বুর্জোয়া বিপ্লব

ফরাসি বিপ্লবকালে ফ্রান্সে সংঘটিত বুর্জোয়া বিপ্লবের পটভূমি হিসেবে জাতীয় সভার অধিবেশন, জাতীয় সভার প্রতিনিধি, তৃতীয় এস্টেটের সদস্য, সভাকক্ষে বসার পদ্ধতি, ভোট পদ্ধতি, আবে সিয়েসের দাবি, তৃতীয় সম্প্রদায়ের দাবি, তৃতীয় সম্প্রদায়ের শক্তি বৃদ্ধি, তৃতীয় সম্প্রদায়ের ঘোষণা, দুঃসাহসিক ও বিপ্লবাত্মক পদক্ষেপ, কোবানের মন্তব্য, ফরাসি বিপ্লবের ক্ষুদ্র প্রতীক, টেনিস কোর্টের শপথ, শপথ গ্রহণ, রাজকীয় আদেশ, রাজকীয় আদেশ লঙ্ঘন, প্রকৃত জাতীয় সভা, রাজার নতি স্বীকার, রাজার মত পরিবর্তনের কারণ, ফরাসি বিপ্লবের শুরু, গুরুত্ব ও ফলাফল সম্পর্কে জানবো।

ফ্রান্সে সংঘটিত বুর্জোয়া বিপ্লব

ঐতিহাসিক ঘটনাবুর্জোয়া বিপ্লব
জাতীয় সভার অধিবেশন৫ মে, ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দ
টেনিস কোর্টের শপথ২০ জুন, ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দ
বুর্জোয়া বিপ্লব২৭ জুন, ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দ
পরিস্থিতিফরাসি বিপ্লব
ফ্রান্সে সংঘটিত বুর্জোয়া বিপ্লব

ভূমিকা:- অভিজাতদের চাপে এবং অর্থসংকট থেকে মুক্তিলাভের উদ্দেশ্যে রাজা ষোড়শ লুই স্টেটস জেনারেল বা জাতীয় সভার অধিবেশন আহ্বান করতে বাধ্য হন এবং ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

ফ্রান্সে বুর্জোয়া বিপ্লবের পটভূমি

ফরাসি বিপ্লবকালে ফ্রান্স -এ বুর্জোয়া বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পটভূমি ছিল নিম্নরূপ। –

(১) জাতীয় সভার অধিবেশন

১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৫ই মে প্যারিস থেকে ১০ মাইল দূরে ভার্সাই নগরীতে ১৭৫ বছর পর আবার ফরাসি জাতীয় সভার অধিবেশন বসে।

(২) জাতীয় সভার প্রতিনিধি

এই সভার মোট ১২১৪ জন নির্বাচিত প্রতিনিধির মধ্যে যাজকদের প্রতিনিধি ছিল ৩০৮ জন, অভিজাতদের ২৮৫ জন এবং তৃতীয় এস্টেটের সদস্য সংখ্যা ছিল ৬২১।

(৩) তৃতীয় এস্টেটের সদস্য

তৃতীয় এস্টেটের নির্বাচিত সদস্যদের অধিকাংশই ছিলেন আইনজীবী, শিল্পপতি, ব্যাঙ্কার, পেশাদার মানুষ এবং অল্প কিছু কৃষিজীবী।

(৪) সভা কক্ষে বসার পদ্ধতি

৫ই মে স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন বসার সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লব শুরু হয়ে যায়। এতদিন জাতীয় সভার প্রতিনিধিরা সম্প্রদায় অনুযায়ী তিনটি পৃথক কক্ষে বসত।

(৫) ভোট পদ্ধতি

এতদিন ভোট হত সম্প্রদায়-পিছু, মাথা-পিছু নয়। যাজক, অভিজাত ও মধ্যবিত্ত – তিনটি সম্প্রদায়ের তিনটি ভোট। যাজক ও অভিজাতদের স্বার্থ একই রকম হওয়ায় তাদের মিলিত ভোট হত দুটি, অন্যদিকে তৃতীয় সম্প্রদায়ের ভোট ছিল একটি। এই ব্যবস্থায় সর্বদা প্রথম দুই শ্রেণিই ভোটে জয়লাভ করত এবং একমাত্র তাদের স্বার্থই রক্ষিত হত।

(৬) অ্যাবে সিয়েসের দাবি

এই অধিবেশন বসার বহু আগেই জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত “What is the Third Estate?’ শীর্ষক এক ইস্তাহারে অ্যাবে সিয়েস দাবি করেন যে, তৃতীয় সম্প্রদায়ই হল সমগ্র ফরাসি জাতির প্রতিনিধি।

(৭) তৃতীয় সম্প্রদায়ের দাবি

জাতীয় সভার প্রথম অধিবেশনেই তৃতীয় সম্প্রদায়ের সদস্যরা একটি কক্ষে বসা এবং মাথা-পিছু ভোটের দাবি করলে গোলযোগের সূত্রপাত হয়। প্রথম দুই সম্প্রদায় ও রাজা নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য এই দাবির বিরোধিতা করতে থাকেন।

(৮) তৃতীয় সম্প্রদায়ের শক্তি বৃদ্ধি

এই সময় মিরাবো, লাফায়েং, অ্যাবে সিয়েস প্রমুখ উদারপন্থী অভিজাতরা তৃতীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগ দিলে এই সম্প্রদায় শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

(৯) তৃতীয় সম্প্রদায়ের ঘোষণা

রাজা তাঁদের দাবি নাকচ করলে তৃতীয় সম্প্রদায়ের ক্ষুব্ধ প্রতিনিধিরা ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই জুন এক সভায় মিলিত হয়ে তাঁদেরকে সমগ্র জাতির প্রতিনিধি ও তাঁদের সভাকেই ‘জাতীয় সভা’ বলে ঘোষণা করে জানান যে, করধার্যের অধিকার একমাত্র তাঁদেরই আছে।

দুঃসাহসিক ও বিপ্লবাত্মক পদক্ষেপ

এই ঘটনাটি নিঃসন্দেহে এক দুঃসাহসিক ও বিপ্লবাত্মক পদক্ষেপ কারণ এই ঘোষণা ছিল সংবিধান-বিরোধী ও দেশের প্রচলিত আইন-বিরোধী।

কোবানের মন্তব্য

ঐতিহাসিক কোবান বলেন এই কাজের দ্বারা তৃতীয় শ্রেণি জানিয়ে দিল যে, তারাই সব – অন্য শ্রেণি দুটি কিছু নয় এবং তৃতীয় সম্প্রদায়ই জাতীয় সার্বভৌম ক্ষমতার একমাত্র অধিকারী, রাজা বা অন্য কেউ নয়।

ফরাসি বিপ্লবের ক্ষুদ্র প্রতীক

ঐতিহাসিক গ্রান্ট ও টেম্পারলির মতে, “এই ঘটনাটি ছিল ফরাসি বিপ্লবের ক্ষুদ্র প্রতীক।”

টেনিস কোর্টের শপথ

২০শে জুন তৃতীয় সম্প্রদায়ের সদস্যরা তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট সভাকক্ষে প্রবেশ করতে গিয়ে দেখেন যে তা তালাবন্ধ। ক্ষুব্ধ সদস্যরা তখন মিরাবো ও অ্যাবে সিয়েসের নেতৃত্বে নিকটবর্তী একটি টেনিস খেলার মাঠে সমবেত হয়ে শপথ গ্রহণ করেন। এই ঘটনা ‘টেনিস কোর্টের শপথ’ নামে পরিচিত।

শপথ গ্রহণ

টেনিস কোর্টে তারা শপথ গ্রহণ করেন যে, যতদিন না ফ্রান্সের জন্য একটি নতুন সংবিধান তৈরি হচ্ছে, ততদিন তাঁরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাবেন। এই সময় যাজকদের ১৩৯ জন (কোবানের মতে ১৭০ জন) এবং ৪৭ জন অভিজাত (কোবানের মতে ৫০ জন) সদস্য তৃতীয় শ্রেণিতে যোগ দিলে অবস্থা জটিলতর হয়ে ওঠে।

রাজকীয় অধিবেশন

২৩ শে জুন রাজা তিন সম্প্রদায়ের সম্মিলিত রাজকীয় অধিবেশন ডাকেন এবং তৃতীয় সম্প্রদায়ের সকল দাবিগুলিকে অবৈধ বলে ঘোষণা করেন।

রাজকীয় নির্দেশ

সম্মেলন শেষে রাজা সভা ত্যাগ করেন এবং সভা পরিচালনার রাজকীয় মন্ত্রী তিন সম্প্রদায়ের সদস্যদের নিজ নিজ সভাকক্ষে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন।

রাজকীয় আদেশ লঙ্ঘন

প্রথম দুই সম্প্রদায় রাজকীয় নির্দেশ পালন করলেও তৃতীয় সম্প্রদায়ের সদস্যরা সেখানেই বসে থাকেন। তৃতীয় সম্প্রদায়ের অন্যতম বিশিষ্ট সদস্য অভিজাত বংশীয় মিরাবো দৃপ্তকণ্ঠে জানিয়ে দেন “জনগণের ইচ্ছায় আমরা এখানে সমবেত হয়েছি। একমাত্র বেয়নেটের আঘাতই আমাদের এখান থেকে সরাতে পারবে।”

প্রকৃত জাতীয় সভা

বুর্জোয়া-সদস্য বেইলি বলে ওঠেন “তৃতীয় শ্রেণির সভাই হল প্রকৃত জাতীয় সভা। এই সভাকে কেউ আদেশ করতে পারে না।” ঐতিহাসিক আলফ্রেড কোবান বলেন যে, তৃতীয় সম্প্রদায়ের বিরোধিতা করে রাজা বুদ্ধিমানের কাজ করেন নি। তিনি জাতির সমর্থন থেকে বঞ্চিত হন এবং সুবিধাভোগীদের সঙ্গে ঐক্য স্থাপন করেন।

রাজার নতি স্বীকার

শেষ পর্যন্ত ২৭শে জুন ভীত ও হতাশাগ্রস্ত রাজা তিন সম্প্রদায়ের একত্রে অধিবেশন এবং মাথা-পিছু ভোটের দাবি মেনে নেন।

রাজার মত পরিবর্তনের কারণ

রাজার এই মত পরিবর্তনের জন্য দুটি কারণকে দায়ী করা যায়। যথা –

  • (১) ২৫শে জুন যাজক ও অভিজাত সম্প্রদায়ের বেশ কিছু সদস্য তৃতীয় শ্রেণির প্রতি সমর্থন জানান।
  • (২) ইতিমধ্যে খবর রটে যায় যে, রাজা তৃতীয় সম্প্রদায়ের দাবি না মানলে চল্লিশ হাজার দরিদ্র মানুষ রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করবে। এই সংবাদে রাজা বিচলিত হয়ে পড়েন।

ফরাসি বিপ্লবের শুরু

রাজার নতি স্বীকারের এই ঘটনা ‘বুর্জোয়া বিপ্লব’ নামে পরিচিত। এইভাবে রক্তপাতহীন এক সংঘর্ষ তৃতীয় সম্প্রদায়ের সাফল্যের মাধ্যমে শেষ হল। বলা যায় যে, এই সময় থেকেই ফরাসি বিপ্লবের শুরু।

বুর্জোয়া বিপ্লব

রাজতন্ত্র ও অভিজাতদের বিরুদ্ধে তৃতীয় সম্প্রদায়ের এই জয় ছিল প্রকৃত অর্থে বুর্জোয়াদের জয়। তাই এই ঘটনা ‘বুর্জোয়া বিপ্লব’ নামে পরিচিত।

বুর্জোয়া বিপ্লবের গুরুত্ব ও ফলাফল

  • (১) রাজতন্ত্র সুবিধাভোগী শ্রেণির উপর প্রবল আঘাত হানলেও এই ঘটনা সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে কোনও বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে নি। স্টেটস জেনারেলে তিন সম্প্রদায়ের মিলন ঘটলেও সমাজ জীবনে তা হয় নি।
  • (২) অভিজাত সম্প্রদায় কোনও প্রকার বোঝাপড়ায় আসার জন্য মানসিকভাবে তৈরি ছিল না। রাজাও পুরো ব্যাপারটি মেনে নিতে পারেন নি। তিনি সৈন্য সমাবেশ করে শক্তি পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন।
  • (৩) তৃতীয় সম্প্রদায়ের দাবিগুলির প্রতি তাঁর অনমনীয় মনোভাব পরিস্থিতি জটিলতর করে তোলে। তিনি যদি তৃতীয় শ্রেণির সঙ্গে সমঝোতা করে চলতে পারতেন বা তাদের সহযোগিতা নিয়ে অভিজাত সম্প্রদায়কে কোণঠাসা করতে পারতেন, তাহলে ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস অন্যরকম হত।

উপসংহার:- ডেভিড টমসন বলেন যে, রাজা যদি একটু বিপ্লবী হতেন, তাহলে তিনি এই জটিলতা থেকে উদ্ধার পেতেন।

(FAQ) ফ্রান্সে সংঘটিত বুর্জোয়া বিপ্লব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কোন ঘটনা বুর্জোয়া বিপ্লব নামে পরিচিত?

১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে জুন ভীত ও হতাশাগ্রস্ত রাজা তিন সম্প্রদায়ের একত্রে অধিবেশন এবং মাথা-পিছু ভোটের দাবি মেনে নেন। ফ্রান্সের রাজার এই নতি স্বীকারের ঘটনা বুর্জোয়া বিপ্লব নামে পরিচিত।

২. টেনিস কোর্টের শপথ কবে হয়েছিল?

২০ জুন, ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে।

৩. বুর্জোয়া বিপ্লবের সময় ফ্রান্সের রাজা কে ছিলেন?

রাজা ষোড়শ লুই।

৪. কাদের নেতৃত্বে টেনিস কোর্টের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হয়?

মিরাবো ও আবেসিয়েস।

Leave a Comment