বিখ্যাত আমেরিকান ভাইরোলজিস্ট এবং চিকিৎসক জনাস সল্ক পোলিও ভ্যাকসিন আবিষ্কারের জন্য বিশ্বজুড়ে পরিচিত। ১৯৫৫ সালে তাঁর তৈরি করা ভ্যাকসিন পোলিও মহামারী নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। সল্কের ভ্যাকসিনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল এটি নিরাপদ এবং কার্যকরভাবে মানবদেহে পোলিও ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম। তাঁর অবদানের জন্য তিনি বিজ্ঞানের জগতে ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছিলেন এবং তাঁর কাজ লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচাতে সহায়তা করেছে।
বিজ্ঞানী জনাস সল্ক
ঐতিহাসিক চরিত্র | জনাস সল্ক |
পুরো নাম | জনাস এডওয়ার্ড সল্ক |
জন্ম | ২৮ অক্টোবর, ১৯১৪ খ্রি |
পেশা | ভাইরোলজিস্ট এবং চিকিৎসক |
বিখ্যাত আবিষ্কার | পোলিও ভ্যাকসিন |
কর্মস্থল | সল্ক ইনস্টিটিউট ফর বায়োলজিক্যাল স্টাডিজ |
প্রধান অবদান | ১৯৫৫ সালে প্রথম কার্যকরী পোলিও ভ্যাকসিন আবিষ্কার |
ভ্যাকসিনের ধরণ | ইনঅ্যাকটিভেটেড পোলিও ভ্যাকসিন (IPV) |
প্রধান পুরস্কার | Presidential Medal of Freedom (১৯৭৭) |
মৃত্যু | ২৩ জুন, ১৯৯৫ খ্রি |
ভূমিকা :- ভয়ঙ্কর পোলিও রোগের কথা আজ সকলেরই জানা। এই রোগের ভ্যাক্সিন নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রচার শুরু হয় ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে। যে মহান বিজ্ঞানীর আবিষ্কার এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে তাঁর নাম জনাস সল্ক।
জনাস সল্কের জন্ম
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটান শহরে এক ইহুদি পরিবারে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে জন্মেছিলেন জনাস সল্ক। তাঁর বাবা শহরের কাপড়কলে কাজ করতেন। রোজগার যা হত তাতে সকলের খেয়ে পরে কোনো মতে দিন কেটে যেত।
বিজ্ঞানী জনাস সল্কের ছেলেবেলা
সল্করা ছিলেন তিন ভাই। পড়াশুনায় সকলেই চৌকস। তার মধ্যে জনাস সর্বোত্তম। সন্তানদের শিক্ষাদীক্ষার প্রতি বাবার ছিল সতর্ক নজর। ছেলেবেলা থেকেই বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন জনাস। সমবয়সী অন্য ছেলেরা যখন খেলাধুলো নিয়ে ব্যস্ত সেই সময় বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকতেন জনাস। খেলাধুলো বিশেষ পছন্দ করতেন না। শরীরও ছিল শীর্ণ। কিন্তু মেধা ছিল অসাধারণ। একবার যা মন দিয়ে পড়তেন, তা তাঁর মনে গেঁথে যেত।
জনাস সল্কের শিক্ষা
- (১) নিউইয়র্ক শহরের টাউনসেন্ড হ্যারিস হাইস্কুলের খুব নামডাক ছিল। এই স্কুলেই পড়াশুনা করেছিলেন জনাস। পরীক্ষায় তাঁর ফলাফল হত চমকপ্রদ। স্কুলের ছাত্র শিক্ষক সকলেরই প্রিয়পাত্র ছিলেন তিনি। স্কুলের শেষ পরীক্ষা পর্যন্ত বরাবর সবার ওপরে থাকত তাঁর রেজাল্ট।
- (২) হ্যারিস স্কুল থেকে সসম্মানে স্নাতক হয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য জনাস ভর্তি হলেন সিটি কলেজে। এই কলেজে ঢোকার আগে পর্যন্ত বিজ্ঞান বিষয়ে বিশেষ মনোযোগী হয়ে উঠলেন। তাঁর বেশি ভাল লাগত চিকিৎসা বিজ্ঞান।
- (৩) সিটি কলেজ থেকে বেরিয়ে তিনি ভর্তি হলেন নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা বিভাগে। আর এই সময় থেকেই জীবনের পথটিও ছকা হয়ে যায়। তিনি স্থির করেন ডাক্তারি পাশ করে চিকিৎসা গবেষণাতেই আত্মনিয়োগ করবেন।
- (৪) সিটি কলেজের পরীক্ষাগুলিতেও অসাধারণ ফল করতে লাগলেন তিনি। সব পরীক্ষাতেই তাঁর স্থান সবার প্রথমে। ফলে সবরকম বৃত্তিই তিনি লাভ করলেন। বৃত্তির টাকাতেই চলতে লাগল তাঁর পড়াশুনা।
ডঃ ফ্রান্সিসের সাথে জনাস সল্কের পরিচয়
মেডিকেল কলেজে পড়ার সময়েই জনাসের পরিচয় হয় ডঃ মরিস ব্রডির সঙ্গে। ডঃ ব্রডি সেই সময় পোলিও রোগ নিয়ে গবেষণা করছিলেন। সেই কলেজে আরও এক যশস্বী গবেষক অধ্যাপক ছিলেন ডঃ ফ্রান্সিস। তিনিও একই সময়ে গবেষণা করছিলেন ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগের ওপর। জনাসকে কিন্তু আকর্ষণ করল ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগের ওপরে ডঃ ফ্রান্সিসের কাজ। আশ্চর্য এই যে উত্তরকালে ইনফ্লুয়েঞ্জা নয় পোলিও রোগ নিয়ে গবেষণার ফলেই জনাস বিশ্ববিজ্ঞানের ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেছেন।
জনাস সল্কের গবেষণায় প্রেরণা
ডঃ ফ্রান্সিসের কাছেই কাজ শিখতে লাগলেন জনাস। সমকালীন চিকিৎসা বিজ্ঞানে ইনফ্লুয়েঞ্জা বিশেষজ্ঞ হিসেবে ডঃ ফ্রান্সিস ইতিমধ্যেই বিশ্বখ্যাতি লাভ করেছিলেন। তাঁর কাছে কাজ শিখে গবেষণার নাড়িনক্ষত্র জানা হয়ে যায় জনাসের। এই শিক্ষাই তাঁকে পরবর্তীকালে গভীরতর গবেষণায় প্রেরণা জুগিয়েছে।
ভাইরাস-ঘটিত রোগের প্রতিষেধক নিয়ে কাজ
- (১) সেই সময়ে ভাইরাস-ঘটিত রোগের প্রতিষেধক নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিলেন। একদল গবেষক, ভাইরাসকে মেরে তা দিয়ে রোগের প্রতিষেধক তৈরি করে রুগীর শরীরে প্রয়োগ করছিলেন। এর ফলে রুগীর দেহে কোনরূপ বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটত না। কিন্তু এই ধরনের প্রতিষেধকের মেয়াদ হত খুবই অল্প। মেয়াদ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই ভ্যাকসিন নিতে হত।
- (২) দ্বিতীয় ভাগের গবেষকরা চিকিৎসার এই অসুবিধার দিক বিবেচনা করে জ্যান্ত ভাইরাসকেই তাঁরা প্রতিষেধক রূপে রুগীর শরীরে প্রয়োগ করতেন। এতে সুবিধা ছিল। প্রতিষেধক প্রয়োগের ফলে রুগীর দেহে যে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হত, তা দীর্ঘস্থায়ী হত। ঘন ঘন ভ্যাকসিন নেবার দরকার হত না। কিন্তু এই পদ্ধতির একটি মারাত্মক কুফলও ছিল। ভ্যাকসিন প্রয়োগে যদি গোলমাল হত তাহলে রোগ প্রতিরোধের বদলে শরীর রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ত।
- (৩) এই ভাবেই নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে সেই সময় চলছিল রোগ প্রতিরোধ শক্তির গবেষণা। ডঃ ফ্রান্সিস ছিলেন প্রথম মতের সমর্থক। তিনি ইনফ্লুয়েঞ্জার ভাইরাস দিয়ে কালচার বানিয়ে অর্থাৎ জৈব মাধ্যমে তাদের বংশবিস্তার ঘটিয়ে সেই ভাইরাসগুলির ওপর অতি-বেগুনী রশ্মি প্রয়োগ করে মেরে ফেলতেন। পরে ওই মৃত ভাইরাসকেই প্রতিষেধক বা ভ্যাকসিন হিসাবে ব্যবহার করতেন। এই পথ ধরেই চলছিল তাঁর গবেষণা।
পোলিও রোগ নিয়ে গবেষণা
- (১) ইনফ্লুয়েঞ্জা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়েই অনুরূপ লক্ষণযুক্ত আরও একটি রোগের প্রতিও দৃষ্টি পড়েছিল গবেষকদের। সেটি হল পোলিও রোগ। সেই সময়ে এই ভয়াবহ রোগটির আক্রমণে লক্ষ লক্ষ শিশু শৈশবেই পঙ্গু হয়ে পড়ছিল। তাই তার প্রতিষেধক আবিষ্কারের কাজে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন কিছু বিজ্ঞানী। ডঃ ব্রাডিও ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেবার পর থেকেই পোলিও রোগের প্রতিষেধক টীকা আবিষ্কারের জনা গবেষণায় ডুবে গিয়েছিলেন তিনি।
- (২) একই সময়ে আরও একজন চিকিৎসাবিজ্ঞানী একই বিষয় নিয়ে গবেষণা করছিলেন টেম্পল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইরোলজি বিভাগে। তাঁর নাম ডঃ জন ফিলমার। কিন্তু গবেষণার ফলাফল তাঁরা দুজনে যা লাভ করলেন তার ফল হল দুর্ভাগ্যজনক।
- (৩) ভাইরাস দিয়ে প্রতিষেধক তৈরি করলেন দুজনেই। সেই প্রতিষেধক প্রয়োগ করা হল কয়েকজনের সুস্থ শরীরে। পরে দেখা গেল, রোগ প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তুলবার বদলে ওই ভ্যাকসিন শরীরে পোলিও রোগ ডেকে আনল। ফল দাঁড়াল সারাজীবনের পঙ্গুত্ব। এই ঘটনার পরে ডঃ ব্রডি ও ডঃ ফিলমার আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন অকেজো হয়ে গেল। অপযশের দায় মাথায় চাপল দুজনের। আর তাঁদের অবস্থা প্রত্যক্ষ করে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরাও হয়ে পড়লেন আতঙ্কগ্রস্ত। ডঃ ব্রডি ও ডঃ ফিলমারের গবেষণা নিয়ে আর মাথা ঘামাতে চান নি কেউ।
জনাস সল্কের বিবাহ
জনাস ডাঃ ফ্রান্সিসের তত্ত্বাবধানে ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগ নিয়েই গবেষণা করছিলেন। এই সময়েই জীবনে একটি ভুল করে বসলেন তিনি। ডুবে ছিলেন ল্যাবরেটরি নিয়ে, তার মধ্যে কাঁধে চাপালেন সংসারের বোঝা। তিনি বিয়ে করে বসলেন। ফলে সংসারের খরচ-খরচার বাড়তি চাপ নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়লেন। অর্থের অভাব মেটাবার জন্য বাড়তি রোজগারের উপায় ভাবতে হল তাঁকে। শেষপর্যন্ত বন্ধুরা পরামর্শ দিল গবেষণার কাজে সময় নষ্ট না করে অর্থ রোজগারের জন্য প্রাইভেট প্রাকটিস শুরু করতে।
মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে জনাস সল্ক
জনাস কিন্তু আর্থিক অনটনের মধ্যে থেকেও বন্ধুদের পরামর্শ মেনে নিতে পারলেন না। তিনি মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেন এবং ইনফ্লুয়েঞ্জার ভাইরাস ও প্রতিষেধক প্রস্তুতির গবেষণাতেই মেতে রইলেন। এই ভাবে কেটে গেল পাঁচটি বছর।
পিটসবার্গ মেডিকেল কলেজে জনাস সল্ক
এরপর চলে এলেন পিটসবার্গ মেডিকেল কলেজে। সেখানে তখন সবে ভাইরাস বাহিত রোগের ওপর কাজ করার জন্য গবেষণাগার তৈরি হয়েছে। সেই গবেষণাগারেরই অধিকর্তা হলেন জনাস। নতুন কর্মস্থলে স্বাধীনভাবে নিজের কাজ করার প্রশস্ত সুযোগ সুবিধা পাওয়া গেল। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতেও বিলম্ব করলেন না তিনি। ইনফ্লুয়েঞ্জা ছেড়ে গবেষণা শুরু করলেন পোলিও নিয়ে।
পোলিও রোগের গবেষণায় অধিনায়ক জনাস সল্ক
ইতিমধ্যে ইনফ্লুয়েঞ্জা নিয়ে সাত বছর কাজ করেছিলেন জনাস। কিন্তু বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর কাজের ক্ষেত্র ইনফ্লুয়েঞ্জা নয়। পোলিও নিয়েই স্বাধীনভাবে কাজ করতে হবে। এই চিন্তা থেকেই মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ ছেড়ে পিটসবার্গে চলে এসেছিলেন। এখানে ইতিমধ্যেই পোলিও রোগের ওপর কাজ করার জন্য একটি বিশেষ টিম তৈরি করার প্রস্তুতি চলছিল। জনাস এসে এই টিমের অধিনায়কের পদটি গ্রহণ করলেন এবং যথারীতি গবেষণায় আত্মনিয়োগ করলেন।
জনাস সল্কের প্রতি মার্কিন সরকারের সহযোগিতা
নিজের ঘরে বসে একের পর এক প্রতিষেধক নিয়ে গবেষণা চালিয়ে চললেন। পরীক্ষা চালাচ্ছেন গিনিপিগ আর বানরের ওপরে। শেষ পর্যন্ত বানরের ওপরে ভাইরাসের বিভিন্ন প্রকার প্রয়োগের পরেই পেয়ে গেলেন ঈঙ্গিত বস্তুর সন্ধান। এই কাজে মার্কিন সরকারেরও অকুন্ঠ সহযোগিতা পেয়েছিলেন জনাস। ইনফ্লুয়েঞ্জার ভাইরাসের সঙ্গে দীর্ঘ সাত বছরের ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল জনাসের। কাজেই পোলিওর ভাইরাসদের আলাদা করে চিনে নিতে কিছুমাত্র অসুবিধা হল না তাঁর। তিনি জেনে গেলেন পোলিওর ভাইরাস হুবহু ফ্লুর মতো দেখতে হলেও তার ক্রিয়াকর্ম আলাদা।
তিন স্বনামখ্যাত বিজ্ঞানীর সাফল্যের বিবরণ
এই পর্যন্ত অগ্রসর হবার পরেই জনাস হাতে পেয়ে গেলেন পোলিও গবেষণার ওপরে তিন স্বনামখ্যাত বিজ্ঞানীর সাফল্যের বিবরণ। এই তিন বিজ্ঞানী হলেন এন্ডারস, ওয়ালার এবং রবিনসন। এই তিন বিজ্ঞানী প্রাণীর শরীরের টিস্যুতে পোলিও ভাইরাসের কালচার তৈরি করে তাদের বংশ বৃদ্ধির উপায় আবিষ্কার করেছিলেন। আর এই কালচার নিয়ে গবেষণা করে ডাঃ ডেভিড ব্রডিয়ান নামে এক গবেষক আবিষ্কার করেছিলেন পোলিও ভাইরাস তিন রকমের হয়। তিনি তাদের আলাদা করেছিলেন টাইপ-1, টাইপ-II, ও টাইপ-III নামে।
ডাঃ হোউই-এর ভ্যাকসিন
নানান পত্র পত্রিকা ঘেঁটে পোলিও নিয়ে যাঁরা ইতিপূর্বে কাজ করেছেন তাদের বিবরণ সংগ্রহ করতে লাগলেন জনাস। সে সবের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন নিজের গবেষণা। এমনি করেই একসময়ে তিনি পেয়ে গেলেন একটি সংবাদ। ডঃ হোউই নামে এক গবেষক নাকি হপকিন্স গবেষণাগারে কাজ করার সময়ে পোলিও রোগের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে ফেলেছেন। তিনি কালচার তৈরি করার জন্য পোলিও ভাইরাসের ওপরে ‘রে’ প্রয়োগ না করে করেছেন ফরম্যালডিহাইড রাসায়নিক। তার ফলে যে মৃত ভাইরাস পেয়েছেন তা দিয়েই তৈরি করেছেন ভ্যাকসিন। ডাঃ হোউই-এর ভ্যাকসিন পূর্বোক্ত তিন টাইপের পোলিও ভাইরাসের বিরুদ্ধেই প্রাণীর শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে। কিন্তু দেখা গেল ডাঃ হোউই-এর ভ্যাকসিনকে নানা কারণে যথোপযুক্ত বলে গ্রহণ করা যায় নি। তবে তাঁর এই গবেষণার ফলে পোলিও ভ্যাকসিন আবিষ্কারের কাজটি অনেকটাই অগ্রসর হয়েছে।
জনাস সল্কের পোলিও নিয়ে দিনরাত গবেষণা
মার্কিন সরকার পোলিও রোগ প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন। সরকারের তরফ থেকে বিজ্ঞানীদের আশ্বাস দেওয়া হল, খরচের কথা না ভেবে তাঁরা যেন নিশ্চিন্তে গবেষণা করে যান। চিকিৎসা বিজ্ঞানীবা সরকারের সাহায্যের আশ্বাস পেয়ে উঠে পড়ে লাগলেন। জনাসও দিনরাত ভুলে পোলিওকে জব্দ করার উপায় খুঁজতে লাগলেন। কেবল আমেরিকাতেই নয়, সেই সময়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশও পোলিও নিয়ে গবেষণার কাজ এগিয়ে চলেছে। তার বিবরণ প্রকাশিত হচ্ছে বিভিন্ন জার্নালে।
কাজে মগ্ন জনাস সল্ক
উপস্থিত হল ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাস। জনাস এতদিনে একটা বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন। পোলিও রোগের পেছনে রয়েছে টাইপ-I, টাইপ-II, ও টাইপ-III এই তিন ধরনের ভাইরাস। একটি বিষয়ে নিশ্চিত হবার পর তিনি কার্যকরী ভ্যাকসিন আবিষ্কারের কাজে মগ্ন হলেন। এমন ভ্যাকসিন তৈরি করতে হবে যা এই তিন ভাইরাসের বিরুদ্ধেই অ্যান্টিবডি তৈরি করবে কিন্তু প্রাণীর শরীরে হবে না কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া।
ডাঃ সাবিনের ভ্যাকসিন
এর মধ্যে জানা গেল, ডাঃ সাবিন নামে বিজ্ঞানীর তত্ত্বাবধানে একদল বিজ্ঞানীর গবেষণার ফলাফল। ডাঃ সাবিন জানিয়েছেন, ভাইরাসের মৃতদেহ নিয়ে ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা নিষ্ফল। যেভাবে গুটি বসন্তের ভ্যাকসিন যেমন মৃত নয় মৃতবৎ ভাইরাস দিয়ে তৈরি হয়েছিল, পোলিও রোগের কার্যকরী ভ্যাকসিনও সেভাবেই তৈরি করতে হবে। এছাড়া অন্য পথ নেই। জনাস সল্ক কিন্তু এই সম্ভাবনার কথা মানতে পারলেন না। তিনি জানালেন, ডাঃ সাবিনের উপদিষ্ট পথে ভ্যাকসিন তৈরি হলে তা শরীরের পক্ষে হবে খুবই মারাত্মক। পোলিও ভ্যাক্সিন তৈরি করতে হবে মৃত ভাইরাস দিয়েই।
আশাবাদী জনাস সল্ক
ডাঃ ফ্রান্সিসও জনাসের মতামতকে সমর্থন জানালেন। এইভাবে চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মধ্যে গবেষণার ফলাফল নিয়ে দুটি শিবির গড়ে উঠল। এক শিবিরের মাথায় রইলেন ডাঃ সাবিন। অন্য শিবিরের নেতৃত্ব বইল জনাস সল্কের হাতে। মৃত ভাইরাস নিয়ে পোলিও রোগের ভ্যাকসিন তৈরির সম্ভাবনায় জনাস ছিলেন আশাবাদী। তিনি দেখেছেন, মৃত ভাইরাসের ভ্যাকসিন ব্যবহার করে ইনফ্লুয়েঞ্জার ক্ষেত্রে আশানুরূপ ফল পাওয়া গেছে। এই ভ্যাকসিন স্বল্পাযু হলেও এতে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা থাকে না। জনাস এই পথ ধরেই গবেষণায় ডুবে গেলেন।
ভ্যাকসিন তৈরি করতে সক্ষম জনাস সল্ক
সল্ক স্থির করলেন, পোলিও ভাইরাসের তিন রকম টাইপের এমন একটিকে বেছে নিতে হবে যার মৃতদেহ দিয়ে তৈরি ভ্যাকসিন তিনরকম ভাইরাসের বিরুদ্ধে উপযুক্ত অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারবে। যদিও সল্ক জানতেন সবরকম ভ্যাকসিনেই কিছু না কিছু অসুবিধা থেকেই যায়। সর্বসুবিধাযুক্ত আদর্শ ভ্যাকসিন তৈরি করা সম্ভব নয়। সব জেনেও তিনি পরীক্ষার পর পরীক্ষা চালিয়ে ভ্যাকসিনের গুণাগুণ যাচাই করে চলেন। ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা প্রমাণের পরীক্ষা চালাতে থাকেন একের পর এক বানরের ওপর। চেষ্টা ও নিষ্ঠার একাগ্রতার ফল ফলতেও দেরি হয় না। একটি কার্যকরী ভ্যাকসিন অবিলম্বেই তৈরি করতে সক্ষম হলেন সল্ক। কিন্তু সাফল্যের পেছন পেছনই সন্দেহ জাগে মনে, ভ্যাকসিনের নির্ধারিত গুণ মানুষের দেহেও বজায় থাকবে তো?
জনাস সল্কের খবর পত্রিকায় প্রকাশ
১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে জনাস সল্কের পোলিও রোগের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হল নিউইয়র্কের একটি দৈনিক পত্রিকায়। খবর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই পিটসবার্গের মেডিকেল কলেজের সামনে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। দলে দলে নরনারী শিশু সন্তান কোলে নিয়ে ভিড় জমাতে লাগলেন। সকলেই চাইছেন আগাম প্রতিষেধক নিয়ে সন্তানকে ভবিষ্যতে পোলিওর সম্ভাবনা থেকে মুক্ত রাখতে।
পোলিও সম্পর্কে পিতামাতার আতঙ্ক
ইতিপূর্বে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন ১৯১৮-১৯ খ্রিস্টাব্দের মতো ওই বছরেও দেশে একটা মহামারী হবার সম্ভাবনা রয়েছে। ইনফ্লুয়েঞ্জার বদলে এবারে হয়তো পোলিওই হবে সেই মহামারীর উৎস। সেকারণে পোলিও সম্পর্কে আতঙ্কে ভুগছিলেন সন্তানের পিতামাতারা।
দূরদর্শনের মাধ্যমে জনাস সল্কের বক্তব্য
ক্রমবর্ধমান ভিড় দেখে প্রমাদ গুণলেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তাঁদের এবং জাতীয় বৃত্তি কমিটির অনুরোধে সল্ককে দূরদর্শনের মাধ্যমে তাঁর বক্তব্য দেশবাসীকে জানাতে হল। অত্যন্ত কুণ্ঠার সঙ্গে তিনি জানালেন, যে তাঁর ভ্যাকসিনটি পোলিও রোগের একটি আদর্শ প্রতিষেধক হিসাবে কার্যকরী হবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু এখনো যথেষ্ট পরিমাণ ভ্যাকসিন তৈরি করে ওঠা সম্ভব হয় নি বলে উপস্থিত অনেক শিশুকেই ফিরে যেতে হবে। তবে তিনি এই বলে সকলকে আশ্বাস দেন যে অবিলম্বে উপযুক্ত পরিমাণ ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা তিনি করবেন।
নিজ শরীরে জনাস সল্কের টীকা গ্রহণ
সল্কের আন্তরিক আশ্বাস, বিনীত মূর্তি ও ব্যক্তিত্ব সেদিন জনগণের মনে এই বিশ্বাস এনে দিয়েছিল যে সল্ক তাঁদের পোলিও আতঙ্ক থেকে নিশ্চিত মুক্তি দিতে সক্ষম হবেন। পোলিও সম্পর্কে তাদের ভয় অনেকটাই প্রশমিত হল। লোককল্যাণের কাজে পোলিও ভ্যাকসিন টিকা প্রবর্তনের আগে সল্ক পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্য নিজের শরীরেই প্রথমে টিকা নিলেন। ফলাফলে সন্তুষ্ট হয়ে একই টিকা স্ত্রী ও তিন সন্তানকে দিলেন। এরপরে আর কোনো সংশয় রইল না। ব্যাপকভাবে টিকাদান শুরু করলেন।
বিভিন্ন দেশে জনাস সল্কের টিকার ব্যবহার
তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন জাতীয় বৃত্তি ব্যবস্থাপকের কর্তা ব্যাসিল ও’ কন্নার ও অন্যান্য সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান। দেখতে দেখতে সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পরে অন্যান্য দেশেও পোলিওর টিকার ব্যবহার ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
জনাস সল্কের টিকা আবিষ্কারে নিরুদ্বিগ্ন পিতামাতা
সল্কের নতুন এই আবিষ্কারে ব্যবহারিক উপযোগিতা সম্পর্কে বিশ্বের তাবৎ চিকিৎসকদেরও নিশ্চিন্ত করল টিকাদানের প্রসারের গোড়ার দিকের একটি ঘটনা। বিশ্ববিখ্যাত ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ও সল্কের প্রেরণাদাতা ও শিক্ষাগুরু ডাঃ ফ্রান্সিস ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে নিজের উদ্যোগ নিয়ে আঠারো লক্ষ শিশুকে পোলিওর টিকা দেওয়ালেন। পোলিও এই শিশুদের একজনের কাছেও ঘেঁষতে পারল না। সল্কের আবিষ্কারের সাফল্যের এই সংবাদ রাতারাতি ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বজুড়ে উৎসাহ উদ্দীপনার ঢেউ তুলল। এতদিন পরে মারাত্মক পোলিও রোগের একটি ভ্যাকসিন পেয়ে বিশ্বের অসংখ্য আর্ত পিতামাতা তাঁদের শিশুর নিরাপত্তা সম্পর্কে নিরুদ্বিগ্ন হলেন।
বিজ্ঞানী জনাস সল্কের টিকা আবিষ্কারে রক্ষিত পৃথিবীর মানুষ
পোলিও রোগের বৈজ্ঞানিক নাম পোলিও মাইয়েলাইটিস বা শিশু পক্ষাঘাত। শিশুদেরই বেশি এই রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। ভয়ঙ্কর রোগটির লক্ষণ হুবহু ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো। মাথা ধরা, সমস্ত শরীরে প্রচন্ড ব্যাথা, গা-বমি-বমি ভাব সেই সঙ্গে থাকে জ্বর। এই ভাবে খুব অল্প দিনের মধ্যেই এই রোগের জীবাণু স্নায়ুর পেশীগুলোকে অকেজো করে ফেলে। ফল পক্ষাঘাত। কত অমূল্য জীবন যে এই রোগের আক্রমণে অসহায় নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে তার কোনো লেখাজোখা নেই। সমীক্ষায় দেখা গেছে শতকরা ৮০ জন শিশুরই এই রোগের সম্ভাবনা থাকে। সারাজীবন পঙ্গু হয়ে থেকে অশেষ দুঃখকষ্টের মধ্যে কাটাতে হয়। জনাস সল্কের আবিষ্কার পৃথিবীর মানুষকে এই ভয়ঙ্কর রোগের আতঙ্ক থেকে রক্ষা করেছে।
জনাস সল্কের একাগ্র সাধনা ও নিঃস্বার্থ ত্যাগ
সল্কের জীবনের এই মহৎ সাফল্য এনে দিয়েছিল তাঁর একাগ্র সাধনা ও নিঃস্বার্থ ত্যাগ। অবশ্য তাঁকে পথ দেখিয়েছিল তাঁর পূর্বসূরী প্রতিভাবান চিকিৎসাবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস, সাবিন, কিলমার, ব্রডি ও বডিয়ান প্রমুখের পোলিও ভ্যাক্সিন সংক্রান্ত গবেষণার ফলাফলগুলি। অবশ্য বিজ্ঞানের প্রায় প্রতিটি আবিষ্কারের ক্ষেত্রেই বিজ্ঞান সাধকদের সাধনার ফলাফলের পরম্পরা ধরাবাহিক ধারায় চূড়ান্ত পরিপূর্ণতার রূপ লাভ করে। বিজ্ঞানের ইতিহাসের এটিই চিরন্তন ঐতিহ্য। পরবর্তী পর্যায়ে সল্ক তাঁর ভ্যাকসিনকে আরও উন্নত মানে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
বিজ্ঞানী জনাস সল্কের মৃত্যু
আর্ত মানবতার পরম বন্ধু মহান চিকিৎসাবিজ্ঞানী জনাস সল্ক ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
উপসংহার :- জনাস সল্ক ছিলেন এক অসাধারণ বিজ্ঞানী, যিনি পোলিও ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে লাখো মানুষের জীবন বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর আবিষ্কৃত ইনঅ্যাকটিভেটেড পোলিও ভ্যাকসিন (IPV) বিশ্বব্যাপী পোলিও মহামারীর বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তিনি শুধুমাত্র একজন বিজ্ঞানী ছিলেন না, বরং মানবতার প্রতি গভীর দায়িত্ববোধ থেকেও কাজ করেছেন। তাঁর গবেষণার সাফল্য আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়। তাঁর জীবন ও কাজ স্বাস্থ্যসেবা ও ভাইরোলজির ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা হিসেবে আজও স্মরণীয়।
(FAQ) বিজ্ঞানী জনাস সল্ক সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
জনাস সল্ক একজন আমেরিকান ভাইরোলজিস্ট ছিলেন, যিনি পোলিও ভ্যাকসিন আবিষ্কারের জন্য বিখ্যাত। তাঁর গবেষণা লক্ষ লক্ষ মানুষকে পোলিও ভাইরাস থেকে রক্ষা করেছে।
তিনি ১৯৫৫ সালে প্রথম কার্যকরী পোলিও ভ্যাকসিন (Inactivated Polio Vaccine – IPV) আবিষ্কার করেন, যা পোলিও মহামারী নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
সল্কের তৈরি ভ্যাকসিন ইনঅ্যাকটিভেটেড পোলিও ভাইরাস ব্যবহার করে। এটি দেহে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে, যাতে দেহ পোলিও ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত থাকে।
সল্ক ইনস্টিটিউট ফর বায়োলজিক্যাল স্টাডিজ একটি বায়োমেডিক্যাল গবেষণা প্রতিষ্ঠান, যা জনাস সল্ক ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য ও মানব কল্যাণে উন্নয়ন সাধনে কাজ করে।
জনাস সল্ককে তাঁর অবদানের জন্য অনেক পুরস্কার দেওয়া হয়, যার মধ্যে অন্যতম হলো ১৯৭৭ সালে প্রাপ্ত “Presidential Medal of Freedom”।