বঙ্গভঙ্গ ও সাম্প্রদায়িকতা

বঙ্গভঙ্গ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রসঙ্গে বঙ্গভঙ্গের সময় বঙ্গদেশের জনসংখ্যা, দুটি প্রদেশ, বঙ্গভঙ্গের বিশেষ উদ্দেশ্য, মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি তোষণ, মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা, সাম্প্রদায়িক বিভেদের বীজ বপন, সাম্প্রদায়িকতার চিরস্থায়ীত্ব ও স্বদেশী আন্দোলন থেকে মুসলিমদের দূরত্ব সম্পর্কে জানবো।

বঙ্গভঙ্গ ও সাম্প্রদায়িকতা

ঐতিহাসিক ঘটনাবঙ্গভঙ্গ ও সাম্প্রদায়িকতা
বঙ্গভঙ্গ১৯০৫ খ্রি:
বড়লাটলর্ড কার্জন
পূর্ববঙ্গঢাকা
পশ্চিমবঙ্গকলকাতা
বঙ্গভঙ্গ রদ১৯১১ খ্রি:
বঙ্গভঙ্গ ও সাম্প্রদায়িকতা

ভূমিকা :- ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বড়লাট লর্ড কার্জন কর্তৃক বঙ্গভঙ্গ অর্থাৎ বঙ্গদেশকে দুভাগে ভাগ করে দুটি প্রদেশে পরিণত করবার সঙ্গে সঙ্গেই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবে সমগ্র বাংলাদেশব্যাপী, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে এক প্রচণ্ড আন্দোলন দেখা দেয়। এই আন্দোলনই ধীরে ধীরে সমগ্র ভারতবর্ষ-এ বিস্তার লাভ করে ভারতের যুগান্তকারী স্বদেশী আন্দোলন-এ পরিণত হয়।

বঙ্গভঙ্গের সময় বঙ্গদেশের জনসংখ্যা

  • (১) ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের পূর্ব পর্যন্ত বিহার এবং উড়িষ্যাও বঙ্গদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেই সময় এই সংযুক্ত বিশাল বাংলার মোট লোকসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৮০ লক্ষ এবং এর মধ্যে বাঙালীদের সংখ্যা ছিল ৪ কোটি ১০ লক্ষ।
  • (২) মোটামুটি হিসাবে বাঙালীদের অর্ধেক ছিল মুসলমান আর বাকি অর্ধেক হিন্দু। হিন্দুদের প্রধান বাসস্থান পশ্চিমবঙ্গে, আর মুসলমানদের প্রধান বাসস্থান পূর্ববঙ্গে। বিহার এবং উড়িষ্যার অধিবাসীরাও প্রধানত হিন্দু।

বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে দুটি প্রদেশ

প্রদেশ হিসাবে সংযুক্ত বঙ্গদেশের আয়তন অতি বিশাল – এই অজুহাতে বঙ্গদেশকে দুভাগে ভাগ করা হয়। যেমন –

  • (১) উত্তরবঙ্গসহ পূর্ববঙ্গের সাথে আসামকে সংযুক্ত করে একটি প্রদেশ গঠন করা হয়। এই প্রদেশটির রাজধানী হয় ঢাকা। এর লোকসংখ্যা ছিল ৩ কোটি ১০ লক্ষ। এর দুই-তৃতীয়াংশ ছিল মুসলমান। সুতরাং এই প্রদেশটিকে একটি মুসলমান-প্রধান প্রদেশ রূপে গড়ে তোলা হয়।
  • (২) পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার-উড়িষ্যা নিয়ে আর একটি প্রদেশ গঠন করা হয়। এই প্রদেশটির রাজধানী কলকাতাই থাকে।

বঙ্গভঙ্গের বিশেষ উদ্দেশ্য

তিনটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিই শাসকগোষ্ঠী এইভাবে বাংলাদেশকে দুভাগে ভাগ করে। যথা –

(১) কর্নওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ত্রুটি সংশোধন

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-এ জমির খাজনা চিরকালের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। সুতরাং পরে আর জমির খাজনা বৃদ্ধির কোনো উপায় ছিল না। বঙ্গদেশকে দুভাগে ভাগ করার ফলে আসাম সহ নতুন পূর্ববঙ্গ প্রদেশে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অবসান ঘটে। সুতরাং শাসকগোষ্ঠী এবার পূর্ববঙ্গ ও আসামের জমির খাজনা ইচ্ছামতো বৃদ্ধি করবার সুযোগ লাভ করে।

(২) কৃষক আন্দোলন ধ্বংসের পরিকল্পনা

বঙ্গদেশের কৃষকদের কাছ থেকেই ব্রিটিশ শাসন সর্বাধিক বাধা পাচ্ছিল এবং বঙ্গদেশের ক্রমবর্ধমান কৃষক আন্দোলন ব্রিটিশ শাসনের সম্মুখে এক ভয়ঙ্কর বিপদের কারণ হয়ে উঠেছিল। সুতরাং বঙ্গদেশকে দুভাগে ভাগ করে, অর্থাৎ বঙ্গদেশের কৃষককে দুটুকরো করে শাসকগোষ্ঠী বঙ্গদেশের কৃষক সংগ্রামকে ধ্বংস করবার পরিকল্পনা করে।

(৩) সাম্প্রদায়িক বিরোধের সৃষ্টি

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ এবং ওয়াহাবি আন্দোলন-এর পর ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী Divide and Rule এই রোমান নীতিকেই প্রধান অবলম্বন করে নিয়েছিল। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের বঙ্গভঙ্গের পশ্চাতে বঙ্গদেশে সাম্প্রদায়িকতা, অর্থাৎ হিন্দু-মুসলমানের বিরোধের বীজ বপন করা ছিল শাসকগোষ্ঠীর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।

মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি তোষণ

ইংরেজরা মুসলমান ভূস্বামিগোষ্ঠীকে এবং নবজাত অল্প সংখ্যক মুসলমান বুর্জোয়াদের বুঝাল যে, নতুন পূর্ববঙ্গ প্রদেশটিই হবে মুসলমানদের নিজস্ব প্রদেশ, এখানে মুসলমানদের সংখ্যাধিক্য বশত তারা হিন্দু ভূস্বামী ও হিন্দু বুর্জোয়াদের প্রতিযোগিতার বাধা এড়াতে সক্ষম হবে। শাসকগোষ্ঠী তাদেরকে আরও বুঝাল যে, হিন্দু ভূস্বামিগোষ্ঠী এবং হিন্দু বুর্জোয়ারাই তাদের বিকাশের ও আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রধান অন্তরায়।

মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা

শাসকগোষ্ঠীর পরামর্শে ঢাকার নবাবের নেতৃত্বে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই এটি ব্রিটিশ শাসনের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে।

সাম্প্রদায়িক বিভেদের বীজ বপন

কৃষক বিদ্রোহের ভয়ে ভীত হয়ে শাসকগোষ্ঠী একসময় নিজেদের উদ্যোগে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা করেছিল। আজ আবার বঙ্গদেশের ক্রমবর্ধমান কৃষক বিদ্রোহে বাধাদানের উদ্দেশ্যেই শাসকগোষ্ঠী সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি ও মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা করল। এইভাবে বঙ্গভঙ্গের দ্বারা বঙ্গদেশ তথা ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমান বিরোধের বীজ বপন করা হইল।

সাম্প্রদায়িকতার চিরস্থায়ীত্ব

বঙ্গভঙ্গের ফলে কেবল বঙ্গদেশই বিভক্ত হল না, বাংলার কৃষক জনসাধারণও হিন্দু ও মুসলমান এই দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। এই সময় হিন্দুদের ধর্মীয় স্বদেশী আন্দোলনের ফলে সাম্প্রদায়িকতার শিকড় সমাজের গভীরে প্রবেশ করে সাম্প্রদায়িকতাকে চিরস্থায়ী করে তুলল।

সাম্প্রদায়িকতার বৃদ্ধি

১৯১২ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ রদ হলেও সাম্প্রদায়িকতার অবসান হল না, বরং তা শাসকগোষ্ঠী ও হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়াশীল ভূস্বামীদের সমবেত চেষ্টায় ক্রমশ বেড়েই চলে।

বঙ্গভঙ্গের সময় সাম্প্রদায়িকতার মহীরুহ সৃষ্টি

বঙ্গদেশে সাম্প্রদায়িকতার মূল ইতিহাসের গর্ভে নিহিত। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের বঙ্গভঙ্গ সেই বীজ থেকে মহীরুহের সৃষ্টি করেছে। ব্রিটিশ শাসনের সূচনাকাল থেকে একশ বছর পর্যন্ত মুসলমানগণ প্রাণপণে ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা এবং হিন্দুরা ব্রিটিশ শাসনের সাথে পূর্ণ সহযোগিতা করেছিল।

হিন্দু জমিদারের শোষণের শিকার মুসলমান চাষী

১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে হিন্দুরাই প্রায় সকল জমিদারি হস্তগত করেছিল। বাংলাদেশের জনসাধারণের অর্থাৎ কৃষকের দুই-তৃতীয়াংশই মুসলমান। সুতরাং, জমিদারগোষ্ঠী হল হিন্দু, আর মুসলমান চাষীরা তাদের অবাধ শোষণ-উৎপীড়নের শিকার হয়ে রয়েছে।

মুসলমান চাষীদের শত্রু হিন্দু জমিদার

ব্রিটিশ শাসনের প্রথম থেই শোষক হিন্দু জমিদার গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মুসলমান চাষীকে নিরবছিন্নভাবে সংগ্রাম চালনা করেই জীবনধারণ করতে হয়েছে। এর অবশ্যম্ভাবী ফল রূপে শোষক হিন্দু জমিদারগোষ্ঠীকে মুসলমান চাষীরা চিরকাল শত্রু রূপেই ভেবে এসেছে।

জমিদার ও মোল্লাদের সাম্প্রদায়িকতার প্রচার

  • (১) ঊনবিংশ শতাব্দীতে বঙ্গদেশে যে কৃষক বিদ্রোহের ঝড় বয়েছে, তাকে বিপথগামী করবার উদ্দেশ্যে হিন্দু জমিদার গোষ্ঠী এবং মুসলমান মোল্লা মৌলভীরা অবাধে সাম্প্রদায়িকতার প্রচার করে এসেছে। এর ফলে হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ ক্রমশ উগ্র হতে উগ্রতর হয়েছে।
  • (২) প্রত্যেকটি কৃষক বিদ্রোহকে একদিকে হিন্দু জমিদার ও তালুকদারগোষ্ঠী হিন্দুদের সাথে মুসলমানদের বিরোধ ও হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের আক্রমণ বলে এবং অন্যদিকে মোল্লা-মৌলভীরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের আক্রমণ বলে প্রচার করে।
  • (৩) এর ফলে বঙ্গদেশ সাম্প্রদায়িকতার উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এর উপর ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের বঙ্গভঙ্গ এই সাম্প্রদায়িকতাকে শত সহস্র গুণ বাড়িয়ে তুলেছে।

স্বদেশী আন্দোলন থেকে মুসলিমদের দূরত্ব

  • (১) বঙ্গভঙ্গের সময় পূর্ববঙ্গের নুতন প্রদেশের মুসলমান কৃষকদের বিভ্রান্ত করবার জন্য তাদের মধ্যে শাসকগোষ্ঠী এবং মুসলমান ভূস্বামী ও মোল্লা-মৌলভীরা প্রচার চালাত যে, এই নতুন প্রদেশটি মুসলমানদের নিজস্ব প্রদেশ, এখানে মুসলমান চাষী হিন্দু জমিদার-তালুকদারদের শোষণ-উৎপীড়ণ থেকে মুক্তি লাভ করবে।
  • (২) সুতরাং এই নতুন প্রদেশের সৃষ্টি তাদের মঙ্গলের জন্যই। এই সকল প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে বঙ্গদেশের, বিশেষত পূর্ববঙ্গের মুসলমান চাষীরা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ‘স্বদেশী আন্দোলন’ থেকে দূরে সরে পূর্ববঙ্গ প্রদেশের পক্ষে দণ্ডায়মান হয়।

উপসংহার :- হিন্দুপ্রধান পশ্চিমবঙ্গের বিরুদ্ধে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মুসলমানদের বিরোধিতা প্রবল আকারে দেখা দেয়। এই পটভূমিকায় আরম্ভ হয় বঙ্গদেশের স্বদেশী আন্দোলন।

(FAQ) বঙ্গভঙ্গ ও সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. বঙ্গভঙ্গের নির্দেশ দেন কে?

লর্ড কার্জন।

২. বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করা হয় কবে?

১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর।

৩. বঙ্গভঙ্গের পর পূর্ববঙ্গের রাজধানী স্থাপন করা হয় কোথায়?

ঢাকা।

৪. বঙ্গভঙ্গের পর পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী স্থাপন করা হয় কোথায়?

কোলকাতা।

৫. বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয় কবে?

১৯১১ খ্রিস্টাব্দে।

Leave a Comment