ফিরোজ শাহ তুঘলকের বৈদেশিক নীতি প্রসঙ্গে সাম্রাজ্যের ঐক্য রক্ষা, দুর্বলতা, ফিরোজের দাক্ষিণাত্য নীতি, বাংলা অভিযান, বাংলা বিচ্ছিন্ন, উড়িষ্যা আক্রমণ, কাংড়া আক্রমণ, সিন্ধু অভিযান সম্পর্কে জানবো।
ফিরোজ শাহ তুঘলকের বৈদেশিক নীতি
ঐতিহাসিক ঘটনা | ফিরোজ শাহ তুঘলকের বৈদেশিক নীতি |
সুলতান | ফিরোজ শাহ তুঘলক |
বাংলা অভিযান | ১৩৫৩-৫৪ খ্রি |
থাট্টা | সিন্ধু |
রাজ্য জয় নীতি | অস্বীকার |
ভূমিকা :- খলজি সুলতান আলাউদ্দিন বা তুঘলক সুলতান মহম্মদের মত সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক রাজ্য বিস্তার নীতিতে বিশ্বাস করতেন না। ফিরোজের মধ্যে সেনাপতিসুলভ গুণ ছিল না।
সাম্রাজ্যের ঐক্য রক্ষা
তিনি বিশ্বাস করতেন যে, যদি বিদ্রোহের দ্বারা বিচ্ছিন্ন অঞ্চলগুলিকে দমন না করা হয় তবে এই বিদ্রোহীরা সাম্রাজ্যের বাকি অংশ অধিকার করার চেষ্টা করবে। সুতরাং তার অভিযানগুলির লক্ষ্য ছিল সুলতানি সাম্রাজ্যের সীমা সুরক্ষিত করা এবং সম্ভব হলে সাম্রাজ্য হতে বিচ্ছিন্ন অঞ্চলকে ফিরিয়ে আনা। নতুন কোনো স্থান জয় করার চিন্তাকে তিনি মনে স্থান দেননি।
নিজামীর মন্তব্য
ডঃ নিজামীর ভাষায়, “ফিরোজ কোনো নতুন স্থান জয় করেন নি, কোনো স্থান নতুন করে হারান নি; তিনি রাজ্য জয় করার কোনো নীতিই স্বীকার করতেন না।”
দুর্বলতা
একথা মনে রাখা দরকার যে, সেনাপতি ও সামরিক সংগঠক হিসেবে ফিরোজ শাহ দুর্বল ছিলেন। কাজেই তিনি রাজ্য জয়ের কথা ভাবতেন না।
ফিরোজের দাক্ষিণাত্য নীতি
- (১) মহম্মদ বিন তুঘলকের মৃত্যুর আগেই দক্ষিণে সুলতানি আধিপত্য বিনষ্ট হয়। কাজেই ফিরোজ শাহ সিংহাসনে বসার পর দক্ষিণে সুলতানির হৃত ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করা উচিত ছিল। ফিরোজ মনে মনে এই দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। কিন্তু তা কার্যে পরিণত করার ক্ষমতা তাঁর ছিল না।
- (২) তিনি পাণ্ড্যদেশে দূত পাঠিয়ে মুসলিম শাসকদের আনুগত্য লাভের ব্যর্থ চেষ্টা করেন। পরে সেখানকার মুসলিম নেতারা বিজয়নগরের বিরুদ্ধে ফিরোজের হস্তক্ষেপ চাইলে, ফিরোজ অকারণ রক্তপাতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। তিনি অজুহাত দেখান যে থাট্টা বা সিন্ধু অভিযানের ফলে তাঁর বাহিনী ক্লান্ত। এখন তাঁর পক্ষে নতুন কোনো অভিযান পাঠান সম্ভব নয়।
- (৩) দক্ষিণে বাহমনী রাজ্য স্থাপিত হলে সুলতান এই বিদ্রোহী রাজ্যটিকে জয় করার জন্য কোনো চেষ্টা করেননি। কারণ বাহমনী সুলতানের শক্তি সম্পর্কে ফিরোজের ভীতি ছিল।
- (৪) আফিফের মতে, বাংলা অভিযানের পর তিনি বাহমনী সুলতানের বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য তেলেঙ্গানার রাজার দ্বারা অনুরুদ্ধ হন। কিন্তু বিয়ানা পর্যন্ত এগিয়ে তিনি মত পাল্টান এবং দিল্লীতে ফিরে আসেন। মোট কথা, তিনি দাক্ষিণাত্য জয়ের ইচ্ছা স্থায়ীভাবে ত্যাগ করেন।
বাংলা অভিযান
- (১) বাংলার বিদ্রোহের ক্ষেত্রে ফিরোজ সমান অনাগ্রহ দেখান নি। কারণ তিনি বাংলাকে সুলতানি সাম্রাজ্যের মূল্যবান অঙ্গ বলে মনে করতেন। মহম্মদ তুঘলকের আমলে হাজী ইলিয়াস বাংলায় বিদ্রোহের ধ্বজা তোলেন।
- (২) ফিরোজ শাহের আমলে ইলিয়াস ত্রিহুত জয় করে তাঁর সীমান্ত সুলতানি সীমান্তের দিকে ঠেলে নিয়ে যান। ইলিয়াসের এই ক্ষমতা বৃদ্ধি সুলতান ফিরোজ শাহ বিপজ্জনক মনে করেন। সুলতান ফিরোজ শাহ ১৩৫৩-১৩৫৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলার বিরুদ্ধে প্রথম অভিযান পরিচালনা করেন।
- (৩) ইলিয়াস তার সীমান্ত রক্ষায় অক্ষম হয়ে পিছু হঠে, দিনাজপুরে মহানন্দা নদের দ্বীপে একডালা দুর্গে আশ্রয় নেন। ফিরোজ এই দুর্গ কয়েক মাস ধরে অবরোধ করেন। কিন্তু মুসলিম রমণীরা দুর্গের ছাদে উঠে ফিরোজের দয়া ভিক্ষা করায় এবং বর্ষাকাল আসন্ন হওয়ায় ফিরোজ এই অভিযান পরিত্যাগ করেন।
- (৪) এর ফলে ইলিয়াস শাহ স্বাধীন সুলতানের মতই বাংলায় রাজত্ব করেন। বাংলায় এই ব্যর্থ অভিযান বাবদ ফিরোজ রাজকোষের প্রচুর অর্থ নষ্ট করেন। ফিরোজের সামরিক মর্যাদা বিনষ্ট হয়।
বাংলা বিচ্ছিন্ন
- (১) ১৩৫৯ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব বাংলা বা সোনার গাঁ হতে জাফর খান নামে এক আমীর এসে ফিরোজের কাছে অভিযোগ করেন যে, ইলিয়াসের পুত্র সিকন্দার শাহ তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছেন। ফিরোজ জাফর খানকে পুনঃ-প্রতিষ্ঠিত করতে চান। তাছাড়া সিকন্দার শাহের ঔদ্ধত্যে তিনি বিরক্ত হন।
- (২) দিল্লী বাহিনী আসার খবর পেয়ে প্রথম অভিযানের মতই সিকন্দার একডালা দুর্গে আশ্রয় নেন। ফিরোজ কিছুকাল দুর্গ অবরোধ করার পর এক সন্ধি দ্বারা কার্যত সিকন্দার শাহের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেন। বাংলা সুলতানি সাম্রাজ্য থেকে স্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন হয়।
উড়িষ্যা আক্রমণ
- (১) বাংলা থেকে দিল্লী ফেরার পথে বিহার হয়ে ফিরোজ শাহ অকস্মাৎ উড়িষ্যায় ঢুকে পড়েন। জাজনগর বা উড়িষ্যার রাজা গজপতি ভানুদেব সুলতানি বাহিনীর ভয়ে পালিয়ে যান। আফিফের মতে, সুলতানি বাহিনী জগন্নাথের মন্দির ধ্বংস করে ও বহু ধনরত্ন লুঠ করে দিল্লী ফিরে যায়।
- (২) ফিরোজ শাহ শরিয়ত মেনে চলতেন। সুতরাং শরিয়ত অনুযায়ী তিনি তার সাম্রাজ্যের ভেতর কোনো পুরাতন হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেন নি। ফিরোজ শাহ তার আত্মজীবনীতে বলেছেন যে, দার-উল-হারাম অর্থাৎ তার সাম্রাজ্য সীমার বাইরের অঞ্চলে তিনি অমুসলিমদের প্রতি শরিয়ৎ অনুযায়ী কঠোরতা দেখান।
- (৩) যেহেতু উড়িষ্যা ছিল তাঁর রাজ্যসীমার বাইরে সেহেতু এই বিচার অনুযায়ী তিনি সম্ভবত জগন্নাথের মন্দির আক্রমণ করেন। যাই হোক, এই কাজ যে তিনি উলেমাদের সন্তুষ্ট করার জন্য করেন তা বলা যায়।
- (৪) একই কারণে তিনি নগরকোটে জ্বালামুখী মন্দির আক্রমণ করেন। ফিরোজের উড়িষ্যা অভিযান সাম্রাজ্যবাদের পরিচয় বলে ভাবার কারণ নেই। বিধর্মী হিন্দুদের বিরুদ্ধে এই অভিযান পরিচালিত হয় নি।
- (৫) আইন-ই-মহরু, আফিফের রচনা থেকে বুঝা যায় যে, সুলতানি সেনাদলে যাতে প্রয়োজনয়মত রণ হস্তী পাওয়া যায়, এজন্য ফিরোজ উড়িষ্যা অভিযান করেন। তিনি উড়িষ্যা রাজের বশ্যতা গ্রহণ করে সন্তুষ্ট হন এবং বেশ কিছু সংখ্যক হাতী ও মাহুত সংগ্ৰহ করেন। উড়িষ্যার হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাসে তিনি হস্তক্ষেপ করেননি।
কাংড়া আক্রমণ
ফিরোজ শাহ কাংড়া বা নগরকোট দুর্গ আক্রমণ করেন। ছয় মাস অবরোধের পর নগরকোটের রাজা বশ্যতা স্বীকার করেন। ফিরোজ জ্বালামুখী মন্দির থেকে ১৩০০ সংস্কৃত পুঁথিপত্র আনেন। সেগুলি তিনি ফার্সীতে অনুবাদ করান এবং এর নাম ছিল দলাইল-ই-ফিরোজ শাহী।
সিন্ধু অভিযান
- (১) ফিরোজের সর্বশেষে অভিযান সিন্ধুদেশে পরিচালিত হয়। সুলতান মহম্মদ মালিক তার্ঘি সিন্ধুর বিদ্রোহীদের দমন করতে গিয়ে রোগের আক্রমণে মারা যান। তখন থেকে সিন্ধুদেশ দিল্লীর অধীনতা মুক্ত ছিল।
- (২) ফিরোজ সিন্ধুর ওপর দিল্লীর শাসন পুনঃস্থাপনের জন্য ১৩৬৫ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধু অভিযান করেন। আফিফের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে থাট্টা, বা সিন্ধু অভিযানের সময় ফিরোজ তুঘলকের সামরিক অনভিজ্ঞতা ভালভাবে প্রকটিত হয়।
- (৩) তার প্রথম অভিযানের বিরুদ্ধে সিন্ধুর বিদ্রোহীরা প্রবল বাধা দেয়। তার আগে মড়কের ফলে সুলতানি সেনার বেশ ক্ষয় ক্ষতি ঘটে। কিছুকাল সম্মুখ যুদ্ধ চলার পর ফিরোজের ভয় হয় যে, তাঁর সেনাসংখ্যা যথেষ্ট না থাকায় হয়ত তাঁর পরাজয় হবে।
- (৪) তিনি যুদ্ধ বন্ধ করে গুজরাটের দিকে পিছু হঠেন। সিন্ধুবাসীরা তাঁর বাহিনীর পিছু নিয়ে বেশ কিছু ক্ষয়ক্ষতি করে। সিন্ধু নদ পার হওয়ার জন্য তিনি যে ১০০০ নৌকা যোগাড় করেন তা শত্রুরা ছিনিয়ে নেয়।
- (৫) পিছু হঠার সময় সুলতান পথ ভুল করায় কচ্ছের বালুকাময় লবণাক্ত মরু অঞ্চলে ঢুকে পড়েন। এই স্থানে খাদ্য ও পানীয়ের অভাবে তার বহু সেনা মারা যায়। বহু কষ্টে গুজরাট ফিরে আসার পর তার উজির খান-ই-জাহান দিল্লী থেকে নতুন বাহিনী এনে তাঁর সঙ্গে যোগ দিলে তিনি পূর্ব সিন্ধু অঞ্চল অধিকার করেন।
- (৬) পশ্চিম সিন্ধুতে তিনি হানাদারী চালান। শেষ পর্যন্ত সন্ত সৈয়দ হুসেন বুখারীর দৌত্যে তিনি সন্তুষ্ট হয়ে সিন্ধুর বিদ্রোহী মালিকদের বশ্যতা গ্রহণ করেন। নিম্ন সিন্ধু অঞ্চলে তিনি নিজ কর্মচারীর দ্বারা শাসন কার্য চালাবার ব্যবস্থা করেন। ২ বছর ৬ মাস পরে সুলতান দিল্লীতে ফিরে আসেন।
উপসংহার :- আসলে সেনাপতি ও সামরিক সংগঠক হিসাবে ফিরোজ শাহ তুঘলক ছিলেন দুর্বল। তাই তিনি রাজ্য জয়ের কথা ভাবতেন না।
(FAQ) ফিরোজ শাহ তুঘলকের বৈদেশিক নীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
একডালা দুর্গ।
ফিরোজ শাহ তুঘলক।
ফিরোজ শাহ তুঘলক।
১৩৫৩-৫৪ খ্রিস্টাব্দে।