পেস্তালৎসি

একজন সুইস শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষাতাত্ত্বিক ছিলেন ইয়োহান হাইনরিখ পেস্তালৎসি (Johann Heinrich Pestalozzi)। তিনি অষ্টাদশ শতকের শিক্ষা সংস্কারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এবং মানবিক ও শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষাপদ্ধতির প্রবক্তা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। পেস্তালৎসি বিশ্বাস করতেন যে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হল শিশুর হৃদয়, মন এবং হাতে সমন্বিতভাবে বিকাশ ঘটানো। তাঁর শিক্ষাপদ্ধতি প্রকৃতিনির্ভর, অভিজ্ঞতাভিত্তিক এবং স্বতঃস্ফূর্ত শিক্ষার উপর জোর দেয়।

পেস্তালৎসি

ঐতিহাসিক চরিত্রপেস্তালৎসি
পুরো নামইয়োহান হাইনরিখ পেস্তালৎসি
জন্ম১১ জানুয়ারি ১৭৪৬ খ্রি
জন্মস্থানজুরিখ, সুইজারল্যান্ড
পেশাশিক্ষাবিদ, শিক্ষাতাত্ত্বিক
শিক্ষদর্শনহৃদয়, মন এবং হাতে সমন্বিত বিকাশ
উল্লেখযোগ্য কাজপ্রকৃতি শিক্ষা, অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা
গ্রন্থLeonard and Gertrude, How Gertrude Teaches her children
প্রধান অবদানশিশুকেন্দ্রিক শিক্ষাপদ্ধতির প্রবর্তন
মৃত্যু১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৮২৭ খ্রি

পেস্তালৎসি

ভূমিকা :- যুগে যুগে দেশে দেশে শিশুদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে মনীষীরা চিন্তা ভাবনা করেছেন। যাকে শিক্ষা দিতে হবে তার সম্পর্কে কি পদ্ধতিতে কোন কোন বিষয় শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে ইত্যাকার বহুবিধ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়েই আজও যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চলছে নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা। অতি পুরনো এই বিষয়ে ইউরোপ-এ প্রথম যিনি নতুন করে পথ প্রদর্শন করেছিলেন, একটি আদর্শ শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য জীবনপাত সংগ্রাম করে গেছেন, অথচ নিজের জীবনে তার সফল প্রয়োগ দেখে যেতে পারেন নি, তাঁর কথাই এখানে বলবার চেষ্টা করব। প্রাতঃস্মরণীয় সেই মহান শিক্ষাগুরুর নাম পেস্তালৎসি। আশ্চর্য যে, তাঁর প্রদর্শিত প্রণালীকে আদর্শ করেই আজ জগতে শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার হয়ে চলেছে।

জীবনের প্রথম পর্বের শিক্ষা

মানব সমাজে এমন বহুবিধ নিয়ম-নীতি সুযোগ-সুবিধা ক্রিয়াশীল রয়েছে, যা সভ্যতার নিয়ামক রূপে গণ্য হয়ে থাকে। এমনই একটি বিষয় হল শিশুদের শিক্ষা ব্যবস্থা। আজকের শিশু আগামী দিনের দেশের ভবিষ্যৎ। প্রতিটি জাতির পক্ষেই শিক্ষায় সহবতে সুষ্ঠুভাবে শিশুর জীবন গঠন এক সুমহান দায়িত্ব। প্রকৃত শিক্ষাই মানুষের মনকে সজাগ সচেতন করে তোলে। সত্য ও সুন্দরকে ভালবাসতে শেখায়। তাই জীবনের প্রথম পর্বের শিক্ষা অতি গুরুত্বপূর্ণ।

পেস্তালৎসির জন্ম

১৭৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ জানুয়ারী জুরিখে পেস্তালৎসি জন্মগ্রহণ করেন। অতি সাধারণ এক পরিবারে জন্মে অতি সাধারণ অবস্থাতেই সারাজীবন দুঃখকষ্টের সঙ্গে কঠোর সংগ্রাম করেছেন তিনি। তাই তাঁর জীবনের অনেক বিষয়ই আজও রয়ে গেছে অজানা।

শিক্ষাগুরু পেস্তালৎসির শৈশব

বাল্য শৈশব কেমন কেটেছে, কোথায় শিক্ষালাভ করেছেন, এসব বিষয় এতদিন পরে অনুমান নির্ভর। তবে তাঁর পরবর্তী জীবনে তিনি নিজের সম্পর্কে যে ধারণা দিয়েছেন নানা লেখায় তাতে বোঝা যায়, তাঁদের তিন ভাইবোনের শিক্ষার বিষয়ে মা বাবা উভয়েই ছিলেন খুবই সজাগ। বিশেষ করে মায়ের প্রভাব পেস্তালৎসির জীবনে খুবই গভীর হয়েছিল।

পেস্তালৎসির মূল্যবান শিক্ষা লাভ

  • (১) মাত্র আঠারো বছর বয়সে পিতৃহারা হন তিনি। ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিধবা মা সংসারে একেবারে অসহায় হয়ে পড়েন। কিন্তু তিনি ছিলেন এক অসাধারণ নারী। দূরবস্থার মধ্যেও কখনো মনোবল হারান নি। অপার স্নেহে ও সতর্ক যত্নে সন্তানদের মানুষ করত লাগলেন। বাবার মৃত্যুর পর মায়ের জীবন ও বাড়ির অভিজ্ঞতা থেকে পেস্তালৎসি মূল্যবান শিক্ষা লাভ করেন। এই শিক্ষাই তিনি আজীবন মানুষকে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন।
  • (২) এ সম্পর্কে তিনি বলতেন, ‘মায়ের মতো শিক্ষক পৃথিবীতে আর কেউ হতে পারে না। স্নেহময় পিতা তাঁর সন্তানকে যে দৃষ্টিতে দেখেন, শিক্ষকের উচিত ছাত্রকে সেভাবে দেখা। লেখাপড়া শেখার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস হচ্ছে, স্নেহ এবং ভালবাসা।’ বস্তুতঃ যেসব বিষয়ের ওপরে শিক্ষার ভিত দাঁড়িয়ে, সেই বিষয়গুলোই নতুন করে তুলে ধরেছিলেন তিনি।

কারারুদ্ধ পেস্তালৎসি

উনিশ বছর বয়সে খবরের কাগজে পেস্তালৎসির একটি সমালোচনামূলক রচনা ছাপা হয়েছিল। তাঁর বক্তব্য ক্ষমতাসীন সরকারের নীতিবিরুদ্ধ ছিল। ফলে রাজদ্রোহের অপরাধে এই সময় তাঁকে সাময়িকভাবে কারারুদ্ধ হতে হয়।

কৃষকদের অসহায়তায় পেস্তালৎসির পীড়া

দরিদ্র কৃষকেরা সমস্ত জমিদারদের দ্বারা শোষিত হত। প্রতিবাদের ভাষা ছিল না তাদের মুখে, বুকে ছিল না সাহস। দরিদ্র কৃষকদের অসহায়তা পেস্তালৎসিকে পীড়া দিত। তাদের স্বার্থরক্ষার চিন্তায় খুবই অধীর হয়ে উঠেছিলেন তিনি।

পেস্তালৎসির আইনের শিক্ষা লাভের ইচ্ছা

কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি স্থির করলেন আইনের শিক্ষা নেবেন। তাহলে আদালতে কৃষকদের স্বার্থের সমর্থনে দাঁড়াতে পারবেন। এই সময় ইউরোপের মহৎ চিন্তার উদ্গাতা, মানবতার পূজারী দার্শনিক রুশোর কিছু লেখা পড়ে পেস্তালৎসির জীবনের মোড় ঘুরে গেল।

দার্শনিক রুশোর প্রচার

রুশো প্রচার করেছিলেন, সভ্যতার আড়ম্বর মানুষকে প্রকৃতির থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, দুঃখ তার তাই হয়েছে নিত্যসঙ্গী। সভ্যতার নানা আসবাব ত্যাগ করে মানুষকে প্রকৃতির মধ্যে ফিরে যেতে হবে। জীবনযাত্রার প্রয়োজনে যেটুকু দরকার তাই নিয়েই তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে।

চাষবাসের কাজে পেস্তালৎসি

সেই কালে রুশোর এই শিক্ষার প্রভাবে অনেক মানুষেরই জীবনধারা পাল্টে গিয়েছিল। পেস্তালৎসিও রুশোর লেখা পড়ে আইন পড়ার বাসনা ত্যাগ করলেন। ফিরে গেলেন গ্রামে, সামান্য কিছু জমির ব্যবস্থা করে চাষবাসের কাজে মন দিলেন।

পেস্তালৎসির বিবাহ ও সংসার

এই সময়ে এক অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। যথাসময়ে তাঁর একটি ছেলে হল। ছেলেটি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছেলের লেখাপড়ার কি ব্যবস্থা করবেন সে বিষয়ে ভাবনা চিন্তা করতে লাগলেন। তাঁরা তিন ভাইবোন শৈশবে মা ও বাবার স্নেহচ্ছায়ায় শিক্ষালাভ করেছেন। সেই স্মৃতি তাঁর মধ্যে সজাগ ছিল। নিজের ছেলের শিক্ষার প্রসঙ্গে তাঁর মনে হল অন্য সব ছেলেরও ভাল করে লেখাপড়া শেখার একটা ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি সম্পর্কে পেস্তালৎসির মত

প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটিগুলি কৈশোরেই তাঁর চোখে স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়েছিল। বাড়িতে স্কুলে জোর করে, বেতের ভয় দেখিয়ে যেভাবে নানা বিষয় শেখাবার চেষ্টা করা হয়, তার ফলে শিশুমনের অকাল মৃত্যু ঘটে। কেউ বুঝতে চায় না যে কয়েকটা কথা শেখাবার জন্য, এত পরিশ্রম করে, অর্থব্যয় করে যা করা হচ্ছে তার পরিণাম কি দাঁড়াচ্ছে।

আশ্রম খুললেন পেস্তালৎসি

অনভিপ্রেত বোঝার চাপে শিশুদের স্বাভাবিক মনটি মরে যায় বলে তারা শেখানো কথা মনে রাখতে পারে না। মনে থাকলেও জীবনে কোন কাজে লাগে না। জীবনে যা কাজে লাগে না সে শিক্ষার প্রয়োজন কতটুকু? পেস্তালৎসি ভাবতে লাগলেন কোমল মনটি মেরে না ফেলে কি করে ছেলেকে মানুষ করা যায়। শেষ পর্যন্ত তিনি মনস্থির করে ফেললেন। স্ত্রীর যা টাকাকড়ি ছিল তা দিয়ে একটা আশ্রম খুলে ফেললেন। বাড়ি বাড়ি ঘুরে অনুনয় বিনয় করে কুড়িটি ছেলেও জোগাড় করলেন। তাদের বাড়িতে রেখে পুত্রস্নেহে নিজের মনের মতো করে লেখাপড়া শেখাতে লাগলেন।

পেস্তালৎসির স্কুল বন্ধ

কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, পেস্তালৎসির শিক্ষাপ্রণালী তাঁর ছাত্রদের অভিভাবকদের পছন্দ হল না। তিনি লেখাপড়া শেখানোর নামে ছেলেদের নিয়ে খেলাতেই মেতে থাকেন। এই অভিযোগ তুলে কুড়িটি ছেলেকেই একে একে তাঁরা তাঁর কাছ থেকে নিয়ে গেলেন। লেখাপড়া শিখতে এসে বাচ্চারা যদি কেবল খেলাই শিখতে পায় তাহলে কোন অভিভাবক আর তা মেনে নিতে পারেন? কিন্তু পেস্তালৎসির কাছে এ ছিল দামী খেলা। তার পেছনেই দেখতে দেখতে তাঁর সর্বস্ব ব্যয় হল। শেষ পর্যন্ত স্কুলটাও উঠে গেল। তারপর এই দুঃসাহসী স্কুল মাস্টারের খোঁজখবর আর কেউ পায় নি দীর্ঘ আঠারোটি বছর।

নিভৃত নিবাসে পেস্তালৎসি

কেবল ভিটেমাটিটুকুই যা সম্বল বলতে ছিল। দুবেলা নিয়মিত খেতেও তাঁরা পেতেন না। বাইরে বেরুবার উপযুক্ত পোশাকও তাঁর থাকতো না। তবুও সত্যিকারের মানুষ গড়ার শিক্ষার ব্যবস্থা কি করে করা যায়, সেই ভাবনা একদিনের জন্যও তিনি ভুলতে পারেন নি। ধ্যানরত যোগীর মতো দীর্ঘ আঠারো বছর ধরে নিভৃত নিবাসে থেকে কেবলই ভেবেছেন।

গল্প রচনায় পেস্তালৎসি

তারপর একদিন কলম ধরলেন। তাঁর সমস্ত চিন্তা ভাবনার কথা গল্পের ছলে লিখলেন। জার্মান ভাষায় লিখিত তাঁর এই বইটির নাম Leonard and Gertrude, এই বইতে তিনি লিখেছেন, Gertrude নামের একটি মেয়ে কি করে ধীরে ধীরে তার স্বামীর মনোভাব বদল করল, আর নিজের সংসারের সঙ্গে গোটা গ্রামেই নিয়ে এল এক নতুন জীবন। সেই স্বর্গীয় পরিবেশে গ্রামের ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে উঠতে লাগল দেবশিশুদের মতো। বইটি প্রকাশিত হলে কোন কোন মহলে প্রশংসিত হল। সুইস সরকার একটি সোনার মেডেল দিয়ে তাঁকে পুরস্কৃত করল। পেস্তালৎসির তখন সংসারের অন্ন সংস্থানেরই সঙ্গতি নেই। তাই পুরস্কার পাওয়া মেডেলটি বিক্রি করে দিতে হল খাবার কেনার জনা।

শিক্ষা সম্বন্ধে পেস্তালৎসির ছোট ছোট বই রচনা

পুরস্কারে উৎসাহিত হয়ে এরপর তিনি শিক্ষা সম্বন্ধে তাঁর মতগুলি নিয়ে ছোট ছোট বই লিখতে লাগলেন। তাঁর ধারণা ছিল, শিশুদের শিক্ষার বিষয়ে নিজের চিন্তাভাবনা অনুযায়ী কাজ করার একটা সুযোগ কোন না কোন ভাবে পেয়ে যাবেন। প্রয়োজন কিছু অর্থের। তাহলেই তাঁর ধারণাকে তিনি সত্যে রূপ দিতে পারেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বইগুলো সমাদর পেল না। কোন লোকও এগিয়ে এল না তাঁকে সহযোগিতা করতে।

ফরাসীদের দখলে সুইজারল্যান্ড

সেই সময়েই ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে দেখা দিল রাজনৈতিক বিপর্যয়। ফরাসীরা সুইজারল্যান্ড আক্রমণ করে বসল। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর সুইজারল্যাণ্ডের পতন হল, ফ্রান্স-এর দখলে গেল দেশ। যুদ্ধের ফলে অনেক শিশুই অনাথ হয়ে পড়েছিল। ফরাসী সরকার এই শিশুদের Stanz নামক জায়গায় একটা শিবিরে নিয়ে তুলল।

যুদ্ধবন্দী শিশুদের শিবিরে পেস্তালৎসি

পেস্তালৎসি একদিন জানতে পারলেন শিবিরের শিশুদের দেখাশুনা করার জন্য উপযুক্ত লোকের সন্ধান করা হচ্ছে। আশান্বিত হয়ে উঠলেন তিনি। নিজের ধারণাকে সত্যি করে তোলার এই তো পরম সুযোগ। এই সুযোগ হাতছাড়া হতে দিলেন না পেস্তালৎসি। ধরা-করা করে কাজটি নিলেন। শিবিরের ছেলেমেয়েদের নিয়ে এরপর তিনি নেমে পড়লেন কাজে। তাঁর প্রাণপাত পরিশ্রমের ফলে কয়েকমাসের মধ্যেই ছেলেমেয়েদের শিক্ষা সহবতের অভাবনীয় উন্নতি ঘটল।

বাড়ি ফিরে এলেন পেস্তালৎসি

তদারকে এসে সরকারী প্রতিনিধি বিস্মিত হলেন এবং পেস্তালৎসির শিক্ষা প্রণালীর প্রশংসা করলেন। কিন্তু ভাগ্য মন্দ পেস্তালৎসির। কিছুদিন পরেই তাঁকে সেই শিবির ত্যাগ করতে হল। যুদ্ধের প্রয়োজনের মুখে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার বিষয়টার কোনো গুরুত্ব রইল না। অনাথ শিশুদের শিবিরে করা হল আহত সৈনিকদের হাসপাতাল নিরাশ হয়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে এলেন পেস্তালৎসি। সামান্য সময়ের জন্য হলেও তিনি তাঁর ধ্যান-ধারণাকে রূপ দিতে পেরেছিলেন। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর শিক্ষাপ্রণালী কেবল মিথ্যা কল্পনা মাত্র নয়।

নেপোলিয়নের সাথে পেস্তালৎসির সাক্ষাৎ

সাফল্যের আনন্দে এই সময় এক অসম্ভব কাজ করে বসলেন তিনি। বহু চেষ্টা করে নেপোলিয়ন-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর শিক্ষাপ্রণালী তাঁকে বুঝিয়ে বললেন। কিন্তু রণোন্মাদ সমরনায়ক সেদিন তাঁর যুদ্ধজয়ের উন্মাদনায় বিভোর ছিলেন। কোন স্কুলমাস্টারের তুচ্ছ শিক্ষাপ্রণালীর স্থান কোথায় সেখানে? নেপোলিয়ন সরাসরি বলে দিলেন, এ.বি.সি নিয়ে ভাবনার সময় আমার এখন নেই।

পেস্তালৎসির সুমহান কর্তব্য

তবুও আশা ছাড়লেন না পেস্তালৎসি। তাঁর উদার দূরদৃষ্টি যে কোনও ক্ষুদ্র সীমারেখায় আবদ্ধ ছিল না। তা দেশ জাতির পরিধি অতিক্রম করে মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ গতিপথ আলোকিত করছিল। তিনি মনেপ্রাণে উপলব্ধি করতে পারতেন, মহাকালের রথচক্রতলে সবকিছুই একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষার আলো অবিনশ্বর। তার গতিধারা কেউ রোধ করতে পারে না। আর অনাগত দিনে সমাজ, জাতি, দেশ, সভ্যতার ধারক বাহক যারা হবে, বর্তমানের সেই শিশুদের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা এক সুমহান কর্তব্য।

নিজের সংকল্পে অনড় পেস্তালৎসি

সেই কর্তব্যবোধের প্রেরণাতেই তিনি দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ফলপ্রসু শিক্ষাপ্রণালী নিয়ে চিন্তা ভাবনায় ডুবে থেকেছেন। নিজের চিন্তাকে রূপ দিতে গিয়ে হয়েছেন সর্বস্বান্ত। পেয়েছেন মানুষের অবজ্ঞা অবহেলা। তবু নিরস্ত হন নি। নিজের মতামত দেশের লোককে জানাবার জন্য লিখেছেন বই কেউ তাঁর কথায় সাড়া দেয় নি। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসে নি পেস্তালৎসি নিজের সংকল্পে ছিলেন অনড়। কেউ মানুক না মানুক, তাঁর কথা জগৎকে শোনাতে হবে, বোঝাতে হবে। চেষ্টায় নিরত না থেকে তাঁর যে স্বস্তি নেই।

পেস্তালৎসির সমাদৃত বই

আবার কলম তুলে নিলেন পেস্তালৎসি। আগের বইখানির সঙ্গে যোগ রেখে Gertrude-এর কাহিনীই রচনা করলেন। এ বইয়ের নাম দিলেন How Gertrude Teaches her children. তিনি নিজে যে পদ্ধতিতে ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দিয়েছেন তাই বিশদভাবে তুলে ধরলেন Gertrude-এর মধ্য দিয়ে। এবারে অনাদৃত হলেন না। বইখানি শিক্ষিত মহলে সমাদৃত হল। দেশের পণ্ডিতজনেরা তাঁর শিক্ষাপ্রণালী নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন। এবারে দুঃখের বোঝা কিছুটা লাঘব হল। সেই সঙ্গে সংসারের অভাবও অনেকটা ঘুচল।

ছাত্রদের শিক্ষাদানে রত পেস্তালৎসি

পেস্তালৎসি ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে Yverdune-এ একটা স্কুল খুললেন। এবারে আর ছাত্রের জন্য দোরে দোরে ধন্না দিতে হল না আগের মতো। সমাদৃত বইয়ের কল্যাণে অবস্থার অনেকটাই পরিবর্তন ঘটেছিল। একটি দুটি করে বেশ কিছু ছাত্রও জুটে গেল। প্রাণমন ঢেলে নিজস্ব পদ্ধতিতে ছাত্রদের শিক্ষা দিতে লাগলেন তিনি।

শিক্ষক হিসাবে পেস্তালৎসি সুখ্যাতি

শিক্ষক হিসাবে পেস্তালৎসি সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে দেরি হল না। দিনে দিনে ছাত্রের সংখ্যার সঙ্গে তাঁর স্কুলেরও উন্নতি হতে লাগল। এক এক করে সেই স্কুল নিয়েই কেটে গেল কুড়িটি বছর। ততদিনে ইউরোপের দেশে দেশে পরিচিতি লাভ করলেন পেস্তালৎসি। তাঁর শিক্ষাপ্রণালী শিখবার জন্য নানা দেশ থেকে লোক আসতে লাগল তাঁর কাছে। দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে গেল তাঁর চিন্তার ফসল, সাফল্যের গৌরব।

পেস্তালৎসির জীবনে নৈরাশ্য

নানা উত্থানপতনের মধ্যে দিয়েই সারা জীবনের পথ হেঁটেছেন পেস্তালৎসি। সৌভাগ্য তাঁর কোন দিনই স্থায়ী হয় নি। এবারেও হল না। কুড়ি বছর একাদিক্রমে চলার পর একদিন নানা কারণে Yverdune-এর স্কুলটিও উঠে গেল। তীব্র নৈরাশ্যে ভেঙ্গে পড়লেন তিনি।

শিশু শিক্ষক পেস্তালৎসির মৃত্যু

বুকভরা বেদনা নিয়ে ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে ফিরে এলেন নিজের গ্রামে। তাপর নিঃশব্দে একদিন বিদায় নিলেন পৃথিবী থেকে।

উপসংহার :- ছেলেমেয়েদের আদর্শ মানুষ করে গড়ে তুলবার যে প্রণালী পেস্তালৎসি বলে গেছেন, পৃথিবীর মানুষ কিন্তু তাকে অবজ্ঞা করতে পারে নি। সময়ের বিবর্তনে তাঁর অনেক পদ্ধতিই আজ বাতিল হয়ে গেছে। কিন্তু তাঁর মূল বিষয়গুলোই আজও জগতের শিশু শিক্ষার প্রণালী নিয়ন্ত্রণ করছে। পেস্তালৎসির শিক্ষাপ্রণালীর প্রধান কথাই হল, যাকে শিক্ষা দিতে হবে, শিক্ষককে সবার আগে সেই ছাত্রের মন মানসিকতাকে জানতে হবে। শিশু মনকে উপেক্ষা করে কোন শিক্ষাই কার্যকরী হতে পারে না।

(FAQ) পেস্তালৎসি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১। পেস্তালৎসির শিক্ষাদর্শন কী?

পেস্তালৎসি শিক্ষাকে শিশুর হৃদয়, মন এবং হাতের সমন্বিত বিকাশ হিসেবে দেখতেন। তিনি প্রকৃতিনির্ভর এবং অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষার উপর জোর দেন।

২। পেস্তালৎসির বিখ্যাত কাজ কী?

পেস্তালৎসি “লিওনহার্ড অ্যান্ড গারট্রুড” এবং “হাউ ইজ গারট্রুড টিচেস হার চিলড্রেন” বই লিখে খ্যাতি অর্জন করেন।

৩। পেস্তালৎসি শিক্ষাক্ষেত্রে কীভাবে অবদান রেখেছেন?

তিনি শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা পদ্ধতি চালু করেন, যা স্বতঃস্ফূর্ত এবং অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষার উপর ভিত্তি করে।

৪। পেস্তালৎসির শিক্ষা পদ্ধতির মূলনীতি কী?

পেস্তালৎসির শিক্ষা পদ্ধতির মূলনীতি হলো শিশুর প্রাকৃতিক বিকাশ এবং শিক্ষার মাধ্যমে আত্ম-উন্নয়ন।

৫। পেস্তালৎসি কোন দেশের নাগরিক ছিলেন?

পেস্তালৎসি সুইজারল্যান্ডের নাগরিক ছিলেন।

৬। পেস্তালৎসির শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য কী?

শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের উন্নয়ন ঘটানো এবং নৈতিক চরিত্র গঠন করা।

Leave a Comment