চার্লস রবার্ট ডারউইন প্রসঙ্গে তার জন্ম, পিতৃপরিচয়, শিক্ষাজীবন, বিবাহ, সামুদ্রিক গুগলিদের নিয়ে চার্লস ডারউইনের বই, বিবর্তনবাদ সম্পর্কে গবেষণা, মতবাদের প্রতিষ্ঠা, গ্ৰন্থ রচনা ও তার মৃত্যু সম্পর্কে জানবো।
চার্লস রবার্ট ডারউইন
ঐতিহাসিক চরিত্র | চার্লস ডারউইন |
জন্ম | ১২ ফেব্রুয়ারি, ১৮০১ খ্রি: |
দেশ | ইংল্যান্ড |
পরিচিতি | জীববিজ্ঞানী |
বিখ্যাত মতবাদ | বিবর্তনবাদ |
মৃত্যু | ১৯ এপ্রিল, ১৮৮২ খ্রি: |
ভূমিকা :- ঊনিশ শতকের একজন ইংরেজ জীববিজ্ঞানী ছিলেন চার্লস ডারউইন। তিনিই প্রথম প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিবর্তনবাদের ধারণা দেন। তিনিই সর্বপ্রথম অনুধাবন করেন যে সকল প্রকার প্রজাতিই কিছু সাধারণ পূর্বপুরুষ হতে উদ্ভূত হয়েছে এবং তার এই পর্যবেক্ষণটি সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন।
চার্লস ডারউইনের জন্ম
১৮০৯ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি ইংলাণ্ডের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে চার্লস ডারউইন জন্মগ্ৰহণ করেন।
জীববিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের পিতৃপরিচয়
তার পিতা ছিলেন নামকরা চিকিৎসক। মাত্র আট বছর বয়সে মাকে হারান ডারউইন। সেই সময় থেকে পিতা আর বড় বোনদের স্নেহচ্ছায়ায় বড় হয়ে উঠতে লাগলেন।
চার্লস ডারউইনের শিক্ষাজীবন
- (১) নয় বছর বয়সে তিনি স্কুলে ভর্তি হলেন। চিরাচরিত পাঠ্যসূচীর মধ্যে কোনো আনন্দই পেতেন না। তিনি লিখেছেন, বাড়িতে তাঁর ভাই একটি ছোট ল্যাবরোটরি গড়ে তুলেছিলেন। সেখানে তিনি রসায়নের নানান মজার খেলা খেলতেন।
- (২) ষোল বছর বয়সে চার্লসকে ডাক্তারি পড়ার জন্য এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেওয়া হয়। যাঁর মন প্রকৃতির রূপ রস গন্ধে পূর্ণ হয়ে আছে, মরা দেহের হাড় অস্থি মজ্জা তাঁকে কেমন করে আকর্ষণ করবে!
- (৩) ঔষধের নাম মনে রাখতে পারতেন না। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিবরণ পড়তে বিরক্তি বোধ করতেন। আর অপরেশনের কথা শুনলেই আঁতকে উঠতেন।
- (৪) চার্লসের পিতা বুঝতে পারলেন ছেলের পক্ষে ডাক্তার হওয়া সম্ভব নয়। তাকে কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি করা হল। উদ্দেশ্য ধর্মযাজক করা।
- (৫) সেই সময় কেমব্রিজের উদ্ভিদ বিদ্যার অধ্যাপক ছিলেন হেনসলো। হেনসলোর সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকেই তাঁর অনুরাগী হয়ে পড়লেন চালর্স।
- (৬) অল্পদিনের মধ্যেই গুরু-শিষ্যের মধ্যে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। কেমব্রিজ থেকে পাশ করে তিনি কিছুদিন ভূবিদ্যা নিয়ে পড়াশুনা করতে থাকেন।
জীববিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের সৌভাগ্যের উদয়
- (১) অপ্রত্যাশিতভাবে চার্লস ডারউইনের জীবনে এক অযাচিত সৌভাগ্যের উদয় হল। অধ্যাপক হেনসলোর কাছ থেকে একখানি পত্র পেলেন ডারউইন। ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে বিগল (H. M. S. Beagle) নামে একটি জাহাজ দক্ষিণ আমেরিকা অভিযানে বার হবে।
- (২) এই অভিযানের প্রধান হলেন ক্যাপ্টেন ফিজরয়। এই অভিযানের উদ্দেশ্য হল প্রাকৃতিক পরিবেশ, জীবজন্তু, গাছপালা সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করা এবং বৈশিষ্ট্যকে পর্যবেক্ষণ করা। এই ধরনের কাজে বিশেষজ্ঞ এবং অনুরাগী ব্যক্তিরাই অভিযানের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে।
- (৩) এই অভাবনীয় সৌভাগ্যের সুযোগকে কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাইলেন না ডারউইন। ১৮৩১ সালের ২৭শে ডিসেম্বর “বিগল” দক্ষিণ আমেরিকা অভিমুখে যাত্রা শুরু করল।
- (৪) ক্যাপ্টেন ফিজরয়ের নেতৃত্বে দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে জাহাজ ভেসে চলল পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। দক্ষিণ আমেরিকার উপকূল ছাড়াও গালাপগোস দ্বীপপুঞ্জ, তাহিতি, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যাণ্ড, মালদ্বীপ, সেন্ট হেলেনা দ্বীপে জাহাজ ঘুরে বেড়াল।
- (৫) এই সময়ের মধ্যে ডারউইন ৫৩৫ দিন কাটিয়েছিলেন সাগরে আর ১২০০ দিন ছিলেন মাটিতে। ডারউইন যা কিছু প্রত্যক্ষ করতেন তার নমুনার সাথে সুনির্দিষ্ট বিবরণ, স্থান, সংগ্রহের তারিখ লিখে রাখতেন।
- (৬) কোনো তত্ত্বের দিকে তাঁর নজর ছিল না। বাস্তব তথ্যের প্রতি ছিল তাঁর আকর্ষণ। ২৪শে জুলাই ১৮৩৪ সাল। ডারউইন লিখেছেন “ইতিমধ্যে ৪৮০০ পাতার বিবরণ লিখেছি, এর মধ্যে অর্ধেক ভূবিদ্যা, বাকি বিভিন্ন প্রজাতির জীবজন্তুর বিবরণ।
- (৭) “বিগল” জাহাজে চড়ে দেশভ্রমণের সময় মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর যখন ১৮৩৬ সালে ইংল্যণ্ডে প্রত্যাবর্তন করলেন ডারউইন তখন তাঁর শরীর স্বাস্থ্য ভেঙে গিয়েছে। কিন্তু অদম্য মনোবল, বাড়ির সকলের সেবায় অল্প দিনেই সুস্থ হয়ে উঠলেন।
চার্লস ডারউইনের বিবাহ
এই সময় তিনি তাঁর দুর সম্পর্কের বোন এম্মা ওয়েজউডকে বিবাহ করেন। বিবাহের সূত্রে বেশ কিছু সম্পত্তি লাভ করেন ডারউইন। এম্মার গর্ভে ডারউইনের দশটি সন্তান জন্মায়। শুধু মা হিসাবে নয়, স্ত্রী হিসাবেও এম্মা ছিলেন অসাধারণ।
সামুদ্রিক গুগলিদের নিয়ে চার্লস ডারউইনের বই
ডারউইনের পরবর্তী বই এক ধরনের সামুদ্রিক গুগলিদের নিয়ে। এই বইটি লিখতে ডারউইনের সময় লেগেছিল আট বছর।
বিবর্তনবাদ সম্পর্কে চার্লস ডারউইনের গবেষণা
এই সময় তাঁর মনোজগতে এক নতুন চিন্তার জন্ম হচ্ছিল। যদিও সুদীর্ঘ দিন পর্যন্ত তা ছিল অসংলগ্ন বিশৃঙ্খল। কিন্তু নিরলস পরিশ্রম, অধ্যাবসায়, বিশ্লেষণ, গবেষণার মধ্যে দিয়ে তারই মধ্যে থেকে সৃষ্টি হচ্ছিল এক নতুন মতবাদ – বিবর্তনবাদ।
চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদের প্রাথমিক খসড়া
ডারউইন প্রথমে তাঁর বিবর্তনবাদের প্রাথমিক খসড়া তৈরি করেন। ১৮৪২ সালে এরই বিস্তৃতি ঘটে ৩৫ পাতার একটি রচনার মধ্যে। দু বছর পর অপেক্ষাকৃত বিস্তারিতভাবে প্রস্তুত করলেন বিবর্তনবাদের উপর ২৩০ পাতার পাণ্ডুলিপি।
জীববিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের পাণ্ডুলিপি সংশোধনের কাজ
এরপর শুরু হল পাণ্ডুলিপি সংশোধনের কাজ। তাতে নতুন তথ্য সংযোজন করা, প্রতিটি তথ্যের বিচার-বিশ্লেষণ করা, তাকে আরো যুক্তিনিষ্ঠ করা। সুদীর্ঘ পনেরো বছর ধরে চলেছিল এই সংশোধন পর্ব।
চার্লস ডারউইনের বই লেখার কাজ
- (১) এইবার ডারউইন বইলেখার কাজে হাত দিলেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি গবেষণার কাজ যতখানি ভালবাসতেন, লেখালেখি করতে ততখানিই বিরক্তি বোধ করতেন। অবশেষে ২৪শে নভেম্বর ১৮৫৯ সালে ডারউইনের বই প্রকাশিত হল।
- (২) বই-এর নাম The origin of species by means of Natural Selection or the preservation of Favored Races in the struggle for life. পরবর্তীকালে এই বই শুধু Origin of Species নামে পরিচিত হয়।
- (৩) প্রকাশের সাথে সাথে ১২৫০ কপি বই বিক্রি হয়ে গেল। বিবর্তনবাদের নতুন তত্ত্ব বাইবেলের আদম ইডের কাহিনী, পৃথিবীর সৃষ্টির কাহিনীকে বৈজ্ঞানিক তথ্যের বিশ্লেষণে সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণিত করলেন।
- (৪) এই বইতে তিনি লিখেছেন, আমাদের এই পৃথিবীতে প্রতিমুহূর্তে নতুন প্রাণের জন্ম হচ্ছে। জীবের সংখ্যা ক্রমাগতই বেড়ে চলেছে। কিন্তু খাদ্যের পরিমাণ সীমাবদ্ধ। সেই কারণে নিয়ত জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে চলেছে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিরামহীন প্রতিযোগিতা।
- (৫) যারা পরিবেশের সাথে নিজেদের সামঞ্জস্য বিধান করতে পেরেছে তারাই নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে পেরেছে। কিন্তু যারা পারেনি তারা ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। এই ধারাকেই বলা হয়েছে যোগ্যতমের জয় “Survival of the Fittest”।
- (৬) কিন্তু সময়ের সাথে সাথে প্রাকৃতিক পরিবেশেরও পরিবর্তন হচ্ছে। সমুদ্রের মধ্যে জন্ম হচ্ছে স্থলভাগের, কত স্থলভাগ হারিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রগর্ভে। আবহাওয়ার পরিবর্তন হচ্ছে, নদীর গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে, অরণ্য ধ্বংস হচ্ছে। এই পরিবর্তনের সাথে সাথে জীবিত প্রাণেরও পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ছে সঠিক নির্বাচন
চার্লস ডারউইনের মতবাদের প্রতিষ্ঠা
ডারউইনের মতবাদ এই পরিবর্তনশীলতা, বংশগতি এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের উপর প্রতিষ্ঠিত। প্রাকৃতিক নির্বাচনের সাহায্যে প্রাণী পরিবেশের সাথে নিজেকে সামঞ্জস্য বিধান করে। জীবের সুবিধার জন্য এই পরিবর্তন তাদের উত্তরোত্তর উন্নতি ঘটায়, সৃষ্টি করে নতুন প্রজাতির।
জীববিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের বিভিন্ন গ্ৰন্থ রচনা
- (১) The origin of the species প্রকাশিত হওয়ার পর ডারউইন তাঁর বিবর্তনবাদ তত্ত্বকে আরো উন্নতভাবে প্রকাশ করবার জন্য ১৮৬৮ সালে প্রকাশ করলেন Variation of Animals and Plant under Domestication।
- (২) ১৮৭১ সালে প্রকাশিত হল ডারউইনের আর একখানি বিখ্যাত রচনা The Descent of Man. প্রাণে বিকাশ বৃদ্ধির সাথে সাথে তার অস্তিত্বের সংকট দেখা দিচ্ছে। প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে যোগ্যতমের জয় হচ্ছে। এক প্রজাতি থেকে জন্ম নিচ্ছে আরেক প্রজাতি।
- (৩) প্রাণী প্রতিনিয়ত নিজেকে উন্নত করছে এক স্তর থেকে আরেক স্তরে। ডারউইনের মত অনুসারে মানুষ নিম্নতর জীব থেকে ধাপে ধাপে উন্নত জীবের স্তরে এরসে পৌঁছেছে। এই ক্রমবিবর্তনের চিত্রই তিনি এঁকেছেন তার The Descent of Man গ্রন্থে।
ডারউইনের বিবর্তনবাদে মানুষের উৎপত্তি
ডারউইনের বিবর্তনবাদের প্রসঙ্গে অনেকের ধারণা মানুষের উৎপত্তি বাঁদর থেকে। কিন্তু ডারউইন কখনো এই ধরণের কথা বলেন নি। তাঁর অভিমত ছিল মানুষ এবং বাঁদর উভয়েই কোনো এক প্রাগ ঐতিহাসিক জীব থেকে বিবর্তিত হয়েছে। বাঁদররা কোনো ভাবেই আমাদের পূর্বপুরুষ নয়, তার চেয়ে দূর সম্পর্কের আত্মীয় বলা যেতে পারে।
চার্লস ডারউইনের মতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ
ডারউইনের মতে মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব কারণ সমস্ত জীব জগতের মধ্যে যে সকলের চেয়ে বেশি যোগ্যতম। প্রকৃতপক্ষে মানুষ কোন স্বর্গচ্যুত দেবদূত নয়, সে বর্বরতার স্তর থেকে উন্নত জীব। এগিয়ে চলাই তার লক্ষ্য।
জীববিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের শেষ বারের মতো লণ্ডন ভ্রমণ
- (১) তিনি যখন শেষ বারের মত লণ্ডনে এসেছিলেন তখন তাঁর বয়স ৭৩ বছর। এক বন্ধুর বাড়ির দরজার সামনে এসেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বন্ধু বাড়িতে ছিলেন না।
- (২) বন্ধুর বাড়ির চাকর ছুটে আসতেই ডারউইন বললেন, তুমি ব্যস্ত হয়ো না, আমি একটা গাড়ি ডেকে বাড়ি চলে যেতে পারব। কাজের লোককে কোনোভাবে বিব্রত না করে ধীরে ধীরে নিজের বাড়িতে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। আর বিছানা থেকে উঠতে পারেননি তিনি।
চার্লস ডারউইনের মৃত্যু
ক্রমশই তাঁর অসুস্থতা বেড়ে চলল। ডারউইন বুঝতে পারছিলেন তাঁর দিন শেষ হয়ে আসছে। তিন মাস অসুস্থ থাকার পর ১৯শে এপ্রিল ১৮৮২ সাল, পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলেন চার্লস রবার্ট ডারউইন।
উপসংহার :- চার্লস ডারউইনের মৃত্যুতে দেশ জুড়ে শোকের ছায়া নেমে এল। শত্রুরা উল্লসিত হয়ে উঠল, “তাঁর মত ঈশ্বর-বিদ্বেষী পাপীর স্থান হবে নরকে”।
(FAQ) চার্লস রবার্ট ডারউইন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
ঊনিশ শতকের একজন ইংরেজ জীববিজ্ঞানী।
১৮০৯ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি।
ইংল্যান্ড।
চার্লস ডারউইন
১৯শে এপ্রিল, ১৮৮২ সালে।