ওয়াহাবি আন্দোলন -এর সূচনা, ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলন, ওয়াহাবি কথার অর্থ, বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলন, আন্দোলনের কারণ, তিতুমিরের নেতৃত্ব, কৃষ্ণদেব রায়ের সাথে সংঘর্ষ, তিতুমিরের নিজেকে বাদশাহ ঘোষণা, বারাসাত বিদ্রোহ, বিদ্রোহের বিস্তার, পরাজয়, আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য, চরিত্র ও গুরুত্ব সম্পর্কে জানবো।
ওয়াহাবি আন্দোলন প্রসঙ্গে ধর্মীয় আন্দোলন বা ইসলামীয় শাখা গোষ্ঠীর আন্দোলন, ওয়াহাবি আন্দোলনের সূচনা, ওয়াহাবি আন্দোলনের সময়কাল, ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতৃত্ব, ওয়াহাবি আন্দোলন কি, ওয়াহাবি আন্দোলনের কারণ, ওয়াহাবি আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য, ওয়াহাবি আন্দোলনের চরিত্র, ওয়াহাবি আন্দোলনের দুজন নেতা, বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতা তিতুমির, ওয়াহাবি আন্দোলনের উদ্দেশ্য, ওয়াহাবি আন্দোলনের ফলাফল সম্পর্কে জানব।
ওয়াহাবি আন্দোলন
ঐতিহাসিক ঘটনা | ওয়াহাবি আন্দোলন |
সময়কাল | ১৮২২-৩১ খ্রিস্টাব্দ |
স্থান | বাংলা |
প্রধান নেতা | তিতুমির |
ফলাফল | ব্যর্থতা |
ভূমিকা :- ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল ইংরেজ ও তার পৃষ্ঠপোষক জমিদারদের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্ধ মুসলিমদের সশস্ত্র প্রতিবাদ। তাদের সঙ্গে হিন্দু কৃষকরা যোগ দিলে বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করে।
ওয়াহাবি আন্দোলন
আঠারো শতকে আবদুল ওয়াহাব নামে এক ব্যক্তি আরব দেশে ইসলাম ধর্মে যে সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন তা ‘ওয়াহাবি আন্দোলন’ নামে পরিচিত।
‘ওয়াহাবি’ কথার অর্থ
এখানে ‘ওয়াহাবি’ কথার অর্থ হল ‘নবজাগরণ‘। তিতুমির মক্কায় গিয়ে সৈয়দ আহমেদের কাছ থেকে ওয়াহাবি আদর্শ গ্রহণ করেন। এরপর তিনি বাংলায় এসে ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু করেন।
ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলন
ভারত-এ ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন উত্তরপ্রদেশের রায়বেরিলির বাসিন্দা সৈয়দ আহমদ।
বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের কারণ
আরবের অনুকরণে উনিশ শতকে বাংলায় তিতুমির ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলনের বিভিন্ন কারণ ছিল। যেমন –
(১) ইসলামের শুদ্ধিকরণ
তিতুমির মনে করতেন, বাংলাদেশ-এ প্রচলিত ইসলামধর্মে বহু কুসংস্কার প্রবেশ করেছে। তাই ইসলামের শুদ্ধিকরণ ঘটিয়ে পবিত্র কোরানের নির্দেশ অনুসারে ইসলামকে পরিচালনার উদ্দেশ্যে তিতুমির শুদ্ধিকরণ আন্দোলন শুরু করেন।
(২) খাজনা আদায়ে অত্যাচার
প্রথম জীবনে তিতুমির বিভিন্ন জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনীতে কাজ করতেন। এই সময় তিনি খাজনা আদায়ের জন্য দরিদ্র কৃষকদের ওপর জমিদারদের অত্যাচার স্বচক্ষে দেখেন।
(৩) সংগঠন প্রতিষ্ঠা
তিতুমির জমিদার, মহাজন ও নীলকরদের হাতে নির্যাতিত দরিদ্র মুসলিমদের নিয়ে একটি বিশাল বাহিনী গড়ে তোলেন। এর ফলে জমিদার ও নীলকরদের সঙ্গে তাঁর সংঘর্ষ বেধে যায়।
(৪) ওয়াহাবিদের ওপর অত্যাচার
পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায় ঘোষণা করেন যে, কেউ তিতুমিরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলে এবং দাড়ি রাখলে তাদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হবে এবং যারা তিতুমিরকে বাড়িতে স্থান দেবে তাদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হবে। এতে তিতুমিরের অনুগামীরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়।
ওয়াহাবি আন্দোলনে তিতুমিরের নেতৃত্ব
বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন মির নিসার আলি বা তিতুমির। তিনি জমিদার ও নীলকরদের হাতে নির্যাতিত দরিদ্র মুসলমানদের নিয়ে একটি বিরাট বাহিনী গড়ে তোলেন। এতে জমিদার ও নীলকররা আতঙ্কিত হয়ে ওঠে।
কৃষ্ণদেব রায়ের সঙ্গে তিতুমিরের সংঘর্ষ
বিভিন্ন কারণে তিতুর বাহিনীর সঙ্গে কৃষ্ণদেব রায়ের সংঘর্ষ বাধে। তিতুমির ৩০০ জন অনুগামী সহ কৃষ্ণদেব রায়ের বাড়ি আক্রমণ করলে সংঘর্ষে হিন্দু মন্দির ধ্বংস হয় এবং বহু পুরোহিত নিহত হন।
নিজেকে ‘বাদশাহ’ ঘোষণা তিতুমিরের
তিতুমির বারাসাত-বসিরহাটের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটিয়ে নিজেকে ‘বাদশাহ’ বলে ঘোষণা করেন। তাঁর শাসনের প্রধানমন্ত্রী হন মৈনুদ্দিন এবং সেনাপতি হন গোলাম মাসুম।
বারাসাত বিদ্রোহ
তিতুমির নারকেলবেড়িয়া গ্রামে একটি বাঁশের কেল্লা তৈরি করে সেখানে তাঁর সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিভিন্ন স্থানের জমিদারদের কাছে কর দাবি করেন। এই ঘটনা বারাসাত বিদ্রোহ‘ নামে পরিচিত।
তিতুমিরের আন্দোলনের বিস্তার
২৪ পরগনা, নদিয়া, ঢাকা, খুলনা, যশোহর, রাজশাহি, মালদহ-সহ বাংলার বিভিন্ন জেলায় তিতুমিরের আন্দোলন প্রসারিত হয়।
তিতুমিরের পরাজয়
জমিদার, নীলকর ও ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি-র মিলিত বাহিনী ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে তিতুমিরের বাহিনীকে আক্রমণ করে এবং কামানের আঘাতে তিতুমিরের বাঁশের কেল্লা ধ্বংস করে দেয়।
তিতুমিরের মৃত্যু
১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৯ নভেম্বর তিতুমির ও তার কয়েকজন অনুগামী যুদ্ধক্ষেত্রে বীরের মতো মৃত্যু বরণ করেন।
বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য
উনিশ শতকে তিতুমিরের নেতৃত্বে পরিচালিত ওয়াহাবি আন্দোলনের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন –
(১) শুদ্ধিকরণ
বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল ইসলামের কুসংস্কারগুলি দূর করা এবং পবিত্র কোরান-নির্দেশিত পথে ইসলামের শুদ্ধিকরণ ঘটানো।
(৩) জমিদার-বিরোধিতা
ধর্মীয় সংস্কারের উদ্দেশ্যে শুরু হলেও ওয়াহাবি আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল অত্যাচারী জমিদার, নীলকর ও মহাজনদের আধিপত্য ধ্বংস করা।
(৩) ব্রিটিশ বিরোধিতা
ইংরেজ কোম্পানি যেহেতু বাংলার অত্যাচারী জমিদার, নীলকর ও মহাজনদের রক্ষাকর্তা ছিল। সেহেতু ওয়াহাবি আন্দোলন শীঘ্রই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়।
(৪) স্বাধীনতা
ওয়াহাবি আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল বিদেশি ব্রিটিশ শাসন ও দেশীয় জমিদারদের আধিপত্য ধ্বংস করে স্বাধীনতা এবং নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা।
(৫) মুসলিম প্রাধান্য
শুরু থেকেই বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনে মুসলিম প্রাধান্য ছিল। কারণ ইসলামের আদর্শের ভিত্তিতেই ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু হয়। তথাপি বহু নির্যাতিত ও দরিদ্র নিম্নবর্ণের হিন্দুও মুসলিমদের সঙ্গে এই আন্দোলনে শামিল হয়েছিল।
বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলনের চরিত্র বা প্রকৃতি
বাংলার তিতুমিরের নেতৃত্বে সংঘটিত ওয়াহাবি আন্দোলন বা বারাসাত বিদ্রোহের চরিত্র বা প্রকৃতি কী ছিল তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক আছে। যেমন –
(১) ধর্মীয় আন্দোলন
ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, বিহারীলাল সরকার, কুমুদনাথ মল্লিক প্রমুখ বারাসাত বিদ্রোহের মধ্যে ‘সাম্প্রদায়িক’ অর্থাৎ ধর্মীয় চরিত্র দেখতে পেয়েছেন। কেউ কেউ মনে করেন যে, এই আন্দোলন ছিল ‘ধর্মোন্মাদ মুসলমানদের কাণ্ড এবং হিন্দু বিরোধী। ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছেন যে, এই বিদ্রোহ ছিল ‘হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সংগঠিত আক্রমণ।”
(২) অসাম্প্রদায়িক আন্দোলন
কোনো কোনো ইতিহাসবিদ ওয়াহাবি আন্দোলনের মধ্যে কোনো সাম্প্রদায়িকতা অর্থাৎ ইসলামি উন্মাদনা দেখতে পাননি। তাই হান্টার, খনটন প্রমুখ মনে করেন যে, এই আন্দোলন ছিল অসাম্প্রদায়িক।
(৩) শোষণের বিরোধিতা
নরহরি কবিরাজ, ড. কেয়ামুদ্দিন আহমদ প্রমুখ মনে করেন, বারাসাত বিদ্রোহ ছিল অত্যাচারী জমিদার, নীলকর ও ব্রিটিশ-বিরোধী এক আন্দোলন। শোষণ ও অত্যাচারের বিরোধিতাই ছিল বিদ্রোহের মূল কথা।
(৪) কৃষক বিদ্রোহ
ওয়াহাবি আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা মুসলিম কৃষক হলেও তাদের মধ্যে ধর্মীয় চেতনা যথেষ্ট সক্রিয় ছিল। তাই অধ্যাপক বিনয়ভূষণ চৌধুরীর মতে, “ওয়াহাবি আন্দোলন ধর্মীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত কৃষক আন্দোলন।”
বাংলাদেশে ওয়াহাবি আন্দোলনের গুরুত্ব
ব্রিটিশ শাসনকালে বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনে তিতুমিরের নেতৃত্বে একইসঙ্গে বিদেশি ইংরেজ শাসন এবং দেশীয় জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু হয়। ড. শশীভূষণ চৌধুরীর মতে, “এই আন্দোলন ছিল জমিদার-বিরোধী ও ব্রিটিশ সরকার বিরোধী গণসংগ্রাম।”
(১) জমিদার-বিরোধিতা
বারাসাত বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের সঙ্গে তিতুমিরের বাহিনীর সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে। তিতুমির হিন্দু-মুসলিম উভয় শ্রেণির জমিদারদের বিরুদ্ধে তাঁর অনুগামীদের ঐক্যবদ্ধ করেন। তাই ড. বিনয়ভূষণ চৌধুরী বলেছেন, “তিতুমিরের সংগ্রাম ছিল জমিদারদের বিরুদ্ধে।”
(২) ব্রিটিশ বিরোধিতা
বারাসাত বিদ্রোহ জমিদারদের বিরুদ্ধে শুরু হলেও শেষপর্যন্ত তা ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহে পরিণত হয়। বারাসাত-বসিরহাটের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘোষণা করে তিতুমির নিজেকে ‘বাদশাহ’ বলে ঘোষণা করেন। ড. শশীভূষণ চৌধুরী বলেছেন যে, “এই আন্দোলন ছিল প্রবলভাবে ব্রিটিশ বিরোধী।”
(৩) কৃষক ঐক্য
ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল কৃষক ঐক্যের একটি মূর্ত প্রতীক। মুসলিম কৃষকরা ছিল এই আন্দোলনের চালিকাশক্তি। ড. বিনয়ভূষণ চৌধুরী বলেছেন, “এই বিদ্রোহ হল ধর্মীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত এক কৃষক বিদ্রোহ।”
(৪) নিম্নবর্ণের শ্রেণিসংগ্রাম
তিতুমিরের ডাকে সমাজের নিম্নবর্গের দরিদ্র মানুষ বারাসাত বিদ্রোহে শামিল হয়। বহু দরিদ্র হিন্দু কৃষকও এই আন্দোলনকে সমর্থন করে।
রণজিৎ গুহর অভিমতে ওয়াহাবি আন্দোলন
ওয়াহাবি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তিতুমির দরিদ্র, সাধারণ কৃষকদের রাজনৈতিক সংগ্রামের আঙিনায় আনতে সক্ষম হন। ড. রণজিৎ গুহও মনে করেন যে, ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল নিম্নবর্ণের মানুষের রাজনৈতিক সংগ্রাম ও মর্যাদা রক্ষার লড়াই।
হিন্দু বিরোধি ওয়াহাবি আন্দোলন
অধ্যাপক বিনয়ভূষণ চৌধুরী বলেছেন যে, তিতুমিরের সংগ্রাম ছিল জমিদারদের অনাচারের বিরুদ্ধে। সে যুগে অধিকাংশ জমিদার হিন্দু হওয়ায় এই আন্দোলনকে হিন্দু-বিরোধী বলে মনে হতে পারে। কিন্তু মুসলিম জমিদাররাও ওয়াহাবিদের হাত থেকে রেহাই পাননি। তা ছাড়া নিম্নবর্গের বহু হিন্দুও তিতুমিরকে সমর্থন করত।
উপসংহার:- মূলত কৃষক আন্দোলন হলেও ওয়াহাবি আন্দোলনের ধর্মীয় চরিত্রকে অস্বীকার করা যায় না। অর্থনৈতিক জীবনের সাথে জড়িত ও ধর্মীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত এই আন্দোলন শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয় ঠিকই, তবে এই আন্দোলন ভবিষ্যৎ কৃষক আন্দোলনগুলির পথপ্রদর্শকের ভূমিকা নিয়েছিল।
(FAQ) ওয়াহাবি আন্দোলন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
আবদুল ওয়াহাব আরব দেশে।
সৈয়দ আহমদ।
১৮২২-৩১ খ্রিস্টাব্দ।
বারাসাত বিদ্রোহ।
তিতুমির।