চার্লি চ্যাপলিন

হাসির রাজা চার্লি চ্যাপলিন প্রসঙ্গে তার জন্ম, পিতামাতা, সংসারে অভাব অনটন, গান ও অভিনয়ের চর্চা, গান গাওয়া, মজার কাণ্ড, নির্বাক চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি চরিত্র, হলিউডে প্রবেশ, প্রথম ছবিতে অভিনয়, বিপুল জনপ্রিয়তা, শেষ জীবন, আত্মকথা ও তার মৃত্যু সম্পর্কে জানবো।

হাসির রাজা চার্লি চ্যাপলিন

ঐতিহাসিক চরিত্রচার্লি চ্যাপলিন
জন্ম৬ এপ্রিল, ১৮৮৯ খ্রি:
দেশইংল্যান্ড
পরিচিতিকৌতুক অভিনেতা
বিখ্যাত উপাধিহাসির রাজা
মৃত্যু২৫ ডিসেম্বর, ১৯৭৭ খ্রি:
হাসির রাজা চার্লি চ্যাপলিন

ভূমিকা :- শিল্প-সংস্কৃতির এক বিশেষ ধারা হাস্যকৌতুক, দর্শক এবং শ্রোতাকে নির্মল আনন্দদানই যার লক্ষ্য। বিষয়টি হালকা মনে হলেও কিন্তু সহজ নয়। অনেক হাসির খোরাক হয় বটে, কিন্তু মানুষ হাসিয়ে আনন্দদানের ব্যাপারটি আয়ত্ত করতে পারে এমন লোকের সংখ্যা খুব কম। কিন্তু এই অসাধ্য কাজটি যিনি অনায়াসে সাধন করতে পেরেছিলেন তিনি ছিলেন হাসির রাজা স্যার চার্লি চ্যাপলিন, যাঁর নাম শুনলেই বিশ্বজুড়ে সবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটি হাস্যকৌতুকপূর্ণ মুখের ছবি। যাঁকে দেখামাত্রই শিশু-কিশোর যুবা-বৃদ্ধ সবাই এমনিতেই হাসিতে আপ্লুত হয়ে ওঠে।

চার্লি চ্যাপলিনের জন্ম

এই কৌশলী অভিনেতার জন্ম হয়েছিলো ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল ইংল্যান্ডে।

হাসির রাজা চার্লি চ্যাপলিনের পিতামাতা

  • (১) চার্লি চ্যাপলিনের আসল নাম ছিলো চার্লস স্পেনসার। চ্যাপলিনের পিতার নামও ছিলো চার্লস চ্যাপলিন। মায়ের নাম ছিল লিলি হার্নি। পিতামাতা দু’জনেই ছিলেন অতি সাধারণ পরিবারের সন্তান। ভবঘুরে যাত্রাদলের নর্তক নর্তকী।
  • (২) মা লিলি হার্নি গান গাইতেন আর নাচতেন। আর চার্লস বাদ্য বাজাতেন আর মাঝে মধ্যে অভিনয় করতেন। লিলি হার্নির একবার বিয়ে হয়েছিল জনৈক বড়লোকের সাথে। কিন্তু এ বিয়ে টেকেনি।
  • (৩) যাত্রাদল থেকেই এক বড়লোকের সাথে ভাব করে বিয়ে করেছিলেন লিলি। তিন বছর পর এই বিয়ে ভেঙে গেলে লিলি আবার এসে জুটেছিলেন আগের দলে। তখনো চার্লস সে দলেই কাজ করতেন।
  • (৪) দু’জনের সাথে আগেই পরিচয় ছিলো। এবার সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হলো। তারপর বিয়ে। আর তাঁদের সংসারেই জন্ম হলো বিশ্বখ্যাত কৌতুকাভিনেতা চার্লি চ্যাপলিনের।

চার্লি চ্যাপলিনের ঘরে অভাব অনটন

  • (১) তার পিতামাতা দু’জনে যাত্রাদলে নেচে আর গান গেয়ে সামান্য আয় করতেন তা দিয়ে তাদের সংসার চলতো না ঠিকমতো। সবসময় অভাব-অনটন লেগেই থাকতো।
  • (২) এ ছাড়া চ্যাপলিনের বাবা চার্লসের স্বভাবও খুব ভালো ছিলো না। সামান্য যা আয় করতেন তার বেশিরভাগই খরচ করতেন নেশা করে। অতঃপর লিলি হার্নির দ্বিতীয় বিয়েও টিকলো না।
  • (৩) নেশাখোর স্বামীর ঘর করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হলো না। চার্লির জন্মের কয়েক বছর পরেই তাঁদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলো। মা লিলি ছেলে চ্যাপলিনকে নিয়েই রয়ে গেলেন যাত্রাদলে। বাবা চলে গেলেন অন্যত্র।

হাসির রাজা চার্লি চ্যাপলিনের গান ও অভিনয়ের চর্চা

মায়ের দেখাদেখি ছোটবেলা থেকেই গানের এবং অভিনয়ের চর্চা করতেন চ্যাপলিন। তাঁর গলার সুর ছিলো ভারি চমৎকার। মা যেখানেই যেতেন ছেলে তাঁর সাথে থাকতেন। মা যতক্ষণ স্টেজে গান গাইতেন বা নাচতেন, চ্যাপলিন পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখতেন। সর্বক্ষণ নজর থাকতো মায়ের উপর।

চার্লি চ্যাপলিনের মায়ের অনুষ্ঠানে অঘটন

  • (১) হঠাৎ একদিন তাঁর মায়ের অনুষ্ঠানে ঘটলো এক অঘটন। সেটা ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের কথা। মা স্টেজে গান গাইতে উঠেছেন। তাঁর শরীরটা দুদিন থেকেই খারাপ ছিলো। পয়সার অভাবে অসুস্থ শরীর নিয়েও গান গাইতে এসেছিলেন। ফলে যা হবার তাই হলো।
  • (২) স্টেজে গান গাইতে গাইতেই মায়ের গলার আওয়াজ বের হলো না। ওদিকে দর্শকের গ্যালারি থেকে শুরু হলো হই হুল্লোড়-চিৎকার। মা নিজের অবস্থা এবং স্টেজের হইচই দেখে আরো ঘাবড়ে গেলেন। পরে ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় তিনি পালিয়ে এলেন স্টেজ থেকে।

হাসির রাজা চার্লি চ্যাপলিনের গান গাওয়া

  • (১) পাশে দাঁড়িয়ে সব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছিলেন বালক চ্যাপলিন। যখন মা স্টেজ থেকে বের হয়ে এলেন তখনই চ্যাপলিন এক অবাক কান্ড করে বসলেন। তিনি গিয়ে সোজা দাঁড়ালেন স্টেজে দর্শকের সামনে। তারপর ধরলেন গান Jack Jones well and / Known to everybody.
  • (২) তাঁর চমৎকার গলা শুনে দর্শকরা তো থ বনে গেলো। মুহূর্তে থেমে গেলো গোলমাল। এবার দর্শকরা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো এবং সেই সাথে টাকা আধুলি সমানে এসে ছিটকে পড়তে লাগলো স্টেজে। বৃষ্টির মতো। সবাই তাঁর গানে খুশি।

চার্লি চ্যাপলিনের মজার কাণ্ড

  • (১) তবে এরই মধ্যে আরেক মজার কাণ্ড করে বসলেন চ্যাপলিন। যখন দেখলেন বৃষ্টির মতো তাঁর চারপাশে টাকাপয়সা এসে ছিটকে পড়ছে অমনি গান থামিয়ে দর্শকদের লক্ষ্য করে বলতে লাগলেন আমি এখন আর গান গাইব না। আগে পয়সাগুলো কুড়িয়ে নিই, তারপর আবার গাইবো।
  • (২) চ্যাপলিন এমন বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে কথাগুলো বললেন যে দর্শকরা একটুও রাগ না করে বরং আরো মজা করে হাসতে লাগলো। এবং আরো পয়সা পড়তে লাগলো। চ্যাপলিনও নানা অঙ্গভঙ্গি করে করে স্টেজের পয়সা কুড়াতে লাগলেন। সব পয়সা সংগ্রহ শেষ হলে স্টেজের বাইরে দাঁড়ানো মায়ের হাতে তুলে দিয়ে এসে আবার নতুন করে গান ধরলেন চ্যাপলিন।

চার্লি চ্যাপলিনের প্রতিভায় বিস্মিত মা

শুধু দর্শকবৃন্দ নয়, সেদিন মা নিজেও ছেলের প্রতিভা দেখে বিস্মিত হয়ে ভাবছিলেন, হয়তো-বা ভবিষ্যতে তাঁর ছেলে বিশ্বয়কর কিছু একটা হবে। মায়ের আশা পূর্ণ হয়েছিলো চ্যাপলিনের জীবন প্রতিষ্ঠায়

চার্লি চ্যাপলিনের জীবনের প্রথম ভাগে দুঃখকষ্ট

চার্লি চ্যাপলিন প্রথম জীবনে অনেক দুঃখকষ্ট সহ্য করেছেন। তাঁর কিশোর-জীবন কাটে মুদি দোকানে, ছাপাখানায়, রাস্তায় কাগজ বেঁচে, ওষুধের দোকানে এবং লোকের বাড়িতে কাজ করে।

নির্বাক চলচ্চিত্রের প্রশংসিত চরিত্র চার্লি চ্যাপলিন

চার্লি চ্যাপলিন ছিলেন তাঁর সময়কার সবচেয়ে আলোচিত ও প্রশংসিত চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বের একজন। বিশ্বের কোটি কোটি দর্শক আজো তাঁর অপূর্ব অভিনয়দক্ষতা দেখে মুগ্ধ হন প্রশংসার হন পঞ্চমুখ। চিত্রসমালোচকদের মতে চার্লি চ্যাপলিন তাঁর সময়কার নির্বাক চলচ্চিত্রকে একটি উন্নত শিল্পে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

চার্লি চ্যাপলিনের হলিউডে প্রবেশ

মাত্র ১১ বছর বয়সে তিনি জন্মভূমি ইংল্যান্ড ছেড়ে চলে আসেন আমেরিকায়। এখানে এসে তিনি জড়িয়ে পড়েন চলচ্চিত্র জগতের সাথে। প্রবেশ করেন হলিউডে।

চার্লি চ্যাপলিনের প্রথম ছবিতে অভিনয়

১৯১২ খ্রিস্টাব্দে কিস্টোন স্টুডিওতে চ্যাপলিন একটি কমেডি ছবিতে অভিনয় করার সুযোগ লাভ করেন। তবে এখানে তিনি ছিলেন অন্যান্য সাধারণ অভিনেতাদের মধ্যে একজন। তাঁর ভূমিকা সম্পর্কেও তিনি ছিলেন অনিশ্চিত।

‘লিটল ট্রাম্প’ তৈরিতে চার্লি চ্যাপলিনের অবদান

দ্বিতীয় ছবি ‘কিড আটোরেসেস অ্যাট ভেনিস’ ছবিতে অভিনয় করেই চার্লি তাঁর নিজস্ব ভঙ্গি প্রদর্শন করতে সক্ষম হন। এই ছবিতে অভিনয় করার সময় তিনি প্রযোজকের পোশাক-পরিচ্ছদেও কৌতুক আনার চেষ্টা করেন এবং সেজন্য বিশেষ অদ্ভুত ধরনের ব্যাগের মতো প্যান্ট, বিরাট জুতো পরিধান করেছিলেন। আর সেই সাথে লাগিয়েছিলেন একটি নকল গোঁফ-এভাবেই তৈরি হয় ‘লিটল ট্রাম্প’।

চার্লি চ্যাপলিনের বিপুল জনপ্রিয়তা

চলচ্চিত্র জগতে চ্যাপলিন নিজেই নিজের ভাগ্যকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য সফল করতে সক্ষমও হয়েছিলেন। তাঁর দক্ষতা, বিপুল জনপ্রিয়তা একদিকে সৃজনশীল প্রতিভা এবং অন্যদিকে অর্থের দ্বার-দুটোই খুলে দিয়েছিলো।

চার্লি চ্যাপলিনের জীবনের প্রথম প্রযোজক

ম্যাকসিনট ছিলেন চ্যাপলিনের জীবনের প্রথম প্রযোজক। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দেই যুবক চ্যাপলিনকে দিয়েছিলেন ছবি পরিচালনার গুরু দায়িত্ব আর পারিশ্রমিক দিয়েছিলেন সপ্তাহে ১৫০ ডলার করে। এক বছর সময়ের মধ্যে তিনি ৩৫টি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি নির্মাণ করেন।

চার্লি চ্যাপলিনের আর্থিক উন্নতি

এর পরের বছর এখানে ছবি তৈরি করার জন্য তাঁকে সপ্তাহে ১২০০ ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তারও বছর দেড়েক পর, মিউচ্যুয়াল ফিল্ম করপোরেশন’ তাঁকে সপ্তাহে ১২,৮৪৪ ডলার করে দেয় এবং বোনাস হিসেবে দেয় দেড় লাখ ডলার। এরপর আরো উন্নতি হয় তাঁর । ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রদর্শক সার্কিটের সাথে ১০,০০,০০০ ডলারের এক চুক্তি করেন।

নীতিগর্হিত কাজের জন্য অভিযুক্ত চার্লি চ্যাপলিন

  • (১) ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি নীতিগর্হিত কাজের জন্য অভিযুক্ত হয়েছিলেন। অবশ্য এ অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন। এরপর তিনি সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়েও একটি মামলায় জড়িয়ে পড়েছিলেন।
  • (২) এ ছাড়া যুদ্ধোত্তর আমেরিকায় কম্যুনিস্টবিরোধী পরিবেশে কম্যুনিস্টদের প্রতি তাঁর কথিত সহানুভূতি ও তাদের সাথে গোপন যোগাযোগ সম্পর্কে একটি কংগ্রেসীয় কমিটি তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত করে।

চার্লি চ্যাপলিনের সুইজারল্যান্ডে গমন

১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপ ভ্রমণকালে তাঁর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের পারমিট বাতিল করা হয়। অবশ্য তিনি কখনো যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেননি। তাঁর এই মর্মবেদনা নিয়ে তিনি সুইজারল্যান্ডে চলে যান।

চার্লি চ্যাপলিনের শেষ জীবন

সুইজারল্যান্ডেই তাঁর অবশিষ্ট জীবন কাটে সর্বশেষ স্ত্রী উনা ও নীলের সাথে। উনা ছিলেন নোবেল বিজয়ী নাট্যকার ইউজীন ও নীলের মেয়ে।

চার্লি চ্যাপলিনের আত্মকথা

১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে চার্লি চ্যাপলিনের আত্মকথা ‘My Autobiography’ প্রকাশিত হয়। সে সময় তাঁর এই বই সর্বকালের বেস্টসেলার হিসেবে বিক্রি হয়। তবে চ্যাপলিনের বইতে তাঁর কাজ করার ভঙ্গি বা কায়দা সম্পর্কে কোনো বর্ণনা ছিলো না।

চার্লি চ্যাপলিনের মৃত্যু

অবশেষে সুইজারল্যান্ডেই বিশ্বের কোটি কোটি দর্শকের প্রিয় অভিনেতা হাসির সম্রাট চার্লি চ্যাপলিন প্রায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ডিসেম্বর পরলোকগমন করেন।

শিল্পীর ক্যানভাস চার্লি চ্যাপলিন

চার্লি চ্যাপলিন আমাদের মধ্যে না থাকলেও বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মনে এক বিশাল শিল্পীর ক্যানভাস হিসেবেই বেঁচে আছেন।

উপসংহার :- চলচ্চিত্রে কৌতুকাভিনয় বলে একটি বিশেষ ধারা গড়ে উঠেছে। কৌতুক, হাসি, তামাশা, ঠাট্টা, ইয়ার্কি ইত্যাদির একটি বিশেষ ধরনই আধুনিক কৌতুক। আর এই বিশেষ ধারাটি যাঁর দক্ষ হাতের স্পর্শে পূর্ণাঙ্গ বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে তিনি হলেন কৌতুকাভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন।

(FAQ) হাসির রাজা চার্লি চ্যাপলিন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. চার্লি চ্যাপলিন কে ছিলেন?

হলিউডের কৌতুকাভিনেতা।

২. হাসির রাজা কাকে বলা হয়?

চার্লি চ্যাপলিন -কে।

৩. চার্লি চ্যাপলিনের আত্মকথার নাম কি?

‘My Autobiography’

৪. চার্লি চ্যাপলিনের আসল নাম কি ছিল?

চার্লস স্পেনসার।

Leave a Comment