সারা বার্নহার্ডের প্রেমপত্র

বিখ্যাত অভিনেত্রী সারা বার্নহার্ডের প্রেমপত্র প্রসঙ্গে সারা বার্নহার্ডের পরিচিতি, সারা বার্নহার্ডের খ্যাতি, সারা বার্নহার্ডের প্রেম, সারা বার্নহার্ডের প্রেমিক, ও সারা বার্নহার্ডের মূল প্রেমপত্র সম্পর্কে জানব।

অভিনেত্রী সারা বার্নহার্ডের প্রেমপত্র

ঐতিহাসিক প্রেমপত্রসারা বার্নহার্ডের প্রেমপত্র
দেশফ্রান্স
পরিচিতিমঞ্চ ও চলচ্চিত্র অভিনেত্রী
প্রকৃত নামহেনরীয়েটা রোসাইন বার্নহার্ড
প্রেমিকপিটার বার্টন
সারা বার্নহার্ডের প্রেমপত্র

সারা বার্নহার্ড (Sarah Bernhardt) ছিলেন উনবিংশ শতকের বিখ্যাত অভিনেত্রী। হীন বংশে তার জন্ম। কিন্তু অসামান্য অভিনয় নৈপুন্য ও নৃত্যকূশলতায় তিনি সামান্য় অবস্থা থেকে যশের উচ্চশিখরে আরোহণ করেছিলেন। তাঁর আত্মজীবনী পাঠে আমরা অনেক কিছুই জানতে পারি, শুধু জানি না তার পিতৃপরিচয়। লোকে বলে তাঁর মা ছিলেন ইহুদী এবং পিতা একজন স্কটল্যান্ড বাসী নাবিক। তাঁর জন্ম ও বাল্যবৃত্তান্ত এত কলঙ্কময় যে তিনি তাঁর পিতৃমাতৃ পরিচয় গোপন করতে বাধ্য হয়েছিলেন – এই হল সকলের ধারণা।

সারার চরিত্রে বিভিন্ন ও বিপরীত প্রকৃতির সমাবেশ একত্র পরিলক্ষিত হয়। নানা ঘাত প্রতিঘাতে কখনো তিনি কোমল হৃদয়া, আবার কখনো নিষ্ঠুর। তার দাসদাসী, নাট্যালয়ের পরিচারকেরা তাকে ‘ঘূর্ণি বায়ু’ বলত। তাঁর মত সুন্দরী যেমন সে যুগে ছিল না বললেই হয় তেমনই তাঁর চেয়ে বেশী প্রেমপত্র কেউ লিখেছে কিনা সন্দেহ। আর সেই সব পত্রের সম্বন্ধে যদি কেউ কোনো কথা জিজ্ঞাসা করত তা হলে তিনি বলতেন “এই সব পত্র কোনো বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে আমার হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশ থেকে বেরিয়ে এসেছে, কিন্তু তা চির দিনের সামগ্রী নয়”। প্রকৃত পক্ষে সে চিঠি নিছক প্রেমের অভিব্যক্তি ছাড়া কিছুই নয়।

তিনি ভালবেসেছিলেন মাত্র তিন জনকে। তাদের মধ্যে Peter একজন – বিখ্যাত ‘Zazza’ গ্রন্থের জনক। বিবাহ সম্বন্ধে তার ধারণা অন্যরূপ তাই ১৮৮২ অব্দে এক গ্রীক ভাস্করকে বিবাহ করার আটমাস পরেই তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। তিনি বলতেন “বিবাহ আসলে পুলিশের অনুমোদিত বন্ধুত্ব ছাড়া আর কিছুই নয়।” প্রেমের গুরুত্ব কোনো দিনই তিনি উপলব্ধি করেন নি বা করতে চান নি।

তিনি একসময়ে বলেছিলেন ‘বন্ধুত্ব, যার অপর নাম প্রেম, সেটা হচ্ছে আর কিছুই নয়, শুধু স্ত্রীলোকের কাছ থেকে পুরুষের কতকগুলি সুবিধা আদায়ের ব্যবস্থা, আর স্ত্রীকে পুরুষের বশে আনবার সর্বশ্রেষ্ঠ অস্ত্র বা প্রলোভন। এই প্রেম যেন বিনা খরচায় হোটেলে বসে খানা খাওয়া, এতে বিনা পয়সায় গান শোনা, নাচ দেখা ও খাওয়া হয়। এক কথায় নারীর প্রতি পুরুষের প্রেম হলো পুরুষ পায় এমন কতকগুলো জিনিস যা-সব দাম দিলেও কিনতে পাওয়া যায় না আর সেইটিই পার্থিব লোকের কাছে সবচেয়ে কাম্য ও বড় জিনিস।”

পূর্ব্বোল্লিখিত তিনজন প্রেমিকের মধ্যে ‘The Odesa’, ‘Fedora’ প্রভৃতি গ্রন্থের লেখক ভিক্টোরিয়ান সাডনকে লিখেছিলেন, “জান কি তোমায় আমি কত ভালবাসি? হলুম বা আমি বিবাহিতা – কি আসে যায় তাতে? তুমি এ কথা ভেবো না অন্য় এক পুরুষের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে বলে তোমার প্রতি আমার ভালবাসা কমে গেছে – বিয়ে হয়েছে বলেই আগের মত তোমাকে আর ভালবাসি না! তা যদি ভেবে থাক তাহলে ভুল করেছ। আমি তোমার আগেও ছিলাম এখনও সম্পূর্ণ তোমারই। স্বামী এক জিনিস আর প্রেমিক অন্য় জিনিস, স্বামীকে ত্যাগ করা যায় কিন্তু প্রণয়ীকে যেন চোখের আড়াল করা যায় না।”

আশী বছর বয়সে তিনি মারা যান। চিঠি তাঁর অনেক। বর্তমান প্রবন্ধে পিটারকে লেখা কয়েকখানা পত্রের সারাংশ দেওয়া হল।

ওগো প্রিয়তম,

তুমি যখন চলে গেলে তখন আর থাকতে পারলাম না, বালিকার মত কেঁদে উঠলাম। তোমাকে যা বলেছি সে সব ভাবতে আমার কষ্ট হয় – সত্যই তার জন্য অনুতাপের আগুনে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছি – আমায় ক্ষমা কর। সময় সময় রূঢ় ভর্ৎসনা আপনা হতেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় কোনো রকমে তা চেপে রাখা যায় না। নারী যে প্রণয়িনী – প্রেমকেই জীবনের সার জ্ঞান করে প্রেমাস্পদকে যে নিজের সম্পূর্ণ সত্তা দিয়ে উপলব্ধি করতে চায় তার কাছে সমস্ত জগৎ প্রেমময় হয়ে ওঠে। আর সেই প্রেমের একটু ব্যতিক্রম হলেই মাঝে মাঝে তার নিজের অজ্ঞাতেই প্রণয়ীর প্রতি মৃদু ভর্ৎসনা স্বভাবতই হয়ে থাকে। তারপর অনুতাপ এসে মর্ম্মে আঘাত করে। তুমি চলে যাবার পর আমারও যে তাই হয়েছিল প্রিয়! আমি অভিমান বশে তোমার ওপর রাগ করে যে সব জিনিস বাইরে ফেলে দিয়েছিলাম সে সব আবার কুড়িয়ে এনে পরম যত্নে যেখানকার যা সব তুলে রেখেছি – আদর করে কত চুমা খেয়েছি।

ওগো প্রণেশ্বর, এস ফিরে এস! তুমি যেখানে গেছ সেখানে আর থেকো না, সে তোমার উপযুক্ত স্থান নয় – সে যে নরক। এস, আমি তোমার জন্য় স্বর্গ তৈরী করে রেখেছি – তোমার সিংহাসন শূন্য। এস, এস প্রিয়তম, সে শূন্য আসন পূর্ণ কর।

তুমি যে কাজ করেছ সে কি তোমার শোভা পায়! তুমি যদি আবার ভালবাসতে তাহলে কখনই এমন নিষ্ঠুর হতে পারতে না। যে ভালবাসতে জানে সে ভাল কাজও করতে পারে। তুমি যে রাগ করে রাত চারটার সময় ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে সে কাজ কি তোমার পক্ষে উচিত হয়েছে? আমি না হয় রাগের বশে তোমায় দুটো কটু কথা বলেছিলাম, তোমার দুটো একটা জিনিস বাইরে ফেলে দিয়েছিলাম, কিন্তু পুরুষ হয়ে আমায় একাকী রেখে তোমারও চলে যাওয়া কি ঠিক হয়েছে। আমি নারী, ক্রোধে অভিমানে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছিলাম বলে তোমারও কি কাজটা ঠিক হয়েছে? আমি বুঝতে পারি নি, আমায় ক্ষমা কর। কিন্তু আমার রাগ ও অভিমানের কি কোনই কারণ নেই? তোমাকে সেই মেয়েটির সঙ্গে প্রকাশ্যে দেখেই ত আমার নারীত্ব গর্জে উঠেছিল। আচ্ছা তুমিই বল তার বয়স তোমার চেয়ে দ্বিগুণ কিনা? তার সঙ্গে তোমার বিহার ও বিচরণ সত্যই জগতের লোককে আশ্চর্য করে দিয়েছে। এরকম সাহচর্যের কোনো মূল্য আছে কি?

তোমার যদি বস্তুতই কোনো লাভের আশা থাকত তাহলে তুমি তার সঙ্গে বেড়াও, কেউ তা বারণ করবে না। তোমার আর্থিক স্বার্থ যদি তার সঙ্গে জড়িত থাকত তবে না হয় লোকে ক্ষমার চক্ষে দেখত। তোমার যখন সে রকম কোনো উদ্দেশ্য ছিল না তখন বুড়ীর সঙ্গে বেড়ান, মেলামেশা তোমার উচিত হয় নাই। ধরে নিলাম তোমার কোনো উদ্দেশ্যই ছিল না, যা-কিছু ছিল তা ওই বৃদ্ধার। সে বৃদ্ধা হয়ত তোমার সঙ্গে কোনো বৈষয়িক পরামর্শ করছিল কিম্বা তোমাকে দিয়ে তার কোনো কাজ করিয়ে নেবার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু তাঁত নয় – কারণ, তাহলে বুড়ীর উচিত ছিল তোমার কাছে ভদ্রভাবে আসা, তোমার কাছে পরামর্শ চাওয়া! তার সাজশয্যার আড়ম্বর ও তার চালচলন শিক্ষিত মার্জিত রুচির ভদ্র মহিলার মতই হওয়া সমীচিন ছিল। কিন্তু একি! কি বিশ্রী তার রুচি! তার মত বয়সের মেয়েদের পোষাক সম্বন্ধে আরও মার্জিত হওয়া উচিত ছিল – শালীনতা বোধ থাকা একেবারে অসম্ভর নয়! কিন্তু সে-সব ত তার ছিল না, অধিকন্তু রাস্তায় যেতে ওরকম করে অল্প বয়সী ছেলেদের দিকে কামকলুষ নেত্রে তাকান মোটেই সভ্যসমাজের নয়। আমি বেশ লক্ষ্য করেছি তার চোখে ছিল লালসার দৃষ্টি! আমি শপথ করে বলতে পারি – আমার দৃঢ় বিশ্বাস সে মোটেই ভদ্র ও সম্ভ্রান্ত ঘরের নয়, সে কখনই ভদ্রপল্লীর নয় – খারাপ, কুলটা, বারবিলাসিনী সে। সুতরাং তার সঙ্গে তোমার চলাফেরা করতে দেখে আমার রাগ হতে পারে না কি? এ যে আমার নারীত্বকে অপমান করা! অবশ্য কাল তোমায় এত সব কথা বলে তোমার মনে আঘাত করবার ইচ্ছা আমার ছিল না। সত্য বলছি আমার সেই উদ্দেশ্য মোটেই নয়। কিন্তু তবু হঠাৎ কোথা থেকে কি হতে কি হয়ে গেল! আমি নারী হয়েও বলছি – কে ভাল আর কে মন্দ সে বিচার তোমার কাছে করাব না। প্রকৃত কথা বলতে কি, ভাল মন্দ চেনা বড় কঠিন; তাদের মধ্যে পার্থক্য আছে কি নেই সে বিচার করাও কঠিন। দুয়ের মধ্যে তফাৎ এই যে সুচরিত্রা যারা, তারা তাদের সাত জীবনের আদর্শ সামনে রেখে জীবনপথে এগিয়ে যায়, আর কুলটারা চলে ভবিষ্যতের দিকে পেছন ফিরে। সরল ভাষায় যারা ভাল তারা চায় যে তাদের সুনাম যেন বজায় থাকে, তাদের আছে আত্মসম্মান বোধ। আর মন্দেরা চায় বর্তমানেই সব ভোগ করে নিতে, ভবিষ্যতের কলঙ্ক ভয় তাদের হৃদয়কে বিচলিত করে না – অবশ্য এ আমার ব্যক্তিগত অভিমত। থাক সে কথা। তুমি ফিরে এস! তোমার সারা এখন চোখের জল সম্বল করে বেঁচে আছে! এস তাকে সান্ত্বনা দাও। হৃদয়ে আছে তার অনন্ত প্রেম আর তা তোমারই জন্য প্রিয়তম।

তোমার সারা

আর একখানি পত্র

পিটার, প্রিয়তম আমার,

অনেক রাত হয়েছে। খোলা জানালার ফাঁক দিয়ে ভোরের বাতাসের আমেজ আসছে। মনে হয় সকাল হতে আর বেশী দেরী নেই। বিশ্ব নিদ্রিত শুধু আমি জেগে আছি – তোমায় চিঠি লিখছি। তোমাকে প্রত্যহ কিছু না লিখে আমি ত ঘুমোতে পারি না।। আমার যৌবন উপবনের তুমি যে একটিমাত্র কুসুম। তোমার সংবাদ না নিয়ে কেমন করে আমি নিশ্চিন্ত থাকব প্রাণেশ্বর! তোমার ভাল লাগুক আর না লাগুক আমার যে তোমাকে বলতেই হবে – শুনে তোমার আনন্দ বা লাভ কিছু না হতে পারে কিন্তু আমার যে তাতে আনন্দ হবে প্রিয়তম! নিদ্রা? সে তো বিলাস, কর্তব্য ফেলে রেখে বিলাসব্যসনে সময় কাটান উচিত নয় তাই ত এত রাত্রেও তোমায় এক কলম না লিখে শয্যা গ্রহণ আমার পক্ষে অসম্ভব।

আমার সুখ – আমার গৌরব, আমার যা কিছু সম্পদ সবই তোমার সঙ্গে ভাগ করতে চাই। তুমি আমার সুখের অংশীদার না হলে যে আমার তৃপ্তি হয় না। তোমায় অংশ না দিয়ে কী ভোগ করতে পাবি? সবই তোমায় দিতে পারি, শুধু পারি না আমার দুখের অংশ তোমায় দিতে – সে তো আমার নিজস্ব। আমার ব্যথা বেদনা দুঃখ কাতরতা আমি পূর্ণমাত্রায় পেতে চাই – তোমায় কি তা দিতে পারি সে বিষয়ে আমি একান্ত স্বার্থপর। আমার দুঃখ ত তোমায় দেবই না, অধিকন্তু তোমার দুঃখের সবটুকুই আমি কেড়ে নিতে চাই।

তোমার সুখের পথের যত বাধা আমি দূর করে দিয়ে তোমার যাত্রাপথ সুগম করে তুলব। দুর্ভোগের প্রতিটি অন্তরায়, দুঃখের যত কিছু কণ্টক আামি নিজ হাতে উপড়ে ফেলে তোমার পথ পরিষ্কার করে দেব প্রাণাধিকে। তোমার কোমল চরণ পথের কাঁটায় যে ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাবে! মাটিতে হাঁটবার জন্য ত তোমার পা দুটির সৃষ্টি হয় নি দেব! নারীর কোমল হৃদয় মাড়িয়ে চলাতেই ত তাদের সার্থকতা। তোমার চলার পথ পরিষ্কার করে আমার হৃৎপিণ্ড টেনে আনব – বিছিয়ে দেব তোমার পথে – তুমি আসবে তাব উপর দিয়ে। ওগো দেবতা এস, তেমনি করে এস আমার কাছে। আমি হব দখিন হাওয়া – তোমার ক্লান্তি ঘুচিয়ে বয়ে আনব ফুলের সৌরভ, ছড়িয়ে দেব তোমার গায়ে, তুমি আসবে পূর্ণ মিলনান্দের স্বপ্নে বিভোর হয়ে। প্রতি পাদক্ষেপে যদি তুমি আমার ওপর নির্ভর না কর, তা হলে তোমার হৃদয়ে প্রেমের সঞ্চার করতে পারলাম কই? আহারে বিহারে শয়নে তন্দ্রায় জাগ্রতে তুমি যদি আমার বশ্যতা স্বীকার না করলে তবে বৃথাই আমার নারীজন্ম! নারী হয়ে পুরুষকে জয় করতে যদি না পারলাম তবে বৃথাই নারীত্ব।

“কেন এসব কথা লিখছি জান? আমি জানি এসব পড়ে তুমি নিশ্চয় অবাক হয়ে যাবে। আচ্ছা, তুমি কতবারই না বলেছ যে আমার প্রেম-বাস্তব প্রেম অর্থাৎ সম্পূর্ণ দৈহিক। তার উত্তরে আমি বলতে চাই যে প্রেম মাত্রই বস্তুতান্ত্রিক, জড় জগতে আধ্যাত্মিক প্রেম বলে কোনো কিছু আছে বিশ্বাস হয় না। নৈসর্গিক প্রেম নিসর্গেই সম্ভব, এখানে সম্ভব নয়। বস্তুতান্ত্রিক জীবন মরুভূমির মত – মানুষ এখানে পশুপ্রবৃত্তি প্রধান – আদিম প্রবৃত্তি তার মাজ্জাগত হয়ে আছে; আত্মরক্ষার যা কিছু অস্ত্র সবই ক্ষণভঙ্গুর, শারীরিক শক্তি বলে বেঁচে থাকার জন্য় অহর্নিশি দ্বন্দ্ব করতে হয় মানুষকে। সারাটা জীবন যদি দেহের চাহিদা মেটাবার কাছেই ব্যয় হয়ে যায় – অর্থাৎ বস্তুর অভাব পূর্ণ করতে কেটে যায় তবে স্বর্গীয় প্রেমের চর্চা করবার সময় কোথায়? আত্মা ত আর আশমানে থাকতে পারে না – দেহকে যখন তার আঁকড়ে থাকতেই হবে তখন দেহের চাহিদাকে (ক্ষুধাকে) আত্মারই ক্ষুধা বলে ধরে নিতে হবে। আত্মার কোনো সুযোগই এখানে নেই, আত্মার নিজস্ব কোনো জিনিসেরই অস্তিত্ব নেই। তার সুযোগ সুবিধা দূরের কথা সবটুকুই তার বাধা (বন্ধন)? আত্মা এখানে আসে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র ও অরক্ষিত হয়ে এবং জন্মগ্রহণের পর থেকে ঘটনার ঘাত প্রতিঘাতে সে একেবাবে অসহায় ও ভীত হয়ে পড়ে। আমার মনে হয় প্রকৃত যে আত্মা তা বহুপূর্বেই এ দেহটা ত্যাগ করে চলে যায় – যা থাকে তা শুধু প্রতিবিম্ব এবং মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বেই আবার সে তার পুরাতন আবাসে ফিরে এসে পুনর্জন্ম পর্যন্ত অপেক্ষা করে। দেহের শিরা উপশিরা রক্ত মাংস হাড় চক্ষু কর্ণ নাসা প্রভৃতি ইন্দ্রিয় – এগুলো তো আত্মা নয় প্রিয়তম।

আমার মতে এই বস্তুতান্ত্রিক জগতে আধ্যাত্মিক জীবন যাপন বা আত্মিক প্রেমের বিনাশ না করতে পারলে যদি মানুষকে শাস্তি পেতে হয় হবে তা আশ্চর্য নয় কি? মর্ত্যের মানবের কাছে নৈসর্গিক প্রেম আশা করাও মুর্খতা। তা হতে পারে না – হয় না।

আমরা ত তুচ্ছ ক্ষণস্থায়ী এই আছি এই নেই। পরিবর্তনশীল জগতের আমরা সামান্য় কণা মাত্র – আমরা কি চিরস্থায়ী কিছু করতে পেরেছি। কোথায় সে ব্যবিলন, কোথায় সেই দামস্কস? তাদের আসল প্রাণ ত কবে চলে গেছে শুধু ধ্বংসের স্তূপ। আমরা এখানে ধ্বংসের স্তূপ ও আবর্জনা সৃষ্টি করতে আসি। নিত্য পরিবর্তনশীল দেহের মধ্যে থেকে আত্মাই বা কি করে শাশ্বত অক্ষয় হতে পারে? সে শিক্ষা সে পাবে কোথা থেকে!

লিখতে লিখতে সকাল হয়ে গেল – সূৰ্য্য উঠেছে। চোখে দিনের আলো লেগে চোখ ঝলসে গেল – লেখা ছেড়ে শুতে যাচ্ছি। চিঠিতে কি লিখেছি না লিখেছি তা আর পড়ে দেখব না। কারণ সারারাত যে মন নিয়ে লিখেছি সে মন আর এখন নেই, সুতরাং ভাবের সামঞ্জস্য় রাখা আর আমার দ্বারা সম্ভব নয়, তাই পাছে চিঠিখানা অসমাপ্ত রয়েছে মনে হয়, সেই ভয়ে আর পড়ব না।

আমাকে দৈহিক প্রেমিকা বলে আর কোনোদিন উপহাস করো না। কারণ আমি তো বলেছি দৈহিক (বস্তুতান্ত্রিক) ছাড়া আর কোনো “ইকে”র স্থান এখানে নেই। যিনি এখানে দৈহিক ছাড়া আর কিছুর সন্ধান করতে আসবেন তিনিই ঠকবেন; ‘দৈহিক’ ছাড়া আর যা কিছু করতে যাওয়া মানে বৃথা সময় নষ্ট করা। আমাকে আর কিছু বলো না – উপদেশ দেওয়া বৃথা, আমি এইটুকু জানি বা বুঝি যে আমি তোমায় ভালবাসি। আমি চাই না যে তুমিও প্রতিদান স্বরূপ আমাকে ভালবাস – সে দাবী আমার নেই। তবে এই অনুরোধ যে তুমি যেন আমার এই ভালবাসা প্রত্যখ্যান করো না। ওগো তোমাকে ভালবাসার অধিকারটুকু যেন আমার থাকে! আর যদি একান্ত ভালবাসতেই হয় তবে “দৈহিক” ভালবাসাই আমার আকাঙ্ক্ষা। তোমাকে আমি যা দিচ্ছি তার বেশী আর তোমার কাছে চাইবার অধিকার বা আশা আমার নেই! তুমি যে দয়া করে তোমাকে ভালবাসার অনুমতি দিয়েছ তাই আমার যথেষ্ট। আমার এই প্রেম (দেহজ) তুমি যে ভাবে ইচ্ছা পরখ করে নাও

তুমি হয়ত ভাবছ এ কথা ত তোমায় মুখেই বলতে পারতাম – মিছামিছি চিঠি লেখা কেন? তার উত্তরে আমি বলব, যে সব কথা তোমার কাছে মুখ ফুটে বলতে পারি না সেই সব কথাই তোমায় পত্রে লিখে জানাচ্ছি – জানই ত মেয়ে মানুষের বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে না। যা বলতে পারি না তাই লিখি, আবার যা লিখতে পারি না তাই বলি। এতে তোমারই তো লাভ প্রিয়তম। আমার কথা ত তুমি সব সময় শুনতে পাও না, তাই যখনই ইচ্ছা হবে তুমি চিঠিখানি খুলে পড়বে, আমার গোপন মনের কথা শুনতে ও জানতে পারবে – ঠিক কি না?

আজ রাত্রে তুমি এসো, তোমার ‘সারা’কে তোমার দুই বাহুর আলিঙ্গনে ধন্য করে তোল। তার বদলে ‘সারা’ তোমায় দেবে তার হৃদয়-তার দেহ-দেবে তোমাকে অজস্র চুম্বনোপহার, কেমন? তুমি ঘুমুবে, ‘সারা’ চুমায় চুমায় তোমার ঘুম ভাঙ্গবে। সেকি আমার পক্ষে দুরাশা প্রাণেশ্বর – তোমার এক কণা অনুগ্রহ কি আমি আশা করতে পারি না? তোমার একটুখানি আলিঙ্গন, তোমার একটু প্রেম আমার জীবনের একমাত্র সম্বল হয়ে থাকবে।

অপর একখানা পত্র।

পিটার, প্রিয় আমার,

কেন আমরা সর্ব্বদা একসঙ্গে থাকতে পাই না! সকালে ঘুম ভেঙ্গে তোমার সুন্দর মুখখানি প্রত্যহ কেন দেখতে পাই না! ঘুম ভাঙ্গতেই তোমায় না দেখে যেন আমার কাছে সমস্ত জগত মরুভূমি বোধ হচ্ছে, সূর্য উঠেছে – তার সোনালী আলোক চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে – নিৰ্ম্মল আকাশ নীল – বাতাস ফুলের গন্ধ বয়ে নিয়ে আসছে। কিন্তু এ সব আমার কাছে মূল্যহীন। তোমার অভাবে সবই ম্লান, নিষ্প্রাণ। কেন এমন হয়? তোমার বিহনে জীবন আমার নীরস, কি সার্থকতা আছে এসবের যদি তুমি আমার কাছে না থাক প্রিয়তম! মাত্র দশটি দিন আগে তুমি আমায় চুমো দিয়ে এখান থেকে চলে গেছ, কিন্তু এই দশ দিন আমার কাছে দশযুগ বলে মনে হচ্ছে। তুমি ছাড়া আমার যত প্রিয়জন আছে তাদের বিরহ আমি অনায়াসে সহয় করতে পারি, তাদের সহজে ভুলতে পারি – আর তাদের ভুলে যাওয়াই আমার উচিত – কিন্তু প্রাণাধিক তোমার ক্ষণেকের অদর্শন যে আমার সহ্য হয় না; কেমন করে আমি বেঁচে থাকব।

তুমি এস! আসবার আগে আমায় ‘তার’ করে সংবাদ দিও। আমি তোমার জন্য সব তৈরী করে রাখব। তোমার জন্য প্রস্তুত রাখব সুরা, আর আমার বাহুযুগল তো তোমাকে ব্যগ্র আলিঙ্গনে কাছে টেনে নিতে সর্ব্বদাই উৎসুক হয়ে আছে প্রিয়, তোমার ‘সারা’ জীবনে মরণে তোমারি।

সন্ধ্যাবেলা খোলা জানালার সামনে থেকে দিনের আলো সরে যাচ্ছে – আলো ছায়ার খেলা – আকাশে একটি একটি করে লক্ষ কোটি নক্ষত্র ফুটে উঠছে। আমি নিতান্ত একা বসে বসে প্রেমের অর্ঘ রচনা করছি তোমারই জন্ম প্রিয়। কি ভাবছি জান? ভাবছি মানুষ কি করে একজন আর একজনের অন্তরে মিশে যেতে পাবে!

রাত্রি আসছে – হাতে তার চমৎকার বরণডালা, বাতাসে তার মিলনের মোহন মদিরা – তোমাকে অভিনন্দন করবে প্রাণাধিক! তুমি এস, তোমার আগমনে ফুলে ফুলে জাগবে শিহরণ – ধরণীর প্রতিটি অণু-পরমাণুতে জাগবে প্রাণের স্পন্দন! আমার সব আশা, সমস্ত স্বপ্ন সফল করতে তুমি আমার কাছে চলে এস। তোমার ক্লান্তি, তোমার অবসাদ দূর করতে ওখানে কেউ নেই – তোমার ‘সারা’ যেখানে নেই সেখানে কে আদর কবে তোমার চাঁদমুখে এঁকে দেবে চুম্বনের রেখা?

আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছ? বেশী কি আর লিখব প্রিয়তম, এস শুধু তুমি এসে আমায় বাঁচাও!

তোমারই ‘সারা’

পিটার লিখছেন –

তোমার চিঠি পেলাম। এ রকম পত্র দিয়ে আমার বিরহী অন্তরকে আরও ব্যথাতুর করো কেন? তুমি কি মনে কর তোমার জন্য আমার একটুও ভাবনা হয় না? হয় – তোমার জন্যই আমাব সব।

তোমার হোটেলের বিল কত হয়েছে জানি না। ….. ফ্রাঙ্ক পাঠালাম, দয়া করে নিয়ে আমাকে ও আমার অর্থকে ধন্য করো। তোমার পরপত্রের আশায় রইলাম। চুমা নিও!

পিটার

অভিনেত্রী ‘সারা’ – নিশীথে মিলন তাঁর ভাগ্যে খুবই কম। অধিকাংশ রাত্রেই অভিনয়ের জন্য তাঁকে পিটারের সঙ্গ ত্যাগ করতে হয়েছে। একদিন অভিনয়ের পর মিলনের আকাঙ্খা যখম দুর্ব্বার হয়ে উঠল তখন ‘সারা’ পিটারকে চিঠি লিখতে আরম্ভ করলেন :

হৃদয়েশ্বর। এ মধু যামিনিতে আজ তুমি কোথায়? কত দূরে? সে কোন জগতে তোমাকে পেয়ে যে স্বর্গে পরিণত হয়েছে? তোমার রাতুল পদপাতে কোথাকার পথঘাট আজ পবিত্র হয়ে উঠেছে, তোমার সুগন্ধ নিশ্বাসে কোথাকার বায়ু আজ সুরভিত হয়ে উঠেছে প্রিয়তম। তোমার নীল পশমী চুলে কোন সে ভাগ্যবতীর পরশ? তোমার প্রতিটি অঙ্গ কার পরশে আজ সচেতন হয়ে উঠেছে সখা?

ভাবতেও আজ আমার শরীর শিউরে উঠছে? তুমি যে আমার কাছে নেই – এ যেন আমার ধারণারও অতীত। সেদিন যখন তোমার আলিঙ্গন পাশ থেকে মুক্ত হয়ে কর্তব্যের আহ্বানে চলে আসি, সেদিনকার তোমার প্রেম নিবেদন আমি ভুলতে পারি নি দেব! সমস্ত পথ তোমার কথাই ভাবতে ভাবতে এসেছি – প্রতি পাদক্ষেপে তোমার সুন্দর মুখ আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে, আজ আর এই গভীর রাত্রে বাইরের নিস্তব্ধতার পটভূমিতে তা আরও ভাস্বর হয়ে উঠেছে। তোমার ছবিখানি চোখে চোখে রেখেছি। তুমি যে আমার থেকে আজ অনেক দূরে সরে আছ সে কথা ভাবতে ভাবতে আমার মাথা ঘুরে আসে, পাগল হয়ে যাই।

তোমার ভ্রুভঙ্গি – তোমার চাহনি আমার সবটুকু সত্তা হরণ করে নিয়েছে, তাই এখানে এসেও তোমার প্রভাব আমি অতিক্রম করতে পারি নি। আমার কেশ ও বেশের পারিপাট্য তোমার মনোমত করে আজও আমি সমাধা করি। তুমি যে মাথার কাঁটা দুটি দিয়েছিলে তা আমি এখানেও ব্যবহার করি। তোমার পছন্দ করা রং-এর জামা এখানেও আমার অঙ্গের শোভা বর্ধন করে। তোমার প্রতিটি আদেশ আমি বর্ণে বর্ণে পালন করি – তুমি আমায় ভুলো না কিন্তু!

ভোমাকে আর কি বলব? বলবার কিছু নেই। শুধু এইটুকু প্রার্থনা যে হর্ম্ম্যকিরিটিনী, বিলাসের লীলাভূমি প্যারিতে থেকে সুদূর পল্লীর নাট্যশালার নটীকে যেন ভুলে যেও না! তোমার সারা যে তোমার প্রেমে উন্মাদিনী তাকে ভুলো না, রোজ একখানা করে চিঠি দিও।

সারা

পিটারের জবাব :

প্রাণেশ্বরী,

কেন তোমার এত ভয়? তোমাকে ভুলব? সে কি সম্ভব! তুমি যে পিটারের প্রাণ অপেক্ষাও প্রিয়! জগতে কে এমন নিষ্ঠুর পুরুষ আছে – কে এমন বেরসিক যে তোমার প্রেম প্রত্যাখ্যান করবে? যার অঙ্গুলি হেলনে মুহূর্তে সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যায় – যার কৃপাকটাক্ষের আশায় সমস্ত জগৎ ব্যাকুল উৎসুক নেত্রে চেয়ে, তাকে হৃদয়েশ্বরী করে এমন ভাগ্যবান আর কে?

প্যারী! তুচ্ছ প্যারী! তোমার অবর্তমানে প্যারী ত তুচ্ছ, দেবতার অমরাবতীও ম্লান নিরানন্দ বোধ হয়। আর তুমি যেখানে থাকবে সে ঠাঁই পূতিগন্ধময় নরক হলেও আমার কাছে তা স্বর্গ – তা কি তুমি বোঝো না?

তোমার কথা পড়তে বা শুনতে আমার ভাল লাগে। তাই তোমার লেখার চেয়ে তোমার দেখা পেলে আর কিছু বলতে বা লিখতে পারি না। চিঠি তাই এত সংক্ষেপে – রাগ করো না!

পিটার

(FAQ) সারা বার্নহার্ডের প্রেমপত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. সারা বার্নহার্ড কে ছিলেন?

ফ্রান্সের বিখ্যাত মঞ্চ ও চলচ্চিত্র অভিনেত্রী।

২. সারা বার্নহার্ডের প্রেমিকদের নাম কী?

ভিক্টোরিয়ান সাডন, পিটার বার্টন।

৩. সারা বার্নহার্ড তার বেশিরভাগ প্রেমপত্র কাকে লেখেন?

পিটার বার্টনকে।

Leave a Comment