অপ্সরা ঊর্বশী প্রসঙ্গে ঊর্বশী কর্তৃক ঋক বা মন্ত্র রচনা, ঊর্বশী রচিত মন্ত্র গুলির বিষয়বস্তু, ঊর্বশী পুরুবার কথোপকথন, ঊর্বশীর সম্বন্ধে পৌরাণিক গল্প, পুরুরবা ও ঊর্বশীর কাহিনী এবং সৌন্দর্যলক্ষ্মী ঊর্বশী সম্পর্কে জানবো।
স্বর্গের অপ্সরা ঊর্বশী প্রসঙ্গে বৈদিক ও পুরাণ শাস্ত্রে ঊর্বশীর উল্লেখ, ঊর্বশী পুরুবার কথোপকথন, ঊর্বশী কর্তৃক ঋক বা মন্ত্র রচনা, স্বামী পুরুরবাকে ছেড়ে ঊর্বশীর স্বর্গে গমন, ঊর্বশীর সম্বন্ধে পৌরাণিক গল্প, পুরুরবা ও ঊর্বশীর কাহিনী সম্পর্কে জানব।
অপ্সরা ঊর্বশী
ঐতিহাসিক চরিত্র | ঊর্বশী |
পরিচিতি | স্বর্গের অপ্সরা |
সৃষ্টিকর্তা | দেবরাজ ইন্দ্র |
বিশেষ সম্পর্ক | রাজা পুরুরবা |
খ্যাতি | ঋকবেদের ঋক বা মন্ত্র রচনা |
ভূমিকা :- সৌন্দর্য লক্ষ্মী ঊর্বশী হলেন অপ্সরা কন্যা। মনে করা হয় যে কামদেব নিজের ঊরু থেকে অপ্সরা ঊর্বশীর সৃষ্টি করেছেন।
ঊর্বশী কর্তৃক ঋক বা মন্ত্র রচনা
বিদুষী নারী ঊর্বশী হলেন অপ্সরাকন্যা। ঋগ্বেদ-এর দশম মণ্ডলের ১৫ সূক্তের সাতটি ঋক ঊর্বশী প্রণয়ন করেছিলেন।
ঊর্বশী রচিত মন্ত্রের বিষয়বস্তু
এই সূক্তে ঊর্বশী ও পুরুববার বৈদিক উপাখ্যান আখ্যাত হয়েছে। পুরুরবা অপ্সরা ঊর্বশীর সাথে কিছুকাল বাস করার পর যখন তাঁদের পরস্পরের মিলনবন্ধন বিচ্ছিন্ন হল, সেই সময়ের কথা ঐ সূক্তে বিবৃত হয়েছে। পুরুববা এবং ঊর্বশী উভয়ের বিদায় বেদনাবাণী অতি করুণভাবে বর্ণিত হয়েছে।
ঊর্বশী ও পুরুরবার কথোপকথন
পুরুরবা: “হে পত্নী, তোমার চিত্ত কি নিষ্ঠুর! এত শীঘ্র আমাকে ত্যাগ করে চলে যেও না। এই বিদায়ক্ষণে যদি মনের কথা উভয়ে প্রকাশ করে বলতে না পারি তাহলে চিরদিন অন্তর মধ্যে দুঃখবেদনা বহন করতে হবে।”
ঊর্বশী: “পুরুরবা! তুমি আপন গৃহে ফিরে যাও। বায়ুকে যেমন ধরা যায় না, তুমিও তেমনি আমাকে ধারণ করতে পারবে না। আমি ঊষার মত তোমার কাছে এসেছিলাম, আবার তেমনি অদৃশ্য হয়ে যাব।”
পুরুরবা: “তোমার বিরহে আমার তূণীর হতে বাণ নির্গত হয় নি, জয়শ্রী লাভ হয় নি, আমি যুদ্ধে গমন করে গাভী আনয়ন করতে পারি নি, আমার সৈন্যরা সিংহনাদ করবার চিন্তা এককালে ত্যাগ করেছে।”
ঊর্বশী: “তুমি আমাকে যত্ন ও সেবা করতে বলে আমি এতদিন তোমার গৃহে অবস্থান করেছিলাম। তুমি নিজে মনুষ্য হয়েও দেবলোকবাসিনী অপ্সরার প্রীতি ও প্রেম লাভ করেছিলে, কিন্তু এতদিনে তার অবসান হল, আমি এক্ষণে প্রস্থান করব। হে পুরুরবা, তুমি গৃহে ফিরে যাও, আমাকে আব পাবে না।”
পুরুববা: ঊর্বশীর মুখে এই নিষ্ঠুর বাণী শুনে বললেন, “তলে তোমার প্রণয়ী পুরুরবা আজ পতিত হোক, আর কখনও যেন সে না উঠে। সে যেন বহু দূরে দূর হয়ে যায়। সে যেন নিয়তির অঙ্কে শয়ন করে। বলবান বৃকরা তাকে ভক্ষণ করুক।”
ঊর্বশী: “হে পুরুরবা! এরূপ মৃত্যু কামনা করো না, উচ্ছন্নে যেও না। দুর্দান্ত বৃকেরা যেন তোমাকে ভক্ষণ না করে। রমণীর প্রণয় স্থায়ী হয় না। নারীর হৃদয় এবং বৃকের হৃদয় দুটি এক প্রকার। হে ইলাপুত্র পুরুরবা! দেবতারা তোমাকে আশীর্বাদ করছেন, তুমি মৃত্যুজয়ী হবে, তুমি পুণ্যকর্ম দ্বারা দেবতাদেরকে পরিতুষ্ট করে বহুদিন পরে স্বর্গলোকে গমন করবে।”
ঊর্বশীর সম্বন্ধে পৌরাণিক গল্প
অপ্সরা ঊর্বশীর সম্বন্ধে পৌরাণিক গল্পটি হল নিম্নরূপ –
- (১) কোন সময়ে বিষ্ণু ধর্মপুত্র হয়ে গন্ধমাদন পর্বতে ধ্যান করতে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। ইন্দ্রের মহা ভয় হল, বুঝি তার ইন্দ্রত্ব যায়! তখন ইন্দ্র বিষ্ণুরূপী ধর্মপুত্রের ধ্যান ভঙ্গ করবার জন্য কামদেব ও অপ্সরাদেরকে প্রেরণ করলেন। অপ্সরারা কোনো রূপেই বিষ্ণুর ধ্যান ভঙ্গ করতে পারল না।
- (২) তখন কামদেব নিজের ঊরু হতে ঊর্বশীর সৃষ্টি করলেন। ঊর্বশী বিষ্ণুর ধ্যান ভঙ্গ করায় ইন্দ্র তার প্রতি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে তাকে গ্রহণ করতে চাইলেন। ঊর্বশীও সম্মতা হলেন। এই সময়ে মিত্রাবরুণও ঊর্বশীকে কামনা করলেন।
- (৩) এবার ঊর্বশী কিন্তু সম্মত হলেন না, বরং বিরাগ প্রকাশ করলেন। তাতে মিত্রাবরুণ অসন্তষ্ট হয়ে শাপ দিলেন “মানবী হয়ে জন্মগ্রহণ কর।” ঊর্বশী মানবী হয়ে জন্মগ্রহণ করে দীর্ঘকাল রাজা পুরুরবার পত্নীরূপে তার সাথে বাস করেছিলেন।
পুরুরবা ও ঊর্বশীর কাহিনী
- (১) পুরুরবা সেকালে একজন শ্রেষ্ঠ নৃপতি ছিলেন। চন্দ্রবংশে তাঁর জন্ম। বুধ ছিলেন তার পিতা। পুরুরবা যেমন ছিলেন সাহসী, তেমনি ছিলেন বীর, বিদ্বান ও দানশীল এবং দেখতেও ছিলেন পরম রূপবান। ঊর্বশী পুরুরবাকে দেখে মুগ্ধা হয়ে তাকে বিবাহ করেছিলেন।
- (২) বিবাহের সময় ঊর্বশীর সাথে পুরুরবা এইরূপ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি কখনও পরিচ্ছদবিহীন অবস্থায় তাঁকে দেখা দেবেন না। দ্বিতীয়তঃ শয্যাপার্শ্বে দুটি মেষ বাঁধা থাকবে, আর দিবসে একবার মাত্র ঘৃত পান করে তাকে জীবন ধারণ করতে হবে। পুরুরবা তাতে সম্মত হলেন।
- (৩) যেদিন এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটবে সেদিনই ঊর্বশী পুরুরবাকে পরিত্যাগ করে গন্ধর্বলোকে চলে যাবেন। মহারাজা পুরুরবা বিশেষ দৃঢতার সাথে দীর্ঘকাল এই প্রতিজ্ঞা পালন করেছিলেন, কিন্তু দৈবক্রমে তাঁর সেই প্রতিজ্ঞা ব্যর্থ হয়ে গেল।
- (৪) গন্ধর্বরাজ বিশ্ববেণু ঊর্বশীকে শাপমুক্ত করবার জন্য একদিন রাত্রিকালে তাঁর শয্যাপার্শ্ব হতে মেষ দুটিকে চুরি করে নিয়ে গেলেন। পত্নীর অনুরোধে পুরুরবা বস্ত্রহীন অবস্থাতেই মেষ দুটির উদ্ধারের জন্য বের হলেন। হঠাৎ বিদ্যুতালোকে উর্বশী স্বামীকে বস্ত্রহীন অবস্থায় দেখতে পেয়ে সেই মুহূর্তেই তাঁকে পরিত্যাগ করে গন্ধর্বলোকে প্রস্থান করলেন।
- (৫) বিরহবিধুর পুরুরবা ঊর্বশীর বিরহে সর্বত্র পরিভ্রমণ করেন, অবশেষে কুরুক্ষেত্রের পক্ষ নামক তীর্থে ঊর্বশীর দেখা পেয়েছিলেন। রাজার কাতরোক্তিতে উর্বশী তাঁকে একটি যজ্ঞ সম্পাদনের কথা বললেন।
- (৬) যদি সেই যজ্ঞ অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন হয়, তাহলে বৎসরে একদিন তাদের মিলন হবে এবং তিনি গন্ধর্বলোকে গমনের অধিকারী হবেন। পুরুরবা প্রতিষ্ঠানপুরী নামক স্থানে রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। ঊর্বশীর গর্ভে তাঁর ছয়টি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করেছিল।
সৌন্দর্যলক্ষ্মী ঊর্বশী
ঊর্বশী সৌন্দর্যলক্ষ্মী। যুগে যুগে সেই হরি আদিম প্রভাত হতে সৌন্দর্যের চিরন্তন আদর্শময়ী ঊর্বশীকে লাভ করবার আশায় কত পুরুরবার হাহাকার, কত পুরুরবার বিরহকাতরবাণী, আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয়েছে, কখনও সেই প্রাণময়ী সৌন্দর্য স্বরূপিনী ঊর্বশী পুরুরবাকে ধরা দিয়েছেন, কখনও ছলনা করেছেন, তবু সেই অনাদিকাল হতে সৌন্দর্যপ্রিয় নর নন্দনবাসিনী ঊর্বশীকে লাভ করবার জন্য ব্যাকুল আগ্রহে কেবলই চলেছে সেই সৌন্দর্যলক্ষ্মীর সন্ধানে।
উপসংহার :- তাই কবির কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে – “ফিরিবে না, ফিরিবে না, অস্ত গেছে সে গৌরবশশী,
অস্তাচলবাসিনী ঊর্বশী।
তাই আজি ধরাতলে বসন্তের আনন্দ-উচ্ছ্বাসে
কার চিরবিরহের দীর্ঘশ্বাস মিশে ব’হে আসে,
পূর্ণিমা নিশীথে যবে দশদিকে পরিপূর্ণ হাসি,
দূবস্মৃতি কোথা হ’তে বাজায় ব্যাকুল-করা বাঁশি,
ঝরে অশ্রুরাশি।
তবু আশা জেগে থাকে প্রাণের ক্রন্দনে,
অয়ি অবন্ধনে॥
(FAQ) অপ্সরা ঊর্বশী সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
স্বর্গের অপ্সরা।
পুরুরবা।
কামদেব।
ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ১৫ সূক্তের সাতটি ঋক রচনা করে ঊর্বশী খ্যাতি অর্জন করেন।