পানিপথের যুদ্ধে মারাঠাদের ব্যর্থতার কারণ

পানিপথের যুদ্ধে মারাঠাদের ব্যর্থতার কারণ হিসেবে সৈন্য, যুদ্ধ পদ্ধতির পরিবর্তন, সেনাদলের জাতীয় চরিত্র বিনষ্ট, কামানের শক্তির পার্থক্য, শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার অভাব, যুদ্ধের পোশাকে পার্থক্য, ত্রুটিপূর্ণ রণকৌশল, সদাশিব রাও এর হঠাৎ যুদ্ধে ঝাঁপ, মারাঠা নেতাদের ঐক্য ও সংহতির অভাব ও পেশোয়ার দায়িত্ব সম্পর্কে জানবো।

পানিপথের যুদ্ধে মারাঠাদের ব্যর্থতার কারণ প্রসঙ্গে পরিকল্পিত শাসন ব্যবস্থার অভাব, মারাঠা নায়কদের ব্যর্থতা, মারাঠাদের আদর্শের অভাব, মারাঠাদের অর্থনৈতিক দুর্বলতা, মারাঠাদের সামরিক দুর্বলতা, পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ, যুদ্ধ পদ্ধতির পরিবর্তন ও মারাঠাদের ব্যর্থতায় পেশোয়ার দায়িত্ব সম্পর্কে জানব।

পানিপথের যুদ্ধে মারাঠাদের ব্যর্থতার কারণ

ঐতিহাসিক ঘটনাপানিপথের যুদ্ধে মারাঠাদের ব্যর্থতার কারণ
সময়কাল১৪ জানুয়ারি ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দ
স্থানহরিয়ানা রাজ্যের পানিপথ
বিবাদমান পক্ষআফগান ও মারাঠা বাহিনী
ফলাফলমারাঠাদের পরাজয়
পানিপথের যুদ্ধে মারাঠাদের ব্যর্থতার কারণ

সূচনা :- পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ -এ মারাঠাদের পরাজয় অপ্রত্যাশিত বা আকস্মিক ঘটনা ছিল না। রণকৌশল, সামরিক দক্ষতা, নেতৃত্ব, সংগঠন কোনও দিক থেকেই মারাঠারা আহম্মদশাহ আবদালির সেনাবাহিনীর সমকক্ষ ছিল না। এছাড়া, নেতৃবৃন্দের ভুল-ভ্রাপ্তি এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাব তাদের পরাজয়কে অনিবার্য করে তোলে।

সৈন্য

  • (১) আহম্মদ শাহ আবদালির পক্ষে ৬০ হাজার সৈনিক যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়। এর অর্ধেক ছিল তাঁর নিজস্ব, আর বাকি অর্ধেক সরবরাহ করে অপরাপর ভারতীয় মুসলিম শক্তিগুলি। অযোধ্যার নবাব ও রোহিলখণ্ডের মুসলিমরা তাঁকে সাহায্য করে।
  • (২) অপরপক্ষে, ‘হিন্দু-পাদ-পাদশাহি’-র আদর্শ ত্যাগ করে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার করার জন্য হিন্দু রাজপুত ও জাঠরা মারাঠাদের কোনও প্রকার সাহায্য করে নি।

যুদ্ধ পদ্ধতির পরিবর্তন

মারাঠাদের প্রকৃত শক্তি নিহিত ছিল মারাঠা পদাতিক, হাল্কা দ্রুতগতিসম্পন্ন অশ্বারোহী বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণ ও গেরিলা যুদ্ধ-পদ্ধতির ওপর। কিন্তু মারাঠারা এগুলির ওপর নির্ভর না করে গোলন্দাজ বাহিনী ও গোলন্দাজ সেনাদের রণকৌশলের ওপর নির্ভর করে।

সেনাদলের জাতীয় চরিত্র বিনষ্ট

আফগান সেনাপতি ইব্রাহিম খান গর্দি গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন এবং সেনাদলে বহু আফগান নিযুক্ত হওয়ায় মারাঠা সেনাদলের জাতীয় চরিত্র বিনষ্ট হয়।

কামানের শক্তির পার্থক্য

মারাঠাদের কামানগুলি ছিল ভারি ও শ্লথ। অপরপক্ষে, আবদালির কামানগুলি ছিল হাল্কা, দ্রুতগতিসম্পন্ন ও অধিকতর কার্যকরী।

শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার অভাব

সেনাদলের শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা ও পরিকল্পনার দিক থেকেও আবদালি অনেক এগিয়ে ছিলেন। মারাঠা সেনাদলে অসামরিক ব্যক্তি ও মহিলাদের উপস্থিতি নানা সমস্যা সৃষ্টি করে।

যুদ্ধের পোশাকে পার্থক্য

আবদালির সেনারা বর্ম ব্যবহার করত। অপরদিকে মারাঠাদের পোশাক ছিল হাল্কা।

ত্রুটিপূর্ণ রণকৌশল

মারাঠা বাহিনীর রণকৌশল ছিল ত্রুটিপূর্ণ। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসের শেষ দিকে যখন দুই সেনাদল মুখোমুখি হল মারাঠাদের উচিত ছিল তখনই আক্রমণ হানা, কিন্তু তা না করে মারাঠারা আরও দু’মাস অপেক্ষা করে।

সদাশিব রাও -এর হঠাৎ যুদ্ধে ঝাঁপ

যখন মারাঠা শিবিরে প্রবল খাদ্যাভাব তখন তারা যুদ্ধের সম্মুখীন হয়। কেন এমনটা হল তার কারণ স্পষ্ট নয়। আবার বিশ্বাস রাও-এর মৃত্যুর পর কোনও অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করে সদাশিব রাও কেন হঠাৎ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তাও স্পষ্ট নয়।

মারাঠা নেতাদের ঐক্য ও সংহতি বোধের অভাব

  • (১) মারাঠা নেতাদের মধ্যে বোঝাপড়ার চূড়ান্ত অভাব ছিল। দুই সেনাপতি সিন্ধিয়া ও হোলকারের মধ্যে বোঝাপড়া ও তীব্র ব্যক্তিত্বের সংঘাত ছিল।
  • (২) অবস্থা সামাল দেবার জন্য রঘুনাথ রাও-কে উত্তর ভারত-এ পাঠানো হয়। তাতে কোনও লাভ হয় নি। সদাশিব রাও-কে পাঠালে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়।
  • (৩) আবার তিনি ছিলেন খুবই উদ্ধত ও একগুঁয়ে প্রকৃতির—সবাই তাঁকে পছন্দ করত না। আসলে উত্তর ভারতে মারাঠা নেতাদের মধ্যে কোনও ঐক্য ও সংহতিবোধ না থাকায় তাঁরা অভিভাবকহীন বালকদের মতো আচরণ করতে থাকেন।

পেশোয়ার দায়িত্ব

মারাঠাদের ব্যর্থতার জন্য পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও-এর দায়িত্বও নেহাৎ কম নয়। যেমন –

(১) নীতিগত ত্রুটি

মারাঠাদের উত্তর ভারতের রাজনীতিতে জড়িত হওয়ার কোনও যুক্তিসম্মত কারণ ছিল না। তাদের পাঞ্জাব নীতি ছিল ভুলে ভরা। আবদালির সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে তারা অযথা খাল কেটে কুমির ডেকে আনে।

(২) যুদ্ধের রসদ সরবরাহে ব্যর্থতা

যুদ্ধের প্রয়োজনে নিয়মিত অস্ত্র, খাদ্য, অর্থ, সেনা প্রভৃতি জোগান দেওয়ার দায়িত্ব ছিল পেশোয়ার ওপর। কিন্তু তিনি যথার্থভাবে এ দায়িত্ব পালন করতে পারেন নি। যুদ্ধের ঠিক পূর্বে সদাশিব রাও পেশোয়ার কাছে বারংবার অর্থ সাহায্য চেয়েও পান নি।

(৩) পেশোয়ার নিজে যোগদান না করা

উত্তর ভারতে মারাঠা নেতৃমণ্ডলী যখন আত্মকলহে লিপ্ত তখন পেশোয়ার উচিত ছিল নিজে উত্তর ভারতে উপস্থিত হয়ে সমস্যার সমাধান করা। তিনি তা না করে অপদার্থ নেতাদের হাতে দায়িত্ব অর্পণ করে নিজে নির্বিকার ছিলেন।

(৪) পেশোয়ার সমালোচনা

ভ্রান্ত নীতি ও দায়িত্বহীন ভাবে নির্বিকার থাকার কারণে স্যার যদুনাথ সরকার এবং ডঃ সরদেশাই পেশোয়ার সমালোচনা করেছেন।

উপসংহার :- কালের গহবরে হারিয়ে গেছে পানিপথের সেই যুদ্ধ। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় চিরকাল বেঁচে থাকবে পানিপথ আর পানিপথে ভারতের পরাজয়ের কারণগুলি।

(FAQ) পানিপথের যুদ্ধে মারাঠাদের ব্যর্থতার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ কখন কোথায় হয়?

১৭৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জানুয়ারি হরিয়ানা রাজ্যের পানিপথে।

২. পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ কাদের মধ্যে হয়েছিল?

আহম্মদ শাহ আবদালির আফগান বাহিনীর সাথে মারাঠা বাহিনীর।

৩. পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের সময় মারাঠা পেশোয়া কে ছিলেন?

বালাজি বাজিরাও।

Leave a Comment