মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন প্রসঙ্গে তার জন্ম, শৈশবকাল, পিতৃপরিচয়, শিক্ষা, বিবাহ, ওকালতি, ঐতিহাসিক ভাষণ, রাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগ, দাসপ্রথা বিলোপ, তার সম্পর্কে বিখ্যাত উক্তি, হত্যা কাহিনী ও তার মৃত্যু সম্পর্কে জানবো।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন
ঐতিহাসিক চরিত্র | আব্রাহাম লিঙ্কन |
জন্ম | ১২ ফেব্রুয়ারি, ১৮০৯ খ্রি: |
নাগরিকত্ব | আমেরিকা |
পিতা | টমাস লিঙ্কন |
পরিচিতি | ১৬ তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট |
মৃত্যু | ১৫ এপ্রিল, ১৮৬৫ খ্রি: |
ভূমিকা :- আব্রাহাম লিঙ্কন শুধু আমেরিকার নন, পৃথিবীর ইতিহাসের যে কয়জন মানবতাবাদী গণতন্ত্রপ্রেমী মহান রাষ্ট্রনায়ক জন্মগ্রহণ করেছেন, তিনি তাদের অন্যতম।
আব্রাহাম লিঙ্কনের জন্ম
লিঙ্কনের জন্ম হয় ১৮০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি আমেরিকার কেন্টাফি প্রদেশের একটি ছোট গ্রামে।
আব্রাহাম লিঙ্কনের পিতৃপরিচয়
লিঙ্কনের বাবা টমাস লিঙ্কন ছিলেন ছুতোর মিস্ত্রি। লেখাপড়া কিছুই জানতেন না। অতি কষ্টে দীনদরিদ্রের মত তিনি সংসার চালাতেন। তার মায়ের নাম ছিল ন্যান্সি হ্যাঙ্কস লিঙ্কন।
পরিশ্রমী ও সাহসী লিঙ্কন
- (১) লিঙ্কনের যখন চার বছর বয়স, তাঁর বাবা ইন্ডিয়ানা প্রদেশের অরণ্যময় অঞ্চলে গিয়ে পাকাপাকিভাবে বসবাস করবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। বাড়ির চারদিকে জন্তু-জানোয়ার-এর হাত থেকে বাঁচার জন্য বড় বড় খুটি পোতা থাকত।
- (২) কাঠের কাজ আর শিকার করেই লিঙ্কনের বাবা সংসার চালাতেন। এই কঠিন প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে বসবাস করতে করতে লিঙ্কন হয়ে ওঠেন পরিশ্রমী ও সাহসী।
মাতৃহারা লিঙ্কন
লিঙ্কনের তখন ছয় বছর বয়েস। হঠাৎ তাঁর মা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তখন সেখানে কোন চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না। এক গ্রাম্য ডাক্তার থাকতেন পঁয়ত্রিশ মাইল দূরে। প্রায় বিনা চিকিৎসাতেই সাত দিন পর মারা গেলেন লিঙ্কনের মা।
আব্রাহাম লিঙ্কনের পিতার দ্বিতীয় বিবাহ
মা মারা যাওয়ার পর একটি বছর অতিক্রান্ত হল। লিঙ্কনের বাবার পূর্বপরিচিত এক মহিলার কিছুদিন আগে স্বামী মারা গিয়েছিল। সংসারে একজন মহিলার প্রয়োজন বিবেচনা করেই তাকে বিয়ে করে নিয়ে এলেন টমাস।
আব্রাহাম লিঙ্কনের শিক্ষা
লিঙ্কন বেশিরভাগ স্ব-শিক্ষিত ছিলেন। মোটামুটি ১২ মাসেরও কম সময়ের যাত্রী শিক্ষকদের কাছ থেকে কিছু স্কুলে পড়েছিলেন। তিনি আগ্রহী পাঠক হিসাবে অবিচল ছিলেন এবং শিক্ষায় আজীবন আগ্রহ বজায় রেখেছিলেন।
আব্রাহাম লিঙ্কনের বিবাহ
মেরেমির বোনের স্প্রিংফিল্ড মেনেশনে ৪ নভেম্বর ১৮৪২ সালে আব্রাহাম লিঙ্কন ও মেরি টড বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
উকিল আব্রাহাম লিঙ্কন
ছাত্র হিসেবে আব্রাহাম লিঙ্কন মেধাবী হলেও দারিদ্রের কারনে বেশি লেখাপড়া শিখতে পারেন নি। তিনি ক্লার্ক হিসাবে জীবন শুরু করেন। কিন্তু পরবর্তীতে ওকালতি পাস করে উকিল হন।
যুদ্ধে যোগ দেবার জন্য লিঙ্কনের আহ্বান
লিঙ্কন দেশের সমস্ত মানুষের কাছে আহ্বান জানালেন যুদ্ধে যোগ দেবার জন্য। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সৈন্যদলে নাম লেখাল চল্লিশ বছরের এক প্রাক্তন ক্যাপ্টেন, নাম গ্র্যান্ট। গ্র্যান্ট সৈনিক হিসাবে ছিলেন খুব বীর সাহসী। কিন্তু তার প্রধান দোষ ছিল অত্যধিক পরিমাণে মদ্যপান করতেন আর এই দোষেই তার চাকরি গিয়েছিল।
লিঙ্কনের ঐতিহাসিক ভাষণ
দেশবাসীর কাছে লিঙ্কন তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, “কারোর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ না করে সকলের প্রতি উদার মনোভাব নিয়ে… আসুন আমরা সকলে মিলে আরদ্ধ কাজগুলি শেষ করি। জাতির ক্ষত আরোগ্য করা, এই যুদ্ধের গুরুভার যিনি বহন করেছেন তাকে অথবা তার বিধবা পত্নী ও পিতৃহীন সন্তানদের পালন করা, নিজেদের মধ্যে ও সকল জাতির সঙ্গে ন্যায্য এবং স্থায়ী শান্তি অর্জন ও পোষণের ব্যবস্থা – এই আমাদের কর্তব্য।”
রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিঙ্কন
মার্কিন রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী আব্রাহাম লিঙ্কন ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ সালে তার হত্যার আগে পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬ তম রাষ্ট্রপতি ছিলেন। নৈতিক, সাংস্কৃতিক, সাংবিধানিক এবং রাজনৈতিক সঙ্কটকালে তিনি আমেরিকাকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ইউনিয়ন সংরক্ষণ, দাসত্ব বিলোপ, ফেডারেল সরকারকে মজবুতকরণ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে আধুনিকীকরণে সফল হন।
আব্রাহাম লিঙ্কনের দ্বারা দাস প্রথার বিলোপ
- (১) ১৮৬৩ সালের ১লা জানুয়ারী তিনি আইনত দাসপ্রথা বিলুপ্ত করেন। কিন্তু দক্ষিণ আমেরিকানরা তা মেনে নিতে পারে নি। তাঁরা বিভক্ত হয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠন করে আমেরিকাকে বিভক্ত করে।
- (২) পরবর্তীতে এই অভ্যন্তরীণ বিরোধ গৃহযুদ্ধের সূচনা করে। ১-৩ জুলাই তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসেলভানিয়ার গেটিসবার্গে এই গৃহযুদ্ধে প্রায় আট হাজার মানুষ নিহত হয়।
- (৩) ১৯ নভেম্বর ১৮৬৩ সালে এক স্মরণসভায় আব্রাহাম একটি সংক্ষিপ্ত ও দুনিয়া কাঁপানো ভাষণ দেন। মাত্র দুই মিনিটে ২৭২ শব্দের এই বিখ্যাত ভাষণটি গেটিসবার্গ স্পিচ নামে পরিচিত। এটি পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ।
- (৪) এই ভাষণের সবচেয়ে লক্ষণীয় দিক হলো মাত্র একটি বাক্যে গণতন্ত্রের নিখুঁত সংজ্ঞা দিয়েছেন লিংকন। তার ভাষ্যমতে, ‘গণতন্ত্র হলো জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা সরকার, জনগণের জন্য সরকার’।
আব্রাহাম লিঙ্কনের হত্যা
- (১) থিয়েটার হলে পৌঁছতেই সমস্ত দর্শকরা তাকে অভিনন্দন জানাল। নিজের আসনে গিয়ে বসলেন, লিঙ্কন আর মেরি। দু ঘণ্টা কেটে গিয়েছে, বক্সের দরজার সামনে যে প্রহরী ছিল, তার কাছে একজন লোক এসে বলল, প্রেসিডেন্টকে একটা সংবাদ দিতে হবে।
- (২) রক্ষী ভেতরে যাবার অনুমতি দিতেই আততায়ী ভেতরে ঢুকেই লিঙ্কনের মাথা লক্ষ্য করে গুলি চালাল। চেয়ারের উপর লুটিয়ে পড়লেন লিঙ্কন। লিঙ্কনকে ধরাধরি করে নিয়ে যাওয়া হল থিয়েটার হলের সামনের একটা বাড়িতে।
- (৩) আঘাতের বিরুদ্ধে তাঁর বলিষ্ঠ দেহের প্রাণসত্তার দ্বন্দ্ব চলল নয় ঘণ্টা ধরে। লিঙ্কন অচেতন, সেখানে উপস্থিত মেরি, লিঙ্কনের বড় ছেলে, তাঁর মন্ত্রীপরিষদের সবাই। সকাল সাতটায় অজ্ঞান অবস্থায় লিঙ্কন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
মানুষের মনের দিগন্ত প্রসারে আব্রাহাম লিঙ্কন
মৃত্যুর সময় লিঙ্কনের বয়স হয়েছিল ছাপ্পান্ন। এই জীবনের মধ্যেই তিনি যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের অখণ্ডতা এবং মানুষের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখবার জন্য সংগ্রাম করেছেন তাই নয়, তিনি তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে মানুষের মর্যাদার দিগন্তকে প্রসারিত করেছেন।
আব্রাহাম লিঙ্কন সম্পর্কে বিখ্যাত উক্তি
একটি সামান্য কাঠের ঘরে বাল্য ও কৈশোর কাটানো আব্রাহাম পরবর্তীকালে স্বীয় প্রতিভাবলে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রপতির জন্য নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ‘হোয়াইট হাউস’ ভবনে বাস করেছিলেন। এই কারণে আব্রাহাম লিঙ্কন সম্পর্কে ‘From Log cabin to white house’ – এই বিখ্যাত উক্তিটি প্রচলিত হয়। এই একটি মাত্র কথার মধ্যে তার সমগ্র জীবনের ইতিহাস সুন্দরভাবে ব্যক্ত হয়েছে
আব্রাহাম লিঙ্কনের মৃত্যু কাল
মানুষকে মানুষের জন্মগত অধিকার ফিরিয়ে দেবার দীর্ঘ দশ বছরের সংগ্রাম সম্পূর্ণ করে ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে এক দক্ষিণী গুপ্তঘাতকের গুলিতে প্রাণ বিসর্জন দেন মানবতার অবিসংবাদী পূজারী আব্রাহাম লিঙ্কন।
উপসংহার :- আব্রাহাম লিঙ্কন এক সার্বজনীন আদর্শের উদ্দেশ্যে তাঁর জীবনকে উৎসর্গ করেছেন – জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা, জনগণের শাসন, যা কখনো পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হবে না।
(FAQ) মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
আব্রাহাম লিঙ্কন ছিলেন একজন মার্কিন রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী। তিনি ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ সালে তার হত্যার আগে পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬ তম রাষ্ট্রপতি ছিলেন।
১৮০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি আমেরিকার কেন্টাফি প্রদেশে।
আব্রাহাম লিঙ্কন ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে।
১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে এক দক্ষিণী গুপ্তঘাতকের গুলিতে আব্রাহাম লিঙ্কনের মৃত্যু হয়।