স্বত্ববিলোপ নীতি

স্বত্ববিলোপ নীতি -র প্রবর্তক, প্রবর্তন কাল, দেশীয় রাজ্যগুলির শ্রেনীবিভাগ, নীতির মূল কথা, প্রকৃত প্রবর্তক, প্রয়োগ, মারাঠা রাজ্য গ্রাস, নাগপুর দখল, পদমর্যাদা ও ভাতা বাতিল, নীতির সমালোচনা প্রসঙ্গে দেশীয় রাজ্যগুলির পার্থক্য অমান্য, হিন্দু সমাজে ক্ষোভের সৃষ্টি সম্পর্কে জানবো।

স্বত্ববিলোপ নীতি প্রসঙ্গে স্বত্ববিলোপ নীতি কি, স্বত্ববিলোপ নীতি কাকে বলে, স্বত্ববিলোপ নীতির প্রবর্তক, স্বত্ববিলোপ নীতি প্রবর্তনের সময়কাল, ভারতীয় রাজ্য আত্মসাৎ করার নীতি, লর্ড ডালহৌসির উল্লেখযোগ্য সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি স্বত্ববিলোপ নীতি, স্বত্ববিলোপ নীতির মূল বক্তব্য, স্বত্ববিলোপ নীতির প্রধান শর্ত, স্বত্ববিলোপ নীতি প্রয়োগ, স্বত্ববিলোপ নীতি টীকা, স্বত্ববিলোপ নীতির সমালোচনা ও গুরুত্ব সম্পর্কে জানব।

স্বত্ববিলোপ নীতি

ঐতিহাসিক ঘটনাস্বত্ববিলোপ নীতি
প্রবর্তকলর্ড ডালহৌসি
প্রবর্তনকাল১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ
প্রথম প্রয়োগসাতারা
স্বত্ববিলোপ নীতি

ভূমিকা :- ভারত-এর ব্রিটিশ বড়ােলাট লর্ড ডালহৌসি যেসব নীতি অবলম্বন করে এদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য-এর ব্যাপক প্রসার ঘটান সেগুলির মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযােগ্য হল স্বত্ববিলােপ নীতি।

দেশীয় রাজ্যগুলির শ্রেনীবিভাগ

লর্ড ডালহৌসি ভারতের দেশীয় হিন্দু রাজ্যগুলিকে প্রধানত তিনভাগে বিভক্ত করেন।যথা—

(১) কোম্পানির দ্বারা সৃষ্ট দেশীয় রাজ্য

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দ্বারা সৃষ্ট কোনাে দেশীয় রাজ্যের রাজার পুত্রসন্তান না থাকলে সেই রাজা কোনাে উত্তরাধিকারী বা দত্তক পুত্র গ্রহণ করতে পারবেন না। ফলে রাজার মৃত্যুর পর সিংহাসনের উত্তরাধিকারীর অভাবে সেই রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হবে।

(২) কোম্পানির আশ্রিত করদ রাজ্য

কোম্পানির আশ্রিত করদ রাজ্যের রাজারা কোম্পানির অনুমতি নিয়ে দত্তক সন্তান গ্রহণ করতে পারবে। তবে কোম্পানি সেই দেশীয় রাজাকে দত্তক গ্রহণের অনুমতি না দিলে রাজার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারীহীন রাজ্যটি কোম্পানির অধিকারে চলে যাবে।

স্বাধীন দেশীয় রাজ্য

স্বাধীন দেশীয় রাজ্যগুলির উত্তরাধিকার সম্পর্কে সরকার কোনাে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে না।

স্বত্ববিলোপ নীতি

লর্ড ডালহৌসি এক নির্দেশনামা ঘোষণা করে প্রথম শ্রেণির দেশীয় রাজ্যগুলিতে দত্তক-প্রথা নিষিদ্ধ করেন, দ্বিতীয় শ্রেণির রাজ্যে কোম্পানির অনুমতি ছাড়া দত্তক গ্রহণ করা নিষিদ্ধ করেন এবং স্বাধীন দেশীয় রাজ্যগুলিতে দত্তক প্রথা বহাল রাখেন। ডালহৌসির এই নির্দেশনামা স্বত্ববিলোপ নীতি নামে খ্যাত।

স্বত্ববিলোপ নীতির মূল কথা

এই নীতির মূলকথা ছিল এই যে, ইংরেজদের আশ্রিত কোনো রাজ্যের উত্তরাধিকারী না থাকলে সেই রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করা হবে এবং দত্তক পুত্রের উত্তরাধিকার স্বীকার করা হবে না।

স্বত্ববিলোপ নীতির প্রকৃত প্রবর্তক

  • (১) ডালহৌসিকে কিন্তু কখনোই এই নীতির উদ্ভাবক বা প্রবর্তক বলা যায় না। তাঁর বহু পূর্বে ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির ডাইরেক্টর সভা দত্তক পুত্র গ্রহণের অধিকার নিয়ন্ত্রণের কথা ঘোষণা করেন।কিন্তু সেই সময় তা কার্যকর হয় নি।
  • (২) ইতিপূর্বে মণ্ডাভি (১৮৩৯ খ্রিঃ), কোলাবা ও জলায়ুন (১৮৪০ খ্রিঃ) এবং সুরাটে (১৮৪২ খ্রিঃ) এই নীতি কার্যকর হয়। ডালহৌসিই প্রথম কঠোরভাবে এই নীতি কার্যকর করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারে সক্ষম হন।

স্বত্ববিলোপ নীতি প্রয়োগ

এই নীতি অনুসারে তিনি সাতারা (১৮৪৮ খ্রিঃ), জয়েৎপুর, সম্বলপুর, বাঘাট ও ভগৎ (১৮৫০ খ্রিঃ), উদয়পুর (১৮৫২ খ্রিঃ), করোলি, ঝাঁসি ও নাগপুর (১৮৫৪ খ্রিঃ) প্রভৃতি রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।

স্বত্ববিলোপ নীতি দ্বারা মারাঠা রাজ্য গ্রাস

  • (১) মারাঠাদের পতনের পর তাদের খুশি করার উদ্দেশ্যে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে লর্ড হেস্টিংস সাতারা রাজ্যটি প্রতিষ্ঠা করে শিবাজির এক বংশধরকে সিংহাসনে বসান।
  • (২) অপুত্রক রাজা কোম্পানির বিনা অনুমতিতে দত্তক গ্রহণ করায় লর্ড ডালহৌসি এই দত্তক গ্রহণ অবৈধ বলে ঘোষণা করেন।
  • (৩) এরপর তিনি ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে রাজ্যটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। এলফিনস্টোন ডালহৌসির এই আচরণকে ‘অমানবিক’ ও ‘বিপজ্জনক’ বলে অভিহিত করেছেন।

স্বত্ববিলোপ নীতি দ্বারা নাগপুর দখল

নাগপুর-অধিপতি ভোঁসলে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। অপুত্রক অবস্থায় ভোঁসলের মৃত্যু হলে তাঁর রাজ্য দখল করা হয়, এমনকী সেনাবাহিনী রাজপরিবারের সম্পত্তি, অর্থ ও অলঙ্কার  লুঠ করে।

স্বত্ববিলোপ নীতি দ্বারা পদমর্যাদা ও ভাতা বাতিল

এই নীতি প্রয়োগ করে তিনি কয়েকজন রাজার পদমর্যাদা ও ভাতা বাতিল করে দেন। এই রাজারা হলেন

  • (১) পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও -এর মৃত্যু হলে (১৮৫৩ থ্রিঃ) তাঁর দত্তক পুত্র নানাসাহেবের বৃত্তি ও পেশোয়া উপাধি তিনি বিলুপ্ত করেন।
  • (২) কর্ণাটক (১৮৫৩ খ্রিঃ) ও তাঞ্জোরের (১৮৫৫ খ্রিঃ) ক্ষেত্রেও তিনি অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

স্বত্ববিলোপ নীতির সমালোচনা

এই নীতি সমালোচনার উর্ধে ছিল না। সমকালীন আমলাতন্ত্র ও পরবর্তীকালের ঐতিহাসিকরা এই নীতির কঠোর সমালোচনা করেছেন। স্যার হেনরি রাসেল, ম্যালকম, এলফিনস্টোন সকলেই ডালহৌসির বিরুদ্ধে তিক্ত মতামত প্রকাশ করেছেন। যেমন –

(১) দেশীয় রাজ্যের পার্থক্য মানা হয় নি

এই নীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে ব্রিটিশের দ্বারা সৃষ্ট রাজ্য ও ব্রিটিশ আশ্রিত করদ বা মিত্র রাজ্যের মধ্যে যে পার্থক্য কর হয়েছিল, বাস্তবে তা মানা হয় নি। উদয়পুর ব্রিটিশ-সৃষ্ট রাজ্য ছিল না। অপরদিকে করৌলি ছিল আশ্রিত রাজ্য, কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই এই নীতি প্রযুক্ত হয়।

(২) সাতারা ও নাগপুর দখলের প্রকৃত কারণ

রাজার পুত্রসন্তান না থাকার জন্য সাতারা ও নাগপুর রাজ্য দুটি ডালহৌসি দখল করেন।কিন্তু এর প্রকৃত কারণ ছিল এই যে- বোম্বাই-মাদ্রাজ ও মাদ্রাজ-কলকাতা যাতায়াতের পথে অবস্থিত ছিল।

(৩) হিন্দু সমাজে ক্ষোভের সৃষ্টি

হিন্দুদের চিরাচরিত ধর্মীয় সংস্কার ও ঐতিহ্য দ্বারা দত্তক গ্রহণ স্বীকৃত ছিল। হিন্দুরা মনে করত যে, পুত্র না থাকলে পিতৃপুরুষদের শ্রাদ্ধাদি ক্রিয়া সম্পন্ন হয় না। বলা বাহুল্য, ভালহৌসির কার্যকলাপ হিন্দু সমাজকে ক্ষুব্ধ করে তোলে।

উপসংহার :- ঐতিহাসিক রাসেল বলেন যে, একটি দেশীয় রাজ্যের অবলুপ্তির অর্থ হল কফিনে একটি পেরেক পোঁতা। ঐতিহাসিক এলফিনস্টোন -এর মতে এক একটি রাজ্য ও প্রজা বৃদ্ধির অর্থ হল ভারতে আমাদের পতন ত্বরান্বিত হওয়া।

(FAQ) স্বত্ববিলোপ নীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. স্বত্ববিলোপ নীতি কে প্রয়োগ করেন?

লর্ড ডালহৌসি।

২. স্বত্ববিলোপ নীতি কখন প্রবর্তিত হয়?

১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে।

৩. প্রথম কোন রাজ্যে স্বত্ববিলোপ নীতি প্রয়োগ করা হয়?

সাতারা।

Leave a Comment