বিখ্যাত ইংরেজ কবি জন কিটস প্রসঙ্গে তার জন্ম, শিক্ষা, কবিতার নেশা, জীবনে আঘাত, সাহিত্যকে পেশা হিসেবে গ্রহণ, প্রথম কাব্য সংকলন, কিটসের তৃতীয় ও শেষ কাব্য সংকলন প্রকাশ, যক্ষ্মায় আক্রান্ত কিটস, তার সাহিত্য সম্ভার ও তার মৃত্যু সম্পর্কে জানবো।
বিখ্যাত ইংরেজ কবি জন কিটস
ঐতিহাসিক চরিত্র | জন কিটস |
জন্ম | অক্টোবর, ১৭৯৫ খ্রি |
পিতা | টমাস কিটস |
দেশ | ইংল্যান্ড |
পরিচিতি | রোমান্টিক কবি |
মৃত্যু | ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৮২১ খ্রি: |
ভূমিকা :- দুশো বছর আগেকার কথা। লন্ডন শহরের প্রাণকেন্দ্রে ছিল একটি আস্তাবল। এমনি একটি আস্তাবলের পরিচালক ছিলেন টমাস কিটস। নিচে আস্তাবল, উপরে স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন টমাস। স্ত্রী আস্তাবলের মালিকের মেয়ে। কাজের প্রয়োজনে টমাসকে যেতে হত মালিকের বাড়িতে। সেখানেই দুজনের দেখা, তারপর প্রেম, একদিন বিবাহ। তাদেরই সন্তান বিখ্যাত কবি জন কিটস।
জন কিটসের জন্ম
বিবাহের এক বছর পর ১৭৯৫ সালের অক্টোবর মাসে টমাসের প্রথম সন্তানের জন্য হল। যথাসময়ে শিশুর নামকরণ করা হল জন কিটস্ । কিটসের জন্মের কয়েক বছরের মধ্যেই জন্ম হল তাঁর দুই ভাই জর্জ আর টমের। তিন ভাইয়ের মধ্যে কিটস্ ছিলেন সবচেয়ে সুন্দর।
জন কিটসের শিক্ষা
সাত বছর বয়সে তাকে এনফিল্ডের স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হল। দিন-রাত পড়াশুনা নিয়ে থাকেন তিনি। মাঝে মাঝে মনের খেয়ালে কবিতা লেখেন। ১৫ বছর বয়সে স্কুলের পড়া শেষ হল। কিটসের অভিভাবকের ইচ্ছা কিটস ডাক্তারি পড়বেন। ডাক্তারি পড়বার জন্যে ভর্তি হলেন মেডিকেল কলেজে।
জন কিটসের কবিতার নেশা
কিন্তু যাঁর মনের মধ্যে জেগে উঠেছে কবিতার নেশা, হাসপাতালের ছুরি কাঁচি ঔষধ রোগী তাঁর ভাল লাগবে কেন।
জন কিটসের জীবনে আঘাত
- (১) কিটসের যখন নয় বছর বয়স জীবনে প্রথম আঘাতের মুখোমুখি হলেন। ঘোড়া থেকে পড়ে মারা গেলেন টমাস কিটস।
- (২) স্বামীর মৃত্যুর পর কিটসের মা অন্য একজনকে বিয়ে করলেন। কিন্তু অল্পদিনেই দুজনের সম্পর্কে ফাটল ধরল। এক বছরের মধ্যেই বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেল।
- (৩) ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়ি এলেন কিটসের মা। কিটস তখন দশ বছরের ছেলে। ১৮১০ সালে মারা গেলেন কিটসের মা। মরার আগে নিজের অজান্তেই রাজরোগ যক্ষ্মার বীজ দিয়ে গেলেন সস্তানকে।
- (৪) মায়ের মৃত্যুর পর পিতৃ-মাতৃহীন ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব নিলেন মিস্টার এ্যাবি। স্কুলে ফিরে এলেন কিটস।
কিটসের প্রণয়
কিটস ফ্যানি ব্রন নামে ১৮ বছরের এক তরুণী প্রতিবেশীর প্রেমে পড়ে যান। এর পর থেকেই কিটসের সৃষ্টিশীল সময়ের সূচনা হয়।
তরুণ কবি লে হান্টের সাথে কিটসের পরিচয়
এরপর তাঁর স্কুলের বন্ধু কাউডেন ক্লার্ক কিটসকে নিয়ে গেলেন সেই সময়কার খ্যাতিমান তরুণ কবি লে হান্টের কাছে। ১৮১৬ সালে হান্টের সাথে পরিচয় কিটসের জীবনে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। হান্ট কিটসের কবিতা পড়ে মুগ্ধ হলেন, তাঁকে আরো কবিতা লেখবার জন্য উৎসাহিত করলেন। হান্ট একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। সেই পত্রিকাতেই কিটসের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হল।
কিটসের সাহিত্যকে জীবনের পেশা হিসাবে গ্রহণ
এখানে কিটসের পরিচয় হল শেলীর সাথে। আর ডাক্তারির মোহে নিজেকে বেঁধে রাখতে পারলেন না। অভিভাবকের উপদেশ অগ্রাহ্য করে মেডিকেল কলেজ ছেড়ে দিয়ে স্থির করলেন সাহিত্যকেই জীবনের পেশা হিসাবে গ্রহণ করবেন।
কিটসের প্রথম কাব্য সংকলন প্রকাশ
কিটস তাঁর দুই ভাইকে নিয়ে লন্ডন ত্যাগ করে এলেন হ্যাম্পস্টেডে। এখানে আসবার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল হান্টের সঙ্গ পাওয়া। অল্পদিনের মধ্যেই কিটস প্রকাশ করলেন তাঁর প্রথম কবিতা সংকলন। সকলের মনে আশা ছিল এই বই নিশ্চয়ই জনপ্রিয় হবে। কিন্তু দুভার্গ্য কিটসের পরিচিত কিছু লোকজন ছাড়া এই বই-এর একটি কপিও বিক্রি হল না।
কিটসের প্রথম দীর্ঘ কবিতা রচনা
প্রথম কাব্য সংকলনের ব্যর্থতার সাময়িক আশাহত হলেন কিটস কিন্তু অল্পদিনেই নতুন উৎসাহে শুরু করলেন কাব্য সাধনা। লেখা হল প্রথম দীর্ঘ কবিতা এণ্ডিমিয়ন (Endymion 1817)। এ এক অসাধারণ কবিতা। এই কবিতার প্রথম লাইনের মধ্যেই কিটসের জীবন দর্শন ফুটে উঠেছে – A thing of beauty is joy forever.
কিটসের দেশভ্রমণ
ইতিপূর্বে কখনো দেশভ্রমণে যান নি কিটস, তাই বন্ধুর সাথে বেরিয়ে পড়লেন। ভ্রমণ শেষ করে ফিরে আসতেই দেখলেন তাঁর ভাই টম গুরুতর অসুস্থ।
কিটসের এণ্ডিমিয়ন কবিতা প্রকাশ
প্রকাশিত হল তাঁর এণ্ডিমিয়ন (১৮১৭)। কিটস আশা করেছিলেন তাঁর এই কবিতা নিশ্চয়ই খ্যাতি পাবে। কিন্তু তৎকালীন দুটি পত্রিকা ব্ল্যাকউড ম্যাগাজিন এবং কোয়াটার্নি রিডি তীব্র ভাষায় কিটসের নামে সমালোচনা করল। জঘন্য সে আক্রমণ।
কিটসের ভাইয়ের মৃত্যু
তীব্র বিদ্বেষপূর্ণ সমালোচনা প্রকৃতপক্ষে কিটসের মানসিক শক্তিকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল। একদিকে যখন পত্রিকার সমালোচনায় ভেঙে পড়েছেন কিটস সেই সময় এল আরেক আঘাত। ১৮১৮ সালের ১লা ডিসেম্বর মারা গেল টম।
অর্থ উপার্জনের তাগিদে কিটসের কাব্য রচনা
কিটস স্থির করলেন যেমন করেই হোক তাঁকে অর্থ উপার্জন করতেই হবে। স্বাস্থ্য আগের মত ভাল যাচ্ছিল না। কিন্তু মনের অদম্য শক্তিতে কিটস লিখে চললেন একের পর এক কবিতা। প্রকৃতপক্ষে কিটসের জীবনের সমস্ত শ্রেষ্ঠ কবিতাই এক সময়ে লেখা।
কিটসের অসুস্থ অবস্থা
আর্থিক অবস্থাও ভাল যাচ্ছিল না কিটসের। কিটসের শরীর যতই ভেঙে পড়ছিল ততই ফ্যানি তাঁর কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। তার সাজ-গোজ হাসি অন্য ছেলেদের সাথে মেলামেশা কিটস সহ্য করতে পারতেন না। তাঁর সমস্ত অন্তর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যেত।
যক্ষ্মায় আক্রান্ত কিটস
- (১) তিনি ফিরে এলেন লন্ডনে। একদিন বাইরে বেড়াতে বেরোলেন কিটস। বাড়িতে ফিরে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এল, সেই সাথে কাশি। এক ঝলক রক্ত উঠে এল মুখ দিয়ে।
- (২) কিটস্ বললেন, একটি মোমবাতি নিয়ে এস। ব্রাউন মোমবাতি নিয়ে আসতেই কিটস কিছুক্ষণ রক্তের দিকে চেয়ে বললেন, এই রক্তের রং আমি চিনি, এ রক্ত উঠে এসেছে ধমনী থেকে। এই রক্ত আমার মৃত্যুর শমন।
- (৩) ডাক্তার এল। সে যুগে যক্ষ্মার কোনো চিকিৎসা ছিল না। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে শিরা কেটে কিছুটা রক্ত বার করে দেওয়া হল। কিন্তু তাতে কোনো সুফল দেখা গেল না।
- (৪) তখন তাঁর বয়স মাত্র পঁচিশ। গলার স্বর ভেঙে গিয়েছিল, মাঝে মাঝেই জ্বর হত, গলা দিয়ে রক্ত উঠে আসত, এই সময় তাঁর সৃষ্টির উৎসও ফুরিয়ে আসছিল।
কিটসের তৃতীয় ও শেষ কাব্য সংকলন প্রকাশ
এই সময় প্রকাশিত হল কিটসের তৃতীয় ও শেষ কাব্য সংকলন (১৮২০)। এই কবিতাগুচ্ছ কিটকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিদের পাশে স্থান দিয়েছে।
কিটসের উল্লেখযোগ্য কবিতা
শেষ কাব্য সংকলনে একদিকে ছিল কিছু বড় কবিতা অন্যদিকে ছোট কিছু কবিতা, সনেট। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ইসাবেলা (Isabella or the Pot of Basil 1818)। Hyperion গ্রীক পুরাণের কাহিনী অবলম্বন করে লেখা দীর্ঘকাব্য।
কিটসের সাহিত্য সম্ভার
১৮১৭ সালে ৩০ টি কবিতা ও সনেটের সমন্বয়ে Poems শিরোনামে তার বই প্রকাশিত হয়। কিটসের বিখ্যাত কবিতা গুলির মধ্যে রয়েছে The Eve of St Agnes, La Belle Dame Sans Merci, Endymion, Hyperion, Ode to a Nightingale, Ode on Melancholy, To Autumn, Ode On A Grecian Urn ইত্যাদি। ইংরেজি ভাষায় পাঁচটি বিখ্যাত Ode এর মধ্যে Ode to a Nightingale অন্যতম।
প্রকৃত সৌন্দর্যের খোঁজে কিটস
Ode to Nightingale এ মানব জীবনেরই এক রূপক। এখানে জীবন মৃত্যুর স্রোত পাশাপাশি বয়ে চলেছে। Ode to Autumn-এ এক বিপরীত ধারণা ফুটে উঠেছে, এখানে কবি প্রকৃত সৌন্দর্য খুঁজে বেড়িয়েছেন।
কিটসের স্বল্প কাব্য জীবন
কবিতা ছাড়া কিটস কোনো গদ্য লেখার চেষ্টা করেননি। তাঁর কাব্য জীবন ছিল মাত্র ছয় বছর (১৮১৪-১৮১৯)। অর্থাৎ উনিশ থেকে চব্বিশ বছর বয়স।
ফ্যানিদের বাড়িতে কিটস
১৮২০ সাল, কিটসের দেহ ক্রমশই ভেঙে পড়ছিল। তাঁকে নিয়ে আসা হল ফ্যানিদের বাড়িতে। ইতালিতে যাবার আগে এক মাস তিনি ফ্যানির নিবিড় সান্নিধ্যে পেয়েছিলেন।
ইতালির পথে কিটস
১৮২০ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর কিটস রওনা হলেন ইতালির দিকে। দীর্ঘ সমুদ্র পথ পার হতে ছয় সপ্তাহ লাগল। জাহাজে যেতে যেতে কিটস মুক্ত আকাশের দিকে চেয়ে থাকতেন। চোখে পড়ত ধ্রুবতারা। মনে হত মৃত্যুর পর তিনি ঐ ধ্রুবতারার সাথে একাত্ম হয়ে যাবেন।
কিটসের মৃত্যু
২৩শে ফেব্রুয়ারি শুক্রবার ১৮২১ সাল। সমস্ত দিন কেমন আচ্ছন্ন ছিলেন কিটস রাত তখন প্রায় এগারোটা, মাথার পাশে বসেছিল বন্ধু সেভার্ন। আস্তে আস্তে কিটস বললেন, “আমাকে তুলে ধর, আমার মৃত্যু এগিয়ে এসেছে। আমি শান্তিতে মরতে চাই, তুমি ভয় পেও না – ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, অবশেষে মৃত্যু এল।” সেভার্নের কোলেই চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে পড়লেন চিরসুন্দরের কবি কিটস।
কিটসের সমাধি
পরদিন রোম-এর এক সমাধিক্ষেত্রে তাঁকে সমাধি দেওয়া হল। দু-বছর পরে এই সমাধিক্ষেত্রেই সমাধি দেওয়া হয় আরেক তরুণ কবি শেলীকে।
কিটসের সমাধি লিপি
তার সমাধি লিপিতে লেখা রয়েছে ‘Here lies One Whose Name was writ in Water’.
কিটসের বিখ্যাত উক্তি
Ode On A Grecian Urn এ কিটসের একটি বিখ্যাত উক্তি হল “Beauty is truth, truth beauty that is all Ye know on earth, and all ye need to know”।
উপসংহার :- লর্ড বায়রন ও পার্সি বিশি শেলির সাথে সাথে তিনিও ছিলেন দ্বিতীয় প্রজন্মের রোমান্টিক কবিদের একজন। তার মৃত্যুর মাত্র চার বছর আগে তার সৃষ্টি সমূহ প্রকাশিত হয়। তার মৃত্যুর পর তার কবিতাগুলো সঠিক মূল্যায়ন পেতে শুরু করে এবং উনিশ শতকের শেষ দিকে তিনি অন্যতম জনপ্রিয় ইংরেজ কবির স্বীকৃতি পান।
(FAQ) বিখ্যাত ইংরেজ কবি জন কিটস সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
ইংরেজি সাহিত্যের একজন রোম্যান্টিক কবি।
অক্টোবর ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে।
“Beauty is truth, truth beauty that is all Ye know on earth, and all ye need to know”।
যক্ষ্মা।
সনেট।