ভিক্টর হুগোর প্রেমপত্র

ফরাসি কবি ভিক্টর হুগোর প্রেমপত্র প্রসঙ্গে ভিক্টর হুগোর পরিচিতি, ভিক্টর হুগোর দেশ, ভিক্টর হুগোর প্রেম, ভিক্টর হুগোর প্রেমিকা, ভিক্টর হুগোর প্রেমপত্র রচনার সময়কাল ও ভিক্টর হুগোর মূল প্রেমপত্র সম্পর্কে জানব।

রোমান্টিক কবি ভিক্টর হুগোর প্রেমপত্র

ঐতিহাসিক প্রেমপত্রভিক্টর হুগোর প্রেমপত্র
পরিচিতিফরাসি কবি
দেশফ্রান্স
প্রেমিকাএডেল ফুচার
বিখ্যাত গ্রন্থ‘লা-মিজারেবল’, ‘নাটর ডাম’
ভিক্টর হুগোর প্রেমপত্র

ফ্রান্সের রোমান্টিক যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি নাট্যকার ও উপন্যাসিক ভিক্টোর হুগোর নামের সঙ্গে শিক্ষিত মাত্রই পরিচিত। তাঁর প্রতিভা বহুমুখী। তাঁর ‘লা-মিজারেবল’, ‘নাটর ডাম’ গ্রভৃতি গ্রন্থ বিশ্ব-সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। কিন্তু এই অসাধারণ মনীষীর প্রাণে যে প্রেম ছিল তার সন্ধান আমরা পাই ‘এডেল ফুচারকে” (Edele Foucher) লেখা প্রেমপত্র থেকে।

ভিক্টব হুগোর বয়স যখন সতের, তখন তিনি তাঁর শৈশব-সঙ্গিণী ষোডশী এডেলের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। দেহে তাঁদের যৌবন – মন রঙীন নেশায় মত্ত – নতুন প্রেমের আস্বাদে একে অন্যের জন্য পাগল। এই প্রেমের কথা প্রসঙ্গে কবি এক স্থানে বলেছেন, “বেশী দিনের কথা নয় – এক বছর আগেও আমরা এক সঙ্গে খেলা করেছি, ছুটে বেডিয়েছি, ঝগড়া করেছি। একদিন একটা ভাল আপেল পেয়ে তাকে দিইনি বলে কি ঝগড়া! সে কথা মনে করলে আজ হাসি পায়। পাখীর বাসা নিয়ে সে কি কাড়াকাড়ি। তার মাথায় একটা টোকা মেরেছিলাম – সে কেঁদে উঠেছিল, আমি বলেছিলাম ‘বেশ হয়েছে’ – সে নিয়ে কত রাগারাগি, তারপর দুজনেই ছুটেছিলাম মায়ের কাছে নালিশ করতে। মায়েরা মুখে বললেন আমাদের এরকম ঝগড়া করা উচিত নয়। কিন্তু আমাদের কৈশোর-প্রেমের সে অভিব্যক্তিতে তারা অন্তরে সুখীই হয়েছিলেন। আজ তাকে বাহুবেষ্টনে রেখে সে সব কথা মনে পড়েছে – বুকখানা আনন্দে ফুলে ফুলে উঠছে। আজও কিন্তু সেই দুষ্টামি তার যায় নি – পথে যেতে যেতে আজও মাঝে মাঝে সে ইচ্ছা করেই হাত থেকে রুমাল ফেলে দেয় – আমাকে কুড়িয়ে আনতে হয়। হাতে হাতে ঠেকে – আবার যেন নতুন শিহরণ অনুভব করি। বনের পাখী, আকাশের নক্ষত্র, পশ্চিম আকাশের কালো গাছের আড়ালে সূর্যাস্ত – এই সব দেখে এখনও সে বালিকার মত আহ্লাদে নেচে ওঠে – তার বাল্যসখীদের কথা অনর্গল বলে যায় – এখনও বালসুলভ চাপল্যে আমাকে মাতিয়ে তোলে – মাঝে মাঝে অনুরাগের আবেগে দুধের মত তার সাদা দুটি গাল আপেলের রাঙিমায় রঙীন হয়ে ওঠে। সেদিনের ছোট মেয়ে আজ ভরা যৌবন নিয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে – আজ সে বালিকা নয় – ষোডশী যুবতী।”

১৮২২ খ্রিস্টাব্দে তাঁদের বিবাহ হয়। তাঁদের এই ভালবাসা আভিভাবকদের কাছে গোপন ছিল না – তাই তারা অবাধে খোলাখুলি ভাবে মিলতে পেরেছিলেন। বিবাহের কিছু দিন আগে হুগো পিতার অনুমতি চেয়েছিলেন, পিতার অভিমত জানার পর ১৯ শে মার্চ ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি এডেলকে লিখেছিলেন –

প্রিয়ে,

গতকাল আর পরশুর সন্ধ্যা বড় আনন্দেই কেটেছে (কারণ অজ্ঞাত), আজ আর বাড়ী থেকে বাইরে যাব না – আজ তোমায় চিঠি লিখতে বসলাম। এডেল, প্রিয়তমে – তোমাকে না বলার আমার কি আছে? এই দুদিন ধরে কেবলই ভেবেছি – এ প্রেম কি স্বপ্ন না সত্য? আমার মনে হচ্ছে প্রাণের এ সজীবতা, হাদয়ের এ আনন্দ শিহরণ – এই যে পুলকের অনুভূতি স্বর্গের না মর্তের! মাটির ধরণীতে একি সম্ভব? এ যদি পার্থিব হয় তবে স্বর্গীয় আনন্দ কি এর চেয়েও মধুর – স্বর্গের সৌন্দর্য কি এর চেয়েও মনোমুগ্ধকর! তোমার ভিক্টর কি পাগল হয়ে গেল!

[ এডেল এক সময় ভিক্টরকে বলেছিলেন, “তুমি ঠিক জেনো, যদি আমাদের বাবা-মা আমাদের এ বিয়েতে অমত করেন তবে নিশ্চয় এদেশ ছেড়ে চলে যাব; তোমায় যেতে হবে কিন্তু” হুগো সেই কথার উত্তরে বলছেন-]

বাবার চিঠি আসবার আগে তোমার প্রস্তাব মতই কাজ করব ঠিক করে ছিলাম কিন্তু তা আর করতে হবে না। ভেবেছিলাম মা বাবা যদি আপত্তি করেন তবে আমায় প্রথম যোগাড় করতে হবে কিছু টাকা – তারপর তোমায় নিয়ে চলে যাব (তুমি আমার সর্বস্ব -আমার সঙ্গিনী সহধর্মিনী)। এমন জায়গায় যাব যেখানে কেউ আমাদের চিনতে পারবে না – আর কেউ আমাদের মিলনের পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না – আত্মীয় স্বজন কেউ থাকবে না – কাউকেও চাই না। ফ্রান্স ছেড়ে চলে যাব। মনে করতাম – আজ আমি শুধু অন্তরে তোমার স্বামী – কিন্তু সেখানে গিয়ে প্রকাশ্যে স্বামীত্ব অর্জন করব।

কি করে যেতাম জান? দিনের বেলায় হয়ত আমরা একই কামরায় একসঙ্গে যেতাম – রাত্রেও হয়ত এক ঘরেই থাকতাম – কিন্তু তাই বলে কি সুখের সবটুকু সুযোগই নিতাম! না, ‘এডেল’ – তোমার ভিক্টরকে সে রকম ভেব না। তোমার ভিক্টরের চোখে তুমি আরও মহীয়সী আরও শ্রদ্ধেয়া হয়ে উঠবে। একই ঘরে তুমি থাকতে নির্ভয়ে – সামান্য স্পর্শ – এমন কি আমার একটুখানি সকাম দৃষ্টিও তোমায় কলুষিত করবে না। তুমি ঘুমোবে আর আমি তোমারই শয্যা পাশে জেগে থাকব সারারাত তোমার প্রহরী হয়ে – তোমার বিশ্রামের সময় যাতে কেউ কোনো বিঘ্ন উৎপাদন না করে। বিবাহের বাহ্য় অনুষ্ঠান না হলে – পুরোহিতের অনুমোদন না হলে ত আর স্বামীত্বের সকল অধিকার পুরুষের করায়ত্ত হয় না – শুধু রক্ষক হওয়ারই অধিকার থাকে; তাই যতদিন না ধর্মত স্বামীর সব কর্তব্যের অধিকারী হই ততদিন একাগ্রচিত্তে তোমার প্রহরায় নিযুক্ত থাকব – এই ছিল আমার উদ্দেশ্য; – শুধু এই কথাই ভাবতাম বাবার চিঠি আসার আগে।

ওগো, আমার হৃদয় বড় দুর্বল – তখন মন আমার একেবারে ভেঙ্গে পড়েছিল – তোমার মত মনকে দৃঢ় করতে পারি নি, তার জন্য তুমি আমায় ঘৃণা করো না, নিন্দা করো না, লজ্জা দিও না প্রিয়া আমায়!

বাবার কাছ থেকে কি উত্তর আসে – এই ভেবে যখন আমার দিন কাটছিল, একাকী নিঃসঙ্গ অবস্থায় আমার তখনকার মনের অবস্থা একবার ভেবে দেখ দেখি প্রিয়ে। আটদিন ধরে প্রতি মুহূর্তে মনে হয়েছে – এই বুঝি তোমায় হারালাম। আশা নিরাশায় কী সে দ্বন্দ্ব। একবার মনে করে দেখ দেখি। এতে আশ্চর্য হবার কিছু নাই – এই ত স্বাভাবিক।

তুমি তন্বী, সুন্দরী, মহীয়সী, তোমার রূপের প্রভায় স্বর্গের অপ্সরীও ম্লান হয়ে যায়। প্রকৃতি তোমাকে গড়েছেন নিখুঁত করে – তুমি, তুমি আমার শক্তির উৎস – তুমি আমার আনন্দ – তুমি হাসি, আবার তুমিই আমার অশ্রু!

মনে করো না যা বলছি এ শুধু উচ্ছ্বাস অন্ধ মোহ! এই মোহ-ই আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে – দিনে দিনে আমায় পরিব্যাপ্ত করছে। তুমি যে আমার প্রাণ – আমার সর্বস্ব! আমার অস্তিত্ব যে তোমাতেই বিলীন হয়ে আছে – আমার হৃদয়ের তন্ত্রী তোমার সুরে সুর মিলিয়ে চলেছে। তুমি আর আমি ত পৃথক নই – তা যদি হত তবে আমার জীবনের অবসান হত।

বাবার চিঠি পেয়ে আমার যে কি আনন্দ হয়েছিল তা আর কি বলব! মানুষের অভিধানে এমন কোন ভাষা নেই যা দিয়ে সে আনন্দ প্রকাশ করা যায়। সে কি আনন্দ না সুখ, তৃপ্তি না শান্তি – সে-ই আমার স্বর্গ।

চিন্তার অবসানে নিশ্চিন্ততার মধ্যে প্রাণ আমার হাঁপিয়ে উঠছে। এখন যেন মনে করতে পারছি না সত্যই কি সে পত্র আমি পেয়েছি, সে কি স্বপ্ন না সত্য? যদি স্বপ্নই হয় তবে পাছে সে সুখস্বপ্ন ভেঙ্গে যায় এই ভয়ে যেন এখনও শিউরে উঠছি। ওগো, এমনি করেই তুমি আমার হতে চলেছ। আঃ, কি আনন্দ, কি তৃপ্তি, তুমি আমার-আমার!

আর দু’দিন পরেই এই দেবী হবে আমার – একান্ত নিজস্ব। তার ভয় ভাবনা চিন্তা সবই হবে আমার। আমার বাহু হবে তার সমস্ত সত্তা – তার আশা আকাঙ্ক্ষা পূলক শিহরণ দুঃখ সুখ, তার নৈশ উপাধান – এই বক্ষ অবলম্বন করেই তার চোখে নেমে আসবে ঘুম – জেগে উঠবে নিদ্রার অবসানে। চোখে চোখে মিলন হবে – তারই সৌন্দর্য আকাশে বাতাসে প্রতিফলিত হয়ে মর্তে স্বর্গ নেমে আসবে। আজ তুমি আমার প্রেমিকা – কাল হবে আমার পত্নী সহধর্মিণী, তারপর একদিন হবে আমার পুত্রের জননী, তোমার সেই মাতৃমূর্তিকে ঘিরে একটি মহীয়সী নারী – তার অন্তরালে নববধূর প্রেম – চিরশুভ্র পবিত্র নির্মল! ভাব দেখি সে আনন্দের ভবিষ্যৎ – সেই শাশ্বত মিলন আর অক্ষয় অনাবিল প্রেম!

আজ তবে আসি প্রিয়ে! আজ ত তুমি কাছে নেই – কল্পনায় তোমায় করি আলিঙ্গন – স্বপ্নে দিই তোমার ওষ্ঠে অধরে অজস্র চুমো।

কত কি যে লিখলাম – পাগলের প্রলাপ মনে করে আমায় ক্ষমা করো! আমি কিছুই চাই না – শুধু তোমার ভালবাসার অধিকার – ইহকালে তোমায় ভালবাসি পরজন্মে যেন তোমায় পাই।

ইতি

তোমারই ভিক্টর হুগো

(FAQ) ভিক্টর হুগোর প্রেমপত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ভিক্টর হুগো কে ছিলেন?

ফ্রান্সের রোমান্টিক কবি।

২. ভিক্টর হুগোর প্রেমিকা তথা তার স্ত্রীর নাম কী?

এডেল ফুচার

৩. ভিক্টর হুগো কখন তার প্রেমিকাকে পত্রটি লেখেন?

১৯ শে মার্চ ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে।

৪. ভিক্টর হুগোর দুটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের নাম লেখ।

‘লা-মিজারেবল’, ‘নাটর ডাম’

Leave a Comment