আসামের ফুলাগুঁড়ি কৃষক বিদ্রোহ

আসামের ফুলাগুঁড়ি কৃষক বিদ্রোহ প্রসঙ্গে অধিবাসীদের উপর প্রথম আয়কর ধার্য, চাষীদের পপির চাষ নিষিদ্ধ, ফুলাগুঁড়ি অঞ্চলের চাষীদের আবেদন পেশ, বিদ্রোহের সময় ধার্য, কৃষকদের সমাবেশ, ক্ষোভ, কৃষক পুলিশ সংঘর্ষ , নেতাদের বিচার ও বিদ্রোহের অবসান সম্পর্কে জানবো।

আসামের ফুলাগুঁড়ি কৃষক বিদ্রোহ

ঐতিহাসিক ঘটনাফুলাগুঁড়ি বিদ্রোহ
স্থানআসাম
দেশভারত
সময়কাল১৮৬১ খ্রি:
ধরণকৃষক বিদ্রোহ
আসামের ফুলাগুঁড়ি কৃষক বিদ্রোহ

ভূমিকা :- আসামের নওগাঁও জেলার ফুলাগুঁড়ি অঞ্চল প্রধানত উপজাতীয় আদিবাসীদের বাসভূমি। আদিবাসীদের প্রায় সকলেই ছিল অত্যন্ত দরিদ্র। তারা ধান, পান ও পপির চাষ করে কোনো প্রকারে কায়ক্লেশে জীবিকা নির্বাহ করিত।

অধিবাসীদের উপর প্রথম আয়কর ধার্য

১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দের প্রথম ভাগে আসামের ব্রিটিশ শাসকগণ এই অঞ্চলের অধিবাসীদের উপর প্রথম আয়কর ধার্য করে। তারা চাষীদের সুপারী এবং পানের উপরেও কর ধার্য করে।

ফুলাগুঁড়ি অঞ্চলের চাষীদের পপির চাষ নিষিদ্ধ

পপি থেকে আফিম জাতীয় একটি দ্রব্য তৈরি করা চলত বলে চাষীদের পপির চাষও নিষিদ্ধ করা হয়। পপির চাষ নিষিদ্ধ করবার যুক্তি থাকলেও এর ফলে চাষীদের আর্থিক আয় যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস পায় এবং চাষীদের দুর্দশা চরম আকার ধারণ করে। এই আকস্মিক উৎপীড়নে চাষীরা দিশেহারা হয়ে পড়ে।

ফুলাগুঁড়ি অঞ্চলের চাষীদের আবেদন পেশ

তারা প্রথমে তাহাদের ‘মেল’-এর অধিবেশন আহ্বান করে এবং হাজার হাজার কৃষক স্বাক্ষর ও টিপসহি দিয়ে কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন পত্র পেশ করে। কিন্তু নওগাঁও জেলার কমিশনার চাষীদের এই আবেদন-নিবেদনে কর্ণপাত করলেন না।

ফুলাগুঁড়ি অঞ্চলের চাষীদের বিদ্রোহের সময় ধার্য

অবশেষে কৃষকগণ বিদ্রোহের পথে এই শোষণ-উৎপীড়ন বন্ধ করবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বিদ্রোহের সময় ধার্য হয় ১৯৬১ খ্রীষ্টাব্দের অক্টোবর মাসের শেষ দিকে।

ফুলাগুঁড়ি অঞ্চলের চাষীদের সমাবেশ

কিন্তু তার পূর্বে আর একবার আপস-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবার সিদ্ধান্ত হয়। এই সিদ্ধান্ত অনুসারে কৃষকদের এক বিশাল সমাবেশের আয়োজন হয়। বহু সহস্র কৃষক এই সমাবেশে যোগদান করে।

কৃষক সমাজ কর্তৃক নওগাঁও জেলার ডেপুটি কমিশনারকে আহ্বান

  • (১) পুলিস প্রথম থেকেই সমবেত কৃষকদের ছত্রভঙ্গ করবার জন্য সচেষ্ট হয়। কিন্তু তারা দৃঢ়তার সঙ্গে পুলিসের সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। এই সমাবেশে উপস্থিত হয়ে তাদের দাবি শুনবার জন্য কৃষকগণ নওগাঁও জেলার ডেপুটি কমিশনারকে আহ্বান করে।
  • (২) কিন্তু ডেপুটি কমিশনার তাচ্ছিল্যভরে কৃষকদের সেই দাবি অগ্রাহ্য করেন এবং স্বয়ং সেই সমাবেশে উপস্থিত না হয়ে অল্পবয়স্ক সহকারী কমিশনারকে সেই সমাবেশে প্রেরণ করেন।

ফুলাগুঁড়ি অঞ্চলের চাষীদের ক্ষোভ

১৮ই অক্টোবর সহকারী কমিশনার একদল সশস্ত্র পুলিস নিয়ে সমাবেশে উপস্থিত হন। কৃষকদের দাবি ছিল, ডেপুটি কমিশনার স্বয়ং এসে তাহাদিগকে আয়কর প্রভৃতি রদ করবার প্রতিশ্রুতি দিবেন। কিন্তু তাঁর পরিবর্তে সহকারী কমিশনারকে উপস্থিত থাকতে দেখে কৃষকগণ ক্ষিপ্ত হইয়া উঠে।

ফুলাগুঁড়ি অঞ্চলের চাষীদের স্থান ত্যাগ না করার সিদ্ধান্ত

জনতাকে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে দেখেই সহকারী কমিশনার তাদেরকে অবিলম্বে ছত্রভঙ্গ হবার নির্দেশ দেন। কৃষকগণ চিৎকার করে জানিয়ে দেয়, তারা আয়কর ও পপির চাষের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার নির্দেশ না শুনে স্থানত্যাগ করবে না।

ফুলাগুঁড়ি অঞ্চলের চাষীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ

  • (১) সহকারী কমিশনার ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে কৃষকদের কাছ থেকে অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করবার জন্য পুলিশদলকে নির্দেশ দেন। পুলিসদল তাঁর আদেশ পালন করতে অগ্রসর হলে প্রচণ্ড সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়।
  • (২) কৃষকদের আক্রমণে কয়েকজন পুলিস ধরাশায়ী হলে সহকারী কমিশনার তাঁর রিভলভার উত্থিত করে কৃষকদের দিকে ধাবিত হন। কিন্তু তিনিও কৃষকদের লাঠির আঘাতে ধরাশায়ী হন। কৃষকগণ তাঁকে লাঠি দিয়ে হত্যা করে। এই ঘটনা দেখামাত্র সকল পুলিশ প্রাণের ভয়ে ছুটে পালাতে থাকে।

ফুলাগুড়ি ‘মেল’-এর প্রায় সকল নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি গ্রেপ্তার

এই ঘটনা শুনা মাত্র আসামের চীফ কমিশনারের নির্দেশে ডেপুটি কমিশনার ‘আসাম পদাতিক বাহিনী’-এর সৈন্য নিয়ে ফুলাগুঁড়ি উপস্থিত হন। তার নির্দেশে সৈন্যগণ বহু কৃষককে গুলি করিয়া হত্যা করে এবং বিদ্রোহী কৃষকদের নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করে এক ভয়ঙ্কর বিভীষিকা সৃষ্টি করে। ফুলাগুঁড়ি ‘মেল’-এর প্রায় সকল নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি গ্রেপ্তার হন।

ফুলাগুঁড়ি অঞ্চলের কৃষক নেতাদের বিচার

  • (১) প্রথমে দরং জেলার ডেপুটি কমিশনার অভিযুক্তদের বিচার করেন। পরে আসামের বিচার বিভাগের কমিশনার স্বয়ং বিচারের ভার গ্রহণ করেন। তাঁর বিচারে ‘মেল’-এর নায়কগণের মধ্যে নরসিং লালুং, সম্বর লালুং, লখন কোচ ও সুরেন কোচ প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন
  • (২) শিবসিং ও বাবু ডোম যাবজ্জীবন কারাদণ্ড লাভ করেন, মণি কাছারী ও ময়রা সিং-এর ১৪ বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ আর লাহু চুতিয়া তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।

ফুলাগুঁড়ি অঞ্চলের কৃষক বিদ্রোহের অবসান

এইভাবে সরকারি দমন নীতি ও পুলিশি অত্যাচারের ফলে আসামের বিখ্যাত ফুলাগুঁড়ি বিদ্রোহের অবসান ঘটে।

উপসংহার :- সরকারী বিবরণীতে এই বিদ্রোহকে “দাঙ্গা-হাঙ্গামা” বলে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় জনসাধারণ এখনও এই বিদ্রোহকে “ফুলাগুঁড়ি ধাওয়া” অর্থাৎ ফুগাগুঁড়ির যুদ্ধ বলে স্মরণ করে এবং তা থেকে সংগ্রামের প্রেরণা লাভ করে।

(FAQ) আসামের ফুলাগুঁড়ি কৃষক বিদ্রোহ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ফুলাগুঁড়ি বিদ্রোহ কোথায় হয়?

আসামের নওগাঁও জেলার ফুলাগুঁড়ি অঞ্চল।

২. ফুলাগুঁড়ি বিদ্রোহ কখন হয়?

১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে।

৩. ফুলাগুঁড়ি বিদ্রোহের পর কাদের ফাঁসির সাজা হয়?

নরসিং লালুং, সম্বর লালুং, লখন কোচ ও সুরেন কোচ।

৪. সরকারি বিবরণীতে ফুলাগুঁড়ি বিদ্রোহকে কি অ্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে?

দাঙ্গা – হাঙ্গামা।

Leave a Comment