বলবনের রাজতান্ত্রিক আদর্শ

গিয়াসউদ্দিন বলবনের রাজতান্ত্রিক আদর্শ প্রসঙ্গে অভিজাত কর্মচারীদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, সুলতানের ঐশ্বরিক অধিকার দাবী, দরবারে নতুন আদব-কায়দার প্রচলন, উচ্চ বংশের দাবি, পারসিক প্রথা, মদ্য পান নিষিদ্ধ, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা, দমন নীতি, কর্মচারীদের আনুগত্য, দিল্লির আড়ম্বর ও গুপ্তচর ব্যবস্থা সম্পর্কে জানবো।

গিয়াসউদ্দিন বলবনের রাজতান্ত্রিক আদর্শ

বিষয়বলবনের রাজতান্ত্রিক আদর্শ
সুলতানগিয়াসউদ্দিন বলবন
নীতিরক্ত ও লৌহ নীতি
পারসিক প্রথাসিজদা ও পাইবস
উপাধিজিলিল্লাহ
গিয়াসউদ্দিন বলবনের রাজতান্ত্রিক আদর্শ

ভূমিকা :- বলবন ছিলেন স্বৈরতন্ত্রে বিশ্বাসী। তিনি উপলব্ধি করেন যে, সুলতানি সিংহাসনকে স্থায়ী করতে হলে, তুর্কী আমীরদের সঙ্গে সিংহাসনের সাংবিধানিক সম্পর্ককে স্থির করতে হবে।

বলবনের সময় অভিজাত কর্মচারীদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা

  • (১) তুর্কী আমীররা ইলতুৎমিস-এর আমল থেকে মনে করতেন যে, তাঁরা মর্যাদায় সুলতানের সমকক্ষ। এমন কি তারা সুলতানি সিংহাসনে বংশানুক্রমিক অধিকার প্রথাকে অস্বীকার করে, উত্তরাধিকারীকে নিজেরাই নির্বাচন করার প্রথা বহাল করেন।
  • (২) এই কারণে রাজিয়ার উত্তরাধিকারকে অগ্রাহ্য করে আমীরগণ নিজেদের পছন্দমত লোককে সিংহাসনে বসান। বলবন নিজে বন্দেগী-ই-চাহালগানীর সদস্য ছিলেন এবং রাজিয়ার পতনে তারও ভূমিকা ছিল। সুলতান নাসিরুদ্দিন মামুদ শাহর শাসনকালে দাস কর্মচারীদের মধ্যে তিনিই ছিলেন প্রধান।
  • (৩) সুতরাং অভিজাত কর্মচারীদের উচ্চাকাক্ষা ও ক্ষমতার মোহ সিংহাসনের কিরূপ ক্ষতি করতে পারে তা তিনি ভালভাবে জানতেন। বলবন এজন্য অভিজাতদের সিংহাসনের অধীনে স্থাপন করতে প্রয়াস করেন।

বলবন কর্তৃক সুলতানের ঐশ্বরিক অধিকার দাবী

  • (১) বলবন দাবী করতেন যে, সুলতান হলেন ঈশ্বরের আশীর্বাদপূত নির্দিষ্ট ব্যক্তি। সুলতানের এই ঐশ্বরিক অধিকার দাবীর দ্বারা তিনি অন্যান্য তুর্কী কর্মচারীরা সুলতান অপেক্ষা হীন একথা বুঝাবার চেষ্টা করেন।
  • (২) তিনি প্রাচীন পারসিক সাসানীয় রাজবংশের ঐশ্বরিক অধিকারতত্ত্বকে অনুকরণ করেন। বলবন নিজেকে নায়েবৎ-ই-খুদাই অর্থাৎ খোদার নায়েব বা প্রতিনিধি বলে ঘোষণা করেন। তিনি ‘জিলিল্লাহ’ উপাধি নেন। বলবন বুঝিয়ে দেন যে, তাঁর কাজকর্মের সমালোচনা মর্তের কোনো মানুষ করতে পারে না। কারণ তিনি ঈশ্বরের আদিষ্ট পুরুষ।
  • (৩) বলবন তার ঐশ্বরিক অধিকারের কথা সদাসর্বদা প্রচার করতেন। তার উদ্দেশ্য ছিল এই প্রচার দ্বারা সামসী অভিজাতদের বুঝিয়ে দেওয়া যে তারা তাঁর সমকক্ষ হতে পারে না। তার স্বর্গীয় ক্ষমতার দাবী জোরালো করার জন্য তিনি খালিফার ফর্মান যোগাড় করেন।
  • (৪) মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ায় চেঙ্গিজের আক্রমণের ফলে অধিকাংশ প্রাচীন মুসলিম রাজবংশের পতন হয়। বাগদাদের খালিফারও পতন হয়। দিল্লীই ছিল একমাত্র মুসলিম রাজধানী যা মোঙ্গল আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়।
  • (৫) স্বভাবতই বলবন এজন্য নিজেকে খালিফার প্রধান সেবক হিসেবে দাবী করেন। খালিফার ফর্মান তার সম্মান ও পদমর্যাদা এতই বাড়ায় যে অন্য অভিজাতরা আর তার সঙ্গে সমকক্ষতা দাবী করতে সাহস করত না।

বলবনের দরবারে নতুন আদব-কায়দার প্রচলন

  • (১) সিংহাসনের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য তিনি দরবারে নানাপ্রকার প্রথা ও আড়ম্বর চালু করেন। তিনি সাধারণ লোকের সঙ্গে বা সাধারণ কর্মচারীর সঙ্গে বাক্যালাপ বন্ধ করেন। দরবারে সুলতানকে কোনোও আবেদন জানাতে হলে উজিরের মারফৎ তাকে জানাতে হত।
  • (২) কোনো ব্যক্তি সরাসরি তার সঙ্গে কথা বলতে পারত না। তিনি প্রচুর আড়ম্বর সহ বহু দেহরক্ষী ও পরিচারকসহ দরবারে আসতেন। নকীব বা ঘোষণাকারী তার উচ্চ বংশ পরিচয় ও উপাধিগুলি সেই সময় চীৎকার করে ঘোষণা করত।
  • (৩) বলবন তাঁর দরবারে চপল কথাবার্তা, হাসি-ঠাট্টা করা নিষিদ্ধ করেন। অত্যন্ত গম্ভীর মুখে তিনি দরবারে বসতেন এবং সকল কর্মচারীকেও গাম্ভীর্য রাখতে হত। দরবারে কোনোরূপ ব্যক্তিগত ভাবাবেগ প্রকাশ করা তিনি অপছন্দ করতেন।
  • (৪) বলা হয় যে একদা মোঙ্গল যুদ্ধে বলবনের প্রিয়পুত্র যুবরাজ মহম্মদের নিহত হওয়ার খবর দরবারে এলে, বলবন দরবারে কাঁদতে পারেন নি। তিনি দরবার ভেঙে দিয়ে নিজ কক্ষে ক্রন্দন করেন।

বলবনের উচ্চবংশের দাবি

সুলতান বলবন নিজেকে উচ্চ বংশজাত বলে দাবী করতেন। প্রাচীন পারসিক বীর খাকন আফ্রাশিয়ারের বংশধর বলে তিনি নিজেকে দাবী করতেন। তিনি সরকারী পদে এমন কি নিম্ন পদগুলিতেও উচ্চবংশের লোক বিশেষত তুর্কী নিয়োগের জন্য কড়াকড়ি করতেন। তিনি অবশ্য উচ্চবংশ বলতে তুর্কী বুঝতেন। হিন্দুস্থানী মুসলমান বা হিন্দুদের তিনি ঘৃণা করতেন।

বলবনের পারসিক প্রথা

বলবন তাঁর দরবারে নানা পারসিক প্রথা চালু করেন। তিনি দরবারে ‘পাওবস’, ‘জমিনবস প্রভৃতি পারসিক অভিবাদন প্রথা চালু করেন এবং তুর্কী কর্মচারীদের তা পালন করতে বাধ্য করেন।

বলবনের পুত্রদের নামকরণ

সিংহাসনে বসার আগে তার যে সকল পুত্র জন্মে তাদের নাম তুর্কী প্রথা অনুযায়ী মহম্মদ বা মামুদ রাখেন। সিংহাসনে বসার পর তাঁর পৌত্রদের নাম তিনি পারসিক কায়দায় কাইকোবাদ, কাইখসরু, কাইকোস প্রভৃতি রাখেন।

বলবন কর্তৃক মদ্য পান নিষিদ্ধ

তিনি সুরাপান ত্যাগ করেন। দরবারে কোনো অভিজাত সুরাসক্ত হয়ে ঢুকতে পারত না। বলবন তাঁর মর্যাদা রক্ষার জন্য সর্বদা রাজকীয় পরিচ্ছদ পরতেন। এমন কি গৃহে বিশ্রামের সময়ও তিনি রাজকীয় পোষাক পরে থাকতেন। প্রাচ্যদেশীয় সকল প্রকার আড়ম্বর দ্বারা তিনি তার স্বৈরতন্ত্রকে মর্যাদাময় করে তোলেন।

বলবনের ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা

  • (১) বলবন তাঁর রাজতন্ত্রকে ন্যায় বিচারের ওপর স্থাপন করার চেষ্টা করেন বলে জিয়াউদ্দিন বরণী মন্তব্য করেছেন। যদিও তিনি ছিলেন ঘোর স্বৈরাচারী কিন্তু সাধারণ লোকের ওপর তিনি ন্যায্য ব্যবহার করার চেষ্টা করতেন।
  • (২) তাঁর গুপ্তচররা তাঁকে সর্বদা জানাত কোনো তুর্কী কর্মচারী সাধারণ লোকের ওপর অত্যাচার করছে কিনা। এমনকি অত্যন্ত মর্যাদাশীল দাস কর্মচারী – যথা হৈবৎ খান প্রমুখকে অধীনস্থ দাসদের নির্যাতন করায় তিনি জরিমানা ও বেত্রাঘাতের দ্বারা শাস্তি দেন।

সুলতান বলবনের দমন নীতি

  • (১) বলবন শুধুমাত্র সিংহাসনের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে ক্ষান্ত থাকেন নি। তিনি উচ্চাকাঙ্ক্ষী তুর্কী আমীরদের কঠোর হাতে দমন করেন। যাতে তাঁর ও তাঁর বংশধরদের বিরুদ্ধে ইলতুৎমিসের কোনো বংশধরের দাবী না তোলা যায় এজন্য তিনি ইলতুৎমিসের বংশের সকলকে নিহত করেন।
  • (২) বন্দেগী-ই-চাহালগানী বা ৪০ জন প্রধান ক্রীতদাসের সমিতির সদস্যদের অনেককেই তিনি বিষ প্রয়োগে বা গুপ্তঘাতক দ্বারা হত্যা করান। যে কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও ক্ষমতালোভী তুর্কী কর্মচারী বলবনের দ্বারা নির্যাতিত অথবা নিহত হতেন।
  • (৩) বলবন বিষ প্রয়োগে তাঁর নিজ আত্মীয় এবং অত্যন্ত যোগ্যতাসম্পন্ন নেতা শের খানের মৃত্যু ঘটান। মোট কথা যাদের দ্বারা সিংহাসনের বিপদ হতে পারত তাদের তিনি প্রায় ধ্বংস করার জন্য রক্ত ও লৌহ নীতি অনুসরণ করেন। এক্ষেত্রে তিনি ন্যায় বিচারের কথা ভাবতেন না।

বলবনের প্রতি কর্মচারীদের আনুগত্য

তিনি দক্ষ ও ক্ষমতাশালী দাস সেনাপতিদের গ্রামে বদলী করায় তারা রাজধানীতে তাদের প্রভাব হারিয়ে ফেলে। তিনি নিম্নপদস্থ যুবক তুর্কী কর্মচারীদের পদোন্নতি ঘটিয়ে প্রবীণ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী কর্মচারীদের একাধিপত্য বিনষ্ট করেন। এর ফলে নবীন কর্মচারীরা বলবনের প্রতি অনুগত থাকত।

বলবনের সময় দিল্লী দরবারের আড়ম্বর

সুলতান বলবন রাজধানী দিল্লীকে জাক-জমকের সঙ্গে সাজিয়ে তাঁর রাজপদের মহিমা প্রচার করেন। দরবারে গালিচা, কার্পেট, সোনা ও রূপোর আসবাব স্থাপন করা হয়। রাত্রে দিল্লীর দরবারের প্রাসাদের চূড়ায় মশাল জ্বালার ব্যবস্থা করা হয়। তাঁর দরবার ও দিল্লীর আড়ম্বর দেখে লোকে ‘বিসমিল্লাহ’, ‘বিসমিল্লাহ’ ধ্বনি করতে থাকে।

বলবনের গুপ্তচর ব্যবস্থা

সুলতান বলবন সাম্রাজ্য-এর সর্বত্র গুপ্তচর বা বারিদ নিয়োগ করেন। তারা বিশেষভাবে অভিজাতদের কাজকর্মের ওপর নজর রাখত। গুরুত্বপূর্ণ খবর সুলতানের কাছে পৌঁছে দিত। স্ট্যানলি লেনপুলের (Stanley Lanepool) মতে, “সাম্রাজ্যে এমন কিছু ছিল না যা বলবনের গুপ্তচরদের চোখ এড়িয়ে যেত” (There was little that Balban’s spies did not discover)।

বলবনের রাজতান্ত্রিক নীতির ত্রুটি

  • (১) বলবনের রাজতান্ত্রিক আদর্শ নিঃসন্দেহে তুর্কী আমীরদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা দমনের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু তিনি তার স্বৈরতন্ত্রকে কোনো তাত্ত্বিক ও প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্র দিতে পারেন নি। কতকগুলি কৃত্রিম আড়ম্বর ও রক্তাক্ত দমন নীতির দ্বারা তিনি তাঁর স্বৈরতন্ত্রকে কায়েম করেন। এজন্য তার ব্যবস্থা স্থায়ী হয়নি।
  • (২) তুর্কী আমীরদের নির্বিচার হত্যার ফলে, তুর্কীদের মধ্যে যোগ্য নেতার পদে শূন্যতা সৃষ্টি হয়। তাঁর মৃত্যুর পর যোগ্য নেতার অভাবে ইলবারী তুর্কী আধিপত্য ধ্বংস হয়। বলবন হিন্দুস্থানী মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে এক সঙ্কীর্ণ মনোভাবের পরিচয় দেন। তুর্কী প্রাধান্য রক্ষার জন্যে তিনি এই কাজ করলেও তার ফল ভাল হয়নি।
  • (৩) বলবনের মৃত্যুর পর খলজিদের নেতৃত্বে হিন্দুস্থানী মুসলমানরা ইলবারী তুর্কী শাসন ধ্বংস করে। এমনকি হিন্দু ও হিন্দুস্থানী মুসলিমদের তিনি তাঁর সেনাদলে স্থান না দেওয়ায় তাঁর সেনাদল দুর্বল হয়ে পড়ে।

উপসংহার :- ইনশা-ই-মহরুর মতে মোঙ্গল আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য এই কারণে বলবনকে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হয়। বলবনের দূরদৃষ্টির অভাবেই এরূপ ঘটেছিল।

(FAQ) গিয়াসউদ্দিন বলবনের রাজতান্ত্রিক আদর্শ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কোন সুলতান দরবারে পারসিক প্রথা চালু করেন?

গিয়াসউদ্দিন বলবন।

২. কোন সুলতান উন্নত গুপ্তচর ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন?

গিয়াসউদ্দিন বলবন।

৩. দিল্লীর কোন সুলতান নিজেকে খোদার নায়েব বা প্রতিনিধি বলে ঘোষণা করেন?

গিয়াসউদ্দিন বলবন।

৪. মেওয়াটী দস্যু দমন করেন কোন সুলতান?

গিয়াসউদ্দিন বলবন।

Leave a Comment