বিজয়নগর রাজ্যের শ্রেষ্ঠ রাজা কৃষ্ণদেব রায় প্রসঙ্গে পূর্বের সন্ধি বহাল, পর্তুগীজ নৌশক্তির সঙ্গে আপোষ, তুর্কী তীরন্দাজ নিয়োগ, মুসলিম রাজ্য গুলির আক্রমণ, বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্যের অধিপতি, শাসন ব্যবস্থা, শিল্পের পৃষ্ঠপোষক, সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক, ধর্মসহিষ্ণুতা, প্রশংসা ও তার মৃত্যু সম্পর্কে জানবো।
রাজা কৃষ্ণদেব রায়
ঐতিহাসিক চরিত্র | কৃষ্ণদেব রায় |
সাম্রাজ্য | বিজয়নগর সাম্রাজ্য |
বংশ | তুলুভ বংশ |
রাজত্বকাল | ১৫০৯-১৫৩০ খ্রি |
পর্যটক | বারবোসা, পায়েজ |
ভূমিকা :- তুলুভ বংশের রাজা বীর নরসিংহের পর তাঁর ভ্রাতা কৃষ্ণদেব রায় (১৫০৯-১৫৩০ খ্রি) বিজয়নগরের সিংহাসনে বসেন। তিনি ছিলেন বিজয়নগরের শ্রেষ্ঠ রাজা। তাঁর আমলে বিজয়নগরের ক্ষমতা ও সমৃদ্ধি সর্বোচ্চ সীমায় উঠে।
দক্ষিণের মুসলিম রাজ্য গুলির শক্তি হ্রাস
বীর নরসিংহ পর্তুগীজদের সঙ্গে যে চুক্তি করেন তার ফলে আরবদেশ থেকে আমদানি যুদ্ধের ঘোড়াগুলি পর্তুগীজরা একমাত্র বিজয়নগরকে সরবরাহ করে। দক্ষিণের অন্য মুসলিম রাজ্যগুলি পর্তুগীজ হার্মাদদের উৎপাতের জন্য সমুদ্রপথে ঘোড়া আনতে পারত না। এজন্য তাদের শক্তি কমে যায়।
কৃষ্ণদেব রায় কর্তৃক পূর্বের সন্ধি বহাল
কৃষ্ণদেব রায় পর্তুগীজ গভর্ণর আলবুকার্কের সঙ্গে আগের সন্ধি বহাল রাখেন। তিনি পর্তুগীজদের ভাইকাল দুর্গ পুনর্নির্মাণের অনুমতি দেন। বিজাপুরের কাছ থেকে পর্তুগীজরা গোয়া বন্দর অধিকার করলে, কৃষ্ণদেব রায় এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন নি।
পর্তুগীজ নৌশক্তির সঙ্গে কৃষ্ণদেব রায়ের আপোষ
তিনি স্থল বাহিনীকে শক্তিশালী করলেও, নৌবাহিনী গঠনে সমান উৎসাহ দেখান নি। এজন্য তাকে পর্তুগীজ নৌশক্তির সঙ্গে আপোষ করতে হয়।
কৃষ্ণদেব রায় কর্তৃক তুর্কী তীরন্দাজ নিয়োগ
বিজয়নগর রাজ্যের শ্রেষ্ঠ রাজা কৃষ্ণদেব রায় তুর্কী তীরন্দাজ নিয়োগ করে বিজয়নগর বাহিনীকে শক্তিশালী করেন। এর ফলে কৃষ্ণদেব রায় একের পর এক যুদ্ধে জিততে থাকেন।
কৃষ্ণদেব রায়ের আমলে মুসলিম রাজ্য গুলির আক্রমণ
কৃষ্ণদেব রায়ের রাজত্বকালে দক্ষিণে বাহমনী রাজ্য ভেঙে ৫টি মুসলিম রাজ্য স্থাপিত হয়। এই ৫টি রাজ্য জোট বেঁধে বিজয়নগরকে ধ্বংস করার চেষ্টা করলে কৃষ্ণদেব রায় দক্ষতার সঙ্গে তা প্রতিহত করেন। যেমন –
- (১) সুলতান মাহমুদ শাহ বিজয়নগরের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন। কৃষ্ণদেব রায় শুধুমাত্র তাকে পরাস্ত করেন নি, তাঁর পিছু নিয়ে তার রাজ্যে ঢুকে পড়েন।
- (২) বিজাপুরের সুলতান ইউসুফ আদিল শাহ যুদ্ধে পরাস্ত ও নিহত হন। তিনি বিজাপুর বাহিনীকে বিধ্বস্ত করেন। সিওয়েলের মতে ‘বিজাপুরের বিরুদ্ধে জয়লাভের পর কৃষ্ণদেব রায় কিছুটা উদ্ধত, আত্মগর্বী এবং স্বৈরচারী হন। কৃষ্ণদেব রায়চুর দোয়াব ও বিদরের দুর্গ অধিকার করেন।
- (৩) মুসলিম সুলতানদের মধ্যে মুসলিম রাজ্যগুলি ভেদনীতি খাটাবার জন্য কৃষ্ণদেব বিদর রাজ্য মহম্মদ শাহকে ছেড়ে দেন।
- (৪) গোলকুণ্ডা ও বিজাপুর একযোগে বিজয়নগর আক্রমণের চেষ্টা করলে ১৫২০ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণদেব তা প্রতিহত করেন।
- (৫) বিজাপুরের সুলতানের বিখ্যাত দুর্গ গুলবর্গা বিজয়নগরের হাতে চলে আসে। তিনি বিজাপুরের সিংহাসনে ইউসুফ আদিল শাহের স্থলে দ্বিতীয় মহম্মদ শাহকে বসিয়ে গুলবর্গা ফিরিয়ে দেন।
- (৬) তিনি উড়িষ্যা আক্রমণ করে উদয়গিরি ও কোণ্ডবিডু অধিকার করেন।
বিস্তৃত সাম্রাজ্যের অধিপতি কৃষ্ণদেব রায়
কৃষ্ণদেব রায় এক সুবিস্তীর্ণ সাম্রাজ্যের অধিপতি হন। তার সাম্রাজ্যের পূর্ব সীমা ছিল উড়িষ্যার কটক, পশ্চিম সীমা ছিল মহারাষ্ট্রের সলটে এবং দক্ষিণ সীমা ছিল কন্যাকুমারী।
কৃষ্ণদেব রায়ের শাসন ব্যবস্থা
বিজয়নগর রাজ্যের শ্রেষ্ঠ রাজা কৃষ্ণদেব রায় তাঁর সুবিস্তীর্ণ রাজ্যকে সুশাসনের ব্যবস্থা করেন। তিনি সামন্তশক্তির প্রভাব খর্ব করে কেন্দ্রের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন। প্রধানমন্ত্রী বা মহাপ্রধান ছিলেন রাজার বিশ্বাসভাজন লোক। প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের মহাপ্রধান নিয়ন্ত্রণ করতেন। প্রাদেশিক শাসকরা তালুক থেকে খাজনা আদায় করে রাজকোষে জমা দিত।
শিল্পের পৃষ্ঠপোষক কৃষ্ণদেব রায়
কৃষ্ণদেব রায় শিল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি নেগমপুর নগরের প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিজয়নগরে বহু মন্দির, গোপুরম, মণ্ডপ তৈরি করেন। তিনি বিজয়নগরের নিকটে এক বিরাট জলসেচের হ্রদ খোদাই করেন।
সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক কৃষ্ণদেব রায়
তার পৃষ্ঠপোষকতায় তেলেগু সাহিত্যের বিশেষ উন্নতি হয়। তিনি নিজে তেলেগু ও সংস্কৃত ভাষায় দক্ষ ছিলেন। তিনি তেলেগু ভাষায় একটি রাজনীতির ও সংস্কৃত ভাষায় একটি নাটক রচনা করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থটির নাম ছিল অমুক্ত মাল্যদা। তিনি সংস্কৃতের অনুকরণ না করে স্বাধীনভাবে তেলেগু ভাষায় সাহিত্য রচনার জন্য উৎসাহ দেন।
কৃষ্ণদেব রায়ের ধর্মসহিষ্ণুতা
তার আমলে বাণিজ্যের বিরাট প্রসার ঘটে। বিজয়নগরের ঐশ্বর্য ও সমৃদ্ধি সর্বোচ্চ সীমায় উপনীত হয়। কৃষ্ণদেব রায় যদিও বৈষ্ণবধর্মের অনুরাগী ছিলেন তবুও তিনি অন্য ধর্মের প্রতি যথার্থ সহিষ্ণুতা দেখাতেন। তার সাম্রাজ্যে সকল ধর্মের লোক স্বাধীনতা ভোগ করত।
কৃষ্ণদেব রায়ের প্রশংসা
পর্তুগীজ পর্যটক পায়েজ তাঁর চরিত্র ও নীতির উচ্চ প্রশংসা করেছেন। বারবোসা তার ন্যায় বিচার ও ধর্মসহিষ্ণুতার উচ্চ প্রশংসা করেছেন।
কৃষ্ণদেব রায়ের মৃত্যু
১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে এই প্রখ্যাত শাসক কৃষ্ণদেব রায়ের মৃত্যু হয়।
উপসংহার :- পর্তুগীজ পর্যটক বারবোসার মতে “কৃষ্ণদেব রায়ের আমলে যে কোনো ব্যক্তি বিজয়নগরে আসা-যাওয়া ও নিজ নিজ ধর্মীয় মত নির্ভয়ে পালন করত।”
(FAQ) বিজয়নগর রাজ্যের শ্রেষ্ঠ রাজা কৃষ্ণদেব রায় সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
কৃষ্ণদেব রায়।
তুলুভ বংশ।
১৫০৯-১৫৩০ খ্রিস্টাব্দ।
কৃষ্ণদেব রায়