশি কখনো খুলে বসেছেন ছাপাখানা, কিংবা মনিহারি দোকান। আবার করেছেন বাড়ি বানাবার কাজ, সম্পত্তি বেচাকেনার ব্যবসা।

হুইটম্যানের সাহিত্যের পটভূমি

মূলতঃ শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত শহর ব্রুকলিন, লং আইল্যান্ড এবং নিউইয়র্ক ছিল তাঁর সাহিত্যের পটভূমি। তিনি তাঁর সাহিত্যের রসদ সংগ্রহ করেছেন জন্মভূমি ও কর্মভূমির পরিসর থেকে। শহরের মানুষ পথঘাট-মাঠ, ফুলটন ফেরিঘাট-এসবের মধ্যেই তাঁর স্মৃতিমেদুর মন ঘোরাফেরা করত। সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ বেদনা-ঘেরা জীবনের আবেদনই তাঁর কাছে ছিল সমধিক।

নাটকের প্রতি ওয়াল্টার হুইটম্যানের আকর্ষণ

কাজের অবসরে প্রায়ই তিনি নাটক দেখতে যেতেন। বেশি উপভোগ করতেন শেক্সপীয়রের নাটক। নাটক-প্রীতির আকর্ষণেই সঙ্গীত শাস্ত্রের প্রতিও তাঁর আগ্রহ জেগেছিল। পরবর্তীকালে এই গীতিনাট্যের প্রভাব তাঁর সাহিত্যেও পড়েছিল। তিনি নিজেই বলেছেন, গীতিনাট্যের প্রেরণা ও প্রভাবেই আমার লিভস অব গ্রাস কাব্যগ্রন্থ লেখা সম্ভব হয়েছিল। হুইটম্যানের লিভস অব গ্রাস কাব্যগ্রন্থটি বিশ্বসাহিত্য অঙ্গনে তাঁকে অমরত্ব দান করেছে।

কর্মব্যস্ত জীবনে ওয়াল্টার হুইটম্যানের অবসর

শৈশব ও কৈশোরে পড়াশুনার সুযোগ পান নি হুইটম্যান। কিন্তু পরবর্তীকালে সেই অভাব পূরণ করেছিলেন তিনি। কর্মব্যস্ত জীবনের অবসরটুকু তিনি ব্যয় করতেন হোমার, শেক্সপীয়র, কোলরিজ, ডিকেন্স ওয়াল্টার স্কটের লেখা পড়ে। প্রচুর পড়াশোনা করেছেন তিনি। এ কারণে প্রথম দিকের রচনার ভাব ভাষা ও আঙ্গিকের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেবার সুযোগ হত না তাঁর। তাই শিল্পের বিচারে তাঁর গোড়ার দিকের লেখাগুলো ছিল দুর্বলতর।

ওয়াল্টার হুইটম্যানের অস্থিরতা

চাকরি জীবনে সর্বদাই সৃষ্টির একটা অস্থিরতা বোধ করতেন হুইটম্যান। যা করছেন তাতে মন ভরতো না। আরও বড় কিছু, মহৎ কিছু করার জন্য নিরন্তর মন ছটফট করত। ব্রুকলিনের একটি সাপ্তাহিক কাগজ ফ্রিম্যান-এর সম্পাদকের কাজ করার সমরে অন্তস্থিত এই অস্থিরতা অনেক বেড়ে গেল। সময়টা ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দ। অগ্রপশ্চাৎ চিন্তা না করে মনের তাড়নায় সেই চাকরি ছেড়ে দিলেন হুইটম্যান। অশান্ত মন খানিকটা শান্ত হল কবিতা রচনায় নিমগ্ন হয়ে।

হুইটম্যানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ

  • (১) এই সময়েই কবিতা রচনার পুরনো আঙ্গিক বাতিল করে দিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করলেন। তাঁর এই নতুন ভাবনা-চিন্তার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হল লিভস অব গ্রাস কাব্যগ্রন্থটি। বিচিত্র এক চমক নিয়েই আবির্ভাব হল বইটির। লেখক প্রকাশকের নাম ঠিকানা বিহীন বইয়ের মলাটে দেওয়া ছিল কেবল লেখকের একটি ছবি। এই ছবি দেখেই পাঠকরা বুঝতে পারলেন লিভস অব গ্রাসের লেখক হুইটম্যান। এইভাবে পাঠকমহলে অভূতপূর্ব চমক সৃষ্টি করেই কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রকাশ ঘটেছিল।
  • (২) প্রথম গ্রন্থের অভিনব আঙ্গিকে রচিত কবিতাগুলি পাঠকদের কাছে হুইটম্যানের এক নতুন পরিচয় তুলে ধরল। চিন্তায় মননে তিনি ছিলেন অনেক বেশি পরিণত, ধীরস্থির ও উদারহৃদয়। যে মানসিক অস্থিরতা ইতিপূর্বে তাঁর লেখাগুলোতে ধরা পড়ত, এই কাব্যগ্রন্থে তার আভাস কোথাও নেই। এক আত্মমগ্ন ধ্যানস্থ কবি হিসেবেই তাঁকে পাওয়া গেল এই গ্রন্থে।
  • (৩) আমেরিকার ইতিহাসের এক সন্ধিলগ্নে প্রকাশিত হয়েছিল লিভস অব গ্রাস। সেই সময় আমেরিকার জনজীবনে গণতন্ত্রের আদর্শ সবেমাত্র আলো ফেলতে শুরু করেছে। সেই আলোককে হুইটম্যান তাঁর কবিতার মধ্য দিয়ে জনমানসের গভীরে পৌঁছে দিতে চাইলেন। তাঁর কাব্য রচনায় হাতিয়ার হয়ে উঠল রাজনৈতিক স্বাধীনতা, জাতীয়তা, ও জনজীবনের অটুট ঐক্য।
  • (৪) নতুন যুগের নতুন আলোকচ্ছটাকে এইভাবে লেখার মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে দিয়ে এক আশ্চর্য মানবিক-বিপ্লবের পথ রচনা করতে লাগলেন হুইটম্যান। তিনি হলেন নবজাগ্রত আমেরিকার নতুন জীবনের ভাষ্যকার দিশারী-কবি।

ওয়াল্টার হুইটম্যানের কবিতা ক্রসিং ব্রুকলিন ফেরি

১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হল লিভস অব গ্রাস গ্রন্থের পরিমার্জিত দ্বিতীয় সংস্করণ। এই সংস্করণে সংযোজিত হল আরো নতুন কিছু কবিতা। তার মধ্যে ছিল কবির অমর সৃষ্টি ক্রসিং ব্রুকলিন ফেরি কবিতাটি।

নিজের কাব্যগ্রন্থের সমালোচনায় ওয়াল্টার হুইটম্যান

  • (১) সেইকালে সাহিত্যক্ষেত্রে প্রচলিত ছিল একটা অদ্ভুত রীতি। কবি সাহিত্যিকরা নিজেরাই নিজেদের বই-এর সমালোচনা করতে পারতেন। তবে তাঁরা এই সমালোচনা করতেন ছদ্মনামে। হুইটম্যানও তাঁর কাব্যগ্রন্থের সমালোচনা নিজেই লিখলেন। সেই সঙ্গে প্রকাশিত হল অন্যদের সমালোচনাও। নিজের কথা বলতে গিয়ে হুইটম্যান নিজেকে জনগণের কবি বলে চিহ্নিত করলেন।
  • (২) যৌনতা ও শরীরী সৌন্দর্যকে স্বীকার করে প্রচার করলেন নতুন রীতি পদ্ধতিতে রচিত তাঁর অনন্ত সম্ভাবনাময় কবিতা। লেখকদের স্বরচিত নিজস্ব বইয়ের সমালোচনা পাঠকমহলে যথেষ্ট কৌতুকের খোরাক যোগাত। তাঁদের কৌতূহলী করে তুলত। হুইটম্যান কিন্তু তাঁর সমালোচনাতে মজার খোরাক রাখেন নি। তাতে অন্য মাত্রা যোগ করেছিলেন।
  • (৩) তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, গণতন্ত্রের আদর্শে উদ্বুদ্ধ, স্বাধীনতার পূজারী বলে আমেরিকার জনগণ তাঁকে জানতে চিনতে পারুক, সেইভাবে স্বীকৃতি দিক। গভীর আত্মপ্রত্যয়ে ভরপুর তাঁর সমালোচনাগুলি যথার্থই ছিল প্রতিভার দীপ্তিতে উদ্ভাসিত। ইতিপূর্বে কোন কবির লেখাতেই এই ভাবনার প্রকাশ ঘটেনি। ফলে জনমনের আরো গভীরে স্থান করে নিতে পারলেন হুইটম্যান।

টাইমস পত্রিকায় হুইটম্যানের চাকরি গ্রহণ

আবার চাকরি নিলেন কবি। এবারে ব্রুকলিন টাইমস পত্রিকায়। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে এই কয় বছর সম্পাদনার কাজে যুক্ত বইলেন। কিন্তু চাকরি ছাড়লেন আবার সেই অন্তস্থিত অস্থিরতার ধাক্কায়। অদ্ভুত একটা জীবনবোধ এইসময় তাঁকে এতটাই অস্থির করে তুলল যে কোনো কিছুর সঙ্গেই নিজেকে জড়িত রাখতে পারলেন না। পালছেঁড়া নৌকোর মতো দিক-দিশাহারা অবস্থা হল তাঁর। জীবন কাটতে লাগল ভবঘুরের মতন।

ওয়াল্টার হুইটম্যানের আর্থিক অবস্থা

১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হল লিভস অব গ্রাস-এর তৃতীয় সংস্করণ। এই সংস্করণেও সংযোজিত হল এমন কিছু নতুন কবিতা, যার মধ্যে ধরা ছিল কবির জীবনের জীবনযন্ত্রণার কথা। হুইটম্যানের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থটিই তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল খ্যাতির শীর্ষে। তাই যুগান্তকারী এই গ্রন্থটির সংশোধন ও সংযোজনের কাজে প্রায় সমগ্র জীবনকালটাই ব্যাপৃত থেকেছেন। এই গ্রন্থের সংস্করণের পর সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু বই বিক্রির টাকা থেকে কবির আর্থিক অবস্থার বিশেষ কিছু পরিবর্তন ঘটে নি। কেবল লেখা নিয়ে থেকে ফল এই হয়েছিল যে অনেকদিনই তাঁকে কাটাতে হয়েছে অনাহারে। ফলে বাধ্য হয়েই আবার ফিরে যেতে হয়েছে সাংবাদিকতার পুরনো কাজে।

হুইটম্যানের জ্বালাময়ী সম্পাদকীয় লেখা

এইভাবে জীবনযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হতে হতে মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সেই বিতৃষ্ণায় ভরে উঠেছিল তাঁর মন। বিতৃষ্ণা থেকে দ্রোহ ভাব আর সেই ভাবই তাঁর নির্ভীক নীতিনিষ্ঠ কলম থেকে জ্বালাময়ী সম্পাদকীয় লেখা হয়ে প্রকাশিত হল। এরপর থেকে, ব্রুকলিন টাইমস পত্রিকায় সম্পাদক পদে থাকার সময় থেকে, সমাজের দুর্নীতি, অবিচার ও নীচতার বিরুদ্ধে অবিশ্রান্ত কলম চালনা করতে লাগলেন। তাঁর প্রতিটি লেখাই হয়ে উঠতে লাগল বিস্ফোরক। সাময়িক সামাজিক প্রয়োজনে লিখিত হলেও এই লেখাগুলির সর্বজনীন আবেদন ছিল অনস্বীকার্য। সমকালীন আমেরিকান সাংবাদিকতার ইতিহাসে হুইটম্যানের এই সময়কার রচনাগুলি দিকচিহ্ন স্বরূপ হয়ে আছে।

গৃহযুদ্ধের সময় ওয়াল্টার হুইটম্যান

হুইটম্যানের কবিখ্যাতি যখন মধ্যগগনে, সেই সময় ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে আরম্ভ হল গৃহযুদ্ধ। এই যুদ্ধে তাঁর ভাই আহত হলেন। তাঁকে দেখার জন্য তিনি ছুটে গেলেন ফেড্রিক্সবার্গের সেনা ছাউনিতে। সেই সূত্রে সেনাদের সঙ্গেই কাটালেন কিছুকাল। এই সময়ে ওয়াশিংটনে একটি চাকরিও নিলেন। যুদ্ধে আহত ও মৃতপ্রায় সৈনিকদের প্রতি সমবেদনায় হুইটম্যান বারবার ছুটে যেতেন তাদের কাছে। রোজগারের সামান্য অর্থ থেকেই অসুস্থ সৈনিকদের জন্য কিনে নিয়ে যেতেন উপহার।

ওয়াল্টার হুইটম্যানের কেরানির চাকরি

১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে সৈন্যবিভাগে কেরানির চাকরি পেলেন হুইটম্যান। কিন্তু মাস কয়েকের মধ্যেই চাকরি থেকে হলেন বরখাস্ত। তাঁর অপরাধ তিনি কবিতা লেখেন। লিভস অব গ্রাস-এর কবিতাগুলি পড়ে তাঁর ওপরওয়ালার পছন্দ হল না। তিনি ঠিক করলেন, কবিকে চাকরিতে রাখা ঠিক হবে না। যথারীতি বরখাস্ত হলেন হুইটম্যান। সৌভাগ্যবশতঃ সেই সময়েই এক বন্ধুর চেষ্টায় অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে নতুন চাকরি পেয়ে গেলেন তিনি। তারপর ওয়াশিংটনেই থেকে যান ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।

লিঙ্কনের মৃত্যুতে ওয়াল্টার হুইটম্যানের প্রতিক্রিয়া

১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ঘটল আমেরিকার ইতিহাসের সেই চরমতম দুর্ঘটনাটি। আততায়ীর গুলিতে নিহত হলেন মানবতার সেবক প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন। এই ঘটনায় তীব্র মানসিক আঘাত পেলেন হুইটম্যান। গভীর শোকে অভিভূত, মর্মাহত কবি এই সময় লিখলেন তিনটি হৃদয়-বিদারক কবিতা। পরবর্তীকালে এই কবিতাগুলি সংযোজিত হয়েছিল লিভস অব গ্রাসের চতুর্থ সংস্করণে।

কবি ওয়াল্টার হুইটম্যানের অসুস্থ জীবন

জীবনের পথ ছিল বন্ধুর। তাই অকালেই শরীর ভেঙ্গে পড়েছিল তাঁর। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে মাত্র চুয়ান্ন বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন তিনি। প্রাণে বেঁচে গেলেন কবি। কিন্তু পঙ্গু হয়ে পড়লেন পক্ষাঘাতে। বাধ্য হয়ে ওয়াশিংটন ছেড়ে চলে এলেন নিউ জার্সিতে, ছোট ভাইয়ের বাড়িতে। সেখানে তাঁর মা তখনো বেঁচে। কিন্তু তাঁর অবস্থাও মৃতপ্রায়। শয্যাশায়ী মা মারা গেলেন কিছুদিন পরেই। নীরবে রোগশয্যায় শুয়ে কবি সইলেন মাতৃশোকের বেদনা। নিউ জার্সির বাড়িতেই জীবনের শেষ অধ্যায় কাটিয়েছেন হুইটম্যান। কবিতা লেখায় ক্ষান্তি ছিল না তাঁর। শেষ নিঃশ্বাস ফেলার আগে পর্যন্ত কবিতা নিয়েই মগ্ন থেকেছেন।

ওয়াল্টার হুইটম্যানের মৃত্যু

অবশেষে এগিয়ে এলো ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের ২৬ শে মার্চ দিনটি। শেষ নিঃশ্বাস ফেলবার আগে হাতে পেলেন তাঁর লিভস অব গ্রাস কাব্যগ্রন্থের সদ্য প্রকাশিত নবম সংস্করণটি। সে বইটি হাতে নিয়েই মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নেন কবি হুইটম্যান।

উপসংহার :- আমেরিকার নবজাগরণের প্রবক্তারূপে স্বীকৃত এমার্সন এবং থরোর সঙ্গেই নাম করা হয় হুইটম্যানের। বস্তুতঃ ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়ের অন্যতম মনীষীপুরুষ রূপে স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে আছেন তিনি। বিশ্বসাহিত্যের একটি অমূল্য সম্পদরূপে স্বীকৃত কবি হুইটম্যানের কাব্যগ্রন্থ লিভস অব গ্রাস। তিনি ছিলেন র‍্যাডিকালপন্থী এবং তাঁর কবিতার মধ্য দিয়ে এই মতবাদই তিনি প্রচার করেছেন।

(FAQ) ওয়াল্টার হুইটম্যান সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ওয়াল্টার হুইটম্যানের সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ কী?

ওয়াল্টার হুইটম্যানের সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ হলো “Leaves of Grass” (লিভস অব গ্রাস), একটি কবিতার সংকলন যা তিনি জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে সম্প্রসারিত এবং পুনঃপ্রকাশ করেন। এতে তিনি ব্যক্তিস্বাধীনতা, প্রকৃতি, প্রেম, এবং গণতন্ত্রের ধারণাগুলো উদযাপন করেছেন।

২. হুইটম্যানের লেখা কোন সাহিত্য ধারা দ্বারা প্রভাবিত ছিল?

হুইটম্যানের লেখা ট্রান্সসেন্ডেন্টালিজম এবং বাস্তববাদের মিশ্রণে গড়ে উঠেছিল। তিনি প্রকৃতি, ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং আধ্যাত্মিকতার উপর গুরুত্ব দেন, যা ট্রান্সসেন্ডেন্টালিজম থেকে উদ্ভূত, এবং একই সাথে মানুষের দৈনন্দিন বাস্তবতাকে তার লেখায় উপস্থাপন করেন।

৩. “Leaves of Grass”* কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

“Leaves of Grass”* আমেরিকান সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে এক বিপ্লবের সূচনা করে। এটি হুইটম্যানের মুক্তচিন্তা, মানবতাবাদ, এবং গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করে এবং আমেরিকার সাধারণ মানুষদের জীবন, অনুভূতি ও সংগ্রামের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে।

৪. ওয়াল্টার হুইটম্যানের সাহিত্য আমেরিকান কবিতার উপর কী প্রভাব ফেলেছে?

হুইটম্যান আমেরিকান কবিতায় মুক্তছন্দ (free verse) ব্যবহারের মাধ্যমে একটি নতুন ধারা সৃষ্টি করেন। তার উদার দৃষ্টিভঙ্গি এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে লেখা আমেরিকার পরবর্তী কবিদের জন্য এক শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করে।

৫. হুইটম্যানের জীবন ও কাজের ওপর কোন ঐতিহাসিক ঘটনা প্রভাব ফেলেছিল?

আমেরিকান গৃহযুদ্ধ হুইটম্যানের জীবনে এবং লেখায় গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তিনি গৃহযুদ্ধের সময় সৈন্যদের সেবা করেছিলেন, যা তার মানবিকতা এবং সহমর্মিতা প্রকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

Leave a Comment