আসামের জয়ন্তিয়া বিদ্রোহ

আসামের জয়ন্তিয়া বিদ্রোহ প্রসঙ্গে সিন্টেঙ্গ উপজাতি, জয়ন্তিয়া অঞ্চলে থানা, ব্রিটিশ শক্তির শোষণমূলক ব্যবস্থা, সরকারি বিবরণে সিন্টেঙ্গদের উল্লেখ, সিন্টেঙ্গদের বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন, গৃহকর ধার্য, সিন্টেঙ্গদের পুলিশ ঘাঁটি আক্রমণ, সরকারের বিদ্রোহ দমন, বিদ্রোহীদের জয়ন্তিয়া অঞ্চল দখল ও জয়ন্তিয়া বিদ্রোহের অবসান সম্পর্কে জানবো।

আসামের জয়ন্তিয়া বিদ্রোহ

ঐতিহাসিক ঘটনাজয়ন্তিয়া বিদ্রোহ
স্থানআসাম
দেশভারত
সময়কাল১৮৬০ ও ১৮৬২ খ্রি:
ধরণকৃষক বিদ্রোহ
আসামের জয়ন্তিয়া বিদ্রোহ

ভূমিকা :- ১৮৩৫ খ্রীষ্টাব্দে আসামের জয়ন্তিয়া পার্বত্য অঞ্চলে ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐ বছরই এই পার্বত্য অঞ্চলের রাজাকে অবসর ভাতা দিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই অঞ্চলটিকে নিজ শাসনাধীনে নিয়ে আসে।

আসামের সিন্টেঙ্গ উপজাতি

এই অঞ্চলটি সিন্টেঙ্গ উপজাতির বাসভূমি। এরা খাসি উপজাতীয় আদিবাসীদের সমগোষ্ঠীভুক্ত। সিন্টেঙ্গরা অত্যন্ত স্বাধীনতা প্রিয়। তাদের জীবনে কোনোদিন তারা বাইরের হস্তক্ষেপ সহ্য করে নি।

জয়ন্তিয়া অঞ্চলে থানা প্রতিষ্ঠা

শাসকগোষ্ঠীর বুঝতে বিলম্ব হয় না যে, সিন্টেঙ্গরা নির্বিবাদে বিজাতীয় ব্রিটিশ শাসন মেনে নেবে না। তা বুঝেই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ প্রথমেই জয়ন্তিয়া অঞ্চলের কেন্দ্র জোয়াই নামক স্থানে একটি থানা বা পুলিস ঘাঁটি স্থাপন করে। এই পুলিসঘাঁটি স্থাপন করবার পরই ব্রিটিশ বণিক শাসকগোষ্ঠী নিজমূর্তি ধারণ করে।

ব্রিটিশ শক্তির শোষণমূলক ব্যবস্থা

নুতন শাসকগণ উপজাতীয় কৃষকদের উপর একে একে শোষণমূলক ব্যবস্থা প্রয়োগ করতে থাকে। তার সঙ্গে সঙ্গে উপজাতীয় কৃষকগণও বিদ্রোহের পতাকা উড়িয়ে সেই সকল শোষণ-ব্যবস্থায় বাধা দেয়।

সরকারি বিবরণে সিন্টেঙ্গদের উল্লেখ

তৎকালীন সরকারী বিবরণে সিণ্টেঙ্গদের ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রাম সম্বন্ধে বলা হয়েছে, “সিন্টেঙ্গদের কখনও সম্পূর্ণ জয় করা সম্ভব হয় নি। ভারত সাম্রাজ্যের বিপুল ধনসম্পদ সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা ছিল না। যতদিন তাদের নিজেদের জীবনধারার উপর হস্তক্ষেপ করা হয় নি, ততদিন তারা কোনো উৎপাত সৃষ্টি করবার কারণ খুঁজে পায় নি। কিন্তু তাদের উপর কর ধার্য প্রভৃতি অসস্তোষজনক ব্যবস্থা প্রয়োগ করবার সঙ্গে সঙ্গেই তারা তার বিরুদ্ধে বাধা দান করেছে।”

সিন্টেঙ্গদের বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন

সিন্টেঙ্গদের অসস্তোষ উদ্দীপক এই প্রকার কর ধার্য করে অর্থ সংগ্রহ করবার জন্য আসামের ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী উন্মাদ হয়ে উঠেছিল এবং শাসকগোষ্ঠীর এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধেই সিন্টেঙ্গ উপজাতীয় কৃষকগণ বারংবার বিদ্রোহের পতাকা উড্ডীন করেছিল।

আসামে সিন্টেঙ্গদের উপর গৃহকর ধার্য

ব্রিটিশ বণিক শাসকগণ প্রথম উৎপীড়নমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করে ১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দে। এই বছর শাসকগণ সিন্টেঙ্গদের প্রতি গৃহের উপর কর ধার্য করে। সিন্টেঙ্গ উপজাতীয় কৃষকগণ প্রথমে এই গৃহকর রদ করবার জন্য শাসকদের নিকট বহু আবেদন-পত্র পেশ করে।

সিন্টেঙ্গদের পুলিশ ঘাঁটি আক্রমণ

কোনো ফল না পেয়ে সিন্টেঙ্গরা বিদ্রোহের উদ্দেশ্যে ‘মেল’-এ সঙ্ঘবদ্ধ হয় এবং গ্রামে গ্রামে সভা করতে থাকে। অবশেষে তারা লাঠি, তীরধনুক, বল্লম প্রভৃতিতে সজ্জিত হয়ে পাহাড় অঞ্চলের বিভিন্ন পুলিসঘাঁটি আক্রমণ করে। তাদের আক্রমণে বহু পুলিস নিহত ও আহত হয়।

ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর দ্বারা বিদ্রোহ দমন

এই সময় পাহাড় অঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রকাণ্ড সৈন্যবাহিনীকে বিদ্রোহ দমনের কাজে নিযুক্ত করা হয়। তাদের সাথে সংগ্রাম করে বহু সিন্টেঙ্গ প্রাণ বিসর্জন দেয়। অবশেষে সংগ্রামের অবসান হলেও সিন্টেঙ্গদের মধ্যে বিদ্রোহের মনোভাব অব্যাহত থাকে। তারা আবার বিদ্রোহের সুযোগ খুঁজতে থাকে।

সিন্টেঙ্গদের উপর আয়কর ধার্য

১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দের বিদ্রোহ দমন করে শাসকগোষ্ঠীর সাহস ও লোভ বেড়ে যায়। তারা গৃহকরের সঙ্গে সিন্টেঙ্গদের উপর আয়কর ধার্য করে। প্রথমে ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দে ৩১০ জনের উপর এই আয়কর ধার্য হয় এবং আরও বহু ব্যক্তির উপর আয়কর ধার্যের পরিকল্পনা স্থির হয়।

উপজাতীয় কৃষকদের সভা

সিন্টেঙ্গদের ‘মেল’ গুলি আবার সক্রিয় হয়ে উঠে। গ্রামে গ্রামে উপজাতীয় কৃষকদের সভায় এই কর আদায়ে বাধা দানের জন্য পরামর্শ চলতে থাকে। এবারেও আবেদন-নিবেদনের পালা শেষ করে তারা বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুত হয়।

সিন্টেঙ্গ উপজাতির দ্বিতীয় বিদ্রোহ

অবশেষে তারা বৃটিশ শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-উৎপীড়নে বাধাদানে দৃঢ়সঙ্কল্প হয়ে সংগ্রাম আরম্ভ করে। জয়ন্তিয়া পাহাড়ে সিন্টেঙ্গ উপজাতির দ্বিতীয় বিদ্রোহ আরম্ভ হয়ে যায়।

বিদ্রোহীদের জয়ন্তিয়া পাহাড় অঞ্চল দখল

  • (১) বিদ্রোহী সিন্টেঙ্গরা প্রথমেই জয়ন্তিয়ার কেন্দ্রস্থল জোয়াই-এর উপর আক্রমণ আরম্ভ করে। সৈন্যগণ জোয়াই-এর রক্ষণ-ব্যবস্থাকে দুর্ভেদ্য করে তুলবার জন্য জোয়াই-এর চতুর্দিকে বড় বড় গাছের একটি প্রাচীর তৈরি করেছিল। বিদ্রোহীরা প্রথমেই এই প্রাচীরটির উপর আক্রমণ করে তাকে ধুলিসাৎ করে দেয়।
  • (২) তার পর প্রাচীরের অন্তরালে অবস্থিত থানা বা প্রধান পুলিস ঘাঁটির উপর আক্রমণ আরম্ভ হয়। বিদ্রোহীরা শয়তানের ঘাঁটিস্বরূপ এই পুলিস ঘাঁটি কে আগুন দিয়ে ভস্মীভূত করে। তারা চারদিকে আক্রমণ চালিয়ে ব্রিটিশ শাসন নিশ্চিহ্ন করে ফেলে এবং জয়ন্তিয়া পাহাড় অঞ্চলটি পুনরায় অধিকার করে।

জয়ন্তিয়া বিদ্রোহ দমন

  • (১) এই বিদ্রোহের সংবাদ পেয়ে বিদ্রোহ দমন করবার জন্য এই অঞ্চলে একটি প্রকাণ্ড সৈন্যবাহিনী এসে উপস্থিত হয়। সৈন্যবাহিনী বিদ্রোহীদের হাত থেকে জোয়াই কেন্দ্রটি পুনরুদ্ধার করে।
  • (২) এর পর আরম্ভ হয় সরকারী সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের নিয়মিত গেরিলা যুদ্ধ। এই গেরিলা যুদ্ধ চলে ১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বর মাস পর্যন্ত। শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহীরা প্রায় সকলেই আত্মসমর্পণ করে।

উপসংহার :- আসামের জয়ন্তিয়া বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও বিদ্রোহীদের প্রাণপন চেষ্টা ও তাদের স্বাধীনতার আকাঙ্খা আমাদের জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত করে।

(FAQ) আসামের জয়ন্তিয়া বিদ্রোহ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. আসামের জয়ন্তিয়া পার্বত্য অঞ্চলে ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় কখন?

১৮৩৫ সালে।

২. জয়ন্তিয়া বিদ্রোহ কখন হয়?

১৮৬০ ও ১৮৬২ সালে।

৩. জয়ন্তিয়া বিদ্রোহ কোথায় হয়?

আসামে।

৪. আসামের জয়ন্তিয়া পার্বত্য অঞ্চলে কাদের বাসভূমি ছিল?

সিন্টেঙ্গ উপজাতি।

Leave a Comment