জন বানিয়ান

১৭শ শতাব্দীর ইংরেজ খ্রিস্টীয় লেখক ও প্রচারক জন বানিয়ান (John Bunyan) তাঁর বিখ্যাত ধর্মীয় রচনা The Pilgrim’s Progress (১৬৭৮) এর জন্য সর্বাধিক পরিচিত। তিনি ব্যপটিস্ট মতবাদের অনুসারী ছিলেন এবং জীবনের একটি বড় অংশ কারাবন্দি অবস্থায় কাটিয়েছেন। তাঁর রচনায় খ্রিস্টীয় বিশ্বাসের গভীর ব্যাখ্যা, আত্মিক যাত্রা এবং পাপ ও মুক্তির কাহিনী ফুটে ওঠে, যা তাকে ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলোকবর্তিকা করে তুলেছে।

লেখক জন বানিয়ান

ঐতিহাসিক চরিত্রজন বানিয়ান
জন্ম২৮ নভেম্বর, ১৬২৮; এল্‌সোথ, বেডফোর্ডশায়ার, ইংল্যান্ড
পেশালেখক, প্রচারক
ধর্মখ্রিস্টীয় (ব্যাপটিস্ট মতবাদ)
সাহিত্যধারাধর্মীয় আলঙ্কারিক সাহিত্য, আত্মজীবনীমূলক রচনা
বিখ্যাত রচনাThe Pilgrim’s Progress (১৬৭৮), Grace Abounding (১৬৬৬)
প্রভাবইংরেজি সাহিত্য, খ্রিস্টীয় ধর্মীয় চিন্তাধারা
মৃত্যু৩১ আগস্ট, ১৬৮৮; লন্ডন, ইংল্যান্ড
জন বানিয়ান

ভূমিকা :- ইংরাজি ভাষায় বাইবেলের পরেই এখনো পর্যন্ত বিক্রি সংখ্যার দিক থেকে যে বইটির নাম করা হয় তা হল পিলগ্রিমস প্রোগ্রেস। বইটির সম্পূর্ণ নাম অবশ্য বেশ দীর্ঘ – দ্য পিলগ্রিমস প্রোগ্রেস ফ্রম দিস ওয়ালর্ড টু দ্যাট হুইচ ইজ টু কাম ডেলিভার আন্ডার দ্য সিমিলিচুড অব দ্য ড্রিম। সহজ সরল সরস ভাষায় লেখা এটি একটি রূপক কাহিনী মাত্র। কাহিনীর মূল বিষয় খ্রিস্টানদের জীবনযাত্রা। ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই এই বই সর্বশ্রেণীর ও সমাজের মানুষের দ্বারা বিপুল ভাবে সমাদৃত হয়। লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হতে থাকে। সমস্ত খ্রিস্টানের কাছেই ছোট বইটি হয়ে ওঠে যেন দ্বিতীয় বাইবেল স্বরূপ। পূর্ব পরিকল্পনা না থাকলেও পাঠকদের চাহিদার চাপে লেখককে বইটির দ্বিতীয় খণ্ডও লিখে ফেলতে হল। এরপর অতিক্রান্ত হল তিন শো বছরেরও বেশি সময়। কিন্তু বইটির সমাদর আজও পর্যন্ত একই রকম রয়ে গেছে। বিক্রি সংখার দিক থেকে বাইবেলের পরেই এই বইটির স্থান। এই বিস্ময়কর বইটির লেখকের নাম জন বানিয়ান।

জন বানিয়ানের জন্ম

বেডফোর্ডের কাছে এলস্টোতে এক অতি সাধারণ পরিবারে ১৬২৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্ম। জন বানিয়ান নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে অতি সাধারণ ও অখ্যাত পরিবারের সন্তান বলে বর্ণনা করেছেন। আসলে কিন্তু তাঁদের পরিবার ছিল ওই এলাকায় বিশেষ পরিচিত ও প্রাচীন।

বাবার পেশায় নিযুক্ত জন বানিয়ান

জনের বাবা টমাস বানিয়ান ছিলেন একজন কর্মকার। এলস্টোতে পেতলের বাসনকোসন মেরামত ও ঝালাইয়ের একটি কামারশালা ছিল তাঁর। বয়স একটু বাড়লে জন তাঁর বাবার পেশাই গ্রহণ করলেন। তিনি নিজেকে পেতলের বাসন সারানোর মিস্ত্রী বলেই পরিচয় দিতেন।

স্বল্প শিক্ষিত জন বানিয়ান

বাবার সঙ্গে কাজে বেরনোর আগে পর্যন্ত বাড়িতে সামান্য লেখাপড়া শিখেছিলেন জন। কিন্তু যখন ঝালাইওয়ালার পেশা গ্রহণ করলেন, ততদিনে সবকিছু গুলে খাওয়া শেষ। একরকম ভুলেই গিয়েছিলেন লেখাপড়া।

লেখক জন বানিয়ানের মায়ের মৃত্যু

জনের মা মারা গেলেন ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে। তখন তাঁর বয়স মাত্র ষোল বছর। মায়ের মৃত্যুর পর দুমাসের মধ্যেই তাঁর বাবা আবার বিবাহ করলেন। এই ঘটনায় বিতৃষ্ণায় ভরে উঠল তাঁর মন। তিনি সৈন্য বিভাগে নাম লিখিয়ে বাড়ির বাইরে চলে গেলেন।

ব্যক্তিগত জীবনে জন বানিয়ান

ব্যক্তিগত জীবনে বানিয়ান ছিলেন সৎ, বিনয়ী, সরল ও নিরহঙ্কারী। মৃদুস্বরে কথা বলতেন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলতেন না। তিনি কখনো নিজের প্রশংসা করতেন না, কিংবা নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করতেন না।

দেশের সৈন্য বিভাগে জন বানিয়ান

সৈন্য বিভাগের কাজে ছ বছর ছিলেন জন। এই সময়ে যুদ্ধক্ষেত্রে রীতিমতো অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে হয়েছে তাঁকে। একবার নেহাৎ ভাগ্যজোরে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। একটি সামরিক অভিযানে শেষমুহূর্তে জনের বদলে যে সৈনিকটি যোগ দিয়েছিল, যুদ্ধক্ষেত্রে তাকে প্রাণ হারাতে হয়েছিল।

জন বানিয়ানের সংসার

উনিশ বছর বয়সে যুদ্ধ থেকে ফিরে এলেন জন। আকস্মিক ভাবেই সংসার পাতলেন পিতৃ-মাতৃহীন এক ধর্মপ্রাণা তরুণীকে বিয়ে করে। হতদরিদ্র এই দম্পতির সংসারে আসবাব তো দূরের কথা গৃহস্থালীর সামানা থালা বা চামচও ছিল না। বলতে গেলে একেবারে শূন্য থেকেই সংসারযাত্রা শুরু করেছিলেন তাঁরা। জনের স্ত্রী ছিলেন ধর্মপ্রাণা মহিলা। স্বামীর ঘরে আসার সময় তিনি দুখানি ধর্মগ্রন্থ সঙ্গে করে এনেছিলেন। ধর্মগ্রন্থগুলির নাম, দ্য প্রেইল ম্যানস পাথওয়ে টু হেভেন ও দ্য প্রাকটিস অব পাইরিটি। সংসারে সম্পত্তি বলতে ছিল কেবল ওই দুখানি বই।

প্রাণবন্ত জন বানিয়ান

জন ছিলেন প্রাণবন্ত টগবগে যুবক। নাচ গান হৈহুল্লোড় করে ফুর্তিতে সময় কাটাতেই পছন্দ করতেন। তবে কখনো কুসঙ্গের প্রভাবে পড়ে কোন বদ কাজের সঙ্গে যুক্ত হন নি। খারাপ ধরনের শপথ করা ছাড়া তাঁর জীবনে বিশেষ কোনো দোষ ছিল না কথায় কথায় যখন তখন যা-তা ভাষায় তিনি শপথ করে বসতেন। এই ব্যাপারটা একরকম অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল তাঁর। সৈন্য বিভাগে থাকার সময় লেখাপড়ার ব্যাপারটা খানিক ঝালিয়ে নিতে পেরেছিলেন। স্ত্রীর আনা বই দুখানা পড়ে তিনি প্রভাবিত হলেন। তাঁর নিজেকে একজন অপরাধী, পাপী বলে মনে হতে লাগল।

ঈশ্বর প্রসঙ্গে জন বানিয়ানের মনে প্রশ্ন

এই সময়ের একদিনের একটি ঘটনা তাঁর জীবনের ধারা আমূল পাল্টে দিল। কয়েকজন মহিলা এক জায়গায় বসে ঈশ্বর প্রসঙ্গে আলোচনা করছিলেন। বানিয়ান সেখান দিয়ে যাবার সময় লক্ষ্য করলেন কী গভীর ঈশ্বর বিশ্বাস নিয়ে মহিলারা কথা বলছেন। এই ঘটনাটি বানিয়ানকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করল। তাঁর মনেও ঈশ্বর প্রসঙ্গে নানা প্রশ্ন জেগে উঠল। দীর্ঘ চার বছর তাঁর মধ্যে আধ্যাত্মিক বিষয়ের আন্দোলন চলল এবং একদিন নিজের মধ্যেই সব প্রশ্নের সমাধান পেয়ে গেলেন তিনি। গভীর প্রশান্তিতে ভরে উঠল তাঁর মন। এই সময়ের মনের আকুলতা, আবেগ ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব আত্মজিজ্ঞাসা নিয়ে একখানি বইও তিনি লিখেছিলেন। বইটির নাম দিয়েছিলেন গ্রেস অ্যাবার্ডনডিং টু দ্য চীফ অব সিনারস।

জন বানিয়ানের স্ত্রীর মৃত্যু

বানিয়ান প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগ দিলেন ১৬৫৩ খ্রিস্টাব্দে। দুবছর পরে তিনি চলে এলেন বেডফোর্ডে। দুর্ভাগ্যই যেন তাঁকে এখানে টেনে নিয়ে এলো। কিছুদিন পরেই তাঁর স্ত্রী মারা গেলেন। স্ত্রীর শোকে নিজেও কিছুদিন অসুস্থ হয়ে রইলেন।

যাজক জন বানিয়ান

১৬৫৫ খিস্টাব্দে বেডফোর্ডের সেন্ট জন চার্চের অন্যতম যাজক নিযুক্ত হলেন জন। পুরোপুরি ভাবেই অধ্যাত্মিক জীবনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে নিলেন তিনি। এককালের ঝালাইওয়ালা ও সৈনিক জন বানিয়ানকে এর পরে দেখা গেল ধর্মপ্রচারকের ভূমিকায়। এই কাজে অসামান্য সফলতা অর্জন করলেন তিনি। আগে কখনো জনসমক্ষে বক্তৃতা দেওয়ার অভ্যাস ছিল না বানিয়ানের। তাই নিজেও তিনি জানতেন না যে বক্তৃতা দেবার সহজাত দক্ষতা তাঁর রয়েছে।

জন বানিয়ান কর্তৃক ধর্ম প্রচার

ধর্মপ্রচারের কাজে নেমে তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই সুখ্যাতি অর্জন করলেন। তাঁর প্রচার সভায় লোকেরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে তাঁর বক্তৃতা শুনত। কিন্তু এককালে যাবা এঁকে জানত খারাপ শপথ করা বাচাল ফুর্তিবাজ বলে তাঁরা সভায় কৌতূহল নিয়ে ভিড় বাড়াত তাঁর ধর্ম প্রচারক চেহারা দেখার জন্য। কেউ কেউ তাঁকে টিটকিরিও দিত। কিন্তু সব অবস্থাতেই অবিচলিত থাকতেন বানিয়ান। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ধর্মকথা প্রচার করতেন বানিয়ান। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সকলে শুনতো তাঁর কথা। সহজ সরল কথার মধ্য দিয়ে তিনি লোকের মধ্যে আত্মজিজ্ঞাসা জাগিয়ে তুলতে পারতেন। আধ্যাত্মিক প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হত তাদের হৃদয়।

লেখক জন বানিয়ানের বিরুদ্ধে অভিযোগ

একজন সামান্য ঝালাইওয়ালা শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠেছে মানুষের আত্মার সংস্কারক-এই ব্যাপারটা রক্ষণশীল যাজক সম্প্রদায় সহজ ভাবে মেনে নিতে পারল না। বানিয়ানের জনপ্রীতিও তাদের গাত্রদাহের কারণ হয়ে উঠল। তাঁকে অপদস্থ করবার জন্য তারা নানা অভিযোগ তুলতে লাগল। এমন সব অভিযোগ যায় কোনো ভিত্তি ছিল না। কৌশলে প্রচার করা হতে লাগল, বানিয়ান একজন ডাইনি। কেউ বলে বেড়াত লাগল, ধর্মান্ধ পাদ্রিটা ডাকাত ছাড়া কিছু নয়। তাছাড়াও নানা মিথ্যা কুৎসা রটনা করা হতে লাগল। শেষ পর্যন্ত এই অপপ্রচার এবং বিরুদ্ধাচরণ বানিয়ানকে মামলায় পর্যন্ত জড়িয়ে ফেলেছিল। ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা উঠেছিল। তার ফলাফল কিছু অবশ্য জানা যায় নি।

বই লেখায় নিযুক্ত জন বানিয়ান

এই সময় থেকেই বানিয়ান একের পর এক বই লিখতে থাকেন। ১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হল সাম গসপেল ট্রয়স ওপেন্ড। বাইবেলের ওপরে অসাধারণ দখল ছিল তাঁর। বাইবেলের নীতিবাক্য ও পাপ-পুণ্য বিষয়ে তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে লাগল।

জন বানিয়ানের দ্বিতীয় বিবাহ

১৬৫৩ খ্রিস্টাব্দে প্রথমা স্ত্রী গত হয়েছিলেন। ছ বছর পরে ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয়বার বিবাহ করলেন। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম এলিজাবেথ। তিনিই দেখাশোনার দায়িত্ব নিলেন বানিয়ানের প্রথম পক্ষের চারটি সন্তানের। বিবাহের কিছুকাল পর থেকেই বানিয়ানের জীবনে নেমে এলো বিপর্যয়।

গ্রেপ্তার জন বানিয়ান

দ্বিতীয় চার্লসের ক্ষমতা লাভের পর থেকেই, গির্জাগুলির অধিকার সরকারের হাতে চলে গেল। ফলে বানিয়ানের পক্ষে স্বাধীন ভাবে ধর্মপ্রচার করা খুবই বিপজ্জনক হয়ে উঠল। তবু তিনি প্রচার কার্য চালিয়ে যেতে লাগলেন। ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দের ১২ই নভেম্বর, বেডফোর্ডের এক বাড়িতে ধর্মসভায় বানিয়ান যখন বক্তৃতা করছিলেন সেই সময় রাজাদেশ লঙ্ঘনের অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হল। বানিয়ান আগেই জেনেছিলেন, তাঁর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বেরিয়েছে। তবুও ভীত হন নি তিনি। কাজ ছেড়ে পালিয়ে যান নি। বিচারকের সামনে উপস্থিত করা হলে বানিয়ানকে। বলা হল আর কখনও ধর্মপ্রচার করবেন না এই মর্মে মুচলেকা লিখে দিতে। কিন্তু এই প্রস্তাব বানিয়ান প্রত্যাখ্যান করলেন। মুচলেকা দিলে হয়তো অল্পতেই ছাড়া পেয়ে যেতেন তিনি। কিন্তু বানিয়ান কিছুমাত্র নরম মনোভাব দেখালেন না।

জন বানিয়ানের বিচার

  • (১) ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে শুরু হল বানিয়ানের বিচার। তাঁর বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ ছিল যে তিনি সরকারী আদেশ অমান্য করে সভা ডেকে বক্তৃতা করে রাজভক্ত প্রজাদের সম্রাটের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলছেন। আরও ছিল, তিনি কোনো গির্জায় প্রার্থনা সভায় যোগ দেন না। অন্যান্য ধর্মাচরণেও অংশ নেন না। সকল অর্থেই তিনি একজন ধর্মদ্রোহী।
  • (২) বানিয়ান তাঁর বিরুদ্ধে আনা মিথ্যা অভিযোগগুলির কোনো প্রতিবাদ করলেন না। উপরন্তু সব অভিযোগ স্বীকার করে নিলেন এবং দ্বিধাহীন ভাষায় ঘোষণা করলেন, সুযোগ পাওয়া মাত্রই তথাকথিত অপরাধগুলি তিনি আবার করবেন। তাঁর বিশ্বাস অনুযায়ী ধর্মপ্রচারের কাজ থেকেও তিনি বিরত হবেন না।
  • (৩) একতরফা বিচারে বিচারক তাঁর রায়ে ঘোষণা করলেন, প্রথম দফায় বানিয়ানকে তিন মাস কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। তিন মাস পরে নিজস্ব ধর্মপ্রচার ছেড়ে তাঁকে গির্জার ধর্মসভায় যোগ দিতে হবে। যদি তিনি তা না করেন, তবে তাঁকে রাজত্ব থেকে বহিষ্কার করা হবে। এরপরেও যদি তিনি রাজার কাছ থেকে বিশেষ অনুমতি না নিয়ে আবার ফিরে আসেন, তাহলে সেই অপরাধে তাঁকে দেওয়া হবে মৃত্যুদণ্ড।

লেখক জন বানিয়ানের স্ত্রীর আবেদন

বানিয়ান তিনমাস কারাদন্ড ভোগ করলেন। কিন্তু তিনি তাঁর পূর্বঘোষিত সিদ্ধান্ত বদল করতে রাজি হলেন না। এর কিছুদিন পরেই বাজা চার্লসের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠান উপলক্ষে দন্ডপ্রাপ্ত আসামীদের ক্ষমা প্রার্থনার অবেদন জানাবার সুযোগ দেওয়া হল। বানিয়ান কিন্তু এরকম কোনো আবেদনই জানালেন না। ইতিমধ্যে তাঁর স্ত্রী লন্ডনে হাউস অব লর্ডসে উপস্থিত হয়ে স্বামীর মুক্তির জন্য প্রার্থনা জানালেন। তাঁর বক্তব্য যথেষ্ট সহানুভূতির সঙ্গেই শোনা হল এবং তাঁকে বিষয়টি আদালতে উপস্থিত করতে পরামর্শ দেওয়া হল। বানিয়ানের স্ত্রী যথারীতি আদালতে বিচারকের কাছে তাঁর স্বামীর ন্যায় বিচারের প্রার্থনা জানালেন। পর পর তিনবার আবেদন জানাবার পর বিচারক সভার সদস্য ম্যাথিও হেল তাঁকে জানালেন যে তাঁর স্বামী যে বিবৃতি দিয়েছে তাতে তার শাস্তি ভোগের ইচ্ছা বলেই আদালত ধরে নিয়েছে। এক্ষেত্রে তাঁকে মুক্তি পেতে হলে রাজার কাছে ভ্রান্তি স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। বলাবাহুল্য, বানিয়ান এই প্রস্তাবে সম্মত হলেন না এবং তাঁকে এরপর বারো বছর কারাদন্ড ভোগ করতে হল।

জন বানিয়ানের জেলের জীবন

  • (১) কারাবাসের প্রথম দিকে বানিয়ানকে তাঁর নিজের সম্প্রদায়ের ধর্মসভাতে যোগ দিতে দেওয়া হত। পরে সেই সুযোগ কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। বানিয়ানকে যে জেলখানাতে রাখা হয়েছিল, সেখানে প্রায়ই নন-কনফরমিস্টদের এনে রাখা হত। বানিয়ান তাদের নিয়েই জেলখানার ভেতরে ধর্মসভা বসাতেন।
  • (২) জেলের ব্যবস্থাপত্র ভালই ছিল। সংসারের খরচ নির্বাহের জন্য জেলে বসেই তিনি ফিতে তৈরি করতেন এবং সেগুলো ফেরিওয়ালাদের কাছে বিক্রি করতেন। জেলে বসে লেখাপড়ারও সুযোগ পেতেন তিনি। বাইবেল ও বুক অব মার্টারস বই দুটি সঙ্গেই ছিল। কাগজ কলম সংগ্রহ করে একসময় লেখাও শুরু করলেন। জেলে বসেই তিনি লিখলেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ গ্রেস অ্যাবাউনডিং।
  • (৩) জেলের জীবনে যথেষ্ট মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে বানিয়ানকে। স্ত্রী পুত্রের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার যন্ত্রণা তাঁর হৃদয়কে দগ্ধ করত। এই সময়ের মনোভাব প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, শবীর থেকে মাংস টেনে ছিঁড়ে নেওয়ার মতো যন্ত্রণা তাঁকে ভোগ করতে হত। তাঁর একটি সন্তান ছিল অন্ধ। সেই হতভাগ্য সন্তানটির কথা ভেবে বেদনায় তাঁর হৃদয় বিদীর্ণ হত। ঈশ্বর বিশ্বাসী মানুষটি পরিবারের সকলকে ঈশ্বরের হাতে সমর্পণ করে সান্ত্বনা পাবার চেষ্টা করতেন।

লেখক জন বানিয়ানের মুক্তি

দীর্ঘ বারো বছর কারাবাসের পরে দ্বিতীয় চার্লসের আদেশে ১৬৭২ খ্রিস্টাব্দে নন-কনফরমিস্টদের মুক্তি দেওয়া হল। সেই সঙ্গে বানিয়ানও মুক্তি পেলেন। ইতিমধ্যে বেজকার্ডের সেন্ট জন গির্জাটির অধিকার তার আসল মালিকরা ফিরে পেয়েছিলেন। তাই সেখানে ফিরে যাবার পথ ছিল না। বানিয়ান তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে খামার বাড়িতেই ধর্মসভা বসাতে লাগলেন।

ঘুরে ঘুরে ধর্ম প্রচারে রত জন বানিয়ান

তিনি অবশ্য একজায়গায় আবদ্ধ থাকলেন না। আবার আগের মতো ঘুরে ঘুরে ধর্ম প্রচারের কাজ শুরু করলেন জন বানিয়ান। এই সময়ে তাঁকে সকলে বিশপ বটি বানিয়ান বলে সম্বোধন করত। ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়ে এই সময়টা ছিল খুবই গোলযোগপূর্ণ। একমাত্র চার্চ অব ইংল্যান্ডের অনুমোদিত ধর্মাচরণ ছাড়া অন্য সম্প্রদায়ের ধর্মপ্রচার ছিল নিষিদ্ধ। এই বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যেও বানিয়ান তাঁর নিজমতের ধর্মপ্রচারের কাজ অব্যাহত রাখলেন। তিনি ওয়াগন চালকের ছদ্মবেশে, হাতে একটি দুপটি নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দিতে লাগলেন। বাইবেলের বাণী প্রচারই ছিল বানিয়ানের ধ্যানজ্ঞান। এজন্য তিনি যে কোনো পন্থা অবলম্বন করতে দ্বিধা করতেন না। লোকের মধ্যে সত্যকার ধর্মভাব জাগিয়ে তোলার কাজকে তিনি তাঁর ধর্মাচরণের অঙ্গ বলে বিশ্বাস করতেন।

জন বানিয়ানের বিখ্যাত গ্রন্থ দ্য পিলগ্রিমস প্রোগ্রেস

  • (১) লেখার কাজেও বিরাম ছিল না তাঁর। ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হল তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ দ্য পিলগ্রিমস প্রোগ্রেস। এই একটি মাত্র গ্রন্থের জন্যই তিনি বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেছেন। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই পাঠক সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল দ্য পিলগ্রিমস প্রোগ্রেস। সেই চমক অব্যাহত রইল বছরের পর বছর-দশকের পর দশক।
  • (২) আশ্চর্য ব্যাপার এই যে এই চমকপ্রদ বইটি একশ বছর ধরে সাহিত্য জগতের অভিভাবক মহলের দৃষ্টির বাইরেই রয়ে গিয়েছিল। অথচ উচ্চশিক্ষিত বুদ্ধিজীবী মহলের স্বীকৃতির ওপরেই কোনো বইয়ের সাহিত্যিক মূল্য ও স্থায়িত্ব নির্ভরশীল। সাধারণ পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করলেও শিক্ষিত মহল বইটি সম্পর্কে কোনো রকম আগ্রহ বোধ করেন নি। দীর্ঘ একশত বছর এভাবেই অতিবাহিত হল।
  • (৩) অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বইটি সম্পর্কে শিক্ষিত মহলে আগ্রহ সঞ্চার হল। সাধারণতঃ কোনো বইয়ের গুণাগুণ নির্ণয় করেন মুষ্টিমেয় শিক্ষিত লোক-সাধারণ পাঠকদের মতামত কখনোই আমল পায় না। প্রায়শই দেখা যায় সাধারণ পাঠকের মতামতকে তোয়াক্কা না করেই বুদ্ধিজীবী মহলের মন্তব্যের ফলে একটি বই স্থান পেয়ে যায় সাহিত্যের ইতিহাসে।
  • (৪) চিরাচরিত এই রেওয়াজ রীতিমত পাল্টে দিল দ্য পিলগ্রিমস প্রোগ্রেস বইটি। একশো বছর পরে হলেও শেষ পর্যন্ত সাধারণ পাঠকশ্রেণীর মতামতকে মূল্য দিতে হল শিক্ষিত মহলকে। বিক্রির ইতিহাসের মতোই সাহিত্যের ইতিহাসে স্থান পাবার বিষয়েও রীতিমত চমকপ্রদ ইতিহাস সৃষ্টি করে যথাযোগ্য মর্যাদা আদায় করে নিল দ্য পিলগ্রিমস প্রোগ্রেস। সাহিত্যের ইতিহাসে এ এক নজিরবিহীন ঘটনা।

লেখক জন বানিয়ানের অন্যান্য গ্রন্থ

তাঁর অন্যান্য গ্রন্থগুলোও কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। এই প্রসঙ্গে নাম করা যায় দ্য লাইফ অ্যান্ড ডেথ অব মিঃ ব্যাডম্যান এবং দ্য হোলি ওয়ার-এর। দ্য পিলগ্রিমস প্রোগ্রেসের দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশিত হল ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দে। এই পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থটি দ্বিতীয় বাইবেল রূপে খ্যাতি লাভ করে। ধর্মপ্রচারের ব্যস্ততার মধ্যেও অত্যন্ত দ্রুত লিখতে পারতেন বানিয়ান। এই লেখার কাজ তাঁর অব্যাহত ছিল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।

বাইবেলের বাণী প্রচারে রত জন বানিয়ান

জনগণের মনে ধর্মীয় চেতনা জাগাবার উদ্দেশ্যে বাইবেলের বাণী প্রচার করেই জীবন অতিবাহিত করেছেন বানিয়ান। লন্ডনের সাউথ ওয়ার্কের গির্জায় গিয়ে প্রায়ই তিনি বক্তৃতা দিতেন। তাঁর ভাষণ শুনবার জন্য শত শত ধর্মপ্রাণ মানুষ সেখানে জড়ো হতেন। একবার এক শীতের ভোরবেলায় প্রচন্ড ঠান্ডার মধোও বারশো লোক নিবিষ্টভাবে তাঁর ধর্মীয় ভাষণ শুনেছিলেন।

প্রচারক জন বানিয়ানের সম্মান ও খ্যাতি লাভ

জীবনের শেষ পর্বে পৌঁছে সম্মান খ্যাতি সবই লাভ করেছেন বানিয়ান। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি লন্ডনের লর্ড মেয়রের সহকারী পদ লাভ করেছিলেন। সারাজীবন কঠোর দুঃখ কষ্টের মধ্যে কাটাবার পর এই সুখ সম্মান যেন ঈশ্বরের দেওয়া পুরস্কার।

জন বানিয়ানের মৃত্যু

কিন্তু তাঁর জীবনের মেয়াদও ফুরিয়ে এসেছিল। ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে এক পরিবারে পিতা-পুত্রের পুনর্মিলন ঘটাবার জন্য তাঁকে লন্ডন থেকে রিডিং যেতে হয়েছিল। সেদিন প্রচন্ড বৃষ্টি মাথায় করেই কর্তব্য পালন করে এসেছিলেন। কিন্তু ফিরে এসে জ্বরে পড়লেন। ৩১শে আগস্ট প্রিয় বন্ধু জন স্টাডউইকের স্নো হিলের বাড়িতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

উপসংহার :- দেবপ্রতিম এই মানুষটির যথোপযুক্ত মূল্যায়ন করেছেন পরবর্তীকালের মানুষ। মানুষের ইতিহাসে পিলপ্রিমস প্রোগেস-এর লেখক বানিয়ান লাভ করেছেন অমরত্বের দুর্লভ সম্মান।

(FAQ) জন বানিয়ান সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১। জন বানিয়ান কে ছিলেন?

জন বানিয়ান ছিলেন ১৭শ শতাব্দীর একজন ইংরেজ খ্রিস্টীয় লেখক ও প্রচারক, যিনি The Pilgrim’s Progress এর লেখক হিসেবে বিখ্যাত।

২. The Pilgrim’s Progress বইটি কী সম্পর্কে?

The Pilgrim’s Progress হলো একটি খ্রিস্টীয় ধর্মীয় উপন্যাস, যা একটি ব্যক্তির আত্মিক যাত্রার প্রতীকী কাহিনী তুলে ধরে, যেখানে নায়ক পাপের জীবন থেকে মুক্তির দিকে যাত্রা করে।

৩. জন বানিয়ানকে কেন কারাবন্দি করা হয়েছিল?

জন বানিয়ানকে অবৈধ প্রচারকার্য এবং অনুমোদনহীন ধর্মীয় সমাবেশ পরিচালনার জন্য কারাবন্দি করা হয়েছিল, কারণ সে সময় ইংল্যান্ডে শুধুমাত্র সরকার-অনুমোদিত গির্জায় ধর্মীয় কার্যক্রম চালানোর অনুমতি ছিল।

৪. তাঁর সাহিত্যকর্ম কেন গুরুত্বপূর্ণ?

বানিয়ানের সাহিত্যকর্ম, বিশেষত The Pilgrim’s Progress, খ্রিস্টীয় বিশ্বাস ও আত্মিক যাত্রার প্রতীকী ব্যাখ্যা দিয়ে সাহিত্যে গভীর প্রভাব ফেলেছে এবং তা আজও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়।

৫. জন বানিয়ানের অন্য কোন উল্লেখযোগ্য রচনা কী?

তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য রচনা হলো Grace Abounding to the Chief of Sinners, যা তাঁর আত্মজীবনীমূলক রচনা এবং খ্রিস্টীয় বিশ্বাসে তাঁর আত্মিক পুনর্জাগরণের কাহিনী।

Leave a Comment