হরপ্পা সভ্যতার অর্থনৈতিক জীবন

হরপ্পা সভ্যতার অর্থনৈতিক জীবন প্রসঙ্গে কৃষিকাজ, পশুপালন, শিল্প, বাণিজ্য, রপ্তানি দ্রব্য, আমদানি দ্রব্য ও বিনিময় প্রথা সম্পর্কে জানবো।

হরপ্পা সভ্যতার অর্থনৈতিক জীবন

ঐতিহাসিক ঘটনাহরপ্পা সভ্যতার অর্থনৈতিক জীবন
প্রধান ফসলগম, যব, তুলো ও তিল
গৃহপালিত পশুগোরু, ভেড়া, ছাগল, মহিষ
সমুদ্র বন্দরলোথাল
হরপ্পা সভ্যতার অর্থনৈতিক জীবন

ভূমিকা:- পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেসব প্রাচীন সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল ভারত -এর হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতা। আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে ভারতের সিন্ধুনদের উপত্যকা অঞ্চলে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এই সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল।

সিন্ধু সভ্যতা বা হরপ্পা সভ্যতার অর্থনৈতিক জীবন

হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীরা বিভিন্ন অর্থনৈতিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কৃষি, পশুপালন, ব্যাবসাবাণিজ্য, বিভিন্ন শিল্পের কাজ প্রভৃতি ছিল এখানকার অর্থনৈতিক কাজকর্মের প্রধান দিক।

সিন্ধু সভ্যতা বা হরপ্পা সভ্যতার কৃষিকাজ

  • (১) হরপ্পার অধিবাসীদের প্রধান জীবিকা ছিল কৃষিকাজ। কালিবঙ্গানে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান হিসেবে কাঠের লাঙল পাওয়া গেছে, যা মানুষে-টানা হত বলে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন। শহরের চারদিকের গ্রামগুলিতে কৃষিকাজ চলত। নদীবিধৌত উর্বর জমি এবং প্রচুর বৃষ্টিপাত কৃষির অগ্রগতিতে সহায়তা করেছিল।
  • (২) এখানকার প্রধান কৃষিজ ফসল ছিল গম, যব, তুলো ও তিল। লোথাল ও রংপুরে ধান চাষের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাছাড়া ফলমূল, মটর, রাই, খেজুর, বাদাম, শাকসবজি প্রভৃতিও তারা উৎপাদন করত।

সিন্ধু সভ্যতা বা হরপ্পা সভ্যতায় পশুপালন

হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীরা খাদ্যের প্রয়োজনে হাঁস, মুরগি, ছাগল, গোরু, মহিষ, ভেড়া, উট, ষাঁড় প্রভৃতি পালন করত। মালপত্র পরিবহণের জন্য বলদ, ষাঁড়, গাধা, উট, হাতি প্রভৃতি পশুকে পোষ মানানো হত। মানুষ শখ করে বিড়াল, কুকুর ও অন্যান্য পশুপাখিও পুষত। তবে তারা ঘোড়াকে পোষ মানাতে পারেনি বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন।

সিন্ধু সভ্যতা বা হরপ্পা সভ্যতার শিল্প

হরপ্পা সভ্যতায় বিভিন্ন শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। যেমন –

(১) বয়নশিল্প

বিভিন্ন শিল্পের মধ্যে বয়নশিল্প বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এখানে উন্নতমানের তুলো উৎপাদিত হত, যা বয়নশিল্পের বিকাশ ঘটায়। এখান থেকে সুতিবস্ত্র পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে রপ্তানি হত।

(২) ধাতুশিল্প

ধাতুশিল্পে এই সভ্যতার মানুষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিল। সোনা ও রুপোর সুন্দর অলংকার তৈরি, তামা ও ব্রোঞ্জ দিয়ে কাস্তে, কুঠার, ছুরি, বাসনপত্র, কলসি, প্রদীপ, মূর্তি প্রভৃতি তৈরিতে শিল্পীরা দক্ষ ছিল।

(৩) মৃৎশিল্প

মৃৎশিল্প ছিল সিন্ধু সভ্যতার উল্লেখযোগ্য একটি শিল্প। কুমোরের চাকার সাহায্যে শিল্পীরা বিভিন্ন ধরনের মাটির মূর্তি, শিশুদের খেলনা, বাসনপত্র ইত্যাদি তৈরি করত। সেগুলি আগুনে পুড়িয়ে মজবুত করা হত এবং নানা রঙে রঙিন করা হত। পাত্রগুলির গায়ে বিভিন্ন চিত্রের নকশা থাকত।

(৪) প্রস্তরশিল্প

খননকার্যের ফলে এখান থেকে জেড, কার্নেলিয়ান, লাপিস লাজুলি, অ্যাজেট প্রভৃতি দামি পাথরের বিভিন্ন দ্রব্য, পাথরের নানা হাতিয়ার এবং বিভিন্ন মূর্তি পাওয়া গেছে।

(৫) অন্যান্য শিল্প

ইটশিল্প, কাষ্ঠশিল্প, চিনামাটির শিল্প, চুনাপাথরের শিল্প, হাতির দাঁতের শিল্প প্রভৃতি কাজে এখানকার অনেক মানুষ নিযুক্ত ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

সিন্ধু সভ্যতা বা হরপ্পা সভ্যতায় বাণিজ্য

ব্যাবসাবাণিজ্য ছিল হরপ্পার অধিবাসীদের গুরুত্বপূর্ণ জীবিকা। এক্ষেত্রে বিশেষ দিক গুলি হল –

(১) পণি

এখানকার বণিকদের বলা হত ‘পণি’। তারা স্থল ও জলপথে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয়প্রকার বাণিজ্যের সঙ্গেই যুক্ত ছিল। নিকটবর্তী অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্যের পাশাপাশি তারা দূরবর্তী মিশর, সুমের, ব্যাবিলন, পারস্য, মেসোপটেমিয়া, বালুচিস্তান, আফগানিস্তান প্রভৃতি স্থানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চালাত।

(২) সিলমোহরের প্রাপ্তি

হরপ্পার সিলমোহর সুসা ও মেসোপটেমিয়ার নগরগুলিতে আবিষ্কৃত হয়েছে। সিন্ধুর সিলমোহরযুক্ত কাপড়ের গাঁট মেসোপটেমিয়ার উম্মায় পাওয়া গেছে। অধ্যাপক এ. এল. বাসামের মতে, হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর প্রতিটি বণিক পরিবারের পৃথক সিলমোহর ছিল।

(৩) সামুদ্রিক বাণিজ্য

হরপ্পা সভ্যতায় প্রাপ্ত কিছু সিলমোহরে নৌকা, জাহাজ, মাস্তুল, নোঙর, মাঝি প্রভৃতির ছবি থেকে তখনকার মানুষের সামুদ্রিক কার্যকলাপের ইঙ্গিত মেলে। গুজরাটের লোথাল ছিল সিন্ধু সভ্যতার সমুদ্রবন্দর। 

(৪) রপ্তানি দ্রব্য

হরপ্পা সভ্যতা থেকে সুতিবস্ত্র, খাদ্যশস্য, ময়ূর, হাতির দাঁতের সামগ্রী, নীলকান্তমণি, অন্যান্য মণিমুক্তা প্রভৃতি পণ্য রপ্তানি করা হত।

(৫) আমদানি দ্রব্য

হিমালয় থেকে দেবদারু কাঠ, মহীশূর থেকে সোনা, রাজস্থানের ক্ষেত্রী থেকে তামা, সিসা ও চুনাপাথর, পারস্য ও সুমের থেকে রুপো, মধ্য এশিয়া থেকে জেড পাথর প্রভৃতি সিন্ধু সভ্যতায় আমদানি করা হত।

(৬) বিনিময় প্রথা

সেই সময় মুদ্রা ব্যবস্থার প্রচলন না থাকায় ‘বিনিময় প্রথা’র মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানির কাজ চলত।

উপসংহার:- হরপ্পা সভ্যতা অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছিল সুউন্নত। কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের বিকাশের ফলে সিন্ধু নগরের অধিবাসীরা বেশ সচ্ছল জীবন যাপন করত।

(FAQ) হরপ্পা সভ্যতার অর্থনৈতিক জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীদের প্রধান জীবিকা কি ছিল?

কৃষিকাজ।

২. হরপ্পা সভ্যতার প্রধান কৃষিজ ফসল কি ছিল?

গম, যব, তুলো ও তিল।

৩. হরপ্পা সভ্যতার মানুষ কোন পশুকে পোষ মানাতে পারেনি?

ঘোড়া।

৪. হরপ্পা সভ্যতায় সমুদ্র বন্দর কোথায় ছিল?

গুজরাটের লোথাল।

Leave a Comment