বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য প্রসঙ্গে তিন ধরনের বাণিজ্য, আমদানি ও রপ্তানি, নদী কেন্দ্রিক বাণিজ্য অসুবিধা, নদীকেন্দ্রিক ব্যবস্থা, নৌকা পরিবহন, রাজপথ, স্থলপথে পরিবহন, স্থল বাণিজ্যে ক্রয় বিক্রয় সম্পর্কে জানবো।

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য

বিষয়বিজয়নগরের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য
সাম্রাজ্যবিজয়নগর সাম্রাজ্য
বন্দরম্যাঙ্গালোর, কোচিন
পরিবহননৌকা, গোশকট
বৃহৎ রাজপথসাতটি
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য

ভূমিকা :- বাণিজ্যে দক্ষিণ ভারত-এর প্রাণকেন্দ্র ছিল বিজয়নগর। বৈদেশিক বাণিজ্য যেমন উন্নত ছিল তেমনি আভ্যন্তরীন বাণিজ্যের উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো।

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে তিন ধরনের বাণিজ্য

দক্ষিণের বিজয়নগরের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য তিন ধরনের ছিল –

  • (১) উপকূল বাণিজ্য,
  • (২) নদী-কেন্দ্রিক বাণিজ্য ও
  • (৩) স্থল বাণিজ্য।

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে আমদানি ও রপ্তানি

  • (১) ছোটো ব্যবসার ক্ষেত্রে পণ্যদ্রব্য নৌকায় লেনদেন হত ক্যাম্বে, ভাতকল, ম্যাঙ্গালোর, মালাবার, কোচিন, কয়াল, পুলিকট, মোতুপল্লি ও মসুলি পত্তনম-এর মধ্যে। চাল, নারকেল, নারকেল তেল, গুড় এবং অন্যান্য পণ্য মালাবার থেকে ক্যাম্বে এবং সুরাটে যেত।
  • (২) সেখান থেকে তুলা এবং সিল্ক দ্রব্য মালাবার উপকূলে নিয়ে আসত। মালাবার তার উৎপাদিত দ্রব্য পাঠাত কয়াল, নেগাপত্তম, পুলিকট, মোতুপল্লি, মসুলি পত্তনমের আশেপাশে।
  • (৩) ফিরতি মুখে এইসব যানে কয়াল পাঠাত ছোটো-মুক্তো, পুলিকট বস্ত্র, মোতুপল্লি এবং মসুলিপত্তনেম হিরে এবং দামি পাথর পাঠাত মালাবার, গোয়া, সুরাট, ক্যাম্বে এবং বাংলা উপকূলে।

নদী কেন্দ্রিক বাণিজ্যে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অসুবিধা

  • (১) দক্ষিণ ভারতের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যও ছিল খুবই উন্নত। তবে উত্তর ভারতের নদী-কেন্দ্রিক বাণিজ্যের মতো এত উন্নত ছিল না। কারণ উত্তর ভারতের বাণিজ্যে গঙ্গা ও যমুনা যে ভূমিকা পালন করে দক্ষিণ ভারতে সে রকম নৌ-বাণিজ্যোপযোগী নদী নেই বললেই চলে।
  • (২) তাই দক্ষিণ ভারতের নদী-কেন্দ্রিক বাণিজ্য চললেও কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। উত্তর ভারতের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে নদী মাল বহনের ক্ষেত্রে অনবদ্য ভূমিকা পালন করে। পশ্চিমঘাট ও পূর্বঘাট পর্বতমালা নদী-কেন্দ্রিক বাণিজ্যের অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। এই অঞ্চলের নদীগুলি শুষ্ক থাকায় নৌ-বাণিজ্যে উত্তর ভারতের নদীগুলির মতো উপযোগী হয়ে উঠতে পারে নি।

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের নদীকেন্দ্রিক ব্যবস্থা

  • (১) দক্ষিণ ভারতে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ নদী-কেন্দ্রিক ব্যবস্থা আছে। যথা – গোদাবরী নদী ব্যবস্থা, কৃষ্ণা নদী ব্যবস্থা ও কাবেরী নদী ব্যবস্থা। এই তিনটি নদী ব্যবস্থা দক্ষিণ ভারতে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যকে অত্যন্ত সচল রেখেছিল।
  • (২) উত্তর ভারতের নদীগুলিতে গ্রীষ্মে জল শুকিয়ে গেলেও, এই নদীগুলিতে জল শুকিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। এখানে অনেক স্রোতস্বিনী আছে যেগুলি বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। সেগুলি দাক্ষিণাত্যের মালভূমি থেকে পূর্ব উপকূলে পণ্য বহনের কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে।
  • (৩) এছাড়াও দাক্ষিণাত্যে পশ্চিমে আরও তিনটি নদী আছে যথা গঙ্গোভ্যালী, সাবতী ও নেত্রবর্তী। এই নদীগুলি নৌ-যোগাযোগ ও পণ্য-পারাপারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে।

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের নৌকা পরিবহন

  • (১) দাক্ষিণাত্য মালভূমির পশ্চিমে দুধরনের নৌকা দেখা যায়। দুধরনের নৌকাই সুসজ্জিত ও শক্তিশালী এবং পালতোলা। বৃহদাকারের নৌকাও দেখা যায়। পায়েস Basket-boat নামে একধরনের নৌকার উল্লেখ করেছেন। কখনও কখনও এগুলি ঘোড়া ও গোরু বহনের কাজ করত।
  • (২) পায়েস একথাও বলেছেন যে “in all the kingdom where there are streams there are no other boats but these”. Basket- boat-কে বিভিন্ন স্থানে একটু পরিবর্তন করে বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন নামে ব্যবহার করা হত। কর্ণটক অঞ্চল ‘basket-boat’ কে ‘হরিগল’ এবং তামিল অঞ্চলে ‘পারিস’ বলা হত।

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজপথ

  • (১) স্থলপথে বাণিজ্যের প্রধান সাতটি বৃহৎ রাজপথ রাজধানী বিজয়নগর থেকে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানকে সংযুক্ত করেছে। এদের মধ্যে প্রথম উল্লেখযোগ্য রাজপথটি বস্তাপুর হয়ে গোয়ার সঙ্গে মিলিত হয়। দ্বিতীয় রাজপথটি শিবসুন্দরম হয়ে শ্রীরঙ্গপত্তনমের সঙ্গে যুক্ত হয়।
  • (২) তৃতীয়টি সম্ভবত কোচিন ও মালাবার অঞ্চলের সঙ্গে মিলিত হয়। চতুর্থটি চন্দ্রগিরি, তিরুপতি, কাঞ্চী, তিবান্নামালাই, চিদাম্বরম, মাদুরাই ও রামেশ্বরম হয়ে ধানুশকোদিতে গিয়ে মিলিত হয়েছে। পঞ্চম রাস্তাটি যুক্ত করেছে উদয়গিরি হয়ে কোন্দাবিদুকে।
  • (৩) ষষ্ঠটি যুক্ত করেছে কাম্পিলি ও কোভিলকোন্ডা হয়ে মসুলিপত্তমকে। সপ্তমটি যুক্ত করেছে রাইচুর এবং উত্তরের অন্যান্য শহরকে। সমসাময়িক রাজপথগুলির আনুপূর্বিক বর্ণনা দেওয়ার মতো তথ্য আমাদের হাতে বর্তমানে নেই।
  • (৪) বিদেশি পর্যটক বারবোসা, পায়েস, আবদুর রাজ্জাক এবং নিকোলো কটি তাদের যাত্রাপথের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা থেকেই এই স্থলপথের চিত্র পাওয়া যায় এবং তারা তাদের যাত্রাপথে বিভিন্ন অঞ্চলের নামও উল্লেখ করেছেন।

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজপথের তথ্য

  • (১) বারবোসা বলেছেন বন্ধাপুর ছিল বিজয়নগরের নিকট “on the road”। ক্যাস্টাহিডা লিখেছেন যে আলবুকার্ক গোয়া থেকে বিজয়নগরে এক দূত পাঠিয়েছিলেন। এই বক্তব্য হতে এই তথ্য পাওয়া যায় যে বন্ধাপুর হয়ে গোয়া থেকে বিজয়নগর পর্যন্ত একটি রাস্তা ছিল।
  • (২) সিওয়েল মন্তব্য করেছেন “that Bankapur was on the direct road from Honnavar to Vijayanagar.” এইভাবেই বিজয়নগর হতে বিভিন্ন রাজপথের তথ্য পাওয়া যায়। এই পথগুলি অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে পণ্য সরবরাহের কাজে সম্ভবত ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হত।
  • (৩) সম্ভবত বিজয়নগর অন্যান্য প্রাদেশিক রাজ্যের রাজধানী শহরের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রয়োজনে বড়ো বড়ো রাস্তা দ্বারা যুক্ত করা হয়েছিল। এই বড়ো বড়ো রাজপথগুলি বিজয়নগর সাম্রাজ্যের যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে শিরা-উপশিরার কাজ করত।

বিজয়নগর সাম্রাজ্যে চোর ডাকাতের উপদ্রব কম

আসলে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধার জন্য রাস্তাগুলির নির্মাণ ও মেরামত যথাযথ ছিল না। কিন্তু রাস্তাগুলিকে দস্যু-তস্করদের হাত থেকে মুক্ত রাখা হয়েছিল। ব্যবসায়ীরা যাতে নিরাপদে যাতায়াত করতে পারে সেদিকে কঠোর দৃষ্টি দেওয়া হত। রাস্তা-ঘাটে চোর-ডাকাতের উপদ্রব ছিল না বলে পিত্রো দেল্লা উল্লেখ করেছেন।

বিজয়নগর সাম্রাজ্যে স্থলপথে পরিবহন

  • (১) সমসাময়িক তথ্য থেকে জানা যায় যে স্থলপথে পণ্য বহনের কাজে ব্যাপকভাবে নিয়োজিত ছিল হাতি, ঘোড়া, গোরু ও মহিষের গাড়ি। গাধা ও ষাঁড়ের পিঠে গাঁট চাপিয়ে ব্যাপকভাবে পণ্য এক স্থান হতে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল।
  • (২) পায়েস লিখেছেন রাজপথসমূহ ভারবাহী গোশকটে সর্বদাই পরিপূর্ণ থাকত। এই তথ্যও বিদেশি বিবরণ থেকে পাওয়া যায় যে প্রতি বছর পাঁচ থেকে ছয় হাজার গাঁট বহনকারী ষাঁড় পণ্য বহনের কাজে ভাতকলে আসত।
  • (৩) গাধা ও গোরু পিঠে করে গোলমরিচের গুঁটি মালাবার থেকে বিজয়নগরে নিয়ে আসত। ঘোড়া ব্যবহৃত হত সরকারি আমলাদের এক স্থান হতে অন্য স্থানে যাতায়াতের কাজে। গোরু সাধারণ মানুষ বহনের কাজে ব্যবহার করত। গোরুর গাড়ি স্থল বাণিজ্যের প্রধান বাহন ছিল।

বিজয়নগর সাম্রাজ্যে স্থলবাণিজ্যে ক্রয়-বিক্রয়

স্থলবাণিজ্যে গোলমরিচ, সুপারি, ফল, চন্দন কাঠ, এলাচ, জিরা, হিং, লোহা, মটর, শিম, সরষে, নারকেল, খেজুর, তেঁতুল, খয়ের, সিল্ক ও তুলাজাত বস্তু, রেশম, তামাক, হলুদ, আদা, বাঁশের ঝুড়ি, গুড়, চিনি, তেল, নুন, চাল, রাগি, ধান, দড়ি ও খাদ্যশস্য ব্যাপকভাবে ক্রয়-বিক্রয় হত।

উপসংহার :- জিনিসপত্রের মূল্য পায়েস এর মতে অত্যন্ত সস্তা ছিল। পায়েস লিখেছেন “the prices of foodgrains and other necessaries were very low, they were very cheap.

(FAQ) বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. বিজয়নগর সাম্রাজ্যে বৃহৎ রাজপথ কতগুলি ছিল?

৭ টি।

২. বিজয়নগরে স্থলপথে পরিবহন মাধ্যম কি ছিল?

নৌকা, গোশকট।

৩. বিজয়নগর সাম্রাজ্যের দুটি বন্দরের নাম লেখ?

কোচিন, ম্যাঙ্গালোর।

Leave a Comment