জিওফ্রে চসার (১৩৪০-১৪০০) ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের প্রথম যুগের অন্যতম প্রধান কবি এবং “দ্য ক্যান্টারবেরি টেলস” এর রচয়িতা। তাকে ইংরেজি সাহিত্যের “পিতা” বলা হয়, কারণ তিনি ইংরেজি ভাষায় লেখালেখিকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। তার কাজগুলো মধ্যযুগীয় ইংল্যান্ডের সমাজ, ধর্ম, এবং সংস্কৃতির একটি জীবন্ত প্রতিচ্ছবি হিসেবে বিবেচিত হয়। চসারের সাহিত্যকর্ম ইংরেজি সাহিত্যে গভীর প্রভাব ফেলেছে এবং তাকে ইংরেজি সাহিত্যের অগ্রদূত হিসেবে গণ্য করা হয়।
কবি জিওফ্রে চসার
ঐতিহাসিক চরিত্র | জিওফ্রে চসার |
জন্ম | আনুমানিক ১৩৪০ সাল, লন্ডন, ইংল্যান্ড |
প্রধান রচনা | “দ্য ক্যান্টারবেরি টেলস”, “ট্রয়লাস অ্যান্ড ক্রিসেইডা” |
সাহিত্যধারা | মধ্যযুগীয় সাহিত্য, মধ্য ইংরেজি |
ভাষা | মধ্য ইংরেজি |
পেশা | কবি, লেখক, রাজকীয় কর্মকর্তা |
বিশেষ পরিচিতি | ‘ইংরেজি সাহিত্যের পিতা’, ‘দ্য ক্যান্টারবেরি টেলস’ এর রচয়িতা |
প্রভাব | মধ্যযুগীয় ইংল্যান্ডের সমাজ, ধর্ম, ও সংস্কৃতির প্রতিফলন |
সমসাময়িক লেখক | উইলিয়াম ল্যাংল্যান্ড, জন গাওয়ার |
মৃত্যু | ২৫ অক্টোবর ১৪০০, লন্ডন, ইংল্যান্ড |
ভূমিকা :- কবি কৃত্তিবাস যেই অর্থে আমাদের আধুনিক বাংলা কাব্যের আদি কবি, জিওফ্রে চসারও তেমনি আধুনিক ইংরাজি কাব্যের আদি কবি। গবেষকদের মতে তিনি হলেন আধুনিক ইংরাজি কাব্য়ের প্রথম কবি। ‘ক্যান্টারবেরি টেলস’ নামক অবিস্মরণীয় কাব্যগ্রন্থের জন্যই তিনি একজন মহৎ কবি বলে চিহ্নিত হয়েছেন। ইউরোপ-এর মধ্যযুগের কবি চসারের জীবন বৃত্তান্ত এখনও পর্যন্ত সঠিকভাবে উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। গবেষকদের অক্লান্ত চেষ্টায় কবির জীবনের একটা রেখাচিত্র মাত্র তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।
কবিদের ভণিতা
আমাদের দেশের প্রাচীন কবিদের মতো ইউরোপের মধ্যযুগের কোনো কোনো কবিও তাঁদের নিজ নিজ রচনার মধ্যেই সঙ্কেতের মাধ্যমে নিজেদের পরিচয় উল্লেখ করে গেছেন। সেই পরিচয়ের সূত্রেই তাঁদের জীবনচিত্র অঙ্কিত হয়েছে পরবর্তীকালে। উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে তাঁদের জীবনের কিছু কিছু ঘটনা।
জিওফ্রে চসারের জন্ম
প্রাচীন নথিপত্র ঘেঁটে চসারের উল্লেখ পাওয়া গেছে। কবি নিজেও কবিতার ভনিতায় পরিচয়ের উল্লেখ করেছেন। সমস্ত কিছু মিলিয়ে গবেষকরা যে সিদ্ধান্ত করেছেন তা থেকে জানা যায় ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দে লণ্ডনে কবি চসারের জন্ম। অবশ্য জন্মের সঠিক তারিখটি এখনও জানা সম্ভব হয় নি। তবে সাল সম্পর্কে গবেষকদের মধ্যে দ্বিমত নেই। বিস্তৃত তথ্য সংগ্রহের কাজ এখনও চলছে।
চসারের পারিবারিক পরিচয়
কবির পারিবারিক পরিচয়, বাবা-মার নাম বা তাঁর শিক্ষাদীক্ষা ইত্যাদি বিষয় এখনও অজানা। তবে প্রাচীন কাগজপত্র থেকে তাঁর কর্মজীবনের কিছু আভাস পাওয়া যায়। এ পর্যন্ত যে সকল তথ্য উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে তা থেকে জানা যায়, কবি চসার যে পরিবারে জন্মেছিলেন সেই পরিবারের পেশা ছিল সুরা ব্যবসা। তাঁর পিতাও ছিলেন একজন সুরা ব্যবসায়ী। তাঁদের আবাস ছিল টেমস স্ট্রীটে। পাশ দিয়েই বয়ে গেছে ক্ষীণস্রোতা ওয়াল ব্রুক। চসারের পৈতৃক ব্যবসার সূত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে তাঁর পার্ডনার টেলস রচনার মধ্যে। কবি নিজে এই ব্যবসায় বিশেষ পছন্দ করতেন না। তার আভাসও রয়েছে সেখানে। চসার নিজে কখনও পৈতৃক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন নি।
পরিচারকের কাজে জিওফ্রে চসার
রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ডের তৃতীয় পুত্র ছিলেন ডিউক অব ক্লারেন্স। চসার মাত্র সতেরো বছর বয়সেই ডিউকপত্নী এলিজাবেথের গৃহে পরিচারকের কাজ গ্রহণ করেন। কিন্তু রাজপ্রাসাদের এই বালক ভৃত্য ছিলেন বুদ্ধিতে ও কৌতূহলে অন্যদের থেকে অলাদা। তাই সেই সময়ের রাজনৈতিক, সামরিক ও অসামরিক অবস্থার বিষয়ে তিনি রীতিমতো ওয়াকিবহাল থাকতেন।
যুদ্ধের প্রতি আগ্রহী জিওফ্রে চসার
দেশের রাজার সামরিক বিজয়ের আনন্দের আস্বাদ চসার পেয়েছিলেন বাল্য বয়সেই। তাঁর যখন মাত্র ছয় বছর বয়স সেই সময়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ফ্রান্সকে পরাস্ত করেছিল ইংল্যাণ্ড। এই যুদ্ধজয়ের আনন্দে মেতে উঠেছিল গোটা দেশ। সেই স্মৃতি বালক চসারের স্মরণে ছিল। তার পরে ১৩৫৬ খ্রিস্টাব্দে পয়টারের যুদ্ধেও ফরাসীরা হয়েছিল শোচনীয়ভাবে পর্যুদস্ত। চসায় তখনও ডিউকের প্রাসাদে পরিচারকের কাজ গ্রহণ করেন নি। সেই যুদ্ধজয়ের স্মৃতিও চসারের মনে ছায়া ফেলেছিল। এবং স্বভাবতই তিনি কিশোর বয়সেই যুদ্ধের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন।
যুদ্ধে সামিল জিওফ্রে চসার
রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ডের রাজত্বকালেই ফরাসীদের বিরুদ্ধে ইংরাজদের শতবর্ষের যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। এই দিক থেকে বলা যায় চসার ছিলেন রাজকীয় সামরিক তৎপরতার সাক্ষী এবং মাত্র উনিশ বছর বয়সেই উর্দি খুলে রেখে তাঁকেও গায়ে চাপাতে হয়েছিল সামরিক পোশাক। চসারের যখন ১৯ বছর বয়স, সদ্য যুবক তিনি, ১৩৫৯ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় এডওয়ার্ড আবার ফরাসী আক্রমণ করলেন। চসারও সামরিক পোশাক গায়ে চাপিয়ে হাতে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে এই যুদ্ধে সামিল হলেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ যুদ্ধক্ষেত্রে ফরাসী সৈন্যদের হাতে বন্দী হলেন চসার। তবে দুই পক্ষের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর হবার আগেই মুক্তি পেলেন তিনি। তাঁর মুক্তিপণ ১৬ পাউণ্ড রাজতহবিল থেকেই দেওয়া হয়েছিল।
জিওফ্রে চসারের রাজানুগ্রহ লাভ
মুক্তি পাবার পর চসার কোথায় গিয়েছিলেন, কি করেছেন, সে সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। আবার তাঁকে পাওয়া যায় ১৩৬৭ খ্রিস্টাব্দে। তিনি তখন রাজপ্রাসাদে ফিরে এসেছেন পরিচারক হিসেবে। যুদ্ধবন্দী হবার সুবাদে চসার রাজানুগ্রহ লাভ করেছিলেন। তাঁকে আজীবন ভাতা মঞ্জুর করা হয়েছিল। ফলে আর্থিক দিক থেকে অনেকটাই নিশ্চয়তা ফিরে পেয়েছিলেন তিনি।
শয্যা রচনার কাজে জিওফ্রে চসার
দ্বিতীয় দফায় রাজ পরিবারে কাজে যোগ দেবার পর চসারকে দেওয়া হয়েছিল শয্যা রচনার কাজ। সেই সঙ্গে সংবাদ আদান-প্রদানের কাজও করতে হত। প্রাপ্ত কিছু নথিপত্র থেকে গবেষকরা অনুমান করেছেন, প্রাসাদের এই কাজ থেকে পরে চসারকে রাজার চতুর্থ পুত্র জন অব গণ্ট-এর আবাসে বদলি করা হয়েছিল।
বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের কাজে জিওফ্রে চসার
কর্মক্ষেত্রের ব্যস্ততার ফাঁকে যে কবির কাব্যচর্চার অভ্যাসও অব্যাহত ছিল তা অনুমান করা যায়। কেনা না ১৩৬৯ খ্রিস্টাব্দে রচিত তাঁর কবিতার মধ্যে তিনি কর্মজীবনের খণ্ড খণ্ড ঘটনার উল্লেখ করেছেন। চসার ডিউকপত্নী ব্লাঁচের স্মৃতির উদ্দেশ্যে রচনা করেছিলেন দ্য বুক অব দ্য ডাচেস এবং এই রচনার সূত্রেই তাঁর প্রতি ওপরওয়ালাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। অচিরেই রাজপরিবারের ভূত্যের কাজ থেকে অব্যাহতি পান তিনি। তাঁকে নিযুক্ত করা হতে থাকে বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের কাজে।
জিওফ্রে চসারের স্থায়ী চাকুরি
এই ভাবেই একদিন ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেল। চসার হয়ে উঠলেন রাজপুরুষদের কাছের মানুষ। দূতাবাসের কাজে চসার ১৩৭২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জেনোয়া পিসা এবং ফ্লোরেন্স ভ্রমণ করেন। কবি ও কূটনীতিক হিসেবে ইতিমধ্যে খ্যাতি অর্জন করেছেন তিনি। ১৩৭৭ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করে দ্বিতীয় রিচার্ড চসারের চাকুরি স্থায়ী করেন। তাঁর ভাতাও বহাল থাকে।
বোকাচিও ও পেত্রার্কের সঙ্গে জিওফ্রে চসারের সাক্ষাত
পরের বছরেই তাঁকে দূতাবাসের দায়িত্ব দিয়ে ইতালিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই ইতালি ভ্রমণ চসারের জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিল। বলা যায় তাঁর কবি জীবনের পরিপুষ্টি ঘটেছিল ইতালির মাটিতে। নতুন কর্মক্ষেত্রে গিয়ে চসার মহাকবি দান্তে, বোকাচিও ও পেত্রার্কের রচনার সঙ্গে পরিচিত হন। তাঁদের কাব্য তঁকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করে। ইতিমধ্যে মহাকবি দান্তে পরলোকগমন করেছিলেন। কিন্তু বোকাচিও ও পেত্রার্কের সঙ্গে যে চসারের সাক্ষাত হয়েছিল এ বিষয়ে গবেষকরা একরকম নিশ্চিত। তাঁদের ধারণা, যুগন্ধর এই তিন কবি হয় ফ্লোরেন্স অথবা লোম্বার্ডিতে মিলিত হয়েছিলেন।
ভাগ্যবান কবি জিওফ্রে চসার
একদিক থেকে চসার ছিলেন ভাগ্যবান কবি। সাধারণত কবিরা আর্থিক অনটনের শিকার হয়ে থাকেন। চসারকে কখনও অর্থনৈতিক কষ্টে পড়তে হয়নি। রাজানুগ্রহে বারবারই তিনি ছিলেন ভাগ্যবানদের দলে। আর্থিক দিক থেকে স্বাবলম্বী হওয়ায় উপযুক্ত বয়সেই যে চসার সংসারী হয়েছিলেন তা অনুমান করা যায়।
জিওফ্রে চসারের সংসার জীবন
তাঁর জীবনের প্রেম ভালোবাসার বিষয়ে কিছুই জানা যায় না। কেবল তাঁর স্ত্রী ফিলিপ্পার কথাই আমরা জানতে পারি। তাঁদের সংসারযাত্রা যে সচ্ছল ছিল এমন অনুমান করার বাধা নেই। চসার ও তাঁর স্ত্রী ফিলিপ্পার কাজে রাজা খুবই সন্তুষ্ট ছিলেন এবং তাঁদের জন্য ১০ পাউণ্ড করে আজীবন ভাতা মঞ্জুর করেছিলেন।
লন্ডন বন্দরের দায়িত্বপূর্ণ পদে জিওফ্রে চসার
জন অব গন্ট-এর প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন চসার। রাজার বদান্যতায় প্রতিদিন রাজভাণ্ডার থেকে চসারকে এক ভাণ্ড মদ সরবরাহ করা হত। এই সময়ে তাঁর ভাগ্যলক্ষ্মী এতটাই সুপ্রসন্ন ছিলেন যে রাজাদেশে একসময় তিনি লন্ডন বন্দরের কমট্রোলার অব কাস্টমের দায়িত্বপূর্ণ পদটিও লাভ করলেন। লন্ডন বন্দরের কাজে যোগ দেবার কিছুদিন পরেই আরো একটি অতিরিক্ত দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হয়েছিল। কমট্রোলার অব পেটি কাস্টমের কাজও তাঁকে করতে হত।
ওয়েস্ট মিনিস্টারে জিওফ্রে চসারের বাড়ি ক্রয়
লন্ডন থেকে চসার গ্রীনউইচ চলে আসেন ১৩৮৫ খ্রিস্টাব্দে। এখানে পুরসভার ব্যবস্থাপনায় অল্ডগেটের কাছে একটি বড় বসত বাড়ি তাঁকে দান করা হয়। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এই বাড়িতেই তিনি বাস করেন। তবে মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে তিনি ওয়েস্ট মিনিস্টারে সেন্ট মেরী চ্যাপেলের কাছে একটি বাড়ি খরিদ করেছিলেন।
জিওফ্রে চসারের ভাগ্য বিপর্যয়
যাই হোক, একসময় চসার হলেন শায়ারের নাইট। পার্লামেন্টের দেওয়া এই সম্মান কিন্তু চসারের জীবনে শুভসূচক হল না। অচিরেই শুরু হল তাঁর ভাগ্য বিপর্যয়। জন অব গন্ট গিয়েছিলেন স্পেন-এ। এই সুযোগ কাজে লাগিয়েছিলেন ডিউক অব প্রসেস্টার। তিনি রাজা দ্বিতীয় রিচার্ডের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে একটি রিজেন্সী নিয়োগ করেন। চসার ছিলেন জন অব গন্টের প্রিয়পাত্র এবং অনুগ্রহভাজন। তাই রিজেন্সীর হুকুমে চসারকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হল। এতকাল সম্মানের পাশাপাশি অর্থও অর্জন করেছেন চসার। কিন্তু চিরন্তন কবিপ্রকৃতির স্বভাব বশে খরচের ব্যাপারে তিনি ছিলেন লাগামছাড়া। সঞ্চয়ের অভ্যাস কোনো কালেই রপ্ত করতে পারেন নি। ফলে চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়ে খুবই দৈন্য দশায় পড়লেন তিনি।
ক্যান্টারবেরি টেলস কাব্য রচনায় জিওফ্রে চসার
তারপরেই এলো দ্বিতীয় আঘাত। ১৩৮৭ খ্রিস্টাব্দে স্ত্রী ফিলিপ্পার হল অকাল মৃত্যু। শোক দুঃখ-দৈন্যের পীড়নে বিপর্যস্ত অবস্থা চসারের। আশ্চর্য যে, জীবনের এই চরম বিপর্যয়ের পর্যায়েই চসার রচনা করলেন তাঁর অবিস্মরণীয় কাবা ক্যান্টারবেরি টেলস। দুঃখের মধ্যে দিয়েই প্রস্ফুটিত হয় মহৎ সৃষ্টি-এই আপ্তবাক্য কবি চসারের জীবনেও সত্য হতে দেখা গেল। ক্যান্টারবেরি টেলস তাঁর বিড়ম্বিত জীবনের স্মরণীয় কীর্তি। সুখ ও দুঃখের দোলায় আন্দোলিত জীবনের অনুভূতির মধ্যে দিয়েই চসার রচনা করেছেন তাঁর সাহিত্য।
জিওফ্রে চসারের সম্মান ও মর্যাদা লাভ
ভাগ্যের বিড়ম্বনাতেই দেশের রাজনৈতিক উত্থান-পতনের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল চসারের জীবন। টানা দুই বছর এই বিড়ম্বনা ভোগ করতে হল তাঁকে। সুদিন আবার ফিরে এলো ১৩৮৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় রিচার্ড সিংহাসন পুনর্দখল করার পরে। ক্ষমতা করায়ত্ত করার পরেই রিজেন্সীকে বরখাস্ত করলেন দ্বিতীয় রিচার্ড। চসার ওয়েস্টমিনিস্টারে রাজদরবারে নিযুক্ত হলেন কেরানীর কাজে। কিছুদিনের মধ্যেই আগের চাইতেও বেশি সম্মান ও মর্যাদা ফিরে পেলেন তিনি।
আদালতে অভিযুক্ত জিওফ্রে চসার
উলউইচ ও গ্রীনউইচের মধ্যে টেমস নদীর তীর সংস্কারের জন্য উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। চসার নিযুক্ত হলেন এই কমিশনের সম্মানীয় সদস্য পদে। রাজভাণ্ডার থেকে বার্ষিক কুড়ি পাউন্ড ভাতা মঞ্জুর করা হয়েছিল চসারকে। তা সত্ত্বেও ১৩৯৪ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয়বার চরম অর্থসঙ্কটে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছিল যে দেনার দায়ে তাঁকে আদালতে অভিযুক্ত হতে হয়েছিল।
আর্থিক সঙ্কটে জিওফ্রে চসার
১৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে চতুর্থ হেনরী সিংহাসনে আরোহণ করলে নিজেই আর্থিক দুরবস্থার কথা জানিয়ে চসার নির্ধারিত ভাতা বৃদ্ধির আবেদন জানালেন। রাজা চতুর্থ হেনরী কবির জন্য যথাযোগ্য বাবস্থাই করলেন। তিনি তাঁর বার্ষিক ভাতার পরিমাণ বাড়িয়ে দ্বিগুণ করলেন। সেই সঙ্গে ১৩৯৪ খ্রিস্টাব্দের স্থগিত বার্ষিক ভাতা কুড়ি পাউন্ড অনুদান হিসাবে পুনঃপ্রদানের নির্দেশও দিলেন। অচিরেই আর্থিক সঙ্কট দূর হল। আবার সুখস্বাচ্ছন্দ্য ফিরে পেলেন কবি।
জিওফ্রে চসারের মৃত্যু
কিন্তু ততদিনে তাঁর আয়ুর মেয়াদও ফুরিয়ে এসেছিল। ক্যান্টারবেরি টেলস-এর অমর স্রষ্টা ১৪০০ খ্রিস্টাব্দের ২৫শে অক্টোবর পরলোক গমন করলেন। বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অবশ্য চসারের মৃত্যুর সাল তারিখ নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। তা সত্ত্বেও ১৪০০ খ্রিস্টাব্দের ২৫ শে অক্টোবর তারিখটিকে সাধারণভাবে তাঁর মৃত্যুর সময় বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে।
কবি জিওফ্রে চসারের সমাধি
ইংরাজি সাহিত্যের আদি কবি চসারকে সমাহিত করা হয় ওয়েস্ট মিনিস্টার অ্যাবেতে। তাঁর সমাধিকে কেন্দ্র করেই সৃষ্টি হয়েছে এখনকার পোয়েটস কর্নার।
জিওফ্রে চসারের রচনার প্রচার
পদা রচনার পাশাপাশি গদ্যও রচনা করেছেন চসার। মুদ্রণ ব্যবস্থা ছিল না বলে সেকালে তাঁর রচনার প্রচারও সেভাবে সম্ভব হয় নি। মৃত্যুর পর সত্তর বছরেরও বেশি সময় তাঁর গদ্য পদ্য রচনাগুলি হাতে লিখেই প্রচার করা হয়েছে। ১৪৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ছাপা অক্ষরে মুদ্রিত ক্যান্টারবেরি টেলস প্রকাশিত হয়।
চসারের উপর ফরাসী কাব্য রীতির প্রভাব
তাঁর রচনাবলীর ওপরে গবেষণা করে বিশেষজ্ঞগণ যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন সেই হিসেবে ১৩৫৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩৭২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চসার ফরাসী কাব্য রীতির দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। এই সময়ে কিছু ফরাসী কবিতার অনুবাদের সঙ্গে রচনা করেছিলেন দা বুক অব দা ড্যাচেস। ফরাসী সাহিত্যের লে রোমান দ্য লা রোজ নামের মধ্যযুগীয় প্রেমকাব্য থেকে প্রেমভিত্তিক কিছু কবিতা চসার অনুবাদ করেছিলেন। দ্য হাউস অব ফেম সহ আরো কিছু অষ্টপদী কবিতাও একই সময়ে রচনা করেছেন চসার।
ইতালীয় সাহিতয়ের প্রতি জিওফ্রে চসারের আকর্ষণ
কূটনৈতিকের চাকরি নিয়ে চসার যখন ইতালি ভ্রমণ করেন, তার অনেক আগেই মহাকবি দান্তে গত হয়েছিলেন। তাঁর রচনার সঙ্গে চসারের যেমন পরিচয় হয়েছিল তেমনি বোকাচিও এবং পেত্রার্কের রচনা পাঠ করে তিনি পেয়েছিলেন অনুপ্রেরণা। শেষোক্ত দুই কবির সঙ্গে চসারের সাক্ষাতও হয়েছিল। এই সাহচর্যের ফলে স্বভাবতঃই ইতালীয় সাহিত্য বিশেষ করে প্রেমসঙ্গীত ও শিল্পের প্রতি তিনি প্রবল ভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন।
জিওফ্রে চসারের সাহিত্য সম্ভার
বিশেষজ্ঞদের মতে ১৩৭২ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ১৩৮৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে চসারের রচনা হয়েছে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল ও অধিকতর পরিণত। দা হাউস অব ফেম এই সময়েরই রচনা। কল্পনার রঙীন জগতে পাখির মতো ডানা মেলে উড়ে বেড়াত স্বভাব কবি চসারের মন। পাখির জীবন নিয়েই তিনি রচনা করেছেন দ্য এসেমন্ত্রী অব ফাউলস। দ্য লিজেন্ড অব গুড ওমেন কবির অসমাপ্ত কাব্য। এটি লেখায় হাত দিয়েছিলেন তিনি রানীর অনুরোধে। কিন্তু তিনি এটি অসমাপ্ত রেখেছিলেন কী কারণে তা আমরা জানতে পারি না। কবিজীবনের শেষ চোদ্দ বছরের রচনাই ছিল সম্পূর্ণ পরিণত এবং বাস্তবমুখী। বাস্তব জীবনের ঘাত প্রতিঘাতে তাঁর মনোজগতে যে পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছিল তারই প্রতিফলন ঘটেছে এই সময়ের রচনায়।
উপসংহার :- জিওফ্রে চসার ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের প্রথম যুগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি, যিনি ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনার পথপ্রদর্শক হিসেবে বিবেচিত হন। তার প্রধান রচনা “দ্য ক্যান্টারবেরি টেলস” মধ্যযুগীয় ইংল্যান্ডের সমাজ ও সংস্কৃতির এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি হিসেবে চিরকালীন সার্থকতা লাভ করেছে। চসারের সাহিত্যকর্ম শুধুমাত্র তার যুগের মানুষের জীবন ও চিন্তাধারাকে প্রকাশ করে নি, বরং পরবর্তী যুগের সাহিত্যিকদের জন্য এক অসাধারণ প্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি তার রচনায় ভাষার ব্যবহার, চরিত্রচিত্রণ, এবং গল্প বলার নতুন ধারা স্থাপন করে ইংরেজি সাহিত্যের ভিত্তি স্থাপন করেন, যা তাকে সাহিত্যের ইতিহাসে এক অমর ব্যক্তিত্ব করে তুলেছে।
(FAQ) জিওফ্রে চসার সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
চসারকে ইংরেজি সাহিত্যের “পিতা” বলা হয়, কারণ তিনি মধ্য ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনা করে ইংরেজি ভাষায় লেখালেখিকে জনপ্রিয় করেন। তার লেখা “দ্য ক্যান্টারবেরি টেলস” ইংরেজি সাহিত্যের প্রথম শ্রেণির সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচিত হয়।
জিওফ্রে চসারের সবচেয়ে বিখ্যাত রচনা হলো “দ্য ক্যান্টারবেরি টেলস”, যা মধ্যযুগীয় ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের গল্পের একটি সংগ্রহ।
“দ্য ক্যান্টারবেরি টেলস” একটি গল্পসংকলন, যেখানে বিভিন্ন চরিত্র ক্যান্টারবেরি শহরের পথে যাত্রার সময় গল্প বলার প্রতিযোগিতা করে। এটি মধ্যযুগীয় ইংল্যান্ডের সমাজের একটি চিত্র তুলে ধরে।
চসার আনুমানিক ১৩৪০ সালে লন্ডন, ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
চসার মূলত মধ্য ইংরেজি ভাষায় লিখতেন, যা তার সময়ের প্রচলিত ইংরেজি ভাষার রূপ ছিল।
জিওফ্রে চসার ২৫ অক্টোবর ১৪০০ সালে লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেন।