টমাস কারলাইলের প্রেমপত্র

স্কটিশ দার্শনিক টমাস কারলাইলের প্রেমপত্র প্রসঙ্গে টমাস কারলাইলের পরিচিতি, টমাস কারলাইলের খ্যাতি, টমাস কারলাইলের প্রেম, টমাস কারলাইলের প্রেমিকা ও টমাস কারলাইলের মূল প্রেমপত্র সম্পর্কে জানব।

দার্শনিক টমাস কারলাইলের প্রেমপত্র

ঐতিহাসিক প্রেমপত্রটমাস কারলাইলের প্রেমপত্র
দেশস্কটল্যান্ড
পরিচিতিদার্শনিক, প্রাবন্ধিক ও ঐতিহাসিক
প্রেমিকাMiss Welsh
স্ত্রীMiss Welsh
টমাস কারলাইলের প্রেমপত্র

কারলাইলের জীবন যাঁরা জানেন তাঁদের কাছে তাঁর বিবাহিত জীবনের কথা অজ্ঞাত নয়। তবু তিনি তাঁর স্ত্রীকে যে সমস্ত প্রেমপত্র লিখেছিলেন তা সবই অনাবিল প্রেমের নিদর্শন এবং তৎকালীন সাহিত্যে সেগুলি যে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার কবে আছে একথা স্বীকার না করে পারা যায় না।

একসময়ে মিস Welsh কে তিনি লিখেছিলেন (অবশ্য তাঁদের বিবাহের পূর্বে) :

প্রিয়তমাসু, তোমার চিঠি পেলাম; এর প্রতি লাইনে তোমার অন্তরের যে আনন্দ মূর্ত্ত হয়ে উঠেছে আশা করি আজও তা ম্লান হয় নি এবং সেই পুলকানুরাগের আকর্ষণেই আমি হব তোমার। তোমাকে আমার কিছু বলবার আছে এবং যা বলব তাতে তোমার আমার মিলনের পথ আরও সুগম হয়ে উঠবে। তোমাকে আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রমণীরত্ন বলে মনে করি, তাই যা বলব তা হবে আমাদের প্রেমের অনুকূলে নইলে এর পরিণাম মঙ্গল নয়।

তুমি কি আমার সঙ্গে যাবে? তুমি কি আমার হবে? চিরদিনের জন্য তুমি কি আমার আরাধনার ধন হবে? বল, এ আশা কি হৃদয়ে পোষণ করতে পারি? বল, একবার তোমার সম্মতি আমায় জানাও, আমি তোমার সুখের জন্য সব ব্যবস্থা করব। তোমাকে সাদরে আমার হৃদয় মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করবার সকল আয়োজন করি, – আমার শ্রম সার্থক হোক! যে মুহূর্তে আমার সব আয়োজন সম্পূর্ণ হবে সেই মুহূর্তেই তোমায় সঙ্গে নিয়ে যাব। আমার অন্তরে হবে তোমার ঠাঁই। যত ঝঞ্ঝা যত বিপদই আসুক তোমায় আমায় কখনও পৃথক হবো না।

আমার কল্পনাকে তুমি হয়ত নিছক আকাশকুসুম মনে করছ, কিন্তু তা ত নয় সুন্দরি! আমার যা কিছু চিন্তা – তোমায় নিয়ে আমার যা কিছু ভাবনা সবই ত এই কল্পনাকে আশ্রয় করেই! আমার এ কল্পনা, এ স্বপ্ন যদি কোনো দিন বাস্তবে পরিণত হয় সে দিন হবে আমার সকল ব্যাধির, সকল শ্রমের পরিসমাপ্তি ও সার্থকতা। আমার স্বাস্থ্য ভাল হবে, আমার সতেজ হৃদয়ে আসবে অপার আনন্দ – আসবে আমার কর্মে উৎসাহ, বেড়ে যাবে আমার ক্ষীণ প্রাণশক্তি। আমি যে সে-সবই হারিয়েছি শুধু তোমারই জন্য।

আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, তোমাকে পেলে তোমার প্রেমের কাছে আমার এই শিক্ষা হবে যে হারান জিনিস ফিরে পাবার উপায় কি। আমি আজ এই সত্য মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি। আমি নিজে যা অনুভব করি আর লোকের হৃদয় দিয়ে তা যাচাই করে নিই।

তুমি সেদিন সাহিত্যের কথা বলেছিলে; সাহিত্য হ’ল জীবনের মদের মত – আনন্দ দেয়, নেশা আনে, মাদকতা আনে কিন্তু পেট ভরায় না। সে ত আর খাদ্য নয় – সে ত নেশার জিনিস। যারা সাহিত্যের সেবা করে তারা ঘর সংসারের কথা ভুলে যায় – কর্তব্য বিস্মৃত হয়। তারা পারিবারিক ও সামাজিক আমোদ উপভোগ করতে পায় না। গৃহধর্মে যে নৈসর্গিক শান্তি আছে যে শান্তি ইতর প্রাণীও অনুভব করে – হোক তা ক্ষণস্থায়ী তা তারা পায় না – সে জিনিস ছন্দের ঝঙ্কারে নেই, শিল্পীর তুলিতে নেই, এমন কি গানের মূর্ছনাতেও তা আছে বলে সাধারণ গৃহীর মনে হয় না। তাই লেখক হওয়ার চেয়ে মানুষ হওয়াই আমার মত।

মাঝে মাঝে আমার মনে হয় তুমি বড় অসুখী। তোমার উদ্যম আছে, কর্মশক্তি আছে কিন্তু কর্মের আধার নেই। তোমার আছে দরদী হৃদয়, আছে বুদ্ধি, আছে বিচারের ক্ষমতা। তোমার সৎ গুণরাজি আদর্শ পত্নী হবার মতই আছে কিন্তু তুমি তো তা হবে না। তা না হয়ে তুমি শুধু ঘুরছ কক্ষচ্যুত গ্রহের মত। ওগো মহীয়সী নারী, ওগো ছলনাময়ী এস ফিরে এস। আমিও আজ নিরবলম্ব, আমাকেও যেন কিসে স্থির হতে দিচ্ছে না, এস আমরা ফিরে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে মিশে যাই। একে অন্যের মধ্য থেকেই জীবনের মন্ত্র লাভ করি কেমন করে বাঁচতে হয়। এস আমরা হই এই পৃথিবীর অধিবাসী – আমাদের পরস্পরের বিপরিতমুখী বৃত্তিকে একই দিকে পরিচালিত করি, একই আকাশের তলে রৌদ্রস্নাত ধরনীর রূপ রস গন্ধ উপভোগ করে প্রকৃতির সুস্থ সবল সন্তানে পরিণত হই। আমরা চাই গোলাপের মত ফুটে উঠতে – সৌরভে দশদিক আমোদিত করতে কিন্তু তার উপযুক্ত ক্ষেত্র আমরা রচনা করতে পারলাম কই। গোলাপের সৌরভ রূপ রস পাপড়ি পাতা গাছ বীজ ক্ষেত্র – এ সব নিয়েই ত তার পূর্ণতা। সংসারই ত মানুষরূপ গোলাপের ক্ষেত্র – আর এই সংসারের কর্তব্য সম্পাদনেই তার রূপ তার সৌরভ তার গোলাপত্ব।

তুমি হয়ত বলবে “ওসব কবিত্ব। সংসারেব কর্তব্য ত কবিত্ব করলে পালন হয় না। গৃহীর চাই অর্থ – সে অর্থ তোমার কই যে সংসারী হতে চাইছ? সংসারের সর্বসুখের অন্তরায় যে অভাব সে অভাব মোচনের উপায় তোমার কই ?”

বর্তমানে আমার আয় যদিও অল্প তবু প্রায় সমস্ত খরচই এতে কুলিয়ে যাবে। আমার স্বাস্থ্য যদি ভাল থাকত তা হলে এই আয়ে বিলাসিতাও চলত। সৌখিন প্রয়োজনীয় ভোগ্যবস্তু লাভ করা একেবারে যে অসম্ভব তো বলা যায় না, তবে লোক দেখানো বাজে খরচ করা এর দ্বারা চলবে না। এক কথায় তার নাম ‘চাল’! এ ‘চালের’ কি মূল্য আছে? লোকের কাছে নিজের নকল ঐশ্বর্য প্রকাশ করে কি লাভ? বাইরের জাঁক-জমক প্রকৃত মনুষত্বের অন্তরায়। আমরা উভয়ে যদি উভয়কে ভালবাসি, পরস্পরের কর্ত্তব্য যদি আন্তরিকভাবে সুসম্পন্ন করি, প্রকৃত মানুষের মত নিজের শ্রমার্জিত অর্থে একে অন্যের তৃপ্তি বিধান করতে পারি, স্বামী স্ত্রীর প্রতি এবং স্ত্রী স্বামীর প্রতি অনুরক্ত হই, তবেই আমরা যথার্থ সুখী দম্পতি হব। বিবেকই হল সব। নিজে যা নই তাই প্রতিপন্ন করবার চেষ্টা করলে বিবেককে প্রতারিত করা হয়। কি যায় আসে প্রিয়ে যদি জ্যাক বা টম আমাদের চেয়ে ধনী হয়, আমি ধনী হই বা দরিদ্র হই, কিছু ক্ষতি নেই, কারণ আমরা যে পরস্পরকে ভালবাসতে জানি বা ভালবাসি।

এস প্রিয়ে, তোমাকে আর আমার বলবার কিছু নেই। এস আমার বুকে এস! এস, দুজনা দুজনাকে অবলম্বন করে জীবন কাটিয়ে দি, একসঙ্গে বাঁচবার পালা শেষ হলে আামরা একসঙ্গেই মৃত্যুকে বরণ করে নোব।

ওগো দেবী বল, নিজ মুখে বল, তুমি কি আমার হবে? তোমাকে পাওয়ার আশা কি আমার পক্ষে একান্ত দুরাশা? তোমাকে চাওয়া আমার পক্ষে কি মূর্খতার পরিচয় হবে?

তুমি কি আমাকে ভালবাস না? আমাকে কি তোমার বিশ্বাস হয়? তোমার ভাগ্য যে আমার ভাগ্যের সঙ্গে জড়িত, আমার অদৃষ্ট তোমার উপর নির্ভর করছে – এসব কথা তোমার কি একেবারেই ধারণা হয় না? তুমি ‘না’ বলতে পার না, আমার প্রেম তুমি অস্বীকার করতে পার না, পার কি? আমি জানি তুমি আমায় ভালবাস – তোমার অন্তর যে আমার অন্তরের সঙ্গে মিলতে চাইছে। আমি যেমন তোমায় চাই, তুমিও তেমনি আমায় চাও – নয় কি?

তোমার উত্তরের আশায় বুক বেঁধে বসে আছি। আমি জানি তুমি আমায় বসিয়ে রাখবে না – আশায় রাখবে না। ভগবান তোমার মঙ্গল করুন – তোমার মতি পরিবর্তন হোক, তোমার মনের কি ইচ্ছা জানিও। বিদায় চুম্বন –

তোমার কারলাইল

এই পত্রের উত্তরে মিস ওয়েলশ কারলাইলকে লিখলেন :

মঙ্গলবার, ৩ অক্টোবর, ১৮৮৬

তুমি আমার প্রতি এত নিষ্ঠুর প্রিয়তম! তুমি আমায় দুঃখ দিতে পার, আবার তুমিই আমায় সুখের স্বর্গে তুলতে পার। আমি ত তোমারই হাতের খেলার পুতুল। তুমিই ত আমার হৃদয়কে ঘাতসহ করে তুলেছ – এখন যত দুঃখই আসুক আমি অনায়সে তা সহ্য় করব।

ওগো বন্ধু! তুমি আমার প্রতি সদয় হও, দেখবে আমি তোমার প্রেমময়ী পত্নী হবো – তোমায় সুখী করতে আমার সর্ব্বস্ব তোমায় বিলিয়ে দোব। তোমার মুখের দিকে যখন চেয়ে দেখি, তোমার প্রেমের কথা যখন শুনি তখন সে কথা আমার অন্তরকে আলোড়িত করে। তখন আমার কাছে সমস্ত জগৎ তুচ্ছ মনে হয়। মনে হয় তুমি আমার সব, কিন্তু যখন তুমি আমার কাছ থেকে দূরে চলে যাও তখন সে সব অন্ধকার হয়ে যায় প্রিয়তম, আমার কিছু ভাল লাগে না – অন্তর বেদনায় ভরে উঠে।

মা এখনও আসেন নি। এই সপ্তাহের মধ্যেই আসবার কথা আছে। তারপর একসপ্তাহ তাঁর কাছে থাকব তারপর আমি তোমার হব প্রিয়তমে – চিরদিন তোমারই থাকব।

তোমায় আমায় যদি সুখে মনের আনন্দে বসবাস করতে না পাবি তবে দোষ আমার নয় – দোষ তোমার। এই আমার শেষ চিঠি। বল স্বামী, তুমি আমায় ভালবাসবে? তুমি আমায় ভালবাসা দাও, আমায় তোমার চির আদরের ধন করে তোল!

(FAQ) টমাস কারলাইলের প্রেমপত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. টমাস কারলাইল কে ছিলেন?

একজন স্কটিশ দার্শনিক, ঐতিহাসিক ও প্রাবন্ধিক।

২. টমাস কারলাইলের স্ত্রীর নাম কী?

মিস ওয়েলশ।

৩. টমাস কারলাইলের প্রেমিকার নাম কী?

মিস ওয়েলশ।

Leave a Comment