অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডের সংঘটিত শিল্প বিপ্লবের ফলাফল প্রসঙ্গে রাজনৈতিক ফলাফল হিসেবে ভূস্বামী ও অভিজাতদের ক্ষমতার হ্রাস, গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি, সাম্যবাদী ভাবধারার বিকাশ, জাতীয়তাবাদের বিকাশ, আন্তর্জাতিকতার বিকাশ, উপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, সামাজিক ফলাফল হিসেবে শ্রমিক ও মালিক দুই শ্রেণীর উদ্ভব, জনশূন্য গ্রাম, শ্রমিকদের দুরবস্থা, শ্রমিক সংঘ, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবির্ভাব, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক ফলাফল হিসেবে উপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ফ্যাক্টরি প্রথা, শ্রম বিভাজন নীতি, বাণিজ্যিক মূলধন ও মুনাফার পাহাড় সম্পর্কে জানবো।
শিল্প বিপ্লবের ফলাফল
ঐতিহাসিক ঘটনা | শিল্প বিপ্লবের ফলাফল |
প্রথম সূচনা | ইংল্যান্ড |
সময়কাল | অষ্টাদশ শতক |
প্রথম ব্যবহার | অগাস্তে ব্ল্যাঙ্কি |
জনপ্রিয় করেন | আর্নল্ড টয়েনবি |
ভূমিকা:- ইউরোপ-এ তথা সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে শিল্প বিপ্লবের ফলাফল ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী। শিল্প বিপ্লব বিশ্বের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করে। বর্তমান যুগে শিল্পোৎপাদনের উপর ভিত্তি করে এক নতুন সভ্যতার উন্মেষ হয়েছে। এই সভ্যতা শিল্পাশ্রয়ী সভ্যতা নামে পরিচিত।
(ক) শিল্প বিপ্লবের রাজনৈতিক ফলাফল
শিল্প বিপ্লবের ফলে ইউরোপের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দেয়। যেমন –
(১) ভূস্বামী ও অভিজাতদের ক্ষমতা হ্রাস
শিল্প বিপ্লবের আগে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভূস্বামী ও অভিজাতরাই সকল ক্ষমতা ভোগ করত, কিন্তু বিপ্লবের পরবর্তীকালে মূলধনী ও শ্রমিক শ্রেণি রাজনৈতিক প্রতিপত্তি লাভে উদ্যোগী হয়। পূর্বে ভোটাধিকার সম্পত্তির মালিকানার উপর নির্ভরশীল ছিল। শিল্প বিপ্লবের ফলে ভোটাধিকার সংস্কারের দাবি ওঠে এবং ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডবাসীর আন্দোলনের সফলতার পর ইউরোপের দেশে দেশে এই আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে।
(২) গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি
এতদিন গণতান্ত্রিক আদর্শ বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষিত মানুষদের চিন্তা ও চেতনায় আবদ্ধ ছিল, কিন্তু শিল্প বিপ্লবের পর মূলধনী ও শ্রমিক শ্রেণি গণতান্ত্রিক অধিকার দাবি করতে থাকে। নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য ইংল্যান্ডের শ্রমিকরা ‘চার্টিস্ট আন্দোলন’ শুরু করে। শ্রমিকরা ইউরোপের বহু দেশে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন শুরু করে।
(৩) সাম্যবাদী ভাবধারার বিকাশ
কলকারখানায় কর্মরত শ্রমিক ও মালিকদের মধ্যে অর্থনৈতিক সংঘর্ষের সূচনা হয়। সমাজে ধনবণ্টন ব্যবস্থার বৈষম্য, শ্রমিক শ্রেণির দুর্দশা এবং শিল্পপতিদের হাতে দেশের সব সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপে সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদী ভাবধারা জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে।
(৪) জাতীয়তাবাদের বিকাশ
শিল্প বিপ্লবের ফলে জাতীয়তাবাদী আদর্শ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এতদিন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন ধরনের আঞ্চলিক শুল্ক-ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। শিল্প বিপ্লবের ফলে সমগ্র দেশে একই শিল্প-নির্ভর অর্থনীতি চালু হলে জাতীয় সংহতি গড়ে ওঠে এবং জাতীয়তাবাদের পথ প্রশস্ত হয়।
(৫) আন্তর্জাতিকতার বিকাশ
জাতীয়তাবাদের অগ্রগতি আন্তর্জাতিকতাবাদের পথকে প্রশস্ত করে। উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা, বাণিজ্যিক কারণে বিভিন্ন দেশ ও জাতিবর্গের মধ্যে ঘনিষ্ঠতর যোগাযোগ আন্তর্জাতিকতাবাদের উন্মেষ ঘটায়।
(৬) ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা
শিল্পোন্নোত দেশগুলি নিজেদের দেশে উৎপন্ন উদ্বৃত্ত পণ্যাদি বিক্রির জন্য ইউরোপ ও তার বাইরে পৃথিবীর নানা দেশে বাজার খুঁজতে গিয়ে সেখানে উপনিবেশ স্থাপন করতে থাকে। এর ফলে তাদের মধ্যে তীব্র ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। এই উপনিবেশ দখলের লড়াই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমস্যাবলীর সৃষ্টি করে।
(খ) শিল্প বিপ্লবের সামাজিক ফলাফল
শিল্প বিপ্লব ইউরোপের সামাজিক ক্ষেত্রেও বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসে। যেমন –
(১) শ্রমিক ও মালিক দুই শ্রেণি
সমাজে দুটি নতুন শ্রেণির উদ্ভব হয় – পুঁজিপতি মালিক ও শোষিত শ্রমিক। পুঁজিপতিরা কারখানা স্থাপন, শ্রমিক নিয়োগ ও মূলধন বিনিয়োগ করে প্রচুর মুনাফা লুটতে থাকে। অপরদিকে, শ্রমিকরা শ্রমদান করে পণ্য উৎপাদন করত এবং বিনিময়ে তারা মজুরি পেত। কারখানা, যন্ত্র বা উৎপাদিত পণ্যের উপর তাদের কোনও অধিকার ছিল না।
(২) জনশূন্য গ্রাম
শিল্প বিপ্লবের ফলে গ্রামের কৃষকরা মজুরির আশায় দলে দলে শহরের কলকারখানাগুলিতে যোগ দিতে থাকে। এর ফলে একদিকে যেমন গ্রামগুলি জনশূন্য হয়ে পড়ে, তেমনি অপরদিকে শহরগুলি জনবহুল হয়ে ওঠে। গ্রামীণ সভ্যতার বিনাশ ঘটতে থাকে এবং শিল্পাশ্রয়ী নগর সভ্যতার উন্মেষ ঘটে।
(৩) শ্রমিকদের দুরবস্থা
শিল্প বিপ্লব সমাজে নানা কুফল ডেকে আনে। মজুরির লোভে শ্রমিকরা দলে দলে কারখানায় যোগ দেয়। তাদের মজুরি ছিল অতি সামান্য। চাকরির কোনও নিরাপত্তা ছিল না। অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তাদের কাজ করতে হত। তাদের বাসস্থানগুলির অবস্থা ছিল শোচনীয়, অস্বাস্থ্যকর ও অমানবিক। মালিকপক্ষ নানাভাবে তাদের শোষণ করত।
(৪) শ্রমিক সংঘ
একসঙ্গে বাস করার ফলে শ্রমিকদের মধ্যে ঐক্যবোধ গড়ে ওঠে এবং তারা শ্রমিক সংঘ গঠন করে ধর্মঘটের মাধ্যমে তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ে সচেষ্ট হয়। শেষ পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সরকার শ্রমিক কল্যাণমূলক আইন প্রবর্তনে বাধ্য হয়।
(৫) মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব
শিল্প বিপ্লবের ফলে আগের অভিজাত সামন্ততান্ত্রিক শ্রেণির অবলুপ্তি ঘটে এবং শিল্পপতি, বণিক, মহাজন প্রভৃতির সমন্বয়ে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব হয়। পূর্বতন কৃষিভিত্তিক সমাজের স্থলে শিল্পভিত্তিক ও বাণিজ্য-নির্ভর নতুন সমাজ ব্যবস্থার পত্তন হয়।
(৬) জনসংখ্যা বৃদ্ধি
শিল্প বিপ্লবের ফলে ইউরোপে জনসংখ্যার হার প্রবলভাবে বৃদ্ধি পায়। এর ফলে সমাজে নানা জটিল সমস্যার উদ্ভব হয়।
(গ) শিল্প বিপ্লবের অর্থনৈতিক ফলাফল
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শিল্প বিপ্লব বহুমুখী পরিবর্তনের সূচনা করে। যেমন –
(১) ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা
শিল্প বিপ্লবের ফলে অল্প সময়ে প্রচুর পরিমাণ পণ্যসামগ্রীর উৎপাদন হতে থাকে। এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। নিজেদের কারখানায় তৈরি পণ্যসামগ্রী বিক্রির জন্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মধ্যে যে ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছিল, শিল্প বিপ্লবের ফলে তার মাত্রা বহু গুণ বৃদ্ধি পায়।
(২) ফ্যাক্টরি প্রথা
শিল্প বিপ্লবের ফলে ‘ফ্যাক্টরি প্রথা’ বা বৃহৎ কারখানার উদ্ভব হয়। পূর্বে শ্রমিক নিজ গৃহে নিজস্ব যন্ত্রাদির সাহায্যে দ্রব্যাদি উৎপাদন করত। ‘ফ্যাক্টরি প্রথা’-র কাছে কুটির শিল্পের টিকে থাকা সম্ভব ছিল না।
(৩) শ্রম বিভাজন নীতি
আগে একজন কারিগর একটি দ্রব্যের সবটাই নিজে তৈরি করত, কিন্তু শিল্প বিপ্লবের ফলে ব্যাপক হারে দ্রব্যাদি উৎপন্ন হতে থাকে এবং এক একজনকে দ্রব্যটির এক একটি অংশ তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। এইভাবে শিল্প বিপ্লব শিল্পে ‘শ্রম বিভাজন নীতি’ চালু করে।
(৪) বাণিজ্যিক মূলধন
শিল্প বিপ্লবের আগে পুঁজিপতিরা বাণিজ্যে মূলধন বিনিয়োগ করতেন। বাণিজ্যে নিয়োজিত এই মূলধন ‘বাণিজ্যিক মূলধন’ (‘Mercantile Capital’) নামে পরিচিত। শিল্প বিপ্লবের পর পুঁজিপতিরা ব্যবসা-বাণিজ্য অপেক্ষা পণ্যাদি উৎপাদনের জন্য শিল্পে মূলধন বিনিয়োগ করতে থাকেন। এই মূলধন ‘শিল্প মূলধন‘ নামে পরিচিত। শিল্প বিপ্লবের ফলে ‘বাণিজ্যিক মূলধন’ ধীরে ধীরে ‘শিল্প মূলধনে’ পরিণত হয়। পুঁজিপতিরা শিল্পে প্রচুর মূলধন বিনিয়োগ করতে থাকেন এবং এইভাবে যৌথ বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব হয়।
(৫) মুনাফার পাহাড়
মুনাফা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে শিল্পপতিরা শ্রমিকদের যতটা সম্ভব কম মজুরি দিতে থাকেন। শ্রমিকরা নানাভাবে শোষিত হতে থাকে। এইভাবে পুঁজিপতিরা গড়ে তুলতে থাকেন মুনাফার পাহাড়। ধনী দিন ধনী এবং দরিদ্র আরও দরিদ্র হতে থাকে।
উপসংহার:- মানব সভ্যতার ইতিহাসে শিল্প বিপ্লব এক নব যুগের সূচনা করে। প্রাচীন কুটির শিল্প, গ্রামীণ অর্থনীতি, সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রভৃতির স্থানে দেখা দেয় শিল্পাশ্রয়ী সভ্যতা, নগরজীবন, মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও গণতান্ত্রিক আদর্শ।
(FAQ) শিল্প বিপ্লবের ফলাফল সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
ইংল্যান্ডে।
ফরাসি দার্শনিক অগাস্তে ব্ল্যাঙ্কি।
ইংরেজ ঐতিহাসিক আর্নল্ড টয়েনবি।
শ্রমিক ও মালিক শ্রেণী।