মহলওয়ারি বন্দোবস্ত -এর প্রবর্তক, প্রবর্তন কাল, উদ্দেশ্য, প্রচলিত অঞ্চল, মহলওয়ারি বন্দোবস্তের বৈশিষ্ট্য, উত্তর ভারতে রাজস্ব ব্যবস্থা বিষয়ে বিতর্ক, মহলওয়ারি বন্দোবস্তের জনক, মহলওয়ারি বন্দোবস্তের ফলাফল ও মহলওয়ারি বন্দোবস্তের ত্রুটি সম্পর্কে জানবো।
মহলওয়ারি বন্দোবস্ত প্রসঙ্গে মহলওয়ারি বন্দোবস্ত বলতে কি বুঝায়, মহল কথার অর্থ, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত, মহলওয়ারি বন্দোবস্ত, মহলওয়ারি বন্দোবস্ত প্রচলিত অঞ্চল, মহলওয়ারি বন্দোবস্তের প্রবর্তন, মহলওয়ারি বন্দোবস্তের জনক, মহলওয়ারি বন্দোবস্তের বৈশিষ্ট্য, মহলওয়ারি বন্দোবস্তের উদ্দেশ্য, মহলওয়ারি বন্দোবস্তের ত্রুটি, মহলওয়ারি বন্দোবস্তের ফলাফল ও প্রভাব সম্পর্কে জানব।
মহলওয়ারি বন্দোবস্ত
ঐতিহাসিক ঘটনা | মহলওয়ারি বন্দোবস্ত |
প্রবর্তন কাল | ১৮২২ খ্রিস্টাব্দ |
প্রবর্তক | হোল্ট ম্যাকেঞ্জি |
প্রচলিত অঞ্চল | উত্তর-পশ্চিম ভারত |
ভূমিকা :- উত্তর-পশ্চিম ভারতে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিপত্য বিস্তৃত হলে ঐ অঞ্চলে ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রয়োজন দেখা দেয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কে সরকারের আর কোনও আগ্রহ ছিল না।
মহলওয়ারি বন্দোবস্তের উদ্দেশ্য
চিরস্থায়ী ব্যবস্থায় রাজস্ব একেবারে স্থায়ী হয়ে গিয়েছিল, সেখানে নতুন করে রাজস্ব বৃদ্ধির কোনও সুযোগ ছিল না। তাই প্রজার ক্ষতি না করে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধির চিন্তা-ভাবনা থেকেই ‘মহলওয়ারি বন্দোবস্ত-র উদ্ভব (১৮২২ খ্রিঃ) হয়।
মহলওয়ারি বন্দোবস্ত প্রচলিত অঞ্চল
গাঙ্গেয় উপত্যকা, উত্তর-পশ্চিম ভারত ও মধ্য ভারতের কিছু অংশে এই ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়।
মহলওয়ারি ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য
১৮২২ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত মহলওয়ারি বন্দোবস্তের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়।যেমন –
- (১) এই ব্যবস্থায় সরকার রায়তদের সঙ্গে সরাসরি ভূমিরাজস্বের বন্দোবস্ত না করে সমষ্টিগতভাবে এক একটি গ্রামের সঙ্গে রাজস্বের বন্দোবস্ত করে। গ্রামের অধিবাসীরা যৌথভাবে এই রাজস্ব মেটাতে বাধ্য ছিল।
- (২) সরকার গ্রামের ওপর যে রাজস্ব ধার্য করত, তা গ্রামবাসীদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হত। প্রতি গ্রামবাসী বা পরিবার তার জমির জন্য নির্দিষ্ট রাজস্ব গ্রাম প্রধানের হাতে তুলে দিত এবং গ্রাম-প্রধান তা সরকারের কাছে জমা দিত।
- (৩) জমি জরিপ করে প্রতিটি ‘মহল’ বা গ্রামের রাজস্ব ঠিক করা হত।
- (৪) জমির উৎপাদিকা শক্তি অনুসারে ভূমিরাজস্বের হার স্থির হত।
- (৫) প্রতি মহাল বা মৌজার সঙ্গে ২০-৩০ বছরের জন্য জমির বন্দোবস্ত হত।
- (৬) এই ব্যবস্থায় গ্রাম-প্রধান ছাড়া রায়ত ও সরকারের মধ্যে কোনও মধ্যস্বত্বভোগী ছিল না।
উত্তর ভারতে রাজস্ব ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক
এই ব্যবস্থা প্রচলিত হওয়ার আগে—উত্তর ভারতে কী ধরনের রাজস্ব ব্যবস্থা প্রচলিত হওয়া উচিত তা নিয়ে কোম্পানির রাজস্ব কর্মচারীদের মধ্যে জোর বিতর্ক চলে।
- (১) লর্ড হেস্টিংস চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পক্ষে মত প্রকাশ করেন, কিন্তু কোম্পানির পরিচালক সভা এই প্রস্তাব নাকচ করে দেয়।
- (২) ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে হোল্ট ম্যাকেঞ্জি (Holt Mackenje) এক প্রতিবেদনে গ্রামের জমিদারের সঙ্গে এক একটি গ্রাম বা মহলের রাজস্ব বন্দোবস্তের কথা বলেন।
মহলওয়ারি বন্দোবস্ত প্রবর্তন
১৮২২ খ্রিস্টাব্দে ‘সপ্তম আইন (Regulation VII) দ্বারা মহলওয়ারি ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়।
মহলওয়ারি ব্যবস্থার জনক
হোল্ট ম্যাকেঞ্জি-কে মহলওয়ারি ব্যবস্থার জনক বলা হয়।
মহলওয়ারি বন্দোবস্তের ফলাফল
- (১) এই ব্যবস্থা দ্বারা কোনও উপকার হয় নি। কারণ, ভূমিরাজস্বের হার ছিল খুবই উঁচু এবং এর ফলে জমিদাররা সব সময় রাজস্ব মেটাতে পারতেন না।
- (২) তাছাড়া প্রত্যেক জমিদারের সঙ্গে জমি জরিপ করে রাজস্ব নির্ধারণের ব্যবস্থা করা ছিল অতি সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল।
মহলওয়ারি ব্যবস্থা সম্পর্কে এরিখ স্টোকসের অভিমত
কেম্ব্রিজ ঐতিহাসিক এরিখ স্টোকস (Eric Stokes)-এর মতে হোল্ট ম্যাকেঞ্জি নন—জোনাথন ডানকান (Jonathan Duncan)-ই প্রথম এই ব্যবস্থার কথা বলেন।
বেন্টিঙ্কের উদ্দোগে মহলওয়ারি ব্যবস্থার প্রকৃত সূচনা
- (১) এই ব্যবস্থার অসুবিধাগুলি দূর করার জন্য বড়লাট লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক উদ্যোগ নেন এবং বস্তুত তাঁর আমলে ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে মহলওয়ারি ব্যবস্থার প্রকৃত সূচনা হয়।
- (২) হিতবাদী দর্শনের অনুরাগী বেন্টিঙ্ক মনে করতেন যে, কৃষকই জমির প্রকৃত মালিক এবং নিয়মিত রাজস্ব প্রদানের শর্তে এই মালিকানা কৃষকের হাতেই থাকা উচিত।
মহলওয়ারি ব্যবস্থার চূড়ান্ত রূপ ধারণ
কোম্পানির পরিচালক সভা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিরোধী ছিলেন। ১৮৩৩-৩৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রবার্ট বার্ড (Robert Bird) এবং জেমস্ থোমাসন (James Thomason) এর সহযোগিতায় এই ব্যবস্থা চূড়ান্ত রূপ পায়।
মহলওয়ারি ব্যবস্থার ত্রুটি
এই ব্যবস্থায় নানা ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়। যেমন –
- (১) এই ব্যবস্থায় জমির ওপর কৃষকের মালিকানা-স্বত্ব স্বীকৃত হয় নি এবং এতে কৃষকেরা জমিদার নয়—সরকারের অধীনে আসে।
- (২) এই ব্যবস্থায় জমিদার, তালুকদার প্রভৃতি মধ্যস্বত্বভোগীর স্থল দখল করে গ্রাম-প্রধান। রাজস্ব বন্টন, রাজস্ব আদায় এবং সরকারের হাতে রাজস্ব প্রদান—সব কিছুরই দায়িত্ব তাদের ওপর অর্পিত হওয়ায় তারা সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে এবং প্রজাদের ওপর জুলুমের মাত্রা বৃদ্ধি পায়।
- (৩) এতে রাজস্বের হার ছিল যথেষ্ট চড়া, যা দেবার ক্ষমতা কৃষকদের ছিল না। প্রজা কল্যাণের কথা মুখে বললেও সরকারের লক্ষ্য ছিল নিজেদের ধনভাণ্ডার স্ফীত করা। এর ফলে প্রজাদের দুর্দশাই বৃদ্ধি পায়। শেষ পর্যন্ত ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে সরকার রাজস্বের হার হ্রাস করতে বাধ্য হন।
- (৪) এই ব্যবস্থায় রাজস্ব ধার্য হয়েছিল যৌথভাবে পুরো গ্রাম বা মহলের ওপর। সুতরাং মহলের দু’একজন বা কয়েকজন কৃষক রাজস্ব দিতে না পারলে অন্যান্যরা তা মিটিয়ে দিতে বাধ্য হত, অন্যথায় তাদের সকলের জমিই হাতছাড়া হয়ে যেত। এ বিষয়টি সুস্থ অর্থনীতির অনুকূল নয়।
- (৫) এই ব্যবস্থায় কড়াকড়ির ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে বহু কৃষক জমি হারায়। উত্তর প্রদেশের ব্যাপক স্থানে এই হস্তান্তর ঘটে। একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে, ১৮৩৯ থেকে ১৮৪৮-এর মধ্যে ৯৫ হাজার জমির মালিকানা হস্তান্তরিত হয়।
উপসংহার :- রমেশচন্দ্র দত্ত বলেন যে, এই ব্যবস্থায় ধন সঞ্চয় বা মানুষের আর্থিক উন্নয়ন সম্ভব ছিল না। রাষ্ট্রের চাহিদার ওপরেও কোনও সীমারেখা টানা হয় নি। অতিরিক্ত কঠোরতার ফলে এই ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে।
(FAQ) মহলওয়ারি বন্দোবস্ত সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৮২২ খ্রিস্টাব্দে রাজস্বসচিব ম্যাকেঞ্জি নিয়মবিধি (Regulation of 1882) জারি করে গাঙ্গেয় উপত্যকায়, বিশেষভাবে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, দিল্লী এবং পাঞ্জাবে ব্যক্তিগত ভাবে প্রতিটি কৃষকদের পরিবর্তে প্রতিটি গ্রামের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যে রাজস্ব বন্দোবস্ত প্রবর্তন করা হয় তা মহলওয়ারি বন্দোবস্ত নামে পরিচিত।
হোল্ট ম্যাকেঞ্জি।
১৮২২ খ্রিস্টাব্দে উত্তর-পশ্চিম ভারতে।