আকবরের কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা

মুঘল সম্রাট আকবরের কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা প্রসঙ্গে বাদশাহের ক্ষমতা, প্রশাসনের প্রধান কেন্দ্র দরবার, চারটি দপ্তর, ভকিল, উজীর, উজীরের দপ্তর, মীর বকসী ও সদর-উস-সদুর সম্পর্কে জানবো।

মুঘল সম্রাট আকবরের কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা

ঐতিহাসিক ঘটনা আকবরের কেন্দ্রীয় শাসন
সম্রাট আকবর
ভকিল প্রধানমন্ত্রী
উজীর অর্থমন্ত্রী
মীর বকসী সামরিক বিভাগের মন্ত্রী
সদর-উস-সদুর ধর্মবিষয়ক মন্ত্রী
মুঘল সম্রাট আকবরের কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থ

ভূমিকা :- আকবর সিংহাসনের সার্বভৌম ও স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতায় বিশ্বাস করতেন। তিনি স্বৈরাচারী হলেও, উদারনৈতিক স্বৈরাচারী ছিলেন। তিনি নিজেকে প্রজাদের অভিভাবক ও পালক বলে মনে করতেন এবং তার শাসনব্যবস্থায় জনকল্যাণমূলক নীতি বিশেষ গুরুত্ব পায়।

পাদশাহের ক্ষমতা

পাদশাহের ক্ষমতা ছিল কার্যত সীমাহীন। প্রশাসনিক ও সামরিক বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত। কোনো পার্থিব শক্তি তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করার অধিকারী ছিল না। তিনি দৈবী অধিকার (Divine Right) দাবী করেন।

প্রশাসনের প্রধান কেন্দ্র দরবার

  • (১) আকবর তাঁর দরবারকে প্রশাসনিক কার্যনির্বাহের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত করেন। যদিও মাঝে মাঝে উৎসব, অনুষ্ঠানের সময় দরবারের কাজকর্ম ব্যাহত হত, তথাপি তিনি দরবারে সরকারি কাজকর্মকেই প্রাধান্য দেন।
  • (২) সকল কর্মচারীদের সমক্ষে প্রকাশ্যে সিদ্ধান্ত ঘোষিত হত। সন্ধ্যার দরবারে গোপন ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত নেওয়া হত। পত্রলেখকরা দরবারে হাজির থেকে সিদ্ধান্ত লিখে নিত। আকবর সপ্তাহে একদিন দরবারে আপীলের বিচার করতেন।

চারটি দপ্তর

কেন্দ্রে সম্রাটকে সাহায্য করার জন্য ৪ টি প্রধান দপ্তর ৪ মন্ত্রীর অধীনে রাখা হয়। এরা হল ভকিল বা প্রধানমন্ত্রী, উজীর, মীর বকসী ও সদর-উস-সুদূর।

ভকিল

  • (১) বৈরাম খাঁ ভকিলের পদে নিযুক্ত হন। ভকিলের পদমর্যাদা ব্যাখ্যা করে আবুল ফজল বলেছেন যে, ভকিল হলেন সম্রাটের সকল বিষয়ে সাহায্যকারি। নিয়োগ, বদলী, পদচ্যুতি, সকল দপ্তরের কাজকর্মের তদারকি তিনি করেন। বৈরামের মৃত্যুর পর আকবর নিজেই নিজের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতেন।
  • (২) বৈরামের পরবর্তী ভকিলরা নামে মাত্র ক্ষমতা ভোগ করতেন। বৈরামের মৃত্যুর পর মুনিম খান, মুজাফ্ফর খান কিছুকাল ডকিলের পদে ছিলেন। কিন্তু আকবর এই পদটির ক্ষমতা ও গুরুত্ব যথেষ্ট হ্রাস করেন।

উজীর

  • (১) উজীর বা অর্থমন্ত্রী বা দেওয়ানের পদটিকে আকবর বিশেষ গুরুত্ব দেন। ভকিলের বহু দায়িত্ব উজীরের হাতে দেওয়া হয়। উজীরের পদে মুজাফ্ফর খাঁ, টোডরমল ও শাহ মনসুর খুবই নাম করেন। প্রকৃতপক্ষে এদের চেষ্টায় আকবরের রাজস্ব বিভাগ গড়ে ওঠে। তার একান্ত আস্থাভাজন কর্মচারীরাই উজীরের পদে নিযুক্ত হতেন।
  • (২) রাষ্ট্রের আয়, ব্যয়, রাজস্বের হিসেব প্রভৃতি রাখা উজীবের দায়িত্ব ছিল। উজীর প্রাদেশিক দেওয়ান ও রাজস্ব কর্মচারীদের নির্বাচন করতেন। বিভিন্ন রাজস্ব সম্পর্কিত কাগজে তার স্বাক্ষর ও শীল ছাড়া বৈধ হত না। প্রশাসনের বহু দায়িত্ব উজীরের দপ্তরকে বইতে হত।

উজীরের দপ্তর

আকবরের আমলে উজীরের অধীনে তার দপ্তরের ছয়টি শাখা ছিল। যথা –

(ক) দেওয়ান-ই-খালসা

সম্রাটের খালিসা জমির বিষয়টি দেখাশোনা করত। দায়িত্বশীল কর্মচারীকেই এই দপ্তরের ভার দেওয়া হত।

(খ) দেওয়ান-ই-জায়গীর

জায়গীরগুলির ব্যাপারে দেখাশোনা করতেন।

 (গ) দেওয়ান-ই-তৌজি

সামরিক বিভাগের খরচের ব্যাপার দেওয়ান-ই-তৌজি দেখতেন। উজীরের তত্ত্বাবধানে তিনি অন্য দেওয়ানের মতই কাজ করতেন।

(ঘ) দেওয়ান-ই-বয়ুতাৎ

কারখানাগুলির তত্ত্ববধান, আয়-ব্যয়ের কাজ দেখতেন।

(ঙ) মুশরিফি খাজানা

মুশরিফি খাজানা ছিলেন কোষাধ্যক্ষ।

(চ) দেওয়ান-ই-সাদাৎ

দেওয়ান-ই-সাদাৎ ছিল দাতব্য বিভাগ।

মীর বকসী ছিলেন সামরিক বিভাগের মন্ত্রী। পদমর্যাদায় তিনি ঠিক উজীরের নীচে ছিলেন। ঐতিহাসিক ইবন হাসানের মতে, সুলতানি যুগে দেওয়ান-ই-আরজ যে ক্ষমতা ভোগ করতেন মুঘল যুগে মীর বকসী সেই ক্ষমতা পান।

(২) তিনি মনসবদারদের পদ মর্যাদা, বেতন, সেনার সংখ্যার হিসাবপত্র রাখতেন। সামরিক বিভাগের সকল কর্মচারীদের বেতন তার হাত দিয়ে প্রদত্ত হত। প্রতি মনসবদারকে তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হত। তিনি দরবারে সম্রাটের ডান দিকে দাঁড়াতেন।

(৩) তিনি সেনা বিভাগে কোনো কর্মচারী নিয়োগ করতে চাইলে সম্রাটের কাছে হাজির করতেন এবং মনসবদারদের সেনার কুচকাওয়াজ পরিদর্শনে সম্রাটকে আহ্বান করতেন। রাজপ্রাসাদের রক্ষীবাহিনী নিয়োগ তার দায়িত্ব ছিল। রাজ্যের সর্বত্র গুপ্তচর দ্বারা তাকে খবর সংগ্রহ করতে হত।

(৪) কখনও কখনও তাকে নিজে যুদ্ধ পরিচালনা করতে হত। মীর বকসীর দপ্তরে কাজের ভার বেড়ে গেলে বহু সহকারী মীর বকসী নিয়োগ করা হয়। মীর বকসী পদের প্রার্থীদের সামরিক দক্ষতা ছাড়া, প্রশাসনিক দক্ষতা, বিদ্যা-বুদ্ধির পরিচয় দিতে হত।

সদর-উস-সদুর

  • (১) সদর-উস-সদুর ছিলেন ধর্মবিষয়ক মন্ত্রী। তিনি ছিলেন দাতব্য বিভাগের প্রধান। তিনি প্রধান কাজী বা প্রধান বিচারকের কাজ করতেন। তিনি শরয়তী আইনের প্রধান ব্যাখ্যাকার হিসেবে সম্রাটকে আইন সম্পর্কে পরামর্শ দিতে পারতেন। এজন্য সদর উলেমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলতেন।
  • (২) তিনি উলেমাদের ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে, মাদ্রাসায় সেয়ুরঘাল বা নিষ্কর জমি দান করার জন্য সুপারিশ করতেন। আকবর পরবর্তীকালে সদর-উস-সদুরের ক্ষমতা হ্রাস করেন। ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দে মাহজরনামা ঘোষণার পর সদরের ক্ষমতা বহুল পরিমাণে হ্রাস পায়।
  • (৩) তিনি সদরের আইন রচনায় পরামর্শদানের অধিকার লোপ করেন। এমনকি সেয়ুরঘাল দান করার ক্ষমতাও সঙ্কুচিত করেন। সদরের দপ্তরে বহু দুর্নীতি উদ্ঘাটিত হলে তিনি আরও কড়া ব্যবস্থা নেন।

উপসংহার :- কেন্দ্রে উপরোক্ত ৪ মন্ত্রী ছাড়া মীর সামান ছিলেন রাজকীয় কারখানার পরিচালক ও প্রাসাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সংগ্রহকারক। দারোগা-ই-ওসলখানা সম্রাটের সচিবের কাজ করতেন। আরিজ-ই-মুকাবর সম্রাটের ফর্মানগুলি রচনা করতেন।

(FAQ) মুঘল সম্রাট আকবরের কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. আকবরের আমলে প্রধানমন্ত্রীকে কি বলা হত?

ভকিল।

২. আকবরের অর্থমন্ত্রী কি নামে পরিচিত ছিল?

উজীর বা দেওয়ান।

৩. আকবরের আমলে মীর বকসী কে ছিলেন?

সামরিক বিভাগের মন্ত্রী।

৪. আকবরের সময় ধর্মবিষয়ক মন্ত্রী কে ছিলেন?

সদর-উস-সদুর।

Leave a Reply

Translate »