১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের ভারতীয় কাউন্সিল আইন

১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের ভারতীয় কাউন্সিল আইন প্রসঙ্গে আইনের প্রেক্ষাপট, কাউন্সিল বিল পেশ, কাউন্সিল বিলের মূল লক্ষ্য, কাউন্সিল বিলে তিন প্রকারের সংস্কার, আইনের শর্তাবলী, আইনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক সম্পর্কে জানবো।

১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের ভারতীয় কাউন্সিল আইন

ঐতিহাসিক ঘটনা১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের ভারতীয় কাউন্সিল আইন
প্রবর্তন কাল১৮৯২ খ্রি:
প্রবর্তকব্রিটিশ পার্লামেন্ট
পূর্ববর্তী আইন১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ভারতীয় কাউন্সিল আইন
জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা১৮৮৫ খ্রি:
১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের ভারতীয় কাউন্সিল আইন

ভূমিকা :- ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের পরে প্রায় দীর্ঘ ত্রিশ বছর কাল শাসনতান্ত্রিক ক্ষেত্রে বিশেষ কোন সংস্কার সাধিত হয় নি। তবে এই সময়ের মধ্যে ভারতীয় শাসনব্যবস্থায় ব্রিটিশ সরকার ও ভারত সচিবের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পায়।

১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের ভারতীয় কাউন্সিল আইনের প্রেক্ষাপট

ব্রিটিশ সরকার বিভিন্ন কারণে ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে কাউন্সিল আইন প্রবর্তন করে। যেমন –

(১) শিক্ষিত ভারতীয়দের আশা পূরণে ব্যর্থতা

ভারতের আভ্যন্তরীণ প্রশাসনে গভর্নর জেনারেলের ব্যক্তিগত ক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি লাভ করে। অপরদিকে আইন পরিষদগুলোর কার্যকলাপ ভারতের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ক্রমবর্ধমান আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়।

(২) শিক্ষিত ভারতীয়দের দাবি-দাওয়া উত্থাপন

শিক্ষাবিস্তার ও রাজনৈতিক চেতনা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষিত ভারতবাসী দেশের শাসনকার্যে অধিকতর দাবি উত্থাপন করতে শুরু করেন। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক সমিতি এবং সংবাদপত্রের মাধ্যমে এই সকল দাবি-দাওয়া প্রকাশিত হতে থাকে।

(৩) ভারতবাসীর অসন্তোষ

দেশীয় সংবাদপত্র আইন, অস্ত্র আইন, ইলবার্ট বিল সংক্রান্ত আন্দোলন প্রভৃতি ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতবাসীর অসন্তোষ স্পষ্ট আকার ধারাণ করে।

(৪) কংগ্রেসের প্রচার

১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনগুলিতে বিভিন্ন প্রস্তাবের মধ্যে সরকারী নীতির সমালোচনা পরিলক্ষিত হয়। শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের জন্যও কংগ্রেস ব্যাপক প্রচার শুরু করে।

(৫) ইংল্যান্ডে কংগ্রেসের প্রচারকেন্দ্র স্থাপন

১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস ইংল্যান্ড-এ একটি প্রচারকেন্দ্র স্থাপন করে এবং ঐ সংস্থার মাধ্যমে কংগ্রেসের দাবি-দাওয়াগুলি ব্রিটিশ জনগণের নিকট উপস্থাপিত করতে শুরু করে।

ভারতীয় কাউন্সিল বিল পেশ

এই পরিস্থিতিতে গভর্নর জেনারেল লর্ড ডাফরিন আইন পরিষদের পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা নিরূপণের জন্য একটি কমিটি নিয়োগ করেন। এই কমিটির সুপারিশ অনুসারে ভারত সচিব লর্ড ব্রুস ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে পার্লামেন্টে ভারতীয় কাউন্সিল বিল পেশ করেন।

ভারতীয় কাউন্সিল বিলের মূল লক্ষ্য

এই বিলটির মূল লক্ষ্য ছিল ভারত সরকারের প্রশাসনিক ভিত্তি ও কার্যাবলীর পরিধি সম্প্রসারণ করা।

ভারতীয় কাউন্সিল বিলে তিন প্রকারের সংস্কার

বিলটিতে ভারতীয় আইন পরিষদের তিন প্রকারের সংস্কার সুপারিশ করা হয়। এই তিনটি পরিবর্তন হল অর্থনৈতিক বিষয়ে সমালোচনার অধিকার, প্রশ্ন উত্থাপনের অধিকার ও সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি।

১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের কাউন্সিল আইনের শর্তাবলী

এই আইন অনুসারে,

  • (১) কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা হল। কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য সংখ্যা ষোল করা হয় এবং বৃহৎ ও অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র প্রাদেশিক পরিষদগুলোর সদস্যসংখ্যা যথাক্রমে কুড়ি ও পনেরো ধার্য করা হয়।
  • (২) প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্যসংখ্যাও আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি করা হয়। অতিরিক্ত ন্যূনতম বেসরকারী সদস্যের সংখ্যা মাদ্রাজ ও বোম্বাইয়ে আটজন, বাংলায় কুড়িজন এবং যুক্তপ্রদেশে পনের জন করা হয়।
  • (৩) সদস্য নিয়োগের ব্যাপারে যদিও সরাসরিভাবে নির্ধারণের নীতি গৃহীত হয় নি, কিন্তু জেলাবোর্ড, মিউনিসিপ্যালিটি, বিশ্ববিদ্যালয়, চেম্বার অফ কমার্স প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাউন্সিলের সদস্য মনোনীত করার অধিকার দেওয়া হয়।
  • (৪) প্রাদেশিক কাউন্সিল গুলির বেসরকারী সদস্যরা চারজন সদস্যকে কেন্দ্রীয় পরিষদে নির্বাচন করার অধিকার লাভ করে। তা ছাড়া, বিভিন্ন প্রাদেশিক আইন সভার আটজন অতিরিক্ত বেসরকারী সদস্য, পৌরসভা, জেলাবোর্ড, বণিকসভা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নির্বাচিত হওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
  • (৫) ১৮৯২ খ্রীস্টাব্দের কাউন্সিল আইন দ্বারা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন সভাগুলিকে বাজেট ও জনসাধারণের স্বার্থ সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা করার অধিকার দেওয়া হয়।

১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের কাউন্সিল আইনের ইতিবাচক দিক

  • (১) এই আইনে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন সভাগুলিতে নির্বাচন প্রথার আংশিক প্রয়োগ করে এবং সদস্যদের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার সুযোগ দিয়ে আধুনিক ভারতের শাসনতান্ত্রিক বিবর্তনের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সৃষ্টি করে।
  • (২) প্রকৃত পক্ষে পরবর্তীকালে ভারতীয় শাসনতান্ত্রিক বিবর্তনের ইতিহাসে যেসব গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার গৃহীত হয়, ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের কাউন্সিল আইন তার ভিত্তি রচনা করে।

 ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের কাউন্সিল আইনের নেতিবাচক দিক

  • (১) এই আইন পূর্বেকার বিধিব্যবস্থা থেকে অনেক উন্নত মানের হলেও এই আইন ভারতবাসীর জাতীয়তাবাদী আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারে নি। তার প্রধান কারণ ছিল কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক উভয় আইন সভাতেই মনোনীত সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অক্ষুন্ন রাখা।
  • (২) তা ছাড়া আইন পরিষদগুলির সদস্যগণ অর্থসংক্রান্ত ব্যাপারে মতামত প্রকাশের বা প্রশ্ন উত্থাপনের অধিকার পেলেও তারা বাজেট সম্পর্কে ভোটদানের অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। ফলে সদস্যদের পক্ষে সরকারী নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব হয় নি।

উপসংহার :- ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের কাউন্সিল আইনে যদিও সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্ব সম্পর্কে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় নি, তথাপি পরবর্তীকালে এই লাইনের একটি সূত্র অবলম্বন করেই সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্ব ভারতের সাংবিধানিক বিবর্তনের ক্ষেত্রে একটি মূল ভিত্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করে।

(FAQ) ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের ভারতীয় কাউন্সিল আইন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের কাউন্সিল আইনে কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য সংখ্যা কত করা হয়?

১৬ জন।

২. ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের কাউন্সিল আইনে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য সংখ্যা কত করা হয়?

১৫ এবং ২০ জন

৩. ভারতের জাতীয় কংগ্রেস কখন প্রতিষ্ঠিত হয়?

১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে

Leave a Comment