ইউরিপিডিস

প্রাচীন গ্রিসের একজন প্রখ্যাত নাট্যকার ইউরিপিডিস (Euripides) খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে ট্র্যাজেডি রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি এস্কাইলাস এবং সোফোক্লিসের পাশাপাশি গ্রিক ট্র্যাজেডির তিন মহৎ নাট্যকারের অন্যতম হিসেবে বিবেচিত হন। ইউরিপিডিসের নাটকগুলোতে মানব প্রকৃতি, নৈতিক দ্বন্দ্ব, এবং নারীর সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে গভীর বিশ্লেষণ দেখা যায়। তার উল্লেখযোগ্য নাটকগুলোর মধ্যে “মিডিয়া,” “দ্য ব্যাক্কাই,” “হিপোলিটাস” ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তার লেখার ভিন্নতা ও আধুনিক চিন্তার প্রভাব তাকে বিশেষভাবে স্মরণীয় করে তুলেছে।

নাট্যকার ইউরিপিডিস

ঐতিহাসিক চরিত্রইউরিপিডিস
জন্মআনুমানিক ৪৮০ খ্রিস্টপূর্বে, সেলামিস, গ্রিস
পেশানাট্যকার
ধারাট্র্যাজেডি
উল্লেখযোগ্য নাটক“মিডিয়া,” “দ্য ব্যাক্কাই,” “হিপোলিটাস,” “ইলেক্ট্রা”
প্রধান থিমমানব প্রকৃতি, নারীর অবস্থান, নৈতিক দ্বন্দ্ব
প্রভাবগ্রিক ট্র্যাজেডি এবং পরবর্তী পশ্চিমা নাট্যচর্চা
মৃত্যু৪০৬ খ্রিস্টপূর্বে, ম্যাসেডোনিয়া
ইউরিপিডিস

ভূমিকা :- প্রথাবিরোধী নাটক রচনা করে গ্রিসে আলোড়ন তুলে একই সময়ে কুড়িয়েছেন নিন্দা ও প্রশংসা, আর কালের বিচারে লাভ করেছেন চিরকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের সম্মান – এই হলেন ইউরিপিডিস।

নাট্যকার ইউরিপিডিসের জন্ম

খ্রিস্টের জন্মের ৪৮০ অব্দ পূর্বে এথেন্সে জন্ম হয়েছে নাট্যকার ইউরিপিডিসের। সময়টা বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য এই কারণে যে সেই বছরেই স্যালামিসের নৌযুদ্ধে গ্রীকবাহিনী পারস্য সম্রাট জেরাক্সসের নৌবাহিনীকে পর্যুদস্ত করেছিল। পুরাকাহিনী থেকে আরও জানা যায়, বিখ্যাত নাট্যকার অ্যাসকেইলাস সেই স্যালামিসের ভয়ঙ্কর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

ইউরিপিডিসের পরিবার

নাট্যকার ইউরিপিডিসের বাবার নাম মেনসারডিস। তাঁর পরিবার ছিল সম্ভ্রান্ত এবং সচ্ছল। উত্তরাধিকার সূত্রেই ফ্রায়ার অ্যাপোলো মন্দিরের সম্মানজনক কাজ লাভ করেছিলেন তিনি। ইউরিপিডিসের মা-ও ছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। এই সত্য তথ্যকে আড়াল করে তাঁর বিরুদ্ধবাদীদের প্রচারিত কুৎসাই স্থান পেয়েছিল জনমনে। তারা প্রচার করেছিল, ইউরিপিডিস ছিলেন এক হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। তাঁর বাবা ছিলেন ভবঘুরে ও দেউলিয়া। তাঁর মা ছিলেন নষ্ট চরিত্রের মহিলা। বাজারে সবজি বিক্রি করতেন তিনি।

ব্যাক্তিগত জীবনে ইউরিপিডিস

ইউরিপিডিসের ব্যাক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা সম্ভব হয় নি। তাঁর সময়কালে বিরুদ্ধবাদীদের অপপ্রচার ও কুৎসা এতটাই প্রবল হয়ে উঠেছিল যে তাঁর সম্পর্কে সত্য যেটুকু, তাকে আড়াল করে মিথ্যা হয়েছে প্রকট। এভাবেই বিকৃত হয়ে পড়েছে তাঁর জীবন-কাহিনী। তার মধ্যে থেকেই জ্ঞানান্বেষী পন্ডিতবর্গ কঠোর শ্রম স্বীকার করে যথাসম্ভব সত্যকে উদ্ধার করে এনেছেন।

আধুনিক মননের মানুষ ইউরিপিডিস

এই থেকেই বোঝা যায় প্রথাবিরোধী বাস্তবধর্মী নাটক বচনা করে তৎকালীন সমাজে কতটা বিরুদ্ধতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, স্বচ্ছ চিন্তা ও আধুনিক মননের মানুষ ইউরিপিডিসকে। যুগে যুগে এভাবেই অন্ধকারভেদী আলোক রশ্মিকে ঘন মেঘের বাধা উত্তীর্ণ হতে হয়েছে।

নাটক রচনায় ইউরিপিডিসের মনোনিবেশ

প্রথম জীবনে একজন ক্রীড়াবিদ এবং শিল্পী হিসেবেই পরিচিত হয়েছিলেন ইউরিপিডিস। কিন্তু বছর পঁচিশ বয়স হতেই তিনি সবকিছু ছেড়ে নাটক রচনায় মনোনিবেশ করলেন। তাঁর প্রথম নাটক দি ডটারস অব পোলিয়াস মঞ্চস্থ হবার সঙ্গে সঙ্গেই আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এথেন্সের বুদ্ধিজীবীমহল অনুধাবন করেন, গ্রীসের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নতুন সম্ভাবনার আবির্ভাব ঘটেছে। চিরাচরিত নাটকের ধারা বর্জন করে বাস্তবমুখী বৈপ্লবীক উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে এভাবেই জনমনে প্রথম আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই স্থান করে নিয়েছিলেন ইউরিপিডিস।

শ্রেষ্ঠ গ্রীক ট্রাজেডি রচয়িতা ইউরিপিডিস

নাট্যকার ইউরিপিডিস তাঁর জীবনকালেই শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের সম্মান লাভ করেছিলেন। শ্রেষ্ঠ ট্রাজেডি নাটকের জন্য তিনি পুরস্কৃত হয়েছিলেন মাত্র পাঁচবার। অথচ ৮০ টিরও বেশি নাটক তিনি রচনা করেছেন। সমকালে তাঁর আধুনিক চিন্তাভাবনা আশানুরূপ মর্যাদা না পেলেও উত্তরকাল তাঁকে স্বীকার করে নিয়েছে শ্রেষ্ঠ গ্রীক ট্রাজেডি রচয়িতা হিসেবে।

ইউরিপিডিসের নাটকের প্রধান বৈশিষ্ট্য

ট্রাজেডি রচয়িতা ইউরিপিডিসের নাটকের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল তার বাস্তবতার প্রকাশ। তাঁর কাব্যপ্রতিভার মিশ্রণ নাটকগুলিকে করে তুলেছিল উপভোগ্য। নিপুণ শিল্পীর মতো তিনি গ্রথিত করেছিলেন প্রতিটি নাটকীয় মুহূর্ত। সর্বোপরি প্রতিটি নাটকেই তিনি মানুষকে উপস্থিত করেছেন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে। দেবতার করুণাপ্রার্থী অক্ষম অসহায় জীব রূপে নয়।

গ্রীক নাট্যকার ইউরিপিডিসের নাটকের চরিত্র

যে সময়ে গ্রীক নাটকের নায়কদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন দেব-দেবীরা, ভাগ্য-বিড়ম্বিত হয়ে তাঁরা প্রার্থনা করতেন দেবতাদের করুণা, দয়া, তাঁদের নিজেদের চেষ্টায় থাকত না সংকট উত্তরণের প্রয়াস, সেই সামাজিক পরিমন্ডলে ইউরিপিডিসের নাটকের চরিত্ররা ব্যবহার করেছে সাধারণ মানুষেরই মত। রক্তমাংসের মানুষের মতোই দেবতাদের করুণার ওপর নির্ভরশীল না হয়ে তারা নিজেদের চেষ্টাতেই মুখোমুখি হয়েছে যাবতীয় সংকটের।

নাট্যকার ইউরিপিডিসের নাটকে নারী বিদ্বেষের অভিযোগ

এই অভিনব উপস্থাপনায় সাধারণ মানুষ অতিভূত প্রশংসামুখর হলেও সমাজের রক্ষণশীল মানুষ তাঁর প্রয়াসকে ভাল ভাবে গ্রহণ করতে পারে নি। কেবল প্রথা বিরোধী চিন্তাভাবনার জন্যই নয়, তারা ক্ষুব্ধ হয়ে তার বিরুদ্ধে তুলেছিল আরও একটি অভিযোগ। ইউরিপিডিস তাঁর নাটকে নারীচরিত্রগুলির মধ্যদিয়ে প্রচার করেছেন নারী বিদ্বেষ। তিনি অঙ্কন করেছেন কুটিল কুশ্রী চরিত্রের নারী। তারা লিপ্ত হয়েছে ষড়যন্ত্রে, হিংস্র জলসায় ঘটিয়েছে রক্তপাত; হৃদয়হীন প্রতিশোধপরায়ণতার মধ্য দিয়ে ঘটিয়েছে নারীত্বের বিকৃতি ও অবমাননা। কিন্তু ইউরিপিডিসের প্রতি তাদের এই অভিযোগ যে যথাযথ তা কিন্তু নয়। আসলে রক্ষনশীল সমাজ তাঁর নারীচরিত্র অঙ্কনের গুঢ় উদ্দেশ্যই অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছিল।

ইউরিপিডিসের নাটকে নারী চরিত্র

প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও গভীর চরিত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমেই ইউরিপিডিস অঙ্কন করেছিলেন তাঁর নাটকের নারীচরিত্রগুলি। তাঁর নায়িকাদের মধ্যে অ্যালসেসটিস জীবন উৎসর্গ করেছিল তার স্বামীর জন্য। উচ্চ আদর্শের জন্য আপন কৌমার্যকে বলি দিয়েছিল ইফিজেনিয়া। মিথ্যাভাষিণী ও রক্তলোলুপ নারীচরিত্রও তিনি সৃষ্টি করেছিলেন বাস্তবতার আলোকেই। ক্লায়েডা এবং মিডিয়ার মতো মহিলার চরিত্র তিনি এমন ভাবে উপস্থাপন করেছেন যে বিদ্বেষ নয় তাদের প্রতি সহানুভূতিতে আমাদের মন হয়ে পড়ে দ্রবিভূত। যেভাবেই তিনি চিত্রিত করে থাকুন না কেন, ইউরিপিডিসের নারী চরিত্রগুলি কখনওই তাঁর সহানুভূতি থেকে বঞ্চিত হয় নি।

নাট্যকার ইউরিপিডিসের নাটকে ক্রীতদাস ও সাধারণ মানুষ

সমভাবে দেখা যায় তাঁর সহানুভূতি অধিক ছিল সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের চেয়ে ক্রীতদাস ও কৃষক সাধারণের প্রতিই। তাদের দুর্দশাক্লিষ্ট, দুঃখময় জীবনকে তুলে ধরে তিনি নাটকগুলিকে প্রতিবাদী ও অর্থবহ করে তুলেছিলেন। সাধারণ মানুষকে নাটকের চরিত্র হিসেবে তুলে ধরায় ইউরিপিডিসের ট্রাজেডি থেকেই মানুষ নতুন করে ভাবনার প্রেরণা পেল।

বীরচরিত্র সম্পর্কে ইউরিপিডিসের নাটক

ইতিপূর্বে হোমার বা আকিলার্স তাঁদের নাটকে যে সব বীরচরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন, তাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করত মন্দিরে অধিষ্ঠিত দেবতারা। ইউরিপিডিসের নাট্য প্রভাবে এই দেবতা এবং বীরচরিত্রদের সম্পর্কে মানুষের মনে প্রশ্ন দেখা দিল। এতদিন যা তারা করার কথা চিন্তাও করে নি এবারে তারা তাই করতে শিখল চরিত্রের বিচার-বিশ্লেষণ। দেবতারা তাদের স্বার্থোদ্ধার ও খেয়াল খুশি চরিতার্থ করার জন্য বীরপুরুষদের জীবনকে বিড়ম্বিত করেছে, জনমানসে এই জিজ্ঞাসা গভীর রেখাপাত করল।

মানুষের প্রতি ইউরিপিডিসের ভালোবাসা

নাট্যকার ইউরিপিডিস ভালবাসতেন মানুষকে। ন্যায় ও সত্যের প্রতি ছিল তাঁর আনুগত্য। সাধারণের জীবন যারা দুঃখ দুর্দশায় ভারাক্রান্ত করে তোলে সেই হৃদয়হীন, নীতিহীন জননেতাদের তিনি অন্তর থেকে ঘৃণা করতেন। তাদের ভ্রান্ত এবং স্বার্থ বুদ্ধির ফলেই মানুষের জীবনে নেমে আসে দুর্বিপাক ও যুদ্ধ। এই বক্তব্য তিনি তুলে ধরেছেন স্পার্টার ভয়াবহ যুদ্ধের কাহিনীর মধ্যে তাঁর ট্রোজান উওমেন এবং সাপলিয়ান্টস নাটকে।

ইউরিপিডিসের নাটক টেলিকাস

  • (১) এথেন্সের চিরাচরিত ঐতিহ্যকে ভঙ্গ করে তাঁর নাটকের চরিত্রদের মানুষেরই মতো উপস্থাপন করে দেশের মানুষের মনে নতুন ভাবনা নতুন চেতনার সঞ্চার করেছিলেন তিনি। ট্রোজান আর গ্রীকদের মধ্যে যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম সংগঠিত হয়েছিল তার পটভূমিতে ইউরিপিডিস রচনা করেছিলেন তাঁর টেলিকাস নাটকটি।
  • (২) দুই পক্ষে চলছে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ। নিহত হচ্ছে উভয় পক্ষের দেশপ্রেমী বীরগণ। এমনি এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধে গ্রীক সেনানায়ক একিলিসের বর্শার আঘাতে আহত হলেন মিশিয়ার রাজা টেলিকাস। তিনি যুদ্ধ করছিলেন ট্রোজান পক্ষের হয়ে। চিকিৎসকদের চেষ্টা চলল ক্ষত ভাল করে তোলার। কিন্তু কোনো ওষুধেই কাজ দিচ্ছে না।
  • (৩) এমনি সময়ে দৈবজ্ঞরা ঘোষণা করল, অ্যাকিলিসের যে বর্শার আঘাতে টেলিকাসের ক্ষতের সৃষ্টি, সেই বর্শার স্পর্শেই কেবল নিরাময় হতে পারে এই ক্ষত। ক্ষতের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে উঠেছেন টেলিকাস। কী করবেন বুঝতে পারছেন না। শত্রুপক্ষের সেনা নায়কের কাছে তিনি পৌঁছবেন কি করে? যদি বা কোনো ক্রমে পৌঁছতে পারেন, অ্যাকিলিস কি তাঁর ক্ষত নিরাময়ে সাহায্য করতে রাজি হবেন?
  • (৪) অনেক চিন্তাভাবনা করে শেষ পর্যন্ত অসম্ভকেই সম্ভব করে তোলার সংকল্প নিলেন রাজা টেলিকাস। গায়ে ছেঁড়া পোশাক চাপিয়ে তিনি ছদ্মবেশ নিলেন। সাজলেন একজন খঞ্জ ভিক্ষুক। যুদ্ধে আহত হওয়ায় এমনিতেই তাঁকে চলতে হচ্ছিল খুঁড়িয়ে। ফলে ভিক্ষুকের পোশাকের সঙ্গে হাঁটাচলার এই ত্রুটি নিখুঁত মানিয়ে গেল। বাড়তি অভিনয় আর তাঁকে করতে হল না।
  • (৫) খোঁড়া ভিক্ষুকের বেশেই একসময় তিনি পৌঁছলেন গ্রীক সেনানায়কদের এক সমাবেশে। সেখানে কিছু বক্তব্য রাখার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন তিনি। কিন্তু একজন ভিক্ষুকের এই ঔদ্ধত্য সহ্য করলেন না সেনানায়করা। তাঁরা ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে বিতাড়িত করবার চেষ্টা করলেন, আঘাতও করলেন তাঁকে।
  • (৬) সেই অবস্থাতেও টেলিকাস চিৎকার করে তাঁর কথা শোনাতে চান। সেই সময় অ্যাগামেমননের স্ত্রী ক্লিওমেনস্ত্রার অনুরোধে গ্রীক সেনানায়করা রাজি হলেন টেলিকাসের বক্তব্য শুনতে। তাঁকে থাকতে দেওয়া হল তাদের সমাবেশে। সুযোগ পেয়ে আপন বুদ্ধিবলে সেই সুযোগ কাজে লাগালেন টেলিকাস। তিনি এক সুযোগে ক্লিওমেনস্থার শিশুপুত্র ওবেসটেসকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসে প্রকাশ করলেন নিজের সত্য পরিচয়।
  • (৭) তিনি ঘোষণা করেন, অ্যাকিলিস যদি তার বর্শা দিয়ে তাকে নিরাময় করে দেন তবেই এই শিশুকে মুক্ত করে দেবেন। নচেৎ সকলের চোখের সামনেই শিশুর মাথা গুঁড়িয়ে দেবেন তিনি। অগত্যা টেলিকাসের হাতে বন্দী শিশুকে মুক্ত করার জন্য অ্যাকিলিস এসে তার বর্শা ছুঁইয়ে ক্ষত নিরাময় করে দেন। দৈবের অনুগ্রহ প্রার্থনা নেই, নেই কোনো অনুনয় বিনয়, আছে বীরের মনোবল, বুদ্ধির নির্ভরতা।
  • (৮) এখানেই এথেন্সের নাটক রচনার চিরাচরিত প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন ইউরিপিডিস। দেবতার মহিমা নয় মানুষের মানবিক গুণকেই বড় করে তুলে ধরবার চেষ্টা করেছেন তিনি। মানুষকে পরিপূর্ণ মানুষরূপে উপস্থাপন করেছেন। এই বৈপ্লবিক উদ্যোগের ফল হল মিশ্র। নাটকের অভিনবত্ব ও চমৎকারিত্ব একদিকে যেমন মুগ্ধ করল জনতাকে তেমনি পাশাপাশি দেবতার মহিমা ক্ষুণ্ণ করায় ঐতিহ্য-বিরোধী প্রয়াসের জন্য জনমনে ক্ষোভও দেখা দিল।
  • (৯) টেলিকাস নাটকের ১৭ বছর আগে ইউরিপিডিস প্রথম নাটক ডটারস অব পেলিয়াস জনসমক্ষে উপস্থাপন করেছিলেন। তখনও ঘটেছিল একই প্রতিক্রিয়া। বিস্ময় ও মুগ্ধতার সঙ্গে ক্ষোভ। তরুণ নাট্যকার সেই নাটকেই চরম দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন দেবতার বদলে মানুষকে নাটকের চরিত্র হিসাবে বেছে নিয়ে। তবে তার উপস্থাপনা ছিল এমনই সুগঠিত ও বলিষ্ঠ যে তাঁকে জনতা চিহ্নিত করেছিল প্রথা-বিরোধী নাট্যকার রূপে। তাঁরা একরকম মেনেই নিয়েছিল তাঁকে।
  • (১০) কিন্তু এবারে ঘটল বিস্ফোরণ। তার একমাত্র কারণ হল, নাট্যকার নাট্যমঞ্চে হাজির করেছেন এক ভিক্ষুককে। তাঁরা নাট্যকারের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠল। কিন্তু নাটকের সমর্থনেও দাঁড়িয়ে গেল একদল মানুষ। তারা এই পরিবর্তনকে অভিনন্দন জানাল। তাঁরা সোচ্চারে ঘোষণা করলেন, অপ্রিয় বিষয় ও সমস্যাকে নাট্যমঞ্চে উপস্থিত করে ইউরিপিডিস মানুষকেই সম্মান দিয়েছেন, মানুষকে ভাবতে বাধ্য করেছেন। এর ফলে মানুষ বাস্তবের মুখোমুখি হবার সাহস পাবে।

নাট্যকার ইউরিপিডিসের বিরোধিতা

  • (১) বিরুদ্ধপক্ষের অপকৌশলের অভাব কোনো কালেই হয় না। ইউরিপিডিসের ভাগ্যেও তার ব্যতিক্রম ঘটল না। তারা রটনা করে দিল, তিনি ধর্মদ্রোহী, তাঁর ভাবনায় রয়েছে নারী বিদ্বেষ। এখানেই তারা ক্ষান্ত হল না, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে কালিমা লেপন করতেও ইতস্তত করল না। একজন মানুষকে যতভাবে সমাজের চোখে হেয় করা অপদস্থ করা সম্ভব তার কোনওটাই তারা বাকি রাখল না।
  • (২) সমালোচকদের অপপ্রচার ও কুৎসা ক্রমে এমন তীব্র হয়ে উঠল যে নবীন নাট্যকারকে এথেন্স ত্যাগ করে যেতে হল। অন্য ভাবে বলতে হয় স্বদেশ থেকে বিতাড়িত হলেন তিনি। অথচ, পরবর্তীকালে এই অভিশপ্ত নাট্যকারকেই গ্রীসের শ্রেষ্ঠ ট্রাজেডি রচয়িতার সম্মান জানিয়েছে এই এথেন্স। তাঁর নাটকই মঞ্চস্থ হয়েছে সবচেয়ে বেশি। তাঁর সেই খ্যাতি ও সম্মান মহাকাল আজও সমমর্যাদায় বহন করে চলেছে। ইউরিপিডিসের সমাদর ও শ্রেষ্ঠত্ব আজও অম্লান।

প্রথাবিরোধী নাট্যকার ইউরিপিডিস

ট্রাজেডি রচনার ক্ষেত্রে গ্রীসে যে কজন নাট্যকার শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা লাভ করেছেন তাঁরা হলেন অ্যাসকেইলাস, সোফোক্লিস এবং ইউরিপিডিস। এই তিনজনের মধ্যে প্রথাবিরোধী নাট্যকার রূপে স্বীকৃত ইউরিপিডিস। প্রকৃত অর্থেই তিনি ছিলেন আধুনিক চিন্তাধারার মানুষ। তাঁর মনন ও আন্তরসংবেগ হৃদয়কে স্পর্শ না করে পারে না। তাঁর রচনার এই বৈশিষ্ট্যই তাঁকে দিয়েছে কালজয়ী খ্যাতি ও অমরত্ব।

এথেন্সের নাগরিক হিসেবে ইউরিপিডিসের কর্তব্য

যৌবনে নাটক রচনায় মগ্ন হয়েছিলেন ইউরিপিডিস। সৃষ্টির তাগিদে তিনি জনজীবন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। স্যালামিসে নিজস্ব জমিদারির নির্জন পরিবেশে বসবাস করতেন। অনিবার্য প্রয়োজন ছাড়া মানুষের সঙ্গে মিশতেন না। তবে এথেন্সের নাগরিক হিসেবে নিজের কর্তব্য তিনি ভুলে যান নি। এক সময় সেনাদলে কাজ করেছেন। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে অকাতরে অর্থ দান করেছেন। একবার ম্যাগনেশিয়ার কনসালের পদও অলঙ্কৃত করেছিলেন।

ইউরিপিডিসের এথেন্স ত্যাগ

যাই হোক বিরুদ্ধবাদীদের অপপ্রচারে বিরক্ত বিব্রত ইউরিপিডিসকে একসময় তাঁর স্বভূমি এথেন্স ছেড়ে আশ্রয় নিতে হয়েছিল ম্যাসিডনের রাজা আরকিলাসের দরবারে। সেই সময় তাঁর বয়স বাহাত্তর। সময়টা ৪৮০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ। তাঁর ওরেসটিস নাটক মঞ্চস্থ হবার পরে পরেই চিরতরে এথেন্স ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল তাঁকে। ম্যাসিডনরাজ পরম সমাদরে আশ্রয় দিয়েছিলেন তাঁকে। তাঁর জন্য সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ও সুবিধাদির কোনো ত্রুটি রাখেন নি তিনি। জীবনের শেষ দেড়টা বছর ইউরিপিডিস এখানে কাটিয়েছিলেন পরম শান্তি ও আরামের মধ্যে দিয়ে। এখানে তিনি আন্তরিক সাহচর্য পেয়েছিলেন তাঁর পুরনো দুই বন্ধুর। একজন নাট্যকার অ্যাগাথন। দ্বিতীয়জন সঙ্গীতকার টিমথিউস। তাঁরা দুজনেই ম্যাসিডনের রাজদরবার অলঙ্কৃত করতেন। নতুন পরিবেশে এসে যেন নতুন জীবনের সন্ধান পেয়েছিলেন তিনি।

জীবনের শেষ নাটক রচনায় ইউরিপিডিস

ম্যাসিডনিয়ায় এসে ব্যাকাস ও ইফিজনিয়া ইন অলিস নামে দুটি নাটক লেখায় হাত দিয়েছিলেন ইউরিপিডিস। কিন্তু পরমায়ু কুলিয়ে ওঠে নি। নাটক দুটি অসমাপ্ত রেখেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হয়েছিল তাঁকে। তবে এই অসমাপ্ত নাটকের মধ্যেই তিনি রেখে গেছেন শেষ জীবনের শান্তি ও তৃপ্তির ছবি। মৃত্যুকালে ইউরিপিডিসের দুই ছেলে বর্তমান ছিলেন। তাঁদের একজন গ্রহণ করেছিলেন বাবার পেশা এবং একে একে বাবার নাটকগুলি তিনি মঞ্চস্থ করেন।

উপসংহার :- সব মিলিয়ে ৮০টিরও বেশি নাটক রচনা করেছিলেন ইউরিপিডিস। তার মধ্যে সন্ধান পাওয়া গেছে মাত্র আঠারোখানি নাটকের। এবং এই নাটকগুলির বিচারেই তিনি লাভ করেছেন চিরকালের শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের সম্মান

(FAQ) ইউরিপিডিস সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ইউরিপিডিস কে ছিলেন?

ইউরিপিডিস ছিলেন প্রাচীন গ্রিসের একজন বিখ্যাত নাট্যকার, যিনি ট্র্যাজেডি রচনা করতেন এবং গ্রিক ট্র্যাজেডির তিন মহৎ নাট্যকারের একজন হিসেবে পরিচিত।

২. ইউরিপিডিসের বিখ্যাত নাটকগুলো কি কি?

ইউরিপিডিসের উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হল “মিডিয়া,” “দ্য ব্যাক্কাই,” “হিপোলিটাস,” এবং “ইলেক্ট্রা।”

৩. তার নাটকের প্রধান থিম কি ছিল?

ইউরিপিডিসের নাটকে মানব প্রকৃতি, নৈতিক দ্বন্দ্ব, এবং নারীর সামাজিক অবস্থান নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ পাওয়া যায়।

৪. ইউরিপিডিস কোন সময়ে বেঁচে ছিলেন?

তিনি খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক 480 সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং খ্রিস্টপূর্ব 406 সালে মারা যান।

৫. ইউরিপিডিস কেন উল্লেখযোগ্য?

ইউরিপিডিস তার নাটকে চরিত্রের গভীর মানসিক বিশ্লেষণ এবং সমাজের প্রথাগত ধারণার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলার কারণে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার লেখা আধুনিক চিন্তার পূর্বাভাস বলে বিবেচিত হয়।

৬. ইউরিপিডিস কোন যুগের নাট্যকার ছিলেন?

তিনি প্রাচীন গ্রিসের খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর নাট্যকার ছিলেন।

Leave a Comment