মন্দিরে প্রবেশ সংক্রান্ত ঘটনা প্রসঙ্গে দক্ষিণ ও মধ্য ভারতে সাম্প্রদায়িক বিভেদ, মধ্যভারতে মন্দিরে প্রবেশ সংক্রান্ত ঘটনা, মাহাদ মার্চ, মন্দিরে প্রবেশের দাবিতে আন্দোলন, সত্যাগ্ৰহ, দক্ষিণ ভারতে মন্দিরে প্রবেশ সংক্রান্ত ঘটনা, ভাইকম সত্যাগ্রহ এবং বিভাজন ও শাসন নীতি প্রয়োগের চেষ্টা সম্পর্কে জানবো।
ভারতের অনগ্রসর ও অস্পৃশ্য সম্প্রদায়ের মন্দিরে প্রবেশ সংক্রান্ত ঘটনা
ঐতিহাসিক ঘটনা | মন্দিরে প্রবেশ সংক্রান্ত ঘটনা |
দক্ষিণ ভারত | ইঝাবা, পুলায়া |
মধ্যভারত | মাহার |
হরিজন | মহাত্মা গান্ধী |
মাহাদ মার্চ | আম্বেদকর |
ভাইকম সত্যাগ্রহ | কেশব মেনন |
ভূমিকা :- ব্রিটিশ সরকার ভারতের বিভিন্ন ধর্ম ও জাতির মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করে এদেশে ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করেছিল। তবে এক্ষেত্রে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার কিছু রীতি, সংস্কার কম দায়ী ছিল না।
দক্ষিণ ও মধ্য ভারতে সাম্প্রদায়িক বিভেদ
মধ্য ভারতের হিন্দি বলয়ে এবং দক্ষিণ ভারতে, বিশেষ করে কেরালায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এরূপ সাম্প্রদায়িক বিভেদ ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। দলিত হিন্দু সম্প্রদায়, গান্ধিজি যাঁদের ‘হরিজন’ নামে ডাকতেন, নানা ধরনের সামাজিক বৈষম্যের শিকার হয়েছিল।
হিন্দু সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের উদাহরণ
উদাহরণ হিসেবে মধ্য ভারতের অনগ্রসর ও অস্পৃশ্য মাহার সম্প্রদায় ও হরিজন এবং দক্ষিণ ভারতের ইঝাবা ও পুলায়া সম্প্রদায়ের কথা বলা যায়, যারা বর্ণ হিন্দুদের দ্বারা নির্যাতিত হতেন।
মধ্য ভারতে মন্দিরে প্রবেশ সংক্রান্ত ঘটনা
মাহাররা ছিল এক অস্পৃশ্য ও অনগ্রসর হরিজন হিন্দু সম্প্রদায়। সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত এই শ্রেণির মানুষ ঝাড়ু দেওয়া, জুতো তৈরি প্রভৃতি কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকত। তাদের মধ্যে ভাগ্যবানরা চাষের মজুরের কাজ পেত।
(ক) সামাজিক বৈষম্যের শিকার মাহার সম্প্রদায়
মাহার সম্প্রদায়ের মানুষ বর্ণহিন্দুদের দ্বারা নানান সামাজিক বৈষম্যের শিকার হয়েছিল। যেমন –
- (১) সমাজে তারা পশুর চেয়েও অধম জীব বলে গণ্য হত।
- (২) তারা সর্বসাধারণের জন্য নির্দিষ্ট জলাশয় বা কুয়ো থেকে পানীয় জল নিতে পারত না।
- (৩) হিন্দু মন্দিরে তাদের প্রবেশের কোনো অধিকার ছিল না।
- (৪) মাহারদের জন্য ধোপা-নাপিতের পরিসেবাও বন্ধ ছিল।
- (৫) যেসব বিদ্যালয়ে উচ্চবর্ণ পরিবারের সন্তানরা পড়াশোনা করত সেখানে দলিত হিন্দুদের সন্তানরা ভরতির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হত।
(খ) আন্দোলনের সূত্রপাত
ড. ভীমরাও আম্বেদকর মধ্যপ্রদেশের মাহার সম্প্রদায়ভুক্ত এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নিম্নবর্ণের হরিজনদের প্রতি বিভিন্ন সামাজিক বৈষম্যের প্রতিবাদে আন্দোলনে নামেন। যেমন –
(১) মাহাদ মার্চ
অস্পৃশ্যরা যাতে জনসাধারণের জলাশয় থেকে জল নিতে পারে, সেই দাবিতে আম্বেদকরের নেতৃত্বে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে ২০ মার্চ বোম্বাইয়ের কোবালায় চৌদার জলাশয়ে ‘মাহাদ মার্চ’ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আম্বেদকরের নেতৃত্বে প্রকাশ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের বর্ণবৈষম্যের ভিত্তি ‘মনুস্মৃতি’ নামে প্রাচীন গ্রন্থটির কয়েকটি কপি আগুনে পোড়ানো হয়। এভাবে বর্ণভেদ ও পুরোহিত প্রাধান্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়।
(২) মন্দিরে প্রবেশের আন্দোলন
হিন্দু মন্দিরে হরিজন ও অন্যান্য নিম্নবর্ণের হিন্দুদের প্রবেশাধিকার দানের দাবিতে ড. আম্বেদকর ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে আন্দোলন শুরু করেন। আম্বেদকর বলেন, “ইউরোপীয় ক্লাবগুলিতে একদা লেখা থাকত যে, ভারতীয় ও কুকুরের প্রবেশ নিষেধ। এখন হিন্দু মন্দিরে অস্পৃশ্যদের প্রবেশ নিষেধ করে কি একই ধরনের অবজ্ঞা করা হচ্ছে না?” আম্বেদকরের ডাকে নিম্নবর্ণের মাহার সম্প্রদায়ের অগণিত মানুষ আন্দোলনে শামিল হয়। তাঁরা মন্দিরের জলাশয় থেকে জল পান করলে মন্দিরের পুরোহিতরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।
(গ) আন্দোলনের প্রসার
মন্দিরে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের প্রবেশাধিকারের দাবিতে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে জোরদার আন্দোলন শুরু হয়। এতে নেতৃত্ব দেন ড. ভীমরাও আম্বেদকর।
(১) কলারাম মন্দিরে প্রবেশের দাবি
ড. আম্বেদকর নাসিকের কলারাম মন্দিরে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের প্রবেশাধিকারের দাবিতে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে আন্দোলন শুরু করেন। তাঁর ডাকে অন্তত ১৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবক এই মন্দিরে শ্রীরামচন্দ্রের বিগ্রহে পুজো দেওয়ার দাবি জানায়।
(২) সত্যাগ্রহ আন্দোলন
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ২ মার্চ নাসিকে এক সম্মেলনে ড. আম্বেদকর মন্দিরে প্রবেশাধিকারের দাবিতে সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করার কথা ঘোষণা করেন। পরের দিন বিকেলে নাসিকে তাঁর নেতৃত্বে দীর্ঘ এক মাইল লম্বা মিছিল হয়। এটি ছিল সেই সময়ের নিরিখে নাসিকের ইতিহাসে বৃহত্তম মিছিল। মিছিল এগিয়ে কলারাম মন্দিরের পূর্ব ফটকে পৌঁছোয়। কিন্তু মন্দিরের সমস্ত ফটক বন্ধ থাকায় তাঁরা ফটকের সামনে অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন।
(৩) সংঘর্ষ
কলারাম মন্দিরে প্রায় ১ মাস ধরে দলিত হিন্দুদের সত্যাগ্রহ চলে। এরপর ৯ এপ্রিল মন্দিরের রথ অস্পৃশ্যরা স্পর্শ করলে উগ্র বর্ণহিন্দুরা সত্যাগ্রহীদের ওপর ভয়ংকর আক্রমণ চালায়, চলে পাথরবৃষ্টি। ফলে সারা শহরে দলিত হিন্দু ও বর্ণহিন্দুদের মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। উত্তেজনার কারণে মন্দিরটি সারা বছর বন্ধ থাকে। এই উত্তেজনা ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলে।
(৪) মন্দিরে প্রবেশাধিকার আইন
নাসিকের উত্তেজনার মধ্যেই বোম্বাইয়ে প্রাদেশিক কংগ্রেস সরকার ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে মন্দিরে প্রবেশ সংক্রান্ত বিল পাশ করে। এর দ্বারা অস্পৃশ্যদের জন্য বিভিন্ন মন্দিরে প্রবেশের দরজা আংশিক খুলে যায়। হরিজন ও দলিতরা মন্দিরে প্রবেশের রাজনৈতিক অধিকার পেতে শুরু করে। মাদ্রাজ, মধ্যপ্রদেশ ও অন্যান্য প্রদেশের আইনসভাতেও এই বিষয়ে আইন পাস হতে থাকে।
দক্ষিণ ভারতে মন্দিরে প্রবেশ সংক্রান্ত ঘটনা
দক্ষিণ ভারতে কেরালায় ইঝাবা ও পুলায়া নামে দলিত হিন্দুরা ‘তিনদাল’ অর্থাৎ উচ্চবর্ণের মানুষদের ১৬ ফুট ও ৭২ ফুটের চেয়ে বেশি কাছে আসতে পারত না।” নিম্নবর্ণের হিন্দু বা দলিতরা মন্দিরে প্রবেশ, মন্দির সংলগ্ন রাস্তা এবং অন্যান্য কিছু রাস্তায় প্রবেশে বঞ্চিত ছিল। তাই দলিত শ্রেণির প্রতি বিভিন্ন ধরনের বর্ণনার প্রতিবাদে বিভিন্ন স্তরে সংগ্রাম ও আন্দোলন শুরু হয়েছিল।
(ক) দক্ষিণ ভারতের সংস্কারক
উনিশ শতকের শেষদিকে যে সব সংস্কারক সংগ্রাম শুরু করেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন শ্রী নারায়ণ গুরু, এন. কুমারন আসান এবং টি. কে. মাধবন। তাঁদের উদ্যোগ অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে কংগ্রেসকে সচেতন হতে সাহায্য করে।
(খ) ৩০ মার্চের ডাইকম সত্যাগ্রহ
কেরালায় নিম্নবর্ণের হিন্দুদের প্রতি অস্পৃশ্যতার মনোভাব দেখানো এবং তাদের মন্দিরে প্রবেশ করতে না দেওয়ার প্রতিবাদে বিভিন্ন স্তরে আন্দোলন শুরু হয়। যেমন –
(১) কংগ্রেসের উদ্যোগ
কংগ্রেসের কাকিনাড়া অধিবেশনে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়। এরপর কেরালা প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে প্রচার চালানোর পাশাপাশি হিন্দু মন্দির ও জনপথগুলি অবর্ণ বা হরিজনদের জন্য খুলে দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
(২) ভাইকম গ্রামের ঘটনা
কংগ্রেসের উদ্যোগে ত্রিবাঙ্কুরের ভাইকম গ্রামে আন্দোলনের সূচনা হয়। এখানে একটি বড়ো মন্দির ছিল, যার চারটি দেয়াল ঘিরে রাস্তা ছিল। ইঝাবা ও পুলায়াদের মতো অবর্ণ বা নিম্নবর্গের মানুষজন এই মন্দিরে প্রবেশ করতে বা মন্দিরসংলগ্ন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে পারত না। প্রদেশ কংগ্রেস ভাইকম গ্রাম থেকেই অবর্ণদের প্রতি বর্ণনার প্রতিবাদে সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়।
(৩) সত্যাগ্রহের সূত্রপাত
কেরালা প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ২ মার্চ এই মন্দিরসংলগ্ন রাস্তা দিয়ে সবর্ণ (বর্ণহিন্দু) এবং অবর্ণদের যৌথ মিছিল বের করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ বিষয়ে সবর্ণদের নৈতিক চেতনা জাগিয়ে তুলতে জোর কদমে প্রচারাভিযান চালানো হয়। নায়ার সার্ভিস সোসাইটি, নায়ার সমাজম, কেরালা হিন্দুসভা প্রভৃতি সবর্ণ সংগঠনগুলি প্রদেশ কংগ্রেসের আন্দোলনকে সমর্থন জানায়। নাম্বুদিরি নামে বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণদের প্রধান সংগঠন যোগক্ষমা সভা মন্দিরের দরজা অবর্ণদের জন্য খুলে দেওয়ার পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ করে।
(খ) আন্দোলনের প্রসার
ভাইকম গ্রামের মন্দিরের দরজা অবর্ণ হিন্দুদের জন্য খুলে দেওয়ার যে উদ্যোগ শুরু হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দিক থেকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। যেমন –
(১) আন্দোলনে বাধা
মন্দির কর্তৃপক্ষ এবং ত্রিবাঙ্কুর সরকার মন্দিরের দিকে যাওয়ার সব রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করে মন্দিরের দিকে আন্দোলনকারীদের অগ্রগতি রোধের উদ্যোগ নেয়। সেখানকার জেলাশাসক সত্যাগ্রহীদের আন্দোলনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।
(২) সত্যাগ্রহীদের মিছিল
ভাইকম সত্যাগ্রহ সারা দেশে প্রবল উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে স্বেচ্ছাসেবকরা আন্দোলনে যোগ দিতে আসতে থাকেন। বিভিন্ন বাধা সত্ত্বেও সত্যাগ্রহীরা কেশব মেননের নেতৃত্বে ৩০ মার্চ সত্যাগ্রহ শিবির থেকে মিছিল বের করে ভাইকমের মন্দিরের দিকে এগোতে থাকে। পুলিশ যাত্রাপথে সত্যাগ্রহীদের মিছিল আটকে দেয় এবং সত্যাগ্রহীদের গ্রেপ্তার করে।
(৩) গোঁড়া বর্ণহিন্দুদের প্রতিক্রিয়াশীল উদ্যোগ
মন্দিরের দরজা সকল বর্ণের হিন্দুদের জন্য খুলে দেওয়ার বিষয়টিকে কিছু গোঁড়া ও প্রতিক্রিয়াশীল বর্ণহিন্দু মেনে নিতে পারেন নি। তাঁরা ভাইকমে মিলিত হয়ে সত্যাগ্রহের সমর্থক কংগ্রেসিদের সামাজিক বয়কট করার সিদ্ধান্ত নেয়। তা ছাড়া সত্যাগ্রহে যোগদানকারীদের শিক্ষক বা আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ না করা বা তাদের ভোট না দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
(গ) পরবর্তী আন্দোলন
১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মার্চ ভাইকম সত্যাগ্রহের দ্বারা মন্দিরের দরজা অবর্ণ হিন্দুদের জন্য খোলা সম্ভব হয় নি। তবে দলিত মানুষের সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলন থেমে থাকে নি। পরবর্তী উদ্যোগগুলি ছিল –
(১) মহারানির কাছে আবেদন
আগস্ট মাসে ত্রিবাঙ্কুরের মহারাজার মৃত্যুর পর মহারানি শাসনক্ষমতা লাভ করে সব সত্যাগ্রহীকে মুক্তি দেন। এরপর উদারচেতা বর্ণহিন্দুদের একটি দল মহারানির কাছে একটি স্মারকলিপি জমা দিয়ে মন্দিরের দরজা ও রাস্তা সবার জন্য খুলে দেওয়ার আবেদন করেন। কিন্তু মহারানি তাদের আবেদনে সাড়া দেন নি। ফলে সত্যাগ্রহীদের আন্দোলন চলতে থাকে।
(২) গান্ধিজির উদ্যোগ
কংগ্রেস নেতা মহাত্মা গান্ধি ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে কেরালায় মহারানি ও অন্যান্য রাজকর্মচারীদের সঙ্গে দেখা করে একটি আপসরফার চেষ্টা করেন। এর ফলে মন্দিরের চারপাশের রাস্তাগুলি অবর্ণদের জন্য খুলে দেওয়া হয়, কিন্তু মন্দিরের ‘সংকেথন’-এর রাস্তাগুলি তাদের জন্য বন্ধই থাকে। অবর্ণদের মন্দিরে প্রবেশের অধিকার না থাকায় কেরালা সফরকালে গান্ধিজি কোনো মন্দির পরিদর্শন করেন নি।
(৩) গুরুবায়ুর মন্দিরে সত্যাগ্রহ
১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে আবার মন্দিরে অবর্ণদের প্রবেশের অধিকারের দাবিতে আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। এই পর্বে গুরুবায়ুর মন্দিরে প্রবেশের দাবিতে সত্যাগ্রহের মাধ্যমে আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কবি সুব্রমনিয়ান তিরুমান্নুর এর নেতৃত্বে ষোলো জনের একটি সত্যাগ্রহী দল ২১ অক্টোবর গুরুবায়ুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। ১ নভেম্বর সমগ্র কেরালায় ‘মন্দির প্রবেশ দিবস’ পালিত হয়। চলতে থাকে প্রার্থনা, মিছিল, অর্থসংগ্রহ ইত্যাদি। যুবকরা ব্যাপক সংখ্যায় আন্দোলনে যোগ দেয়। বহু মানুষ মন্দিরের পরিবর্তে সত্যাগ্রহ শিবিরেই পূজা দেন। কেন না, তাঁদের মনে হয়েছিল যে, এই সত্যাগ্রহ শিবির মন্দিরের চেয়েও পবিত্র।
(৪) আন্দোলন প্রতিরোধ
মন্দিরের চতুর্দিক কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে দিয়ে, প্রতিরোধ বাহিনী মোতায়েন করে, মারধরের ভয় দেখিয়ে মন্দির কর্তৃপক্ষ আন্দোলনকারীদের মন্দিরে প্রবেশ আটকানোর চেষ্টা করে। ১ নভেম্বর বিশাল পুলিশবাহিনী মন্দিরের তোরণের দিকে আগত সত্যাগ্রহীদের আটকে দেয়। একটু পরেই মন্দির কর্তৃপক্ষ এবং গোঁড়া বর্ণহিন্দুরা অহিংস সত্যাগ্রহীদের ওপর শারীরিক আক্রমণ চালায়। পি. কৃষ্ণ পিল্লাই ও এ. কে. গোপালনকে প্রচণ্ড মারধর করা হয়। পুলিশ নীরবে দাঁড়িয়ে এই তাণ্ডবের দৃশ্য উপভোগ করে।
(৫) কেলাপ্পানের অনশন
কে. কেলাপ্পান অবর্ণ হিন্দুদের জন্য মন্দিরের দরজা খুলে দেওয়ার দাবিতে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে আন্দোলন শুরু করেন। তিনি ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে সকল হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য মন্দিরের দরজা না খোলা পর্যন্ত অনশন শুরু করেন। ফলে মন্দিরে প্রবেশ সংক্রান্ত আন্দোলন সারা দেশে আবার প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করে। কিন্তু কেলাপ্পান শেষপর্যন্ত গান্ধিজির অনুরোধে অনশন ভঙ্গ করেন।
(৬) গোপালনের উদ্যোগ
এরপর এ. কে. গোপালনের নেতৃত্বে মন্দিরে প্রবেশ সংক্রান্ত আন্দোলন আবার জোরদার হয়ে ওঠে। তাঁর নেতৃত্বে একটি দল সমগ্র কেরালা ঘুরে সভাসমাবেশ করে এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন করে। এরপরও এ বিষয়ে আন্দোলন চলতে থাকে।
(৭) আন্দোলনের জয়
দীর্ঘ আন্দোলনের পর অবর্ণ হিন্দুদের জন্য মন্দিরের দরজা খুলে দেওয়া সম্ভব হয়। ত্রিবাঙ্কুরের মহারাজা ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে জাতপাত-নির্বিশেষে সমস্ত হিন্দুদের জন্য সরকার-নিয়ন্ত্রিত সব মন্দির খুলে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারির নেতৃত্বে মাদ্রাজ মন্ত্রীসভা ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে সকলের জন্য মন্দিরের দরজা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কংগ্রেস শাসিত অন্যান্য প্রদেশগুলিতেও অনুরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
‘বিভাজন ও শাসন নীতি’ প্রয়োগ করার চেষ্টা
ব্রিটিশ সরকার প্রথমদিকে ভারতীয় সমাজের অগ্রগতির জন্য বেশ কিছু শুভ উদ্যোগ নিয়েছিল। তারা এদেশে পাশ্চাত্যের আধুনিক শিক্ষা চালু করেছিল, সতীদাহের মতো কুপ্রথা আইন করে বন্ধ করেছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে ভারতীয় সমাজে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে দুর্বল করার প্রয়োজন হলে সরকার সর্বত্র ‘বিভাজন ও শাসন নীতি’ প্রয়োগ করার চেষ্টা করে।
উপসংহার :- ভারতীয় সমাজে সাম্প্রদায়িক বিভেদ জিইয়ে রাখার উদ্দেশ্যেই সরকার নিম্নবর্ণের মানুষদের মন্দিরে প্রবেশ সংক্রান্ত সমস্যার সমাধানে আন্তরিক উদ্যোগ নেয় নি। বরং সরকারের পুলিশ অনেক সময় মন্দিরে প্রবেশ সংক্রান্ত আন্দোলন দমন করে সবর্ণ ও অবর্ণ হিন্দুদের মধ্যে বিভেদ জিইয়ে রাখার চেষ্টা করেছিল।
(FAQ) ভারতের অনগ্রসর ও অস্পৃশ্য সম্প্রদায়ের মন্দিরে প্রবেশ সংক্রান্ত ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
বাবাসাহেব আম্বেদকর।
২০ মার্চ ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে।
বাবাসাহেব আম্বেদকর ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে।
৩০ মার্চ ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে।
কেশব মেনন।
১ নভেম্বর ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে।