ক্যান্টন বাণিজ্য প্রসঙ্গে চিনে বিদেশি পুঁজির অনুপ্রবেশ, ক্যান্টন বাণিজ্য সম্বন্ধে ধারণা, ক্যান্টন বাণিজ্যের সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য, বাণিজ্যিক প্রাধান্য ও ক্যান্টন বাণিজ্যের অবসান সম্পর্কে জানবো।
ক্যান্টন বাণিজ্য
ঐতিহাসিক ঘটনা | ক্যান্টন বাণিজ্য |
দেশ | চীন |
বন্দর | ক্যান্টন |
প্রথম অহিফেন যুদ্ধ | ১৮৩৯-৪২ খ্রি |
নানকিং-এর সন্ধি | ১৮৪২ খ্রি |
ভূমিকা :- চিনের দক্ষিণ উপকূলে অবস্থিত ক্যান্টন বন্দর তাং যুগ (৬১৮-৯০৭ খ্রি.) থেকেই গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নিকটবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত ক্যান্টন বন্দর বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে আধুনিক যুগেও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রগুলির কাছে সমগ্র চিন উন্মুক্ত হওয়ার পূর্বে একমাত্র ক্যান্টনই ছিল বিদেশিদের কাছে চিনের উন্মুক্ত বন্দর। এই সময় ক্যান্টনের বাণিজ্যে পোর্তুগিজরা নিজেদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তখন অন্য পশ্চিমি বণিক গোষ্ঠীগুলি ক্যান্টনের বাণিজ্যে অংশ নিতে পারত না।
চিনে বিদেশি পুঁজির অনুপ্রবেশ
ষোড়শ শতক থেকে চিনের সঙ্গে বিভিন্ন পশ্চিমি দেশের প্রত্যক্ষ ও নিয়মিত যোগাযোগ শুরু হয়। সপ্তদশ শতকে ব্রিটিশ ও ওলন্দাজ বণিকদের আধিপত্য বাড়লে চিনে পোর্তুগিজদের আধিপত্য হ্রাস পেতে থাকে।
(ক) বিদেশি অনুপ্রবেশের বিভিন্ন পর্যায়
চিনে বিদেশি অনুপ্রবেশের তিনটি প্রধান পর্যায় লক্ষ্য করা যায়। যথা –
(১) প্রথম পর্যায়
অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত প্রথম ইঙ্গ-চিন যুদ্ধ বা প্রথম আফিম যুদ্ধ পর্যন্ত সময় ছিল চিনে বিদেশি অনুপ্রবেশের প্রথম পর্যায়।
(২) দ্বিতীয় পর্যায়
১৮৪২ খ্রিস্টাব্দের নানকিং চুক্তি থেকে ঊনবিংশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত সময় ছিল চিনে বিদেশি অনুপ্রবেশের দ্বিতীয় পর্যায়।
(৩) তৃতীয় পর্যায়
ঊনবিংশ শতকের শেষ থেকে ১৯৩০-এর দশক পর্যন্ত সময় ছিল চিনে বিদেশি অনুপ্রবেশের তৃতীয় পর্যায়।
(খ) আধা-উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা
- (১) চিনে বিদেশি পুঁজির অনুপ্রবেশ শুরু হওয়ার পর থেকে চিনের সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে নানকিং-এর সন্ধির পর থেকে চিনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ধারাবাহিকভাবে বিদেশিদের আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ বাড়তে থাকে।
- (২) নানকিং-এর সন্ধির পর থেকে রুদ্ধ চিনে বিদেশিদের আধিপত্যের প্রসার চিন সরকার প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়। চিনের দুর্বল মাঞ্চু সম্রাট সিংহাসনে ক্ষমতাসীন থাকলেও সামন্ততান্ত্রিক চিন ক্ৰমে আধা-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এই সময় থেকে চিনে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর মূলত পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চিনের অর্থনৈতি বিকাশ ঘটে।
ক্যান্টন বাণিজ্য সম্বন্ধে ধারণা
চিনা ও পোর্তুগিজদের বাধাদান, উচ্চ শুল্ক প্রভৃতির ফলে প্রথমদিকে ইংরেজরা ক্যান্টনের বাণিজ্যে অংশগ্রহণের সুযোগ পায় নি। –
(ক) ক্যান্টনে ব্রিটিশদের প্রবেশ
- (১) ক্যান্টনে বাণিজ্যের সুযোগ না পেয়ে ইংরেজ বণিকরা চিনের ফরমোজা, নিংগপো, অ্যাময় প্রভৃতি বন্দরে বাণিজ্য করত। কিন্তু এসব স্থানের বাণিজ্যে ইংরেজদের বিশেষ সুবিধা না হওয়ায় তারা ক্যান্টনের দিকে নজর দেয়।
- (২) ক্যাপ্টেন ওয়েড্ডেল-এর উদ্যোগে ব্রিটিশ বাণিজ্য জাহাজ ১৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ক্যান্টনে প্রবেশ করলেও এখানে ব্রিটিশদের নিয়মিত বাণিজ্য শুরু হয় আরও অনেক পরে। তারা ক্যান্টনে ১৬৯৯ খ্রিস্টাব্দে একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করে এবং ১৭১৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে চা ও রেশমের ব্যাবসা শুরু করে।
(খ) এক বন্দরকেন্দ্রিক বাণিজ্য
- (১) উচ্চ শুল্ক দিয়ে ক্যান্টনে ব্যাবসা করতে ব্রিটিশ বণিকদের সমস্যা হলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উত্তর দিকের নিংগপো-তে ব্যাবসা সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু চিনা সরকার উত্তর দিকের বন্দরগুলিতে বিদেশি বণিকদের প্রবেশ করতে দেয় নি।
- (২) এর ফলে দেখা যায়, ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকালে ক্যান্টনই হয়ে ওঠে বিদেশি বণিকদের কাছে একমাত্র উন্মুক্ত বন্দর। চিনা আদালত ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে এক নির্দেশনামার দ্বারা একমাত্র ক্যান্টন বন্দরকেই বিদেশি বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত বলে ঘোষণা করে।
(গ) ক্যান্টন বাণিজ্য
এইভাবে ক্যান্টন বন্দরকে কেন্দ্র করে চিনে বিদেশিদের এক বন্দরকেন্দ্রিক যে বাণিজ্যপ্রথার সূচনা হয়, তা-ই ‘ক্যান্টন বাণিজ্যপ্রথা’ নামে পরিচিত। এই প্রথা ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে নানকিং-এর সন্ধি স্বাক্ষরিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত চলে।
ক্যান্টন বাণিজ্যের বৈশিষ্ট্য
১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে চিনে বিদেশি বণিকদের জন্য এক বন্দরকেন্দ্রিক ক্যান্টন বাণিজ্যের সুত্রপাত হওয়ার পর এখানকার বাণিজ্যে শীঘ্রই ব্রিটিশ বণিকদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। –
(ক) ব্যক্তিগত মালিকানাভিত্তিক বাণিজ্য
‘কোহং’ নামে বণিকসংঘ দ্বারা পরিচালিত ক্যান্টনের বাণিজ্য ছিল মূলত ব্যক্তিগত মালিকানাভিত্তিক। এজন্য চিনের সঙ্গে বিদেশি বণিকদের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার দরকার হত না।
(খ) প্রত্যক্ষ বাণিজ্যে বাধা
বিদেশি বণিকরা সরাসরি ক্যান্টনে বাণিজ্য করতে পারত না। কোনো অবস্থাতেই তাদের চিনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে দেওয়া হত না বা তারা অন্য বণিকদের কাছ থেকেও সস্তা দরে মাল কিনতে পারত না। সরকারের অনুমোদন প্রাপ্ত এবং একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকারী ‘কো-হং’ নামক বণিকসংঘের মাধ্যমেই বিদেশি বণিকদের সমস্ত লেনদেন চালাতে হত।
(গ) মূল শহরে প্রবেশে বাধা
ক্যান্টন বন্দরে বাণিজ্যরত ইউরোপীয়দের শহরের মূল ফটকের বাইরে একটি নির্দিষ্ট স্থানে বসবাস ও বাণিজ্যিক কার্যকলাপ চালাতে হত। কখনোই প্রধান ফটক পেরিয়ে তারা মূল শহরে প্রবেশ করতে পারত না। বণিকরা ক্যান্টন শহরের প্রাচীরের বাইরে বসবাস করলেও স্ত্রী-পুত্রদের রেখে আসতে হত ম্যাকাও-এ।
(ঘ) কো-হং-দের দুর্নীতি
ক্যান্টনের একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার পেয়ে কো-হং বণিকরা অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। একচেটিয়া এই অধিকার পাওয়ার জন্য তারা চিনা রাজদরবার, আদালত ও শুল্ক-অধিকর্তাকে বিপুল অর্থ ঘুষ দিত। বিদেশিদের বাণিজ্যের শর্ত তারাই ঠিক করত, বাণিজ্যের বেশিরভাগ লভ্যাংশ কো-হং বণিকরা আত্মসাৎ করত।
(ঙ) রুদ্ধদ্বার নীতি
ক্যান্টন বাণিজ্যে অংশগ্রহণকারী বিদেশি বণিকদের চিনা ভাষা ও আদবকায়দা শিক্ষা নিষিদ্ধ ছিল। ক্যান্টনে তারা চিনা ফৌজদারি ও বাণিজ্যিক আইন মেনে চলতে বাধ্য ছিল। বিদেশি বাণিজ্যকুঠিতে মহিলা ও আগ্নেয়াস্ত্রের প্রবেশ, দাসী নিয়োগ প্রভৃতি নিষিদ্ধ ছিল। বাণিজ্যের মরশুম শেষ হলে বিদেশি বণিকদের ক্যান্টন ত্যাগ করতেই হত। চিনে বিদেশি বণিকদের প্রতি এই কঠোর নীতি ‘রুদ্ধদ্বার নীতি’ নামে পরিচিত।
বাণিজ্যিক প্রাধান্য
ক্যান্টন বাণিজ্যের প্রথমদিকে পোর্তুগিজদের হঠিয়ে ইংরেজ বণিকরা সর্বাধিক প্রাধান্য বিস্তার করে। পরবর্তীকালে আমেরিকার বণিকরা এই বাণিজ্যে যোগ দেয়। –
(ক) ইংল্যান্ডের বাণিজ্য
- (১) ইংরেজরা অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকদের পিছনে ফেলে অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগের মধ্যে ক্যান্টন বাণিজ্যে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। তারা ক্যান্টন বন্দর থেকে চিনের চা, রেশম, মৃৎপাত্র, দারুচিনি, ঔষধপত্র প্রভৃতি ইংল্যান্ডে রপ্তানি করে। এগুলির মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ছিল চায়ের বাণিজ্য।
- (২) ঊনবিংশ শতকের প্রথমদিকে ব্রিটিশ বণিকরা ৪ লক্ষ পাউন্ড চা ইংল্যান্ডে রপ্তানি করে। তারা ইংল্যান্ড থেকে পশম বস্ত্র, লোহা, টিন, সিসা, পশুর লোম প্রভৃতি চিনে আমদানি করে। চিনের সঙ্গে ইংল্যান্ডের এই বাণিজ্য ‘দেশীয় বাণিজ্য’ নামে পরিচিত ছিল।
(খ) আমেরিকার বাণিজ্য
অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে আমেরিকার বণিকরা চিনের বাণিজ্যে যোগ দেয়। তারা ইংল্যান্ডের একচেটিয়া বাণিজ্যের বিরোধিতা করে মুক্ত বাণিজ্যের কথা বলে। কিছুদিনের মধ্যেই ক্যান্টন বাণিজ্যে আমেরিকা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে।
ক্যান্টিন বাণিজ্যের অবসান
ক্যান্টন বাণিজ্যে নানা ধরনের কঠোর শর্ত ও বিধিনিষেধের নীতি বিদেশি বণিকদের ব্যাবসার ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করত। যেমন –
(ক) ব্যাবসা বন্ধের হুমকি
বাণিজ্যিক প্রতিন্ধকতা দূর করার উদ্দেশ্যে পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলি চিনের সঙ্গে সমমর্যাদার ভিত্তিতে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে উৎসাহী ছিল। কিন্তু চিন বিদেশিদের ওপর বাণিজ্যের শর্ত শিথিল করতে রাজি ছিল না। বরং বিদেশিদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তাদের ব্যাবসা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিত।
(খ) ইংল্যান্ডের দৌত্য
- (১) চিনের কাছ থেকে মর্যাদাসম্পন্ন বাণিজ্যিক সুবিধা আদায়ের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার চিনে কয়েকবার দূত প্রেরণ করে। ইংল্যান্ড ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে চালর্স ক্যাথকার্টকে ক্যান্টনে পাঠায়। কিন্তু চিনে পৌঁছোনোর আগেই তাঁর মৃত্যু হলে এই মিশন ব্যর্থ হয়।
- (২) জর্জ ম্যাকার্টনির নেতৃত্বে ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় মিশন ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে এবং লর্ড আমহার্স্ট-এর নেতৃত্বে তৃতীয় মিশন ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে চিন সম্রাটের কাছে পৌঁছোয়। কিন্তু উভয় দূতই ব্যর্থ হয়। শান্তিপূর্ণ উপায়ে চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থ হলে ইংল্যান্ড বলপ্রয়োগের নীতি গ্রহণ করে।
(গ) আফিম ব্যাবসা
উনিশ শতকের শুরু থেকে ব্রিটিশ বণিকরা চোরাপথে ভারত থেকে চিনে আফিম রপ্তানি করতে শুরু করলে ক্যান্টন বাণিজ্যের চরিত্র বদলাতে শুরু করে। আফিমের ব্যাবসাকে কেন্দ্র করে চিনের সঙ্গে ব্রিটেনের বিরোধ বাধে এবং প্রথম আফিম যুদ্ধ বা প্রথম ইঙ্গ-চিন যুদ্ধ (১৮৩৯-৪২ খ্রি.) সংঘটিত হয়।
উপসংহার :- প্রথম অহিফেন যুদ্ধে চিনের পরাজয়ের ফলে ক্যান্টন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। চিন ক্যান্টন-সহ বেশ কয়েকটি বন্দর বিদেশি বণিকদের জন্য খুলে দিতে বাধ্য হয়। এই ভাবে ক্যান্টন বাণিজ্য প্রথার অবসান ঘটে।
(FAQ) ক্যান্টন বাণিজ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
চিনের ক্যান্টন বন্দর।
প্রথম অহিফেন যুদ্ধ বা প্রথম ইঙ্গ-চিন যুদ্ধ।
১৮৩৯-৪২ খ্রিস্টাব্দে।
১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে।
কো হং।