কর্ণাটকের দ্বিতীয় যুদ্ধ -এর সময়কাল, স্থান, বিবাদমান পক্ষ, কর্ণাটকের দ্বিতীয় যুদ্ধের প্রেক্ষাপট হিসেবে ডুপ্লের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন, মারাঠা আক্রমণ, দাক্ষিণাত্যের সুবাদারের মৃত্যু, চাঁদা সাহেবের প্রত্যাবর্তন, ডুপ্লের চুক্তি স্বাক্ষর, কর্ণাটকের দ্বিতীয় যুদ্ধের সূচনা, অম্বুরের যুদ্ধ, ফরাসি প্রভাব বৃদ্ধি, ফরাসি বাহিনীর ত্রিচিনপল্লী অবরোধ, ইংরেজ বাহিনীর আর্কট দখল, মহম্মদ আলির মসনদ দখল, সন্ধি স্থাপন, সন্ধির শর্ত ও কর্ণাটকের দ্বিতীয় যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে জানবো।
দাক্ষিনাত্যে কৰ্ণাটকের দ্বিতীয় যুদ্ধ
সময়কাল | ১৭৪৯-১৭৫৪ খ্রিস্টাব্দ |
স্থান | কর্ণাটক |
বিবাদমান পক্ষ | ইংরেজ ও ফরাসি বাহিনী |
ফলাফল | ইংরেজদের সাফল্য |
ভূমিকা :- আই-লা শ্যাপেলের সন্ধির সূত্রে কর্ণাটকের প্রথম যুদ্ধের সমাপ্তির মাধ্যমে ভারত -এ ইঙ্গ-ফরাসী দ্বন্দ্বের অবসান ঘটলেও উভয় পক্ষের মধ্যে তীব্র মতভেদ ছিল।
কর্ণাটকের দ্বিতীয় যুদ্ধের প্রেক্ষাপট
দাক্ষিণাত্যে ইংরেজ ও ফরাসি বিরোধিতায় কর্ণাটকের দ্বিতীয় যুদ্ধের প্রেক্ষাপট ছিল নিম্নরূপ –
(১) ডুপ্লের স্থায়ী সাম্রাজ্য গঠনের স্বপ্ন
ভারতের ফরাসি গভর্নর ডুপ্লে ব্যক্তিগতভাবে মাদ্রাজ ইংরেজদের প্রত্যর্পণে রাজী ছিলেন না। ভারতীয় শাসকদের দুর্বলতার সুযোগে তিনি ভারতে স্থায়ী সাম্রাজ্য গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি চাইছিলেন দাক্ষিণাত্যে অস্থিরতা ও যুদ্ধ চলতে থাকুক। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর সামনে সেই সুযোগ উপস্থিত হয়।
(২) দাক্ষিণাত্যের সুবাদারের মৃত্যু
১৭৪৮ খ্রীষ্টাব্দে দাক্ষিণাত্যের সুবাদার আসফজা নিজাম-উল্-মুলক মারা যান। অতঃপর সিংহাসন দখল করেন তাঁর পুত্র নাসির জং। কিন্তু বাদশাহের এক ফরমান অনুযায়ী তার পৌত্র মুজফ্ফরজং মসনদ দাবি করতে থাকেন।
(৩) চাঁদা সাহেবের প্রত্যাবর্তন
আর্কটের প্রাক্তন নবাব দোস্ত আলীর জামাতা চাঁদা সাহেব মারাঠাদের হাতে বন্দী দশা থেকে মুক্তি পেয়ে কর্ণাটকে ফিরে আসেন এবং নবাবী দাবি করতে থাকেন।
(৪) ডুপ্লের চুক্তি স্বাক্ষর
এই সুযোগে ডুপ্লে মুজফ্ফর জংকে দাক্ষিণাত্যের সুবাদার এবং চাঁদা সাহেব’কে কর্ণাটকের নবাবী পদে প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এক চুক্তিতে আবদ্ধ করেন।
কর্ণাটকের দ্বিতীয় যুদ্ধের সূচনা
পণ্ডিচেরীর ফরাসি গভর্নর ডুপ্লের এই রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে কর্ণাটকের দ্বিতীয় যুদ্ধের সূচনা হয়।
কৰ্ণাটকের দ্বিতীয় যুদ্ধ চলাকালীন অম্বুরের যুদ্ধ
১৭৪৯ খ্রীষ্টাব্দে মুজাফফর জং, চাঁদা সাহেব ও ফরাসি বাহিনী অম্বুরের যুদ্ধে আনোয়ার উদ্দিনকে পরাজিত ও নিহত করে কর্ণাটকের মসনদ দখল করেন। এরপর চাঁদা সাহেব কর্ণাটকের সিংহাসনে বসেন।
মুজাফফর জং দাক্ষিণাত্যের সুবাদার
আনোয়ার উদ্দিনের পুত্র মহম্মদ আলী ত্রিচিনপল্লীতে ইংরেজদের আশ্রয়ে পালিয়ে যান। পরের বছরেই দাক্ষিণাত্যের নিজাম নাসির জং আততায়ীর হাতে নিহত হন। সঙ্গে সঙ্গে মুজফ্ফর জং নিজেকে দাক্ষিণাত্যের ‘সুবাদার’ বলে ঘোষণা করেন।
ফরাসি প্রভাব বৃদ্ধি
ফরাসী সাহায্যের প্রতিদান স্বরূপ মুজফর জং ডুপ্লেকে কৃষ্ণা নদীর দক্ষিণ তীরস্থ অঞ্চলের শাসক নিযুক্ত করেন। ফরাসী স্বার্থ তত্ত্বাবধান করার জন্য ‘বুসী’ নামক জনৈক ফরাসী সেনাপতি নিজামের দরবারে অধিষ্ঠিত হলেন। এইভাবে ফরাসী অনুগত নিজাম ও নবাবের ক্ষমতা দখলের ফলে দক্ষিণ ভারতে ফরাসী প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে।
ফরাসি বাহিনীর ত্রিচিনপল্লী অবরোধ
ডুপ্লে তথা ফরাসীদের মর্যাদা ও প্রভাব বৃদ্ধিতে ইংরেজগণ স্বভাবতই শঙ্কিত ও ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠে। মহম্মদ আলী ত্রিচিনপল্লীতে আশ্রয় গ্রহণ করা থেকেই ফরাসীরা ত্রিচিনপল্লী অবরোধ করে রেখেছিল।
ইংরেজ বাহিনীর আর্কট আক্রমণ
ফরাসীদের সাফল্যে আতঙ্কিত হয়ে মহীশূর, মারাঠাশক্তি ও তাঞ্জোরের রাজা ইংরেজের পক্ষে যোগদান করেন। এই সময় বিচক্ষণ ও সাহসী ইংরেজ যুবক রবার্ট ক্লাইভ আর্কট আক্রমণ করে ফরাসীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে উদ্যোগী হন।
মহম্মদ আলির কর্ণাটকের মসনদ দখল
দীর্ঘ সংগ্রামের পর ইংরেজ-বাহিনী জয়লাভ করে। চাঁদা সাহেব ইংরেজের হাতে বন্দী ও নিহত হন। মহম্মদ আলী কর্ণাটকের নবাব-পদে অধিষ্ঠিত হন।
ফরাসি ও ইংরেজদের মধ্যে ডুপ্লেকে প্রত্যাবর্তনের আদেশ
ইতিমধ্যে দাক্ষিণাত্যেও ডুপ্লের কার্যক্রম বিফল হতে থাকে। ফলে ফরাসী সরকার ডুপ্লের কর্মপদ্ধতিতে যথেষ্ট ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। তাই ১৭৫৪ খ্রীষ্টাব্দে ডুপ্লেকে ফ্রান্স-এ প্রত্যাবর্তনের আদেশ দেওয়া হয়।
ফরাসি ও ইংরেজদের মধ্যে সন্ধি স্থাপন
ডুপ্লের পদে যোগদান করেন গডেহু। ফরাসি গভর্নর গডেহু ১৭৫৪খ্রিস্টাব্দে ইরেজদের সাথে এক সন্ধি স্বাক্ষর করে দ্বিতীয় কর্ণাটক যুদ্ধের অবসান ঘটান।
ফরাসি ও ইংরেজদের মধ্যে সন্ধির শর্ত
গডেহু ও ইংরেজ বাহিনীর মধ্যে স্বাক্ষরিত সন্ধির শর্তানুযায়ী —
- (১) উভয়পক্ষ চুক্তি স্বাক্ষরের সময় নিজ নিজ অধিকৃত ভূখণ্ড বজায় রাখতে রাজী হয়,
- (২) স্থির হয় কেউ তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না,
- (৩) হায়দ্রাবাদে বুসীর ক্ষমতা অপরিবর্তিত থাকে।
কর্ণাটকের দ্বিতীয় যুদ্ধের ফলাফল
আপাত দৃষ্টিতে কর্ণাটকের দ্বিতীয় যুদ্ধও ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে কোনো বিরাট পরিবর্তন ঘটায়নি, কিংবা দাক্ষিণাত্যে ইঙ্গ-ফরাসী আধিপত্যের ব্যাপারেও বিরাট হেরফের ঘটায়নি।
(১) কর্ণাটকের দ্বিতীয় যুদ্ধের ফলে ভাবমূর্তির পরিবর্তন
পরোক্ষভাবে এই যুদ্ধের পরিণতি ইংরেজ ও ফরাসীদের রাজনৈতিক ভাবমূর্তির পরিবর্তন সূচিত করেছিল।
(২) কর্ণাটকের দ্বিতীয় যুদ্ধের ফলে ফরাসিদের গুরুত্ব হ্রাস
এতদিন পর্যন্ত ফরাসী-শক্তি দাক্ষিণাত্যে যেভাবে প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করে যাচ্ছিল দ্বিতীয় কর্ণাটক যুদ্ধের পর তা বিরাট ধাক্কা খায়। ফরাসীদের রাজনৈতিক গুরুত্ব হ্রাস পেতে শুরু করে।
(৩) কর্ণাটকের দ্বিতীয় যুদ্ধের ফলে ইংরেজদের প্রভাব বৃদ্ধি
এতকাল ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দাক্ষিণাত্যের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ব্যাপারে দ্বিধান্বিত ছিল, কিন্তু এই যুদ্ধের পর তারা এ ব্যাপারে আগ্রহান্বিত বোধ করে। তাদের প্রভাব যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়।
উপসংহার :- এই যুদ্ধ একটা করুণ সত্য প্রমাণ করে দেয় যে, ভারতীয় রাজনীতিতে ভারতীয় শক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছা, আশা-আকাঙ্ক্ষা গুরুত্বহীন। অর্থাৎ রাজনীতি কিভাবে এগোবে তা নির্ভর করছে বিদেশী বণিকদের ইচ্ছার ওপর।
(FAQ) কর্ণাটকের দ্বিতীয় যুদ্ধ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৭৪৯-১৭৫৪ খ্রিস্টাব্দ।
১৭৪৯ খ্রিস্টাব্দ।
কর্ণাটকের দ্বিতীয় যুদ্ধের পর ১৭৫৪ খ্রিস্টাব্দে।