রবার্ট ফ্যালকন স্কট

অভিযাত্রী রবার্ট ফ্যালকন স্কট (১৮৬৮-১৯১২) ছিলেন একজন ব্রিটিশ নৌ-অফিসার ও অ্যান্টার্কটিক অনুসন্ধানকারী, যিনি দক্ষিণ মেরু অভিযানের জন্য বিখ্যাত। তিনি ১৯১০-১৯১৩ সালে টেরা নোভা অভিযানে নেতৃত্ব দেন, যেখানে দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছানোর পর আবিষ্কার করেন যে নরওয়ের অভিযাত্রী রোয়াল্ড অ্যামুন্ডসেন তাদের আগে সেখানে পৌঁছেছেন। স্কট ও তার দল মেরু থেকে ফেরার পথে কঠিন আবহাওয়া, খাদ্যসংকট এবং শারীরিক দুর্বলতায় মৃত্যুবরণ করেন। তার সাহসী প্রচেষ্টা ও আত্মত্যাগ তাকে ব্রিটিশ ঐতিহ্যে একজন নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

বীর অভিযাত্রী রবার্ট ফ্যালকন স্কট

ঐতিহাসিক চরিত্ররবার্ট ফ্যালকন স্কট
জন্ম৬ জুন, ১৮৬৮ খ্রি
জন্মস্থানডেভনপোর্ট, ডেভন, ইংল্যান্ড
পেশানৌ-অফিসার, অনুসন্ধানকারী
প্রধান অভিযানডিসকভারি অভিযান (১৯০১-১৯০৪), টেরা নোভা অভিযান (১৯১০-১৯১৩)
ঐতিহাসিক গুরুত্বপ্রথম দিকের অ্যান্টার্কটিক অভিযাত্রী; তার সাহসী প্রচেষ্টা ব্রিটিশ ঐতিহ্যে বিশেষ স্থান পেয়েছে
মৃত্যু২৯ মার্চ, ১৯১২ (সম্ভাব্য তারিখ)
রবার্ট ফ্যালকন স্কট

ভূমিকা :- অজানাকে জানার অদম্য আকাঙ্ক্ষা, অজেয়কে জয় করার দুরন্ত বাসনা যুগে যুগে বহু অসম সাহসী বীর মানুষকে ছুটিয়ে নিয়েছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। তাঁদের সাধনা ও আত্মত্যাগে বিস্তৃত হয়েছে পৃথিবীর ভৌগোলিক সীমা, সমৃদ্ধ হয়েছে মানুষের জ্ঞানভান্ডার। এমনি এক সংগ্রামী বীর অভিযাত্রী ছিলেন রবার্ট ফ্যালকন স্কট। অজানার আহ্বানে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে তিনি চিরদিনের জন্য হারিয়ে গিয়েছিলেন দক্ষিণ মেরুর বরফাবৃত প্রান্তরে।

রবার্ট স্কটের জন্ম

অভিযাত্রী স্কটের জন্ম হয়েছিল ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের ৬ই জুন ইংল্যান্ডের ডেভনপোর্টে।

স্কটের অনুপ্রেরণা

বাবা অসুস্থ ছিলেন বলে বাড়ির কাজকর্ম তাঁকেই দেখতে হত। তাঁর এক কাকা কাজ করতেন নৌবাহিনীতে, অন্য তিন কাকা ছিলেন স্থলবাহিনীতে। এতে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনিও স্বপ্ন দেখতেন বড় হয়ে কাকার মতো জাহাজে চড়ে সমুদ্রে ঘুরে বেড়াবেন। সেই স্বপ্ন তাঁর সফল হল যৌবনে পদার্পণ করার পর। নৌবাহিনীতে নাম লেখালেন স্কট। তারপর সাহস তৎপরতা ও যোগ্যতার বলে অল্পদিনের মধ্যেই লাভ করলেন অফিসার পদ।

দক্ষিণ মেরু সম্পর্কে মানুষের ধারণা

প্রাচীনকালে দক্ষিণ মেরু সম্পর্কে পৃথিবীর মানুষের কোনো পরিষ্কার ধারণা ছিল না। মনে করা হত এটিই পৃথিবীর শেষ প্রান্ত। কিন্তু এই ধারণার পরিবর্তন ঘটেছিল ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে ক্যাপটেন কুকের পৃথিবীর দক্ষিণাঞ্চলে অভিযানের পর। তিনি ফিরে এসে জানিয়েছিলেন, জনপ্রাণীহীন দক্ষিণ অঞ্চলে জমে আছে কেবল বরফ, যেদিকে দৃষ্টি যায় সেদিকেই শুধু বরফ। তারপর শতাব্দীকালের মধ্যে আর নতুন কোনো তথ্য জানা সম্ভব হয় নি দক্ষিণ মেরু সম্পর্কে।

অভিযানের নেতৃত্বে রবার্ট স্কট

নতুন করে উদ্যোগ নেওয়া হল ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে। এক আন্তর্জাতিক ভৌগোলিক বিষয় সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞদের সম্মেলনে স্থির হয় গবেষণার জন্য দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে অভিযান প্রেরণ করা হবে। অভিযানের নেতৃত্ব দেবার জন্য একজন উদ্যমী সাহসী ও অনুসন্ধিৎসু মানুষের প্রয়োজন দেখা দিল। এই সময়েই রয়াল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটির সভাপতি স্যার ক্লিমেন্টের সঙ্গে আলাপ হয় স্কটের। তখন তিনি ৩২ বছরের যুবা। অভিযান পরিচালনা করবার সমস্ত রকম যোগ্যতাই তাঁর ছিল। তা লক্ষ্য করে স্যার ক্লিমেন্ট তাঁকেই দক্ষিণ মেরু অভিযানের নেতা মনোনীত করলেন।

দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে রবার্ট স্কট

চির বরফাবৃত দক্ষিণ মেরু অঞ্চল। ইতিপূর্বে দু-একটি অভিযাত্রী দল এই পথে অভিযান করেছিল। কিন্তু কেউই বরফের রাজ্যে বেশিদূর অগ্রসর হতে পারে নি। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর দলবল নিয়ে স্কট ডিসকভারি জাহাজে করে যাত্রা করলেন দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে। এই অভিযানে স্কটের সঙ্গে ছিলেন একদল বিজ্ঞানী। চির বরফাবৃত দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে দীর্ঘ তিন বছর বাস করে ফিরে এসেছিলেন তাঁরা। দীর্ঘ অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণে সংগৃহীত হয়েছিল বহু বৈজ্ঞানিক তথ্য। জানা গিয়েছিল সেখানকার আবহাওয়া, প্রকৃতি, ভূমি, সমুদ্রস্রোত, প্রাণী, বরফের আকার আকৃতি ইত্যাদি নানা বিষয়ের তথ্যদি।

নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন রবার্ট স্কট

তিন বছর পর স্কট ইংল্যান্ডে ফিরে এসে বীরের সম্মান ও সম্বর্ধনা লাভ করলেন। তাঁকে নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত করা হল। অভূতপূর্ব খ্যাতি সম্মান যশ লাভ করেও তৃপ্ত হল না স্কটের মন। তিনি স্বপ্ন দেখতে লাগলেন দক্ষিণ মেরু অভিযানের।

দক্ষিণ মেরু অভিযানে বাধা

কিন্তু মেরু প্রদেশে অভিযান ছিল বিঘ্নসঙ্কুল। প্রধানত দুটি প্রধান বাধাই হয়ে উঠত অভিযাত্রীদের প্রতিবন্ধক। সমুদ্র জলস্রোতের উষ্ণ অঞ্চল অতিক্রম করলেই শুরু হয় দক্ষিণ সাগরের শীতল জলের স্রোত। পাহাড়ের মত বিরাট বিরাট ভাসমান বরফ খন্ড অবরোধ করে দাঁড়ায় জাহাজের গতিপথ। সামান্য বেসামাল হলেই বরফের চাঁইয়ের ধাক্কায় চুরমার হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে জাহাজের। ভাসমান সেই বরফের পাহাড় যতক্ষণ সরে না যায় ততক্ষণ জাহাজ নিয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। এইভাবে মেরুপ্রদেশের প্রবেশদ্বার অতিক্রম করে ভেতরে প্রবেশ করেই মুখোমুখি হতে হয় অন্য বাধার।

The great ice Barrer

জাহাজ নোঙর করে তীরে পা দিয়েই বরফ। বরফ-ভূমি। সেই বরফ অঞ্চলের বিস্তৃতি দীর্ঘ পাঁচশো মাইল জুড়ে। তার মধ্যে নেই আশ্রয়ের ব্যবস্থা, খাদ্য বা পানীয়। সেখানে প্রকৃতির নিজস্ব ব্যবস্থা মতোই মাথা উচিয়ে দাঁড়িয়ে প্রাচীর রচনা করেছে এক খাড়া পাহাড়। তারই নাম হল The great ice Barrer বা ভূষার প্রাচীর।

রবার্ট স্কটের প্রথম ব্যর্থ অভিযান

  • (১) দক্ষিণ মেরু অভিযানকালে স্কট বুঝতে পেরেছিলেন এই তুষার-প্রাচীর অতিক্রম করতে না পারলে দক্ষিণ মেরুর অভ্যন্তরে প্রবেশ করা যাবে না। তাই দুজন সঙ্গী, স্লেজ গাড়ি, এগারটা কুকুর ও তিন মাসের উপযুক্ত খাদ্য নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু দুস্তর বরফের মধ্যে দিয়ে ৩০০ মাইল যাবার পরই তাঁর একজন সঙ্গী অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। খাদ্যও ফুরিয়ে আসছিল। তাই বাধ্য হয়েই তাঁকে ফেরার পথ ধরতে হল।
  • (২) কিন্তু ফেরার পথে বিপর্যয় ছিল চরম। বারোটা কুকুরের মধ্যে তিনটে গেল আলগা বরফের তলায় হারিয়ে। চারটি মারা পড়ল তুষার ঝড়ে। ফলে যাওয়ার সময় স্নেজে যে গতি ছিল, ক্রমশই সেই গতি কমতে লাগল। শেষ পর্যন্ত দুটি মাত্র কুকুর বেঁচে ছিল। খাদ্যও গিয়েছিল ফুরিয়ে। গাড়ি টেনে নিয়ে চলতে হয়েছিল নিজেদেরই।
  • (৩) তারপরে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছিল যে নিজেদের প্রাণ বাঁচাবার জন্য দুটো কুকুরকেও হত্যা করতে হল। এই নিদারুণ ঘটনার মর্মান্তিক বিবরণ স্কট তাঁর অভিযান-কাহিনীতে বিবৃত করেছেন। নেহাৎ ভাগ্যবলেই শেষ পর্যন্ত স্কট তাঁর দুজন সঙ্গীকে নিয়ে জাহাজে করে ইংল্যান্ডে ফিরে আসতে পেরেছিলেন।

অভিযাত্রী স্কটের উতলা মন

কিন্তু ফিরে এসেও স্বস্তি ছিল না তাঁর। বিস্তীর্ণ তুষার-ভূমির মায়াময় নির্জনতা যেন তাঁকে মুহুর্মুহু হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। আবার বেরিয়ে পড়ার জন্য উতলা হয়ে উঠল মন। কিন্তু যাব বললেই তো আর মেরু অঞ্চলে যাওয়া যায় না। তার জন্য দরকার উপযুক্ত প্রস্তুতির। সেই সম্বল কোথায় তাঁর? স্কট আশা করেছিলেন সরকারের তরফ থেকেই হয়তো আবার উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। কিন্তু কা কস্য পরিবেদনা। দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে অভিযানের কথা কোনো দিক থেকেই উচ্চারিত হল না। আকাঙ্ক্ষার অদম্য তাড়নায় ছটফট করতে লাগলেন স্কট। নিজের উদ্দেশ্যের কথা খুলে জানালেন প্রেমিকা ক্যাথলীন ব্রুসীকে।

রবার্ট স্কটের বিবাহ

১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে ক্যাথলীনের সঙ্গে বিবাহ হয় স্কটের। আর সেই মাসেই তিনি সংবাদপত্র মারফত তাঁর দেশবাসীকে জানালেন, মেরু অভিযানের আকাঙক্ষার কথা। তিনি আরও জানালেন, ইংল্যান্ডের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি দক্ষিণ মেরুর বরফ-ভূমিতে স্থাপন করবেন দেশের জাতীয় পতাকা।

স্কটের একক চেষ্টায় অভিযান

এরপরেও কিছু বাক্তিগত অভিনন্দন ছাড়া সরকার বা জনগণের তরফ থেকে উৎসাহজনক কোনো সাড়া পেলেন না। এই অভিযানের জন্য প্রয়োজন ছিল প্রচুর অর্থের। সেই সঙ্গে দরকার কিছু সাহসী কষ্টসহিষ্ণু ও কর্মদক্ষ মানুষ এবং অজস্র প্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিসের। এই অভিযানের ক্ষেত্রে প্রতিটি ক্ষুদ্র জিনিসই ছিল অত্যন্ত জরুরী। আর এই সমস্ত কিছু সংগ্রহ করার জন্য দরকার ছিল দীর্ঘ অখন্ড অবকাশের। কোনো দিক থেকে সাড়া না পেয়ে স্কট স্থির করলেন তিনি একক চেষ্টাতেই অভিযান সংগঠিত করবেন।

ইংল্যান্ডের বিভিন্ন প্রান্তে রবার্ট স্কটের বক্তৃতা

প্রথমেই তিনি নৌবাহিনী থেকে অর্ধেক বেতনে ছয় মাসের জন্য ছুটি মঞ্জুর করিয়ে নিলেন। তারপর কোমর বেঁধে নেমে পড়লেন কাজে। ইংল্যান্ডের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ঘুরে তিনি মেরু অভিযান প্রসঙ্গে বক্তৃতা করতে লাগলেন। জনসাধারণের সাহায্যের প্রত্যাশায় নিজের মাথার টুপি পেতে ধরতেন তাঁর বক্তৃতামঞ্চে।

অর্থসাহায্য লাভে সক্ষম রবার্ট স্কট

এইভাবে ক্রমে দেশের সাধারণ মানুষ অভিযান সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠল। সহানুভূতির সঙ্গেই অনেকে কিছু কিছু অর্থসাহায্য করতে লাগলেন। উল্লেখযোগ্য যে এই মেরু অভিযানকে কেন্দ্র করে স্কট দেশের জনসাধারণের মধ্যে একটা জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি করতে সক্ষম হলেন। মানুষ যত সচেতন হতে শুরু করল, অর্থ সাহায্য ততই বাড়তে লাগল। ক্রমে কেবল সাধারণ মানুষ নয়, সম্ভ্রান্ত ধনী ব্যক্তিরাও এগিয়ে আসতে লাগলেন। ফলে মেরু অভিযানের জন্য দশ হাজার পাউন্ড সংগ্রহ করতে স্কটের বেশি দিন সময় লাগল না।

সরকারের সমর্থন লাভে সক্ষম রবার্ট স্কট

এরপর দেশের সরকারের পক্ষে আর উদাসীন থাকা সম্ভব হল না। অবিলম্বে সরকারের তরফ থেকে স্কটের অভিযানের জন্য ২০ হাজার পাউন্ড অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হল। স্বয়ং রানী জানালেন, দক্ষিণ মেরুতে যে পতাকা স্থাপন করা হবে, সেটি তিনি নিজে হাতে তৈরি করে দেবেন। এইভাবে অর্থের সমস্যার সমাধান হল।

অভিযানে সঙ্গীর সন্ধানে রবার্ট স্কট

এইবারে অভিযানের জন্য উপযুক্ত লোকের সন্ধান আরম্ভ করলেন স্কট। আগের অভিযানের সঙ্গীদের মধ্য থেকে বাছাই করে ৩২ জন নাবিককে মনোনীত করলেন। এই অভিযানে তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হলেন ১২ জন বিজ্ঞানী এবং তাঁদের সাহায্যকারী ১৪ জন। সমগ্র অভিযান পরিচালনার জন্য গঠিত হল একটি কমিটি। কমিটির প্রধান হলেন স্কট।

ভারত থেকে স্কটের কাছে চিঠি

অভিযানের প্রস্তুতি যখন শেষ হল, সেই সময় ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর লরেন্স ওয়েটস নামে এক অফিসারের চিঠি পেলেন স্কট। তিনি অভিযানে অংশ গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। স্কট তাঁকে আমন্ত্রণ জানালেন। চিঠি পেয়ে যথাসময়ে ইংল্যান্ডে উপস্থিত হলেন ওয়েটস এবং স্কট তাঁকে দলের অন্তর্ভুক্ত করলেন।

রবার্ট স্কটের জাহাজ টেরা নোভা

দক্ষিণ মেরু অভিযানের জন্য অত্যাবশ্যক ছিল উপযুক্ত ঘোড়া ও কুকুর। স্কটের আন্তরিক চেষ্টায় যথাসময়ে সে সবও সংগ্রহ হল। এইভাবে অভিযানের সমস্ত আয়োজনই একসময় সম্পূর্ণ হল। অভিযাত্রীদের নিয়ে যাবার জন্য যে জাহাজটি প্রস্তুত করা হয়েছিল স্কট তার নামকরণ করলেন টেরা নোভা বা নতুন পৃথিবী।

স্কটের পুত্র পিটার স্কট

যাত্রার পূর্বক্ষণে স্কটের এক পুত্র সন্তানের জন্ম হল, তার নাম রাখা হয়েছিল পিটার স্কট। পরবর্তীকালে তাঁর এই পুত্র প্রকৃতিবিদরূপে খ্যাতি লাভ করেছিলেন।

রবার্ট স্কটের কাছে টেলিগ্রাম

  • (১) এবারে যাত্রার পালা। উচ্ছ্বসিত দেশবাসীর আন্তরিক অভিনন্দন গ্রহণ করে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই জুন অভিযাত্রী দলটিকে নিয়ে টেরা নোভা ইংল্যান্ড থেকে যাত্রা শুরু করল। মেলবোর্ন বন্দরে পৌঁছে ১২ই অক্টোবর স্কট একটি টেলিগ্রাম হাতে পেলেন। সেই টেলিগ্রাম মারফত নরওয়ে অভিযাত্রী আমুন্ডসেন জানিয়েছিলেন, তিনিও দক্ষিণ মেরু অভিযানে যাত্রা করেছেন।
  • (২) টেলিগ্রাম পেয়ে হতবুদ্ধি হলেন স্কট। আমুন্ডসেনও যে দক্ষিণ মেরুর পথে অভিযান করেছেন এ তথ্য জানা ছিল না তাঁর। তাই তাঁর আশঙ্কা হল, তাঁর আগে যদি আমুন্ডসেন দক্ষিণ মেরুতে নরওয়ের পতাকা উত্তোলন করেন তাহলে দক্ষিণ মেরু বিজয়ের যাবতীয় গৌরব তাঁর ভাগ্যেই জুটবে। ব্যর্থ হবে তাঁর সমস্ত উদ্যোগ।
  • (৩) এই আশঙ্কা থেকে যাত্রাপথের নানা বিপদের কথাও তাঁর মনকে সংশয়াচ্ছন্ন করে তুলল। কিন্তু প্রচন্ড মানসিক দৃঢ়তা বলে তিনি একদিনের মধ্যেই মন থেকে সংশয়, আশঙ্কা ঝেড়ে ফেলতে সক্ষম হলেন। অতঃপর ক্যাপ্টেন স্কটের জাহাজ ১৯১০খ্রিস্টাব্দের ২৯ নভেম্বর তারিখে নিউজিল্যান্ডের ডুবেডিন বন্দর থেকে তুষারাবৃত মেরুপ্রদেশের অভিমুখে যাত্রা করল।

ঝড়ের মুখে রবার্ট স্কটের জাহাজ

  • (১) মেঘমুক্ত নীল আকাশ আর শান্ত সমুদ্রের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে লাগল জাহাজ। সম্ভাব্য মরুবিজয়ের উত্তেজনা আর উল্লাসে ভরপুর যাত্রীদের মন। দিন দুই নিরাপদেই কাটল। কিন্তু তৃতীয় দিনেই শুরু হল প্রচন্ড ঝড়। উথাল পাথাল হল সমুদ্র। ঢেউয়ের দাপটে ফাটল দেখা দিল জাহাজে। সঙ্গে সঙ্গেই সকলে মিলে হাত লাগাল মেরামতির কাজে।
  • (২) সব কটি ঘোড়া আর কুকুর বাঁধা ছিল ডেকে। ওয়েটসের ওপর ছিল তাঁদের রক্ষণাবেক্ষণের ভার। সহসা দড়ি ছিঁড়ে ঢেউয়ের মুখে একটি ঘোড়া ভেসে যাবার উপক্রম হল। নিজের জীবন বিপন্ন করে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওয়েটস ঘোড়াটিকে উদ্ধার করলেন। দুদিনের এই ঝড়ে শেষ পর্যন্ত দুটি ঘোড়া তাদের হারাতে হয়েছিল।
  • (৩) ঝড়ের মধ্য দিয়েই অনেকটা পথ এগিয়ে এসেছিল জাহাজ। ঝড় থেমে গেলে দিনকয়েক নিরাপদেই কাটল। একদিন একটি অ্যালবাট্রস পাখি চোখে পড়ল। সমুদ্রের জল হয়ে উঠল গাঢ় নীল আর সেই জলে ভেসে যেতে দেখা গেল এককোষী প্রাণী প্লাঙ্কটন। মাঝেমাঝে ছোট বরফের টুকরোও দেখতে পাওয়া গেল। হাওয়াও হয়ে উঠল ভারী আর শীতল। স্কট বুঝতে পারলেন মরু সীমায় প্রবেশ করেছে তাঁদের জাহাজ।

বরফ খন্ডে আটক রবার্ট স্কটের জাহাজ

আরও একদিন চলার পর জাহাজের পথ আটকে দিল বরফের ভাসমান বড় বড় খন্ড। আর এগুনো সম্ভব হল না। এই সব বরফ খন্ড সরে না যাওয়া পর্যন্ত একভাবেই থাকতে হবে তাদের। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন স্কট। এগিয়ে এল বড়দিন-এর উৎসব। জাহাজেই তা পালিত হল। স্কট সঙ্গীদের উৎসাহ জিইয়ে রাখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলেন।

মেরুভূমিতে রবার্ট স্কটের প্রথম পদার্পণ

অবশেষে কুড়িদিন সমুদ্রের বুকে আটক থাকার পর ২৯শে ডিসেম্বর আবার জাহাজ গতি পেল। ক্রমে বছর শেষ হল। নববর্ষের প্রথম সকালেই অভিযাত্রীদের উল্লাসের মধ্য দিয়ে দৃষ্টিসীমায় ভেসে উঠল মেরু মহাদেশের শ্বেতবর্ণ তটরেখা। জাহাজ এগিয়ে চলল। ক্রমে দৃশ্যমান হল প্রায় দুশো ফুট উঁচু তুষার-প্রাচীর। লম্বমান সেই প্রাচীরের গায়ে মাটির বুকে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হাজার হাজার পেঙ্গুইন পাখি। তাদের বিচিত্র কণ্ঠধ্বনি মুখর করে তুলেছে মেরুপ্রান্তরের মায়াময় নিস্তব্ধতা। ধীরে ধীরে তীরে এসে নোঙর করল জাহাজ। ডিঙিতে ভেসে মেরুভূমিতে প্রথম পদার্পণ করলেন ক্যাপ্টেন স্কট। সঙ্গীসাথীরা একে একে তীরে জড়ো হলে সকলে মিলে প্রার্থনা করলেন।

রবার্ট স্কটের শিবির স্থাপন

মেরুপ্রদেশের অভ্যন্তরে যাবার আগে মূল শিবির স্থাপনের জন্য একটি সুবিধা মত স্থান দরকার যাতে তুষার ঝড়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আগের বারে এসে যেখানে কেন্দ্রীয় শিবির স্থাপন করেছিলেন স্কট এবার সেখান থেকে উত্তরে সরে গিয়ে দুই পাহাড়ের মাঝখানে তাঁবু খাটালেন। এই মূল শিবিরকে বলা হয় Hut point। ধীরে ধীরে জাহাজ থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও সব নামিয়ে আনা হল।

মূল অভিযানের প্রস্তুতিতে রবার্ট স্কট

এরপর শুরু হল মূল অভিযানের প্রস্তুতি। স্কট তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে থেকে মোট এগারো জনকে বেছে নিলেন। অভিযানে তারা হলেন তাঁর সহচর। বাকিরা হাট পয়েন্টেই থেকে যাবে এবং নিজেদের পছন্দমতো কাজকর্ম করবেন।

সেফটি ক্যাম্প স্থাপনের উদ্দেশ্যে রবার্ট স্কটের যাত্রা

  • (১) স্কট খুব সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হতে লাগলেন। তিনি স্থির করলেন অভিযান কালে হাট পয়েন্টের সঙ্গে কোনো কারণে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও যাতে মূল কাজের কোন বিঘ্ন না ঘটে সেই উদ্দেশ্যে হাট পয়েন্ট থেকে ২১ মাইল দূরে তিনি একটি নিরাপত্তা শিবির সেফটি ক্যাম্প গড়ে তুলবেন। এই সেফটি ক্যাম্পেই অভিযানের যাবতীয় জিনিসপত্র রাখা হবে।
  • (২) এগারো জন সঙ্গী নিয়ে মোট ৮টি ঘোড়া ও ২৬টি কুকুর সহ স্কট রওনা হলেন সেফটি ক্যাম্প স্থাপনের উদ্দেশ্যে। কুকুর আর ঘোড়ায় টানা স্লেজও রয়েছে দশটি। চড়াই-উতরাই ভেঙ্গে চলতে হচ্ছে অতি কষ্টে। বরফের ওপরে ঠিকরোচ্ছে সূর্যের আলো। তাতে চোখে লাগছে ধাঁধা। ঘোড়াগুলো দিশা হারিয়ে ফেলছে।
  • (৩) বাধ্য হয়ে রাতের নিরাপদ আলোতেই ২১ মাইল পথ পাড়ি দিতে হল। হাতে হাতে তৈরি হল সেফটি ক্যাম্প। তারপর রসদটা সরিয়ে রাখা হল সেখান থেকে ৬০ কিমি দূরে। একটন খাবার রাখা হল বলে জায়গাটার নাম হল ওয়ান টন ডিপো। এসমস্ত কাজ শেষ হতে হতেই শীতকাল এসে গেল। শীতের দেশের শীতকাল-সে যেন মৃত্যুরই অপর নাম। তাঁবু ছেড়ে দু’দণ্ড বাইরে আসার উপায় ছিল না।

দুর্ঘটনার কবলে রবার্ট স্কট

  • (১) শীতের করাল থাবা অভিযাত্রীদের ঘায়েল করতে না পারলেও কয়েকটা ঘোড়াকে বাঁচানো সম্ভব হল না। সহনীয় আবহাওয়া দেখে একদিন সকলে সেফটি ক্যাম্পের দিকে ফিরছেন, অতর্কিতে ঘটে গেল দুর্ঘটনা। বরফের পাতলা আস্তরণ ফেটে গিয়ে একটা স্নেজগাড়ি কুকুরসুদ্ধ চোখের ওপরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
  • (২) একটা কুকুর গহ্বরের কিনারা আঁকড়ে ধরতে পেরেছিল। সকলে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্নেজগাড়ি ও কুকুরদের টেনে তুলে আনল। কিন্তু দুটো কুকুর গহ্বরের ভেতরেই রয়ে গেল। স্কট দূরবীন দিয়ে কুকুর দুটিকে দেখতে পেলেন। প্রায় পঞ্চাশ-ষাট ফুট নিচে বরফের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সকলেই বুঝতে পারল ওই বরফের গহ্বর থেকে ওদের উদ্ধার করা একেবারেই অসম্ভব।
  • (৩) নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও স্কট নিচে নামার জন্য তৈরি হলেন। সামান্য ইতর প্রাণী বলে কুকুরদের তুচ্ছ করলেন না। তাঁর হৃদয় ছিল উদার, প্রতিটি জীব-জন্তুকেই তিনি ভালবাসতেন। তাঁর এই ভালবাসা সহযাত্রীদেরও অভিভূত করেছিল। নিজেই দড়ি বেয়ে নিচে নেমে কুকুর দুটিকে উদ্ধার করলেন স্কট।

৯০০ মাইলের বরফাচ্ছন্ন পথ

১৯১১ খ্রিস্টাব্দের শীতকালটা গত হলে নভেম্বরের শুরুতে শুরু হল দক্ষিণ মেরুর দিকে অভিযাত্রা। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নেওয়া হয়েছে ঘোড়ার পিঠে আর কুকুরে টানা স্লেজে। সামনে সুদীর্ঘ ৯০০ মাইলের বরফাচ্ছন্ন পথ। পাহাড়ের চড়াই-উতরাই। সবুজের চিহ্ন কোথাও নেই, নেই জীবনের অস্তিত্ব। মাঝে মাঝেই পথ আটকে দাঁড়াচ্ছে চলমান হিমবাহ। আচমকা ঝাপটা মেরে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে তুষার ঝড়। মরীচিকার হাতছানি করছে বিভ্রান্ত।

দক্ষিণ মেরুর মালভূমি অঞ্চলে রবার্ট স্কট

ফেরার পথের ভাবনাটাও অভিযাত্রীকে সামনে এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গেই করতে হয়। তাই ৬৫ মাইল অন্তর অন্তর খাটিয়ে নিতে হচ্ছে একটা করে তাঁবু। তাতে খাবার ও প্রয়োজনীয় জিনিস রেখে যেতে হচ্ছে। ফেরার পথে দিকদিশাহীন ধূ ধূ বরফঘন পাথারে এই তাঁবুগুলোই দিকচিহ্ন হিসাবে পথের দিশা দেখাবে। পথের দুরস্ত বাধা অতিক্রম করে ইচ্ছা মতো দূরত্ব অতিক্রম করার উপায় নেই। যেদিন আবহাওয়া অনুকূল পেয়েছেন স্কট তাঁর দলবল নিয়ে সর্বোচ্চ কুড়ি মাইল অবধি এগুতে পেরেছেন। এইভাবে ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ৩ জানুয়ারী তাঁরা এসে পৌঁছলেন দক্ষিণ মেরুর মালভূমি অঞ্চলে। এখান থেকে দক্ষিণ মেরুর দূরত্ব মাত্র ১৮৬ মাইল। এখান থেকেই নতুন করে তৈরি করে নিতে হবে নিজেদের।

রবার্ট স্কটের চারজন সঙ্গী

স্কটের সঙ্গে সহযাত্রী হিসেবে যাঁরা এসেছেন তাঁরা হলেন, ওয়েটস, লাসলী, ক্রীন, সীম্যান, ইভানস, উইলসন আর বেয়ার্স মোট সাতজন। দলপতি হিসেবে তিনি এঁদের মধ্যে থেকেই চূড়ান্ত পথের সঙ্গী নির্বাচন করলেন। অগ্রযাত্রায় আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও দলপতির নিদের্শই সকলে মাথা পেতে নিলেন। সিদ্ধান্ত হল, শেষ ক্যাম্পে লাসলী, ইভানস, আর ক্রীন থেকে যাবেন। অবশিষ্ট চারজন তাঁর অভিযানে সঙ্গী হবেন। ব্যবস্থা মতো তিনজনকে ক্যাম্পে রেখে সঙ্গীদের নিয়ে স্কট এগিয়ে চললেন। সকলেরই চোখ অশ্রুসজল। অদৃষ্টের নির্দেশ কী এঁদের কেউই জানতে পারছেন না। তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে বহুদূর পর্যন্ত অগ্রযাত্রীদের স্নেজগুলো তাকিয়ে দেখলেন লাসলীরা।

তুষার ঝড়ের কবলে রবার্ট স্কট

পরিষ্কার আবহাওয়ায় দু’দিন পথ চলা গেল। কিন্তু তৃতীয় দিন থেকেই ঝোড়ো বাতাস বইতে আরম্ভ করল। সেই সঙ্গে তুষারপাত। তার মধ্য দিয়ে স্লেজ নিয়ে এগনো দুষ্কর হয়ে উঠল। বাধ্য হয়ে সকলে নিজস্ব মালপত্র কাঁধে তুলে নিলেন। কিন্তু তুষার ঝড়ের মার তো এড়াবার পথ নেই। ক্ষত-বিক্ষত হতে লাগল শরীর। ইভানসের ডান হাতে ক্ষত দাঁড়িয়ে গেল। স্কট নিজে সেই হাতে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিলেন। তার মালগুলোও নিজেরা ভাগাভাগি করে তুলে নিলেন।

লক্ষ্যে পৌঁছালেন রবার্ট স্কট

পথের বাধা আর পথ চলার ক্লান্তি ক্রমশই তাদের অবসন্ন করে তুলল। সবকিছু অগ্রাহ্য করে প্রাণপণ শক্তিতে দেহটাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন অভিযাত্রীরা। আর মাত্র কয়েক মাইল পথ পাড়ি দিতে পারলেই লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে। হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন সকলে। সামনেই কিছু একটা উড়তে দেখা যাচ্ছে। সকলের মনেই উৎকণ্ঠা -আমুণ্ডসেন পৌঁছে যান নি তো? অশক্ত শরীর নিয়েই ছুটে যান সকলে। দেখলেন একটা ভাঙা স্নেজের ওপরে উড়ছে নরওয়ের পতাকা। নৈরাশ্যে ভেঙ্গে পড়লেন স্কট। দক্ষিণ মেরু পৌঁছেও বিজয়ের প্রথম গৌরব থেকে তিনি বঞ্চিত হয়েছেন। বেদনায় বুক ভেঙ্গে যেতে লাগল। কিন্তু বিহ্বল হলেন না তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে শক্ত করে নিলেন। দেশবাসীর কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি তো তাঁরা প্রতিপালন করেছেন। লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছেন।

রবার্ট স্কটের বিজয় উৎসব উদযাপন

সঙ্গীদের নিয়ে তখনই সোল্লাসে রানীর দেওয়া স্বদেশের পাতাকা ইউনিয়ন জ্যাক বাতাসে উড়িয়ে দিলেন। সমস্বরে রাজার দীর্ঘায়ু কামনা করে অভিবাদন জানালেন বিজয় পতাকাকে। সকলেই এক টুকরো করে চকোলেট রেখে দিয়েছিলেন। তাই খেয়ে বিজয় উৎসব উদযাপন করলেন। দলে উইলসন ও বেয়ার্স সিগারেট খেতেন না। তবুও উইলসন তিনটি সিগারেট সঙ্গে করে এনেছিলেন। সেই তিনটি তুলে দিলেন ধূমপায়ী স্কট, ওয়েটস ও সীম্যানের হাতে।

আমুণ্ডসেনের চিঠি পেলেন রবার্ট স্কট

কিছু দূরেই শূন্য পড়েছিল আমুণ্ডসেনের পরিত্যক্ত তাঁবু। তাঁর কিছু জিনিসপত্রও ছিল। সেখানে গিয়ে স্কট পেলেন তাঁকে লেখা আমুন্ডসেনের একটা চিঠি। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর তারিখে লেখা। তিনি লিখেছেন,-

“আমাদের পর আপনারা এখানে পৌঁছবেন এই বিশ্বাসে এই চিঠি লিখছি। আপনাদের ব্যবহারে লাগতে পারে এমন কিছু জিনিসও রইল। নরওয়ের রাজাকে একটা চিঠি দিলাম। যদি আর আমার দেশে ফেরা না হয় তবে চিঠিটি আমাদের রাজার কাছে আপনি পৌঁছে দেবেন। আপনার পথ নির্বিঘ্ন হোক, এই কামনা জানাই।”

ইতি আমুন্ডসেন

রবার্ট স্কটের প্রত্যাবর্তন

  • (১) অজেয়কে জয় করার যে দুরন্ত আকাঙ্ক্ষা নিয়ে স্কট যাত্রা শুরু করেছিলেন, তা সমাধা হয়েছে। এবারে ফিরে যাবার পালা। তিনি আর বিলম্ব করলেন না। চিঠিটি নিয়ে হাট পয়েন্টের পথে রওনা হয়ে পড়লেন। বরফের ওপর চিহ্ন রেখে এসেছিলেন। সেই চিহ্ন তাঁদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। দুর্গম পথ বারবারই পা আটকে যরছে।
  • (২) ঝোড়ো হাওয়ার ঝাপটায় চলার গতি রুদ্ধ হয়ে পড়ছে। সোজা হয়ে চলতে না পেরে, মাঝে মাঝেই হামাগুড়ি দিয়ে চলতে হচ্ছে। স্কটের মনে দুর্ভাবনা। দ্রুত এগিয়ে যেতে না পারলে কেউই মৃত্যু এড়াতে পারবেন না। সঙ্গের খাবার আর কয়েক দিনের মধ্যেই ফুরিয়ে যাবে। জ্বালানিও নিঃশেষ হয়ে এসেছে। গরম না করে কোনও খাবারই মুখে তোলা যাবে না।
  • (৩) হঠাৎ পেছনে সন্দেহজনক শব্দ শুনে ফিরে তাকালেন স্কট। দেখলেন ইভানস পড়ে আছেন বরফের ওপর। সংজ্ঞা হারিয়েছেন তিনি। সেদিন আর এগুনো হল না, সেখানেই তাঁবু ফেলতে হল। সঙ্গীকে ফেলে রেখে যাবেন না কেউ। তাতে মৃত্যু হয় হোক। তিনদিন পর ইভানস সুস্থ হলেন কিছুটা। অশক্ত শরীর সত্ত্বেও তিনি বললেন, এবার আমি চলতে পারব।
  • (৪) আবার চলতে শুরু করলেন সকলে। কিন্তু কয়েক পা এগিয়েই ইভানস জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলেন। ছুটে এলেন সকলে ইভানসের মাথাটা তুলে ধরতে গিয়ে দেখা গেল, চিরদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়েছেন তিনি। সঙ্গীকে হারিয়ে সকলেরই মন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ল। কিন্তু থেমে থাকবার উপায় নেই। ইভানসকে সমাধিস্থ করে এগিয়ে চললেন আবার।
  • (৫) খাবার রয়েছে যৎসামান্য। দ্রুত এগিয়ে যাওয়া দরকার। কিন্তু চলতে পারছিলেন না ওয়েটস। তবুও চলতে লাগলেন পা টেনে টেনে। তাঁর অবস্থা দেখে তাঁবু ফেললেন স্কট। ওয়েটস সঙ্গীদের বিব্রত করতে চাইলেন না। খাবারটাও বাঁচানো দরকার।
  • (৬) ১৫ই মার্চ মাঝরাতে তাঁবু থেকে বেরিয়ে পড়লেন ওয়েটস। আর ফিরে এলেন না। সঙ্গীদের যাত্রা নির্বিঘ্ন করবার জন্য নিজেই দল থেকে সরে গেলেন। ডিপো বেশি দূরে নয়। মাত্র আঠারো মাইল। কিন্তু দুটো দিন পথ চলার পরেই শুরু হল প্রচণ্ড ঝড়। বাধ্য হয়ে তাঁবুতে আশ্রয় নিতে হল।

রবার্ট স্কটের ডায়েরি

সমস্ত দুঃখ কষ্টের মধ্যেও একটি কাজ সেই বরফের দেশে প্রতিদিন নিয়মিত করতেন স্কট। ডায়েরি লিখতেন। অভিযানের প্রতিটি ঘটনার নিখুঁত বিবরণ লিপিবদ্ধ করতেন। স্কট কেবল একজন অভিযাত্রী মাত্র ছিলেন না। তাঁর ছিল শিল্পের দৃষ্টি আর একজন দক্ষ সাহিত্যিকের রচনাশৈলী। ডায়েরীর প্রতিটি লেখায় ধরা রয়েছে তাঁর সেই পরিচয়। সর্বোপরি তিনি ছিলেন একজন দরদী মানুষ। দেশের প্রতিও ছিল তাঁর অপরিসীম ভালবাসা।

ডায়েরীতে স্কটের বিখ্যাত লেখনী

ডিপোর কাছাকাছি এসেও ঝড়ের তাণ্ডবে এগারো দিন তাঁবুর মধ্যে আটকে থাকতে হল সকলকে। তাঁরা বুঝতে পারছিলেন মৃত্যু আর বেশি দূরে নেই। সেই অবস্থাতেও স্কট তাঁর ডায়েরীতে লিখলেন “মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে আজ পৃথিবীর মানুষকে জানিয়ে যেতে পারছি, আমার বীর বন্ধুরা জনমানবহীন তুষার প্রান্তরে সীমাহীন কষ্ট দুঃখ সয়েছেন বীরের মতো, এই আমাদের চরম আনন্দ। আমরা প্রমাণ করে গেলাম, ইংল্যাণ্ডের মানুষ মৃত্যুকে জয় করতে পারে, দেশের গৌরববৃদ্ধির জন্য বীরের মতো মৃত্যু বরণ করতে পারে।…..”

স্কটের সর্বশেষ ডায়েরি

অমিতশক্তি বীরের মৃত্যু নেই। মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই তাঁরা অর্জন করেন অমরত্ব। এই চিরন্তন সত্যই প্রমাণ করে গেলেন অভিযাত্রী স্কট ও তাঁর সঙ্গীরা। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে ২৯ মার্চ, বৃহস্পতিবার সর্বশেষ ডায়েরী লিখেছেন স্কট। তারপর চিরদিনের মতো স্তব্ধ হয়ে গেছে তাঁর কলম।

রবার্ট স্কটের মৃত্যু

আটমাস পর উদ্ধারকারী দল তাঁবুর মধ্যে তাঁর প্রাণহীন দেহ আবিষ্কার করে। উইলসন শায়িত ছিলেন পাশেই। কিছু দূরে ছিল বেয়ার্সের দেহ। সেই বরফের প্রান্তরেই মরণজয়ী অভিযাত্রীদের সমাহিত করে ক্রশ পুঁতে দেওয়া হয়। যে জায়গা থেকে ওয়েটস বেরিয়ে গিয়েছিলেন তাঁবু থেকে, সেখানে স্থাপন করা হয় স্মৃতিচিহ্ন। একজন সত্যিকারের মানুষ যে কাছেই কোথাও ঘুমিয়ে আছেন, সে কথা লেখা রইল তাতে।

উপসংহার :- রবার্ট ফ্যালকন স্কটের জীবন ও অভিযান সাহস, সংকল্প এবং মানুষের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করার ইচ্ছার প্রতীক হয়ে উঠেছে। দক্ষিণ মেরু অভিযান তার অসীম সাহস ও আত্মত্যাগের গল্প হয়ে আছে। যদিও তার টেরা নোভা অভিযান মেরু জয় করতে ব্যর্থ হয় এবং দুঃখজনক পরিণামে শেষ হয়, স্কট ও তার দলের প্রচেষ্টা অনুসন্ধান ও অভিযানের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেয়েছে। তাদের সাহসী প্রচেষ্টা আজও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে এবং স্কটকে ব্রিটিশ ঐতিহ্যে নায়কোচিত মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। তার জীবনের গল্প মানবজাতির অসীম অভিযানের স্পৃহা এবং অজানাকে জানার পিপাসার এক অমর উদাহরণ।

(FAQ) রবার্ট ফ্যালকন স্কট সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. রবার্ট ফ্যালকন স্কট কাকে বলে?

রবার্ট ফ্যালকন স্কট একজন ব্রিটিশ নৌ-অফিসার এবং অ্যান্টার্কটিক অঞ্চলের বিশিষ্ট অনুসন্ধানকারী ছিলেন, যিনি দক্ষিণ মেরুতে অভিযান চালানোর জন্য বিখ্যাত।

২. স্কটের বিখ্যাত অভিযানগুলো কী কী?

স্কট দুটি প্রধান অ্যান্টার্কটিক অভিযান পরিচালনা করেন: ডিসকভারি অভিযান (১৯০১-১৯০৪) এবং টেরা নোভা অভিযান (১৯১০-১৯১৩)।

৩. রবার্ট স্কট দক্ষিণ মেরুতে কখন পৌঁছান?

রবার্ট স্কট ও তার দল দক্ষিণ মেরুতে ১৭ জানুয়ারি, ১৯১২-এ পৌঁছায়, কিন্তু তখন দেখতে পান যে রোয়াল্ড অ্যামুন্ডসেন ও তার দল তাদের আগে পৌঁছেছে।

৪. টেরা নোভা অভিযানের পরিণাম কী ছিল?

টেরা নোভা অভিযানের পর ফেরার পথে স্কট ও তার পুরো দল কঠিন আবহাওয়া এবং খাদ্যসংকটে মারা যান।

৫. রবার্ট ফ্যালকন স্কটের অভিযানসমূহ ব্রিটিশ ইতিহাসে কেন গুরুত্বপূর্ণ?

স্কটের সাহসী প্রচেষ্টা, আত্মত্যাগ ও দক্ষিণ মেরু অভিযানের শোকাবহ পরিণাম তাকে ব্রিটিশ ঐতিহ্যে একটি নায়কোচিত স্থান দিয়েছে।

Leave a Comment