মহম্মদ জাকারিয়া রাজি

মহম্মদ জাকারিয়া রাজি ছিলেন একজন প্রখ্যাত পারস্যের বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, দার্শনিক ও রসায়নবিদ। তিনি ৯ম শতাব্দীতে বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগে চিকিৎসাশাস্ত্র এবং রসায়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। রাজি প্রথমবারের মতো গুটিবসন্ত ও হাম রোগের পার্থক্য নিরূপণ করেন এবং তার চিকিৎসাবিদ্যা সম্পর্কিত গ্রন্থগুলো বহু শতাব্দী ধরে পশ্চিমা এবং ইসলামী বিশ্বে প্রভাবশালী ছিল। রসায়নে তার গবেষণা এবং উদ্ভাবন আধুনিক বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছে।

মহম্মদ জাকারিয়া রাজি

ঐতিহাসিক চরিত্রমহম্মদ জাকারিয়া রাজি
জন্ম৮৬০ খ্রিস্টাব্দ (রাভি, ইরান)
পেশাবিজ্ঞানী, চিকিৎসক, দার্শনিক, রসায়নবিদ
উল্লেখযোগ্য কাজগুটিবসন্ত ও হাম রোগের পার্থক্য নিরূপণ
প্রধান অবদানচিকিৎসা ও রসায়ন বিদ্যায় উদ্ভাবনী কাজ
প্রভাবপশ্চিমা ও ইসলামী চিকিৎসাশাস্ত্র
বিখ্যাত গ্রন্থআল-হাবি (The Comprehensive Book)
মৃত্যু৯২৫ খ্রিস্টাব্দ
মহম্মদ জাকারিয়া রাজি

ভূমিকা :- আরব সভ্যতায় আবির্ভূত হয়েছিলেন এক অসাধারণ প্রতিভাধর মানুষ। তিনি হলেন মহম্মদ জাকারিয়া রাজেশ বা রাজি। তিনি খোলা চোখ ও খোলা মন নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে সমকালীন চিকিৎসা বিজ্ঞানে সঞ্চারিত করেছিলেন নতুন গতি। ভয়ঙ্কর গুটি বসন্ত নিয়েও সেই কালে তিনি গভীর গবেষণা করেছেন। নানা রোগ সম্পর্কে তিনি যে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের কাছে আজো তা হয়ে আছে পরম বিস্ময়। অথচ এই প্রতিভাধর মানুষটি সম্পর্কে আমরা জানি খুব কমই। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের পরিধি থেকেই বোঝা যায় কী অসাধারণ মেধা ও আধুনিক মন নিয়ে তিনি জন্মেছিলেন।

মহম্মদ জাকারিয়া রাজির আবির্ভাব

প্রাচীন গ্রিস-এর ইতিহাসে চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক বলা হয়েছে হিপোক্রেটিসকে। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে, যুক্তি ও বিচারের পথে তিনি প্রাচীন চিকিৎসাকে উন্নত করেছিলেন চিকিৎসাবিজ্ঞানে। দেখার চোখ আর বিচারের মন-এই ছিল মহান বিজ্ঞানী হিপোক্রেটিসের সম্পদ। এই একই সম্পদ নিয়ে তাঁর বহুকাল পরে আরব সভ্যতায় আবির্ভূত হয়েছিলেন এক অসাধারণ প্রতিভাধর মানুষ। তিনি হলেন মহম্মদ জাকারিয়া রাজেশ বা রাজি।

জাকারিয়া রাজির জন্ম

প্রাচীন পারস্যের রাজধানী তেহরানের নিকটবর্তী রাভি নামক শহরে ৮৬০ খ্রিস্টাব্দে জন্ম হয় রাজেশের। তাঁর বাল্যকাল সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা না গেলেও অনুমান কার যায় শিশুবয়স থেকেই গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে তিনি বিদ্যাচর্চা করেছিলেন। অতি অল্প বয়সেই বিজ্ঞানের নানা শাখায় তিনি অসামান্য দক্ষতা অর্জন করেছিলেন।

মহম্মদ জাকারিয়া রাজির কৈশোর জীবন

ভবিষ্যৎকালে সমগ্র ইসলাম সভ্যতার চিকিৎসা বিজ্ঞানে যিনি হবেন সূর্যপ্রতিম পুরুষ তার আলোকচ্ছটার আভাস প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর কিশোরকালেই। সাহিত্য, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, দর্শন, আলকেমি বা অপরসায়ন এবং চিকিৎসাবিদ্যা প্রভৃতি সকল বিষয়েই ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ।

চিকিৎসক জাকারিয়া রাজি

প্রথম জীবনে রাজেশ চিকিৎসকের চাকরি গ্রহণ করেন রাভির শাসনকর্তার অধীনে। অসামান্য চিকিৎসা-প্রতিভাবলে তিনি সামান্য চিকিৎসক পদ থেকে উন্নীত হন বাগদাদ শহরের সুবিশাল হাসপাতালের অধিকর্তার পদে। রাজেশের জীবন সম্পর্কে এর বেশি কিছু জানা যায় না।

মহম্মদ জাকারিয়া রাজির কর্মকৃতিত্বের পরিচয়

দীর্ঘ জীবনের বৃত্তান্ত অজানা থাকলেও তাঁর কর্মকৃতিত্বের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর লেখা বিভিন্ন বিষয়ের বই থেকে। তার মধ্যেই বিধৃত বয়েছে কর্মী রাজেশের সত্যিকার পরিচয়। তাঁর অপরসায়ন, আধিবিজ্ঞান এবং চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ের বইগুলি বিশ্ববিজ্ঞান ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে। তাঁর অসাধারণ বই কিতাব- অল-মনসুরি ইয়া মুলুকি বিশ্বের বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

জাকারিয়া রাজির গ্রন্থ আল হাওয়াই

চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্যতম স্তম্ভরূপে বিবেচিত তাঁর আল হাওয়াই বইটি তিনি লিখেছিলেন দীর্ঘ পনেরো বছরের পরিশ্রমে। যদিও নিজের জীবদ্দশায় তিনি সেটি প্রকাশ করেন নি। কি কারণে এই দীর্ঘ পরিশ্রমলব্ধ জ্ঞান তিনি চেপে রেখেছিলেন তা জানা যায় না। বিশ্বের বিশিষ্ট চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা একবাক্যে স্বীকার করেছেন আল হাওয়াই মানব চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক যুগান্তকারী বই। এই বইটি পারস্যের চিকিৎসার ইতিহাস নামে অনুবাদ করে বিশিষ্ট চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী ডাঃ সিরিল এলগুড পৃথিবীর চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের অশেষ উপকার সাধন করেছেন।

আল হাওয়াই গ্রন্থ সম্পর্কে এলগুডের মন্তব্য

বিখ্যাত আল হাওয়াই গ্রন্থের এক জায়গায় এলগুড লিখেছেন, Among these works priority in importance and in interest must be given to his (Rhazes). All Hawai continens of this the Complete Arabic text lhas never been published. In its Latin form it is available in the edition transalated by Faraj Ibn Saleın of Farraguth for king Charles of Anjou in 1276, and printed at Brescia in 1486, portions of the original text can be seen in various libraries, One day, perhaps they will be collected, edited and printed. This is highly desirable for the continens must be regarded as most important even than the connon of Avicenna to the history of Arab Medicine. Access to the complete original text is essential for the full history and appreciation of the past that the Arab and Percians played in the progress of Medicine.”

মহম্মদ জাকারিয়া রাজির পান্ডুলিপি

  • (১) রাজেশের মৃত্যুর কিছুদিন পরে তাঁর এক বোন রাজেশের যাবতীয় বইপত্র, গবেষণার কাগজপত্র ও প্রচুর পান্ডুলিপি বিক্রি করে দিলেন। সৌভাগ্যক্রমে ওই মূল্যবান সম্পদ যোগ্য হাতেই হস্তান্তরিত হয়েছিল। সুলতান রুকন-অল- দৌলার বিদ্যোৎসাহী উজীর ইবন উত আমিদ এগুলো কিনেছিলেন। আমিদ নিজেও ছিলেন পন্ডিত ব্যক্তি। রাজেশের পান্ডুলিপিগুলির মূল্য অনুধাবন করতে তাঁর দেরি হল না।
  • (২) তিনি রাজেশের সকল ছাত্র এবং রাভি শহরের জ্ঞানী গুণী চিকিৎসক সকলকে একদিন এক সমাবেশে আহ্বান জানালেন। গুণীজনের সেই সভায় তিনি তাদের হাতে তুলে দিলেন রাজেশের পান্ডুলিপিগুলি, তাঁদের অনুরোধ করলেন, তাঁরা যেন পান্ডুলিপিগুলি সংস্কার করে একত্র সন্নিবেশিত করেন। তাই করা হল।
  • (৩) সংস্কৃত ও সংকলিত পান্ডুলিপির নাম দেওয়া হল কিতাব- উল-হাওয়াই-ফি-তিব। একথার অর্থ হল চিকিৎসা বিজ্ঞানের পদ্ধতি। এইভাবেই সেদিন তৈরি হয়েছিল আরবী চিকিৎসার মহামূল্যবান দলিল।

চিকিৎসক মহম্মদ জাকারিয়া রাজির পান্ডুলিপি সম্পর্কে মন্তব্য

আলি আব্বাস নামের এক বিখ্যাত চিকিৎসক রাজির পান্ডুলিপি সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, “রাজেশ প্রতিটি রোগের কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসাপদ্ধতির যে বিবরণ দিয়েছেন, সেগুলো আমাদের হিপোক্রেটিস ও গ্যালেনের কথা স্মরণে এনে দেয়”।

মহম্মদ জাকারিয়া রাজির গ্রন্থ

  • (১) চিকিৎসা বিজ্ঞানী রাজেশের বইগুলি থেকে আরবী চিকিৎসার সামগ্রিক পরিচয় পাওয়া যায়। মানব-চিকিৎসা-বিজ্ঞানের অগ্রগতির পথে আরবীয় অবদান নগণ্য নয়। রাজেশের বইগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল, কিতাব মনসুরি, কিতাব-আল-জুদারি-উ-আল-হাশেহ। বিশালাকার কিতাব মনসুরি দশখন্ডে বিভক্ত। চিকিৎসার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিশদ আলোচনা রয়েছে এতে।
  • (২) রাজেশ বইটির নামকরণের মধ্য দিয়ে আরব জগতের এক মহাগুণী প্রতিভার প্রতি সম্মান জানিয়েছিলেন। সিজিস্থানের সামনি শহরে বাস করতেন মহামান্য তাপস মনসুর-ইবন- ইশাখ। তাঁর নামকে স্মরণীয় রাখার জন্যই তিনি মনসুরি নামকরণ করেছিলেন তাঁর বইয়ের। এই বইটি পরে ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়ে সমস্ত ইউরোপ-এ ছড়িয়ে পড়ে।

গুটি বসন্ত ও হাম নিয়ে মহম্মদ জাকারিয়া রাজির গবেষণা

রাজেশই সম্ভবত বিশ্বের প্রথম বিজ্ঞানী যিনি গুটি বসন্ত ও হাম নিয়ে বিজ্ঞানসম্মতভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। তাঁর আগে ইউরোপে চার্চের তত্ত্বাবধানেই এই রোগগুলির চিকিৎসা হত। কিন্তু সেই চিকিৎসায় ছিল না বিজ্ঞানের ছোঁওয়া। রাজেশ তাঁব কিতাব-আল-জুদারি-উ-আল-হাশেহ বইতে গুটি বসন্ত ও হাম নিয়ে গবেষণার অনেক বৈজ্ঞানিক তথ্য দিয়েছেন।

মহম্মদ জাকারিয়া রাজির গ্রন্থের অনুবাদ

রোগ রোগী ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের নানা ব্যবহারিক দিক নিয়ে রচিত একটি পান্ডুলিপি উদ্ধার করেছিলেন বিশিষ্ট ইংরাজ গবেষক-বিজ্ঞানী মেযাবহফ। এই বইটি তিনি আরবী থেকে ইংরাজি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। এই বইটি থেকে রাজেশের জ্ঞানের গভীরতা ও বিপুল অভিজ্ঞতার পরিচয় পাওয়া যায়।

মেনিনজাইটিস ও অ্যাপেনডিসাইটিস সম্পর্কে জাকারিয়া রাজির গবেষণা

সেই সুপ্রাচীন যুগেই মেনিনজাইটিস ও অ্যাপেনডিসাইটিস সম্পর্কে রাজেশ এমন সব বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন, যা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানীদেরও বিস্ময় উৎপাদন করে। রাজেশের প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল চিকিৎসা বিজ্ঞানেই। অপরসায়ন ও পদার্থবিদ্যা নিয়েও যে তিনি গবেষণা করেছিলেন তা তার বইগুলি থেকে জানা যায়।

ভারতে মহম্মদ জাকারিয়া রাজির জ্ঞানের সুবাস

রাজেশের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সুবাস পারস্য থেকে আরবের অন্যান্য দেশ হয়ে পৌঁছয় ভারত-এ। আমাদের দেশেও তাঁর বইগুলি অনুবাদ হয়েছে, নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেসব বই পাঠ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

মহম্মদ জাকারিয়া রাজির মৃত্যু

বাহাত্তর বছর বয়সে ৯৩২ খ্রিস্টাব্দে প্রখ্যাত চিকিৎসক মহম্মদ জাকারিয়া রাজির মৃত্যু হয়।

উপসংহার :- মহম্মদ জাকারিয়া রাজি ছিলেন এক অনন্য প্রতিভাবান বিজ্ঞানী যিনি চিকিৎসাবিদ্যা ও রসায়নে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছেন। তার উদ্ভাবনী চিন্তাধারা ও গবেষণা মধ্যযুগের বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। গুটিবসন্ত ও হাম রোগের পার্থক্য নিরূপণসহ তার চিকিৎসাবিদ্যার কাজগুলো বহু শতাব্দী ধরে চিকিৎসাশাস্ত্রের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। রাজির লেখনী ও গবেষণা শুধু ইসলামী বিশ্বে নয়, বরং পশ্চিমা বিশ্বেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে, যা তাকে বিশ্বব্যাপী একজন স্বনামধন্য বিজ্ঞানী ও দার্শনিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। রাজেশের চিকিৎসা-ভাবনা আধুনিক চিকিৎসা-গবেষণার ক্ষেত্রে আজও দিশারীর ভূমিকা পালন করছে।

(FAQ) মহম্মদ জাকারিয়া রাজি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. মহম্মদ জাকারিয়া রাজি কোন বিষয়ে সবচেয়ে বেশি পরিচিত?

তিনি চিকিৎসাবিদ্যা ও রসায়নে তার অবদান এবং গুটিবসন্ত ও হাম রোগের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণের জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত।

২. মহম্মদ জাকারিয়া রাজি কী ধরনের বই লিখেছিলেন?

তিনি চিকিৎসাবিদ্যা ও রসায়ন নিয়ে বহু গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছিলেন, যার মধ্যে “আল-হাবি” অন্যতম। এটি চিকিৎসাশাস্ত্রের একটি বিশদ সংকলন যা বহু শতাব্দী ধরে ব্যবহার হয়েছে।

৩. মহম্মদ জাকারিয়া রাজির রসায়নে অবদান কী ছিল?

রাজি অনেক রাসায়নিক প্রক্রিয়া ও যৌগ আবিষ্কার করেছিলেন এবং বিভিন্ন উপাদানের বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা করেন যা পরবর্তী সময়ে আধুনিক রসায়নের ভিত্তি স্থাপন করে।

৪. মহম্মদ জাকারিয়া রাজির কাজ কীভাবে পশ্চিমা বিশ্বে প্রভাব ফেলেছিল?

তার কাজের অনুবাদ ল্যাটিন ও অন্যান্য ভাষায় করা হয়েছিল, যা ইউরোপের চিকিৎসাশাস্ত্রের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং মধ্যযুগীয় বিজ্ঞানীদের জন্য রেফারেন্স হিসেবে কাজ করেছিল।

Leave a Comment