আলাউদ্দিন খলজির রাজস্ব ব্যবস্থা প্রসঙ্গে আলাউদ্দিন খলজির প্রধান উদ্দেশ্য, বরনী কর্তৃক আলাউদ্দিনের রাজস্বের বর্ণনা, খুৎ ও মুকদ্দমের প্রতি আলাউদ্দিনের আঘাত, আলাউদ্দিনের তিনটি পরিবর্তন, বরনীর মতে নতুন রাজস্ব ব্যবস্থার উদ্দেশ্য, কৃষকদের সাথে সরকারের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ স্থাপন ও আলাউদ্দিন কর্তৃক কৃষকদের উপর করের বোঝা চাপানো সম্পর্কে জানবো।
আলাউদ্দিন খলজির রাজস্ব ব্যবস্থা
ঐতিহাসিক ঘটনা | আলাউদ্দিন খলজির রাজস্ব ব্যবস্থা |
বিস্তৃত বিবরণ | জিয়াউদ্দিন বরনি |
গ্ৰাম প্রধান | খুৎ ও মুকদ্দম |
নিম্ন শ্রেণির কৃষক | বলাহার |
ভূমিকা :- ইলতুৎমিস ও গিয়াসউদ্দিন বলবন রাজস্ব ব্যবস্থা সংগঠনের জন্য বহু নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু দিল্লীর সুলতানদের মধ্যে আলাউদ্দিন খলজিই সর্বপ্রথম কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে এই সমস্যাটি সম্যকভাবে বিবেচনা করেন।
আলাউদ্দিন খলজির প্রধান উদ্দেশ্য
তিনি তিনটি প্রধান উদ্দেশ্য সাধনের জন্ম নির্দেশ জারি করেন। যথা –
- (১) উচ্চাকাঙ্ক্ষী মুসলমান অভিজাতবর্গকে দুর্বল করতে হবে।
- (২) হিন্দু ভূম্যধিকারীগণের সম্পদ ও প্রভাব হ্রাস করতে হবে।
- (৩) রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি করে রাষ্ট্রের আয় বৃদ্ধি করতে হবে।
বরনী কর্তৃক আলাউদ্দিনের রাজস্বের বর্ণনা
- (১) ঐতিহাসিক বরনী আলাউদ্দিনের রাজস্ব ব্যবস্থার বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন। তিনি দুই শ্রেণীর গ্রাম-প্রধানের উল্লেখ করেছেন – খুৎ (khut) এবং মুকদ্দম (Muqaddam)। গ্রাম-প্রধান অর্থে ‘চৌধুরী’ শব্দটিও ব্যবহৃত হত।
- (২) গ্রাম প্রধানরা উত্তরাধিকার সূত্রে নিযুক্ত হত। তারা ভূমি-রাজস্ব সংগ্রহ করত এবং নিষ্কর ভূমি ও চারণভূমির অধিকার প্রভৃতি কয়েকটি সুবিধা পেত। তাদের উপরে ছিলেন উচ্চ শ্রেণীর হিন্দু নায়কগণ। বরনী এদের ‘রায়’, ‘রাশা’ অথবা ‘রাওয়াত’ বলে উল্লেখ করেছেন।
খুৎ ও মুকদ্দমের প্রতি আলাউদ্দিনের আঘাত
আলাউদ্দিন ‘খুৎ’ ও ‘মুকদ্দম’গণকে আঘাত করতে মনস্থ করলেন, কারণ তার মতে তারা ছিল বিলাসপ্রিয়, তারা রাষ্ট্রের প্রাপ্য দিত না এবং সুলতানের কর্তৃত্ব অমান্য করত।
সুলতান আলাউদ্দিনের তিনটি পরিবর্তন
তিনি তিনটি পরিবর্তন করেন। যথা –
- (১) রাষ্ট্রের প্রাপ্য ধার্য হল উৎপন্ন শস্যের অর্ধাংশ। অনাবৃষ্টি বা অন্য কোনো কারণে তার কোনো অংশ মকুব করা হবে না। এতে পূর্ববর্তী সুলতানদের সময়ের তুলনায় রাজস্ব উল্লেখযোগ্য রূপে বৃদ্ধি পেল। এর সাথে পশুচারণ কর ও গৃহকর (house tax) যুক্ত হওয়ায় কৃষকদের উপর বোঝা আরও ভারী হল। নতুন ব্যবস্থায় ‘খুৎ’, ‘মুকদ্দম’, ‘বালাহার’ (সর্বাপেক্ষা নিম্ন শ্রেণীর কৃষক) প্রমুখ, যারা জমি চাষ করত তারা সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হল।
- (২) রাজস্ব নির্ধারণে জমির মাপ এবং উৎপন্ন শস্যের পরিমাণ যাচাই করা হত। এতে কুষকদের ক্ষতি হলেও রাষ্ট্রের সুবিধা হল। ভূমি পরিমাণে নিযুক্ত রাজস্ব দপ্তরের কর্মচারীগণ কৃষক ও চাষবাসের অবস্থার উপর নজর রাখতে পারত।
- (৩) ‘খুৎ’ ও ‘মুকদ্দম’গণের সর্বপ্রকারের সুযোগ-সুবিধা লোপ করা হল, এবং তারা যে সকল জমি চাষ করত তার জন্য নিয়মিত হারে (উৎপন্ন শস্যের অর্ধাংশ) রাজস্ব আদায় করা হতে লাগল। ‘খুৎ’ ও ‘মুকদ্দমগণ’ আকস্মিকভাবে দারিদ্র্য ও সামাজিক অবনতির সম্মুখীন হল।
খুৎ, মুকদ্দম সম্পর্কে বরনীর মন্তব্য
বরনী বলেন, “তাদের বশ্যতা এরূপ চরমে উঠল যে শহরের রাজস্ব দপ্তরের একজন ‘চাপরাশী’ (foorman) কুড়ি জন খুৎ, মুকদ্দম ও চৌধুরীর গলদেশ একত্রে বেঁধে রাজস্ব আদায়ের জন্য তাদের পদাঘাত ও বেত্রাঘাত করত। হিন্দুর পক্ষে মাথা তোলা অসম্ভব হল। হিন্দুদের বাড়িতে স্বর্ণ, রৌপ্য, ‘টঙ্কা’, ‘জিতল’ (তাম্রমুদ্রা) অথবা প্রয়োজনাতিরিক্ত দ্রব্যাদি অপ্রাপ্য হল এবং অর্থাভাবের জন্য ‘খুৎ’ ও ‘মুকদ্দম’গণের পত্নীরা মুসলমানদের বাড়িতে দাসীবৃত্তি করতে লাগল।”
বরনীর মতে নতুন রাজস্ব ব্যবস্থার উদ্দেশ্য
জিয়াউদ্দিন বরনী বলেন, নতুন রাজস্ব-ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ছিল এই যে ‘হিন্দুগণ পদদলিত হবে, এবং অসন্তোষ ও বিদ্রোহের কারণ যে সম্পত্তি ও দ্রব্যাদি, তা তাদের হাতে থাকবে না। আলাউদ্দিনের উদ্দেশ্য ছিল প্রধানত রাজনৈতিক, কিন্তু ধর্মীয় সমর্থন তার শক্তিবৃদ্ধি করেছিল।
কৃষকদের সাথে সরকারের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ স্থাপন
‘খুৎ’ ও ‘মুকদ্দম’গণের সুযোগ-সুবিধা লোপ পাওয়ায় তারা কৃষকদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের কর্তব্য থেকে অব্যাহতি পেল। এই কাজের জন্য সরকারী কর্মচারী নিযুক্ত হল। তাদের মাধ্যমে কৃষকদের সাথে সরকারের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ স্থাপিত হল।
রাজস্ব আদয়কারী খুৎ, মুকদ্দমগনের জমি
‘খুৎ’ ও ‘মুকদ্দম’দের অধীনে যে জমি ছিল তা প্রকৃতপক্ষে ‘খালিসা’র অন্তর্ভুক্ত হল। কিন্তু এই ব্যবস্থা কেবলমাত্র রাজধানীর নিকটবর্তী অঞ্চলেই চালু হয়েছিল, বাংলা, বিহার ও গুজরাট প্রভৃতি দূরের প্রদেশগুলি এর বাইরে ছিল।
সহকারী উজিরের উক্তি
আলাউদ্দিনের সহকারী উজিরের এক উক্তি বরণী লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি বলেছেন যে সব প্রদেশগুলি ‘একখানি গ্রামের ন্যায় একই রাজস্ব-ব্যবস্থার অধীন’ হল – এই কথা সত্য নয়।
সুলতান আলাউদ্দিন কর্তৃক কৃষকদের উপর বোঝা চাপানো
কৃষকদের উপর আলাউদ্দিন গুরুতর বোঝা চাপিয়েছিলেন। রাজস্ব আদায়কারী দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীদের অত্যাচারের ফলে তাদের দুর্দশা আরও বৃদ্ধি পায়। এই সকল রাজকর্মচারী জনগণের ঘৃণার পাত্র হয়ে উঠল। বরণী বলেন যে তাদের সাথে কেউই কন্যার বিবাহ দিতে চাইত না।
উপসংহার :- সমসাময়িক কবি আমীর খসরু কৃষকদের প্রকৃত অবস্থার এরূপ বর্ণনা দিয়াছেন যে, “রাজকুটের প্রতিটি মুক্তা দরিদ্র কৃষকদের অশ্রুপূর্ণ চক্ষু থেকে ক্ষরিত জমাট রক্তবিন্দু মাত্র”।
(FAQ) আলাউদ্দিন খলজির রাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
জিয়াউদ্দিন বরনি।
দুই শ্রেণী।
খুৎ ও মুকদ্দম।