প্রথম বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলা প্রসঙ্গে পূর্ব ঘটনা, মামলা শুরু, অভিযুক্তদের অপরাধ স্বীকার, প্রধান আসামী, অভিযুক্তদের জেলা সংগঠন, রায়ে উল্লেখ, মামলা সংঘটনের পিছনে বৈপ্লবিক ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে জানবো।
প্রথম বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলা
ঐতিহাসিক ঘটনা | প্রথম বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলা |
সময়কাল | ১২ মে ১৯১৩ খ্রি: |
প্রধান আসামী | রমেশ আচার্য |
বৈপ্লবিক দল | ঢাকার অনুশীলন সমিতি |
ভূমিকা :- বাখরগঞ্জ জেলায় পরপর কতকগুলি রাজনীতিক ডাকাতি অনুষ্ঠিত হওয়ায় অনুসন্ধানের পর পুলিশ এই জেলার অনুশীলন সমিতি সম্পর্কে বহু সংবাদ জেনে ফেলে। তখন থেকেই একটি ষড়যন্ত্র মামলা দাঁড় করাবার আয়োজন চলে।
প্রথম বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলা পূর্ব ঘটনা
- (১) পূর্ব-বৎসর, অর্থাৎ ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসের একটি ঘটনায় মামলার আয়োজন আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে যায়।
- (২) ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে নভেম্বর ঢাকার জনৈক এডিশনাল ম্যাজিস্ট্রেটের পুত্র গিরীন্দ্রমোহন দাস নামে অনুশীলন সমিতির এক সভ্যের কাছ থেকে পুলিশ অনুশীলন সমিতির বহু গোপন কাগজ-পত্র এবং বন্দুক-রিভলভারের বহু কার্তুজ, গান-পাউডার প্রভৃতি উদ্ধার করে।
- (২) এর মধ্যে বাখরগঞ্জে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন ডাকাতিতে লুণ্ঠিত অলংকারও তাদের হস্তগত হয়। কাগজ-পত্রের মধ্যে সমিতির সভ্যদের নাম-ধামও ছিল। এই সকল প্রমাণ নিয়ে পুলিশ ষড়যন্ত্র মামলার আয়োজন করে। এই ব্যাপারে মোট ৪৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
বাংলাদেশে প্রথম বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলা শুরু
১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ১২ই মে সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধোদ্যম”-এর অভিযোগে ৪৪ জন বিপ্লবীকে নিয়ে ‘প্রথম বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলা’ আরম্ভ হয়। এদের মধ্যে ৩৭ জনকে কিছুকাল পূর্বে বিভিন্ন বৈপ্লবিক ক্রিয়াকলাপের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে বাকি সকলকে গ্রেপ্তার করে বঙ্গীয় সরকারের নির্দেশে ‘বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলা’ আরম্ভ করা হয়।
প্রথম বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্তদের অপরাধ স্বীকার
অভিযুক্তদের মধ্যে রজনীকান্ত দাস ও গিরীন্দ্রমোহন দাস স্বীকারোক্তি করে রাজসাক্ষী হয়। এই দুইজন ছাড়া শৈলেশ মুখার্জি এবং আরও ১১ জন অপরাধ স্বীকার করে বিবৃতি দেন। মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে সকলেই ছিলেন বয়সে তরুণ।
বাংলাদেশে প্রথম বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামী
ভারতের পরবর্তীকালের বিখ্যাত সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী নায়ক রমেশ আচার্য মহাশয়ও এই মামলায় অভিযুক্ত হয়েছিলেন এবং তাকেই এই মামলার প্রধান আসামী বলে গণ্য করা হয়েছিল। কিন্তু গ্রেপ্তারের সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর।
প্রথম বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্তদের জেলা সংগঠন
অভিযুক্ত বিপ্লবীদের জেলা-সংগঠন পরিকল্পনায় দেখা যায়, পূর্ববঙ্গের সকল জেলায় এদের সুদৃঢ় সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং “প্রায় সকল জেলা নিয়েই বিপ্লবীদের ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তৃত হয়েছিল।” যারা অপরাধ স্বীকার করেছিলেন তাঁদের মধ্যে কয়েকজন বাখরগঞ্জ জেলার, কয়েকজন ত্রিপুরার এবং কয়েকজন ঢাকার অধিবাসী।
বাংলাদেশে প্রথম বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলার রায়ে উল্লেখ
মামলার রায়ে বলা হয়, “বিচারের সওয়াল, স্বীকারোক্তি ও দলিল-পত্রাদি থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, এই ভদ্রশ্রেণীর তরুণগণ সমগ্র দেশময় এক বিপজ্জনক সংগঠন বিস্তারের উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন। ভারত-এর ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ সাধনই ছিল এই সংগঠনের একমাত্র লক্ষ্য। সংগঠন বিস্তারের উদ্দেশ্যেই তাঁরা কয়েকটি ডাকাতি করেছিলেন । … প্রকৃতপক্ষে এই ষড়যন্ত্র ঢাকার ষড়যন্ত্রেরই একটি অংশ বিশেষ।”
প্রথম বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলা সংঘটনের পিছনে বৈপ্লবিক ক্রিয়াকলাপ
যে সকল বৈপ্লবিক ক্রিয়াকলাপের ফলে ‘প্রথম বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলা’র ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল সেগুলো হল –
- (১) ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই এপ্রিল ‘ঢাকা অনুশীলন সমিতি’র বরিশাল শাখা বাখরগঞ্জ জেলার কুশঙ্গল নামক স্থানে একটি ডাকাতি করে বহু অর্থ লাভ করে। এর দুদিন পর, ১৯শে এপ্রিল কাকুড়িয়ায় এবং একমাস পর বরঙ্গলে এদের দ্বারা দুটি ডাকাতি অনুষ্ঠিত হয়।
- (২) এই সকল ডাকাতিতে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছিল। কুশঙ্গলের ডাকাতির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল একটি সরকারী বন্দুক হস্তগত করা। বিপ্লবীরা সরকারী বন্দুকটি হস্তগত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
- (৩) সেপ্টেম্বর মাসে রজনী দাস নামে সমিতির এক তরুণ সভ্য ডাকাতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে পুলিশের নিকট স্বীকারোক্তি দেয়। তার স্বীকারোক্তির ফলে সমিতির বহু দলিলপত্র পুলিশের হস্তগত হয়।
- (৪) নভেম্বর মাসে কুমিল্লার এক দারোগার পুত্রের নিকট হতে সংবাদ পেয়ে পুলিশ একটি বাড়ি থেকে সমিতির ১২ জন সভ্যকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকালে সকলের পোশাক পরিচ্ছদই জলে ভিজা ছিল। সম্ভবত এরা সাঁতরে নদী পার হয়ে কোথাও ডাকাতি করবার উদ্দেশ্যে এই বাড়িতে সমবেত হয়েছিলেন।
- (৫) পুলিশ এই বিপ্লবীদের দেহ ও গৃহ তল্লাসি করে দুটি রিভলভার, একটি বন্দুক, অনেকগুলি মুখোস এবং সমিতির সভ্যদের নামের একটি তালিকা হস্তগত করে। এইভাবে ধৃত ১২ জন বিপ্লবীকে ডাকাতির চেষ্টার অভিযোগে আদালতে অভিযুক্ত করা হয়। মামলার বিচারে দশজন বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং বাকি দুজন মুক্তিলাভ করেন।
- (৬) নভেম্বর মাসে সমিতির অন্যতম সভ্য গিরীন্দ্রমোহন দাসের গৃহ হতে পুলিশ বহু অস্ত্রশস্ত্র ও দলিলপত্র হস্তগত করে। গিরীন্দ্র তার পিতার আদেশেই এই সকল জিনিস পুলিশের হাতে অর্পণ করেছিল। এই সকল জিনিসের মধ্যে ছিল তিনটি রিভলভার, বহু গুলি, ছোরা, মুখোস প্রভৃতি। এছাড়া তার কাছ থেকে নাঙ্গলবন্দের ডাকাতিতে লুন্ঠিত বহু অলংকারও পুলিশের হস্তগত হয়।
- (৭) গিরীন্দ্র এই সকল জিনিস গৃহে রাখবার অপরাধে ১৮ মাস সশ্রম কারাদণ্ড এবং ডাকাতিতে লুন্ঠিত অলংকারগুলি রাখবার অপরাধে ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড লাভ করে। গিরীন্দ্রের কাছ থেকে পুলিশ সমিতির টাকার হিসাব ও সভ্যদের নামের একটি তালিকা এবং দলিলপত্র হস্তগত করেছিল। এই হিসাবপত্র ও তালিকাটি পুলিশকে ষড়যন্ত্র মামলা আরম্ভ করতে বিশেষ সাহায্য করে।
- (৮) পরে ষড়যন্ত্র মামলা আরম্ভ হলে পিতার নির্দেশে গিরীন্দ্র রাজসাক্ষী হয় এবং সমিতির ক্রিয়াকলাপ ও গোপন সংবাদাদি পুলিশের কাছে প্রকাশ করে দেয়। সরকারী মতে, বরিশালের অনুশীলন সমিতি এই বছরের মধ্যে দুটি হত্যাকাণ্ডের অনুষ্ঠান করে।
- (৯) প্রথমত, সমিতির সভ্য সারদা চক্রবর্তীকে শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধে হত্যা করা হয়। দ্বিতীয়ত, ২৪শে সেপ্টেম্বর রতিলাল রায় নামে একজন হেড-কনেস্টবলকে বিপ্লবীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টার অপরাধে হত্যা করা হয়। পুলিশ হত্যাকারীকে গ্রেপ্তারের জন্য ৫ হাজার টাকার পুরস্কার ঘোষণা করেও হত্যাকারীর সন্ধান পায় নি।
- (১০) সরকারী মতে, ঢাকার পানাম ডাকাতিও ‘অনুশীলন সমিতি’ দ্বারাই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই ডাকাতিতে বিপ্লবীরা নগদ ও অলংকারে ২০ হাজার টাকা লাভ করেছিলেন। বিপ্লবীরা সামরিক পোশাকে সজ্জিত হয়ে সামরিক কায়দায় এই ডাকাতি করেছিলেন। বিপ্লবীরা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে টেলিগ্রাফের তারও কেটে দিয়েছিলেন।
উপসংহার :- মামলার বিচারে প্রথম দফায় ৭ জন, দ্বিতীয় দফায় ২ জন এবং শেষ পর্যন্ত ১২ জন বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। এরা ছাড়া অন্য সকলে মুক্তিলাভ করেন। এই ১২ জনের ২ বছর থেকে ১২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হয়।
(FAQ) প্রথম বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৯১৩ সালে।
রমেশ আচার্য।
ঢাকার অনুশীলন সমিতি।