স্বাধীন হিন্দু রাজা গণেশ প্রসঙ্গে ক্ষমতা লাভ, পূর্ব পরিচিতি, সর্বময় ক্ষমতা লাভ, গোঁড়া হিন্দু, দরবেশ বিদ্রোহ, গণেশের সিংহাসন ত্যাগ, যদুর সিংহাসন লাভ, প্রকৃত ক্ষমতায় গণেশ, গণেশের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, হিন্দু-অভ্যুত্থান, দ্রুত পতন, দরবেশদের ওপর দমন নীতি, একাধিক নাম ও শিল্প সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা সম্পর্কে জানবো।
হিন্দু রাজা গণেশ
রাজা | রাজা গণেশ |
সময়কাল | ১৪১৫-১৪১৮ খ্রি |
ধর্ম | গোঁড়া হিন্দু |
উপাসনা | দেবী চণ্ডী |
উপাধি | দনুজমর্দনদেব |
ভূমিকা :- পঞ্চদশ শতকের বাংলার ইতিহাসে ইলিয়াস শাহী বংশ কিছুকাল রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দেয়। কিন্তু এই বংশের সুলতান আজম শাহের মৃত্যুর পর উপযুক্ত শাসকের অভাবে পুনরায় রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়।
রাজা গণেশের ক্ষমতা লাভ
বাংলার রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে ভাতুড়িয়া পরগণার জমিদার গণেশ দ্রুত ক্ষমতা লাভ করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহকে সিংহাসনচ্যুত করে নিজে বাংলার শাসনভার নেন (১৪১৫ খ্রি)।
রাজা গণেশের পূর্বপরিচিত
বাংলার রাজা গণেশের সম্পর্কে কোনো পক্ষপাতহীন ঐতিহাসিক বিস্তৃত তথ্য দেন নি। বিভিন্ন গ্রন্থে তাঁর সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা থেকে জানা যায় যে, গণেশ ছিলেন রাজশাহী অঞ্চলের ভাতুড়িয়ার ক্ষমতাশালী সামন্ত।
রাজা গণেশের সর্বময় ক্ষমতা লাভ
ইলিয়াস শাহী বংশের শাসনকালে তিনি দরবারে প্রতিপত্তি লাভ করেন এবং বায়াজিদ শাহ ও আলাউদ্দিন শাহের অযোগ্যতার সুযোগে প্রায় সর্বময় ক্ষমতা পান। ১৪১৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি নিজ হাতে শাসনভার নেন।
গোঁড়া হিন্দু রাজা গণেশ
গণেশ গোঁড়া হিন্দু ছিলেন এবং দরবারে বহু ইসলামী প্রথা বন্ধ করে দেন। তিনি মুসলিম ফকির, দরবেশদের প্রতি সম্মান ও বিনয় দেখাতেন না। অধিকন্তু তাঁর বিরোধিতা করার জন্য তিনি কয়েকজন দরবেশকে শাস্তি দেন।
রাজা গণেশের আমলে দরবেশ বিদ্রোহ
গণেশের শাসন ইসলামের পক্ষে ক্ষতিকারক মনে করে দরবেশ সম্প্রদায় তাঁর পতন ঘটাবার জন্য চক্রান্ত করেন। দরবেশদের প্রধান নূর কুতব আলম এক পত্র দ্বারা জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কিকে বিধর্মী গণেশকে উচ্ছেদের জন্য আহ্বান জানান।
রাজা গণেশের সিংহাসন ত্যাগ
গণেশ ত্রিহুতের রাজা শিব সিংহের সঙ্গে ইব্রাহিম শর্কির বিরুদ্ধে জোট করেন। কিন্তু ইব্রাহিম শর্কি শিব সিংহকে পরাস্ত করে বাংলায় চলে আসেন। গণেশ ইব্রাহিমের বিপুল শক্তির চাপে সিংহাসন ছেড়ে দেন।
রাজা গণেশের পুত্র যদুর সিংহাসন লাভ
ইব্রাহিমের পক্ষ গ্ৰহণ করেন গণেশের পুত্র যদু। তাঁকে ইসলামে দীক্ষিত করে, জালালুদ্দিন নাম দিয়ে বাংলার সিংহাসনে বসান হয়। এর পর ইব্রাহিম শর্কি বাংলা ছেড়ে জৌনপুরে চলে যান।
প্রকৃত ক্ষমতায় রাজা গণেশ
ইব্রাহিম শর্কি বাংলা ত্যাগ করার পর গণেশ পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসেন। যদিও জালালুদ্দিন নামেমাত্র সিংহাসনে থাকেন, প্রকৃত ক্ষমতা গণেশ করায়ত্ত করেন। গণেশ ষড়যন্ত্রকারী দরবেশদের কড়া হাতে দমন করেন। নুর কুতব আলম হতাশ হৃদয়ে প্রাণ ত্যাগ করেন।
রাজা গণেশের পুনঃ প্রতিষ্ঠা
কিছুদিন পর নিজ ক্ষমতা নিরঙ্কুশ হলে, গণেশ যদু বা জালালুদ্দিনকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে নিজে সিংহাসন অধিকার করেন। তিনি “দনুজমর্দনদেব” উপাধি নেন। এই সময় তিনি যদুকে হিন্দুধর্মে পুনরায় দীক্ষা দেন।
রাজা গণেশের মৃত্যু
পুত্র জালালুদ্দিনের ষড়যন্ত্রে রাজা গণেশ নিহত হন।
রাজা গণেশের হিন্দু অভ্যুত্থান
- (১) রাজা গণেশের এই উত্থানকে যদিও ডঃ মজুমদার হিন্দু অভ্যুত্থান রূপে দেখেছেন, সকল ঐতিহাসিক তাঁর সঙ্গে এক মত হবেন না। সামন্ত বিদ্রোহ দ্বারা সিংহাসন অধিকার ছিল মধ্য যুগের একটি সাধারণ নিয়ম।
- (২) উচ্চাকাঙ্খী সামন্ত গণেশ হিন্দুত্ববাদের জন্য নয়, তার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা পুরণের জন্য বিদ্রোহের দ্বারা ক্ষমতা দখল করেন। এই রকম ব্যাখ্যাও তার সম্পর্কে দেওয়া হয়। তিনি যদি উগ্র হিন্দুত্ববাদীর ভূমিকা নিতে চেষ্টা করেন, তার অন্যতম কারণ ছিল তাঁর সিংহাসনের পশ্চাতে সমর্থক শ্রেণী যোগাড় করা।
- (৩) তিনি সাধারণ মুসলিম প্রজাদের ওপর কোনো অত্যাচার করেন বলে জানা যায় নি। তবে তাঁর প্রধান ভুল এই ছিল যে, তিনি মুসলিম ধর্মগুরুদের প্রতি তাদের প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা দেন নি।
রাজা গণেশের দ্রুত পতন
- (১) গণেশ ছিলেন বিরাট উচ্চাকাঙ্খী ব্যক্তি। তিনি প্রতিকূল শক্তিকে বিধ্বস্ত করে নিজ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেন। গণেশ পরধর্ম-বিদ্বেষী ছিলেন এবং মুসলিম দরবেশদের প্রতি যথোচিত সম্মান না দেখিয়ে মহাভুল করেন।
- (২) তিনি ভুলে যান যে, ভারতীয় সংস্কৃতি বিভিন্ন ভাবধারার মিশ্রণে গঠিত। ভারতীয় সামাজিক পটভূমিকায় শুধুমাত্র উগ্র হিন্দু বা উগ্র মুসলিম নীতি নিয়ে শাসন করা অসম্ভব। এজন্য তাঁর দ্রুত পতন ঘটে।
দরবেশদের ওপর রাজা গণেশের দমন নীতি
কেউ কেউ বলেন যে, গণেশ রাজনৈতিক কারণে দরবেশদের ওপর দমন নীতি চালান। তিনি বৃহত্তর মুসলিম প্রজাদের ওপর কোনো অত্যাচার করেন নি।
রাজা গণেশের একাধিক নাম
গণেশের একাধিক নাম ছিল। কারণ ফার্সী গ্রন্থগুলিতে তার নাম “কানস” বা কংস লেখা হয়েছে। কারও কারও মতে, তাঁর নাম ছিল “কাশী”। তবে তার মুদ্রায় “দনুজমর্দনদের” উপাধি দেখা যায়।
শিল্প সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক রাজা গণেশ
তিনি “চণ্ডীচরণ পরায়ণ” অর্থাৎ চণ্ডীর উপাসক ছিলেন। বাংলার বেশীর ভাগ অংশ তাঁর অধিকারে ছিল। তিনি শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। মিথিলার কবি বিদ্যাপতি তার সমসাময়িক ছিলেন।
উপসংহার :- ফিরিস্তার মতে, “গণেশের মৃত্যুর পর বহু মুসলিম তাকে মুসলিম হিসেবে কবর দেওয়ার দাবী করেন। তিনি সাধারণ মুসলিমদের সঙ্গে বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক রাখেন।”
(FAQ) স্বাধীন হিন্দু রাজা গণেশ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
ভাতুড়িয়া পরগণার জমিদার।
রাজা গণেশ।
রাজা গণেশ।
১৪১৫-১৪১৮ খ্রিস্টাব্দ।