নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ও যোসেফাইনের প্রেমপত্র

ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন ও যোসেফাইনের প্রেমপত্র প্রসঙ্গে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ও যোসেফাইনের প্রেম, নেপোলিয়ন বোনাপার্টের মূল প্রেমপত্র ও যোসেফাইনের মূল প্রেমপত্র সম্পর্কে জানব।

সম্রাট নেপোলিয়ন ও যোসেফাইনের প্রেমপত্র

ঐতিহাসিক প্রেমপত্রনেপোলিয়ন বোনাপার্ট ও যোসেফাইনের প্রেমপত্র
ফরাসি সম্রাটনেপোলিয়ন বোনাপার্ট
প্রেমিকাযোসেফাইন
দ্বিতীয়া স্ত্রীআর্কডাচেস মেরিয়া
মৃত্যু৫ মে ১৮২১ খ্রি
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ও যোসেফাইনের প্রেমপত্র

বর্তমান পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বীর নেপোলিয়ন বোনাপার্টের জীবন নাটকীয় ঘটনায় পূর্ণ। তাঁর জীবনের ইতিহাস আমরা আলোচনা করব না। তাঁর এই বীর হৃদয়ের অন্তরালে যে একটি প্রেমিক পুরুষ ছিল তার সন্ধান আমরা পাই যোসেফাইনের প্রতি লিখিত প্রেমপত্রগুলি পাঠে। যোসেফাইনের প্রতি যৌবনের যে আকর্ষণ তাকে আত্মহারা করেছিল – তার করুণ পরিণতি হয় পরস্পরের বিচ্ছেদ। যুবক বীর স্বামীর প্রেমে যোসেফাইন ছিলেন বিভোর কিন্তু হায়, কোনো সন্তান না হওয়ায় বন্ধ্যা অপবাদে সম্রাট তাঁকে পরিত্যাগ করেন। ১৮১০ খ্রীষ্টাব্দে অস্ট্রিয়ায় আর্কডাচেস মেরিয়াকে পুনর্বার বিবাহ করেন। যোসেফাইন তখন St. Germaine-এর কাছে নিজ পল্লীভবনে জীবনের বাকী দিনগুলি সামান্য় বিধবার মতই অতিবাহিত করেন।

প্রেমপূর্ণ হৃদয়ে সম্রাট নেপোলিয়ন এক সময়ে লিখছেন যোসেফাইনকে –

আমি আর তোমায় ভালবাসি না! তুমি আজকাল ভাবী দুষ্টু হয়েছ – তুমি খারাপ – তুমি যেন – কি! তুমি তোমার স্বামীকে ভালবাস না – তুমি তাকে চিঠি লেখ না!

ওগো, তুমি ত জান তোমার চিঠি পেলে আমার কত আনন্দ হয়। তোমার সুন্দর হাতের একটু লেখা পাবার জন্য আমি কত আকুল আগ্রহে পথের দিকে চেয়ে থাকি তা’ত তুমি জান! তবে কেন আমায় চিঠি দিতে এত দেরী কর। সামান্য একটু হিজিবিজি কথাও ত এক কলম লিখতে পার! পার না প্রিয়ে? সারাদিন কি এমন কাজে ব্যস্ত থাক যে আমায় তোমার সংবাদটুকু জানাবারও সময় পাও না! কি এমন বাধা। তোমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসার সময় তুমি প্রতিজ্ঞা করে বলেছিলে আমায় – রোজই তোমার হাতের লেখা পাঠাবে, তুমি কি সে প্রতিজ্ঞা ভুলে গেছ?

বল বল প্রিয়ে কে সে, যে তোমার আমার মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করছে? কোন্ ভাগ্যবান আজ তোমার কৃপা লাভ করেছে। সে কি মর্তের মানব না কোনো অশরীরী! হায় হতভাগ্য আমি! কিন্তু আমি বলে রাখছি – আমি তা হতে দেব না! একদিন দেখবে গভীর নিশীথে তোমরা যখন প্রেমালাপে মত্ত থাকবে তখন হঠাৎ তোমার প্রমোদ কক্ষের দরজা ভেঙ্গে তোমার কাছে গিয়ে দাঁড়াব। কি, রাগ করলে? তোমার চিঠি না পেয়ে আমার মাথা ঠিক নেই – কি লিখতে কি লিখে ফেলেছি – আমায় ক্ষমা কর!

আমার মনের অবস্থা তুমি ত বুঝতে পারছ! পত্রপাঠ চিঠি দিও প্রিয়ে, এক-দুই-তিন-চার পাতা চিঠি চাই। একটুখানি ছোট্ট চিঠিতে এত দিনের ক্ষুধা মিটবে না। তোমার প্রেমের কথা – তোমার মধুমাখা প্রিয়তম সম্ভাষণ শোনার জন্য তৃষিত চাতকের মত হয়ে আছি-আর যে পারি না প্রাণেশ্বরী! কবে আবার তোমায় দু’বাহু দিয়ে আলিঙ্গন করে বুকের মাঝে নিয়ে অজস্র চুমায় তোমার মুখখানি রাঙিয়ে তুলব। আশায় রইলাম, নিরাশ করোনা দেবী!

ইতি

বোনাপার্ট

আর একদিন ২৭শে নভেম্বর ১৭৯৬, কোনো পর্ব উপলক্ষে জেনোয়ায় গিয়েছিলেন যোসেফাইন, তখন সম্রাট এসেছিলেন মিলানে (Milan) তাঁর বাড়িতে – কিন্তু প্রেমিকার দেখা না পেয়ে ব্যথিত হৃদয়ে লিখলেন –

ওগো, মিলানে পৌঁছেই তোমার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম কিন্তু হায় চির অভাগা আমি – দেবীর দর্শন পাওয়া আমার ভাগ্যে হল না। আকুল কম্পিত আগ্রহে দুহাতে তোমায় জড়িয়ে ধরতে চাই – পাই না! বেচারা নোপোলিয়নের কথা যদি একবারও ভাবতে তাহলে এমন করে কখনই তার আসবার আগে তুমি চলে যেতে না! বল কেন তুমি এমন হলে?

আমায় কি বল! বিপদ নিয়ে আমাদের খেলা। মরণ ত আমাদের বন্ধু – জীবনের দুঃখ শোকের অবসান কেমন করে করতে হয় তা’ত আমি জানি। রাত্রি ৯টা পর্যন্ত তোমার আশায় থাকব। যদি ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়, তবে হয়ত দেখা পাব।

দেবী, তুমি সুখী হও – তোমার জন্য সুখের সৃষ্টি। সারা বিশ্ব তোমাকে আনন্দ দান করবার জন্য তোমার আদেশের অপেক্ষা করছে কিন্তু হায় চির অভাগা আমি একা, এ বিশ্বে নিতান্ত একা।

তোমার হতভাগ্য স্বামী

সম্রাট নেপোলিয়ন আর এক পত্রে লিখছেন সাম্রাজ্ঞী যোসেফাইনকে –

মহারাণী! সম্রাজ্ঞী,

স্ট্রাসবুর্গ থেকে চলে যাবার পর আর তোমার কোন পত্র পাই নি। তুমি বাডেন, স্টাটগার্ট, মিউনিক সফর করে চলে গেছ – তুমি আমাকে এক খানাও চিঠি দাও নি। সেটা কি তোমার ঠিক হয়েছে? আমার প্রতি এই কি তোমার সুবিচার? আমি এখনও বনে (baunn) আছি। রাশিয়ানরা চলে গেছে তাদের সঙ্গে সন্ধি হয়েছে। দু’একদিনের মধ্যেই ঠিক করব – আমার ‘ভবিষ্যৎ কর্ম পন্থা কি!

আমার অভিবাদন গ্রহণ কর –

নেপোলিয়ন

নেপোলিয়নের আর একখানি পত্র –

পোর্ট মরিস

৩. ৪.১৭৯৬

তোমার সব চিঠিই পেয়েছি কিন্তু তোমার শেষ চিঠিখানি পড়ে যে ব্যাথা পেয়েছি তা আর এ সামান্য পত্রে কি জানাব? ওগো প্রিয়তমে, লেখবার সময় কি একটুও ভাব না যে কি লিখছ? আমার মনের অবস্থা কি তোমার অজানা? তুমি আমাকে এমন দুঃখের পর দুঃখ দিচ্ছ? ব্যাথার উপর ব্যাথা জমে উঠছে, আমার আত্মাকে একেবারে চেপে পেষে মেরে ফেলতে কি তোমার কিছু মাত্র কষ্ট হয় না! তোমার ভাব ও ভাষা এত জ্বালাময়ী যে তাতে মনে হয় আমার এই শুষ্ক হৃদয় নিমেষে ভস্মীভূত হয়ে যাবে।

আমার একমাত্র প্রিয়তমা যোসেফাইনের বিরহে আমার আনন্দ চিরতরে বিদায় নিয়েছে – জগৎ আমার কাছে মরুভূমি মনে হচ্ছে। আমি সেই মরুভূমিতে একা – ধু ধু কচ্ছে বালুকণা, একবিন্দু জল নেই – একটা কীট পতঙ্গ পর্যন্ত নেই। তুমি হরণ করে নিয়েছ আমার হৃদয় – শুধু কি তাই, আমার মনের সমস্ত চিন্তা আজ তোমার চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার নিজের ওপর ধিক্কার আসে – মনে হয় এ জন্মই বৃথা! কেন এমন হয় জান? শুধু বিরহ-প্রিয়বিচ্ছেদ আমায় পাগল করে দিয়েছে। আমার হৃদয় জয় করবার এ কৌশল তুমি কোথা থেকে শিখেছ -কোথায় পেয়েছ এ বশীকরণ শক্তি যাতে আমার সমস্ত সত্তাকে লুপ্ত করে দিয়েছ? আমায় এমন করেছ যাতে আমার মৃত্যুর পর আমার কবরের ওপর আর কিছু লেখা থাকবে না – লোকে শুধু লিখে রাখবে –

“যোসেফাইনের জন্যই এ বেঁচে ছিল”

তোমার সঙ্গ পাবার জন্য একি দুর্বার আকাঙ্ক্ষা! তোমার সান্নিধ্য পাবার আমার চেষ্টার অন্ত নেই! প্রাণ যায় তবু তোমায় পাই না! আমি কি উন্মাদ হয়েছি? কিছু বুঝতে পারছি না! তোমার কাছ থেকে কত দূরে বহুদূরে আছি একথা ভাবতেও যেন শরীর শিউরে উঠছে! তোমার আমার মধ্যে আজও কত দেশ – কত নদ-নদী গিরির বাবধান! জানিনা এ পত্র তোমার হাতে যখন পড়বে তখন আর আমার দেহে প্রাণ থাকবে কি না! এ পাগলের প্রলাপ যখন শুনবে (পড়বে) তখন হয়ত বিরহ বেদনা সহ্য় করতে না পেরে আমার অস্তিত্ব পৃথিবী হতে লুপ্ত হয়ে যাবে!

একদিন ছিল যেদিন নেপোলিয়ন মৃত্যুকে ভয় করত না, সে দম্ভ আজ তার চূর্ণ হয়ে গেছে। একদিন যে নেপোলিয়ন বিপদের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ত সম্পদ আহরণ করবার জন্য, আজ সে নেপোলিয়ন দুর্ভাগ্যের কল্পনায় ভীত সন্ত্রস্ত। হায় প্রিয়ে, তুমিই যে একমাত্র কারণ! অসুখ কাকে বলে জানতাম না – কারো রোগ হতে পারে আমার ধারণার অতীত ছিল কিন্তু আজ প্রতিমূহুর্তে মনে হয় – ‘আমার যোসেফাইন বুঝি অসুস্থ হয়েছে’ – এ চিন্তা আমার সকল সুখ হরণ করেছে।

তুমি আমার সম্বন্ধে কিছু ভেবো না! তুমি শুধু আমায় ভালবেসো – তোমায় আর কিছু করতে হবে না! তুমি তোমার নিজেকে যেমন ভালবাস আমাকেও তেমনি ভালবেসো প্রিয়ে!

কত কি লিখলাম! যদি মনে ব্যথা দিয়ে থাকি আমায় ক্ষমা করো! পাগলের প্রলাপ শুনে তোমার কি রাগ করা উচিত! রাত্রি গভীর! একলাই আমার রাত কাটবে! কত রাত এই ভাবে কেটে যাবে কে জানে? কল্পনায় তোমায় বাহু-বন্ধনে রেখে কত নিশা এই ভাবে চলে যাবে! হায়-আমার মত অভাগা কে আর আছে!

আবার কত রাত্রে স্বপ্নে তোমার সঙ্গ লাভ করব – আহা সে সুখস্বপ্ন কি মধুর সে চিন্তাও স্বর্গ! তুমি আমার সেই স্বর্গের দেবী! বিদায়।

নেপোলিয়ন

নেপোলিয়ন কর্তৃক পরিত্যক্তা হবার পর সাম্রাজ্ঞী যোসেফাইন লিখেছিলেন –

নাভারা, এপ্রিল, ১৮১০

আমাকে যে ভোলোনি তার জন্য তোমায় অসংখ্য ধন্যবাদ। এই মাত্র তোমার চিঠি পেলাম – অনেক ক্ষণ ধরে পড়লাম – এক একটি কথা পড়ি আর কাঁদি – চোখের জলে ভিজিয়ে দিই সব চিঠিখানা। তবু-তবু এ পত্র কত মধুর! আবেগেই মানুষের জীবন – এক একটি অনুভব আপনাতেই আপনি সম্পূর্ণ।

আমার ১৯ তারিখের চিঠি যে তুমি পাওনি তার জন্য আমি দুঃখিত। তাতে যে কি লিখেছিলাম তা আমার আজ মনে নেই – মনের সে আকুলতা, সে ব্যগ্রতা আজও যেন আমাকে তোলপাড় করে তুলছে। হায়-ওগো, তোমার সংবাদ না পেলে আমার যে কি অবস্থা হয় তা আর কি বলব!

ম্যালমেসেন থেকে চলে আসবার পরই তোমায় পত্র দিয়েছিলাম – তার পর থেকে কতবার মনে হয়েছে তোমায় পত্র দিই – তোমার খবব নি’ কিন্তু পারি নি পাছে তোমার মনে কষ্ট দি’। তোমার নীরবতার কারণ আমি জানি – আর জানি বলেই ত তোমায় লিখি নি’ কোনো চিঠি ভয়ে, পাছে আমার ধৃষ্টতায় তুমি মনে ব্যথা পাও! আমার যে কি বেদনা! তোমার চিঠিই আমার সে বেদনার প্রলেপ!

তুমি সুখী হও! কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি মানুষ যতখানি সুখী হতে পারে ততখানি সুখী হও। আমার যতটুকু প্রাপ্য ততটুকু সুখই ত তুমি আমায় দিয়েছ, তোমার চিঠি পেয়েছি – এই আমার যথেষ্ট! তোমার মনের কোণে আমাকে যে একটু ঠাই দিয়েছ – আজও যে আমায় ভোলোনি – তাতেই আমার তৃপ্তি। বিদায় – আজ বিদায় বন্ধু – তুমি আমার বড় আদরের, চিরদিন যেন তোমায় ভালবাসতে পারি।

যোসেফাইন

(FAQ) নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ও যোসেফাইনের প্রেমপত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. নেপোলিয়ন কে ছিলেন?

১৮০৪-১৮১৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ফ্রান্সের সম্রাট ছিলেন নেপোলিয়ন বোনাপার্ট।

২. নেপোলিয়ন বোনাপার্টের প্রেমিকা তথা প্রথম স্ত্রী কে ছিলেন?

যোসেফাইন

৩. নেপোলিয়ন বোনাপার্টের দ্বিতীয় স্ত্রী কে ছিলেন?

আর্কডাচেস মেরিয়া।

নেপোলিয়ন বোনাপার্টের মৃত্যু কখন হয়?

৫ মে ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে।

Leave a Comment