স্যার ফ্রান্সিস ম্যাকফারলন বার্নেট

বিশিষ্ট বিজ্ঞানী স্যার ফ্রান্সিস ম্যাকফারনল বার্নেট ছিলেন একজন বিশিষ্ট ব্রিটিশ চিকিৎসক এবং ভাইরাসবিদ। তিনি ১৯৬০ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন মশাবাহিত পীতজ্বরের ভাইরাস নিয়ে গবেষণার জন্য। বার্নেট ভাইরোলজিতে তার অবদানের জন্য পরিচিত এবং ভাইরাস কিভাবে বিবর্তিত হয় ও প্রভাব ফেলে সেই বিষয়ে গবেষণা করেছেন। তার কাজ জীববিজ্ঞান ও সংক্রামক রোগের গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

ফ্রান্সিস ম্যাকফারলন বার্নেট

ঐতিহাসিক চরিত্রস্যার ফ্রান্সিস ম্যাকফারলন বার্নেট
জন্ম৩ মার্চ, ১৮৯৯ খ্রি
দেশইংল্যান্ড
পেশাচিকিৎসক, ভাইরাসবিদ
বিশেষজ্ঞতাভাইরোলজি এবং সংক্রামক রোগ
গুরুত্বপূর্ণ কাজপীতজ্বর ভাইরাস গবেষণা
বিশেষ অবদানভাইরাস বিবর্তন ও সংক্রমণ প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার১৯৬০ সালে নোবেল পুরস্কার
মৃত্যু৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৫ খ্রি
স্যার ফ্রান্সিস ম্যাকফারলন বার্নেট

ভূমিকা :- মানব-বিজ্ঞানের অঙ্গনে নতুন অঙ্গীকার নিয়ে আবির্ভাব হয় জীববিজ্ঞানী স্যার ফ্রান্সিস ম্যাকফারলন বার্নেটের। স্যার ফ্রান্সিস ম্যাকফারনল বার্নেট একজন উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞানী ও গবেষক, যিনি তাঁর অবদানের জন্য বিশ্বজুড়ে পরিচিত। তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার এবং গবেষণার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। বিশেষত, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং ভ্যাকসিনের উন্নয়নে তাঁর কাজগুলো আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। তাঁর গবেষণাগুলো সংক্রামক রোগের বিস্তার রোধ এবং স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে। স্যার ফ্রান্সিসের অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননা প্রদান করা হয়।

ফ্রান্সিস বার্নেটের আবির্ভাব

  • (১) বিজ্ঞানী লিউয়েন হক নাম রেখেছিলেন অ্যানিমেল কিউল বা পুঁচকে জানোয়ার। বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধি সৃষ্টির মূলে থাকে তাদেরই কারসাজি। পরে এইসব ক্ষুদে জীবাণু ব্যাকটেরিয়ার কালচার থেকেই তৈরি হল এদের জব্দ করার মোক্ষম দাওয়াই ভ্যাক্সিন বা টিকা।
  • (২) এরপর থেকে বিজ্ঞানীদের ধারণা হয় সব জীবাণুই ব্যাকটেরিয়া। এভাবেই চলল উনিশ শতকের শেষ পাদে বিজ্ঞানী আইভানোস্কির নবতম আবিষ্কারের লগ্ন পর্যন্ত। আইভানোস্কি তামাকের পাতায় এক ধরনের জীবাণু আবিষ্কার করেন বা ব্যাকটেরিয়া থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এদের ধরন অনেকটা আঠালো তরলের মতো।
  • (৩) এইভাবেই চিকিৎসা বিজ্ঞানের আসরে ব্যাকটেরিয়ার পরে আবির্ভাব হল ভাইরাসের। আবিষ্কারক আইভানোস্কির নামেই জীবাণুটির নাম এখনো পর্যন্ত বহাল রয়েছে। যদিও ভাইরাস সম্পর্কে সাবেকি ধারণার আধুনিক কালে অনেকটাই বদল হয়েছে।
  • (৪) ক্ষুদে হলেও ব্যাকটেরিয়াকে সাধারণ অণুবীক্ষণের সাহায্যেই দৃষ্টিগোচর করা যায়। কিন্তু আলট্রা মাইক্রোস্কোপ বা শক্তিশালী অণুবীক্ষণ ছাড়া ভাইরাসকে দেখা সম্ভব হয় না। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে দুটি শ্রেণী আছে। তাদের একটি প্রাণীদেহের অনুকূলে কাজ করে। কিন্তু ভাইরাসের প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেল, ভাইরাস সম্পূর্ণ এক বিষ। এই ধরনের রোগ সৃষ্টির মূলে এদের ক্ষমতা ব্যাকটেরিয়ার চাইতেও বেশি।
  • (৫) স্বাভাবিক ভাবেই এই বিষ প্রাণীটিকে নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে শুরু হল ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে এক ব্রিটিশ বিজ্ঞানী, নাম টোয়াট, এক ধরনের ভাইরাসের সন্ধান পেলেন যারা ব্যাকটেরিয়া হন্তারক। দল বেঁধে ব্যাকটেরিয়ার পেটে বংশ বিস্তার করে তাদের মেরে ফেলে। এই ধরনের ভাইরাসের নাম দেওয়া হল ব্যাকটেরিয়া-ঘাতক বা ব্যাকটেরিওফাজ।
  • (৬) পরে এই প্রাণীদের স্বভাব প্রকৃতি বিষয়ে আরও বিস্তৃত আলোকপাত করেন এক ফরাসী বিজ্ঞানী দ্যে হেরেল, ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে। প্রাণী ভাইরাসের প্রথম সন্ধান জানান লোফলার নামে জীববিজ্ঞানী, ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে। এদের পাওয়া গেছে গরুর পায়ে ও মুখের ঘায়ে।
  • (৭) দু’বছর পরেই ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে ওয়াল্টার রীড নামে এক চিকিৎসাবিজ্ঞানী পীতজ্বরের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে ভাইরাসের সন্ধান পান। মানুষের রোগের উৎস রূপে ভাইরাসের সন্ধান সেই প্রথম পাওয়া যায়। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা এমন অসংখ্য ভাইরাসের সন্ধান পেয়েছেন। এরপরেই মানব-বিজ্ঞানের অঙ্গনে নতুন অঙ্গীকার নিয়ে আবির্ভাব হয় জীববিজ্ঞানী স্যার ফ্রান্সিস ম্যাকফারলন বার্নেটের।

ফ্রান্সিস বার্নেটের জন্ম

১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ৩রা সেপ্টেম্বর অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া রাজ্যের ট্রারালগন শহরে জন্ম হয় বার্নেটের।

স্যার ফ্রান্সিস বার্নেটের ছেলেবেলা

ছেলেবেলা থেকেই প্রখর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার পরিচয় তাঁর মধ্যে দেখা গেছে। তাঁর যাবতীয় কৌতূহল নিহীত ছিল প্রকৃতি রাজ্যের ছোট বড় নানান প্রাণীদের নিয়ে। ক্ষুদে গুবরেপোকা পেলে যেমন তিনি তাকে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতেন, নিবিষ্টভাবে লক্ষ্য করতেন প্রাণীটির চালচলন, হাবভাব স্বভাবপ্রকৃতি, তেমনি আকাশচারী বিচিত্র বর্ণের পাখিদের নিয়েও চলত তাঁর মুগ্ধ অনুসন্ধান।

ফ্রান্সিস বার্নেটের শিক্ষা

স্বভাবতঃই স্কুলজীবনে বরাবরই তিনি ছিলেন জীববিজ্ঞানের সেরা ছাত্র। ভবিষ্যতের প্রতিভাবান জীববিজ্ঞানীর লক্ষণ তখনই তাঁর মধ্যে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছিল। স্কুলে এবং কলেজে, শিক্ষক অধ্যাপকরা তাঁর প্রতিভায় বিস্মিত হয়েছেন। জীববিজ্ঞান থেকে চিকিৎসাবিজ্ঞান। কলেজের গন্ডি পার হয়ে বার্নেট মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্লাশে। মাত্র চব্বিশ বৎসর বয়সে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে ডাক্তারি পাশ করলেন বার্নেট।

প্যাথোলজিস্ট ফ্রান্সিস বার্নেট

এই সময়ে রয়াল মেলবোর্ন হাসপাতালে প্যাথোলজিস্টের একটি পদ খালি হয়েছিল। বার্নেট সেখানেই চাকরি নিলেন। এইভাবেই শুরু হল তাঁর কর্মজীবন। এই হাসপাতালে সেই সময় ভাইরাস নিয়ে চলছিল পরীক্ষা-নিরীক্ষা। গবেষণার ব্যবস্থাদিও ছিল চমৎকার। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই ভাইরাস সংক্রান্ত গবেষণায় রীতিমত অভিজ্ঞ হয়ে উঠলেন বার্নেট।

লন্ডনে ফ্রান্সিস বার্নেট

মেলবোর্ন হাসপাতালে প্যাথোলজিস্টের পদে তিন বছর কাজ করার পর তিনি চলে এলেন লন্ডনে। তখনকার লিস্টার বিশ্ববিদ্যালয় ছিল রোগ প্রতিরোধ গবেষণার শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে এখানেই বার্নেট স্বাধীনভাবে ভাইরাস সংক্রান্ত গবেষণা শুরু করলেন।

ফ্রান্সিস বার্নেটের ভাইরাস নিয়ে গবেষণা

দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জার্নাল ঘেঁটে ভাইরাস-বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিস্তারিত বিবরণের সঙ্গে পরিচিত হলেন বার্নেট। ফলে তাঁর সমস্ত মনোযোগ ভাইরাসেই কেন্দ্রীভূত হল। সিদ্ধান্ত নিলেন, ভাইরাস নিয়ে গবেষণাই হবে তাঁর জীবনের ধ্যানজ্ঞান।

অনুসন্ধিৎসু ফ্রান্সিস বার্নেট

ততদিনে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী টোয়ার্ট ব্যাকটেরিয়া-ঘাতক ব্যাকটেরিওফাজ-এর আবিষ্কার সম্পূর্ণ করেছেন। তার বিস্তারিত শুলুক-সন্ধানও পেয়ে গেছেন ফরাসী বিজ্ঞানী দ্যে হেরেল। বার্নেটের অনুসন্ধিৎসু মন আকৃষ্ট হল এই বিশেষ শ্রেণীর ভাইরাসটির প্রতি। তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত অনুসন্ধানের প্রস্তুতি নেন তিনি।

সচেতন ফ্রান্সিস বার্নেট

ইতিমধ্যে লিস্টারের কাজের মেয়াদ শেষ হল। বার্নেট ফিরে এলেন অস্ট্রেলিয়ায়। কিছুদিন আনাগোনা করলেন মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপরে যোগ দিলেন স্থানীয় চিকিৎসা গবেষণা কেন্দ্র ওয়াল্টার অ্যান্ড এলিজাবেথ হল ইনসটিটিউট অব মেডিকেল রিসার্চে। শুরু হল তাঁর ভাইরাস নিয়ে বিস্তৃত গবেষণা। ভাইরাস সম্পর্কে অনেক তথ্যই জীববিজ্ঞানীরা ততদিনে উদঘাটন করেছেন। জানা গেছে, ভাইরাস নানা ভয়াবহ রোগের উৎস। এসব রোগের অনেকগুলোই আবার সংক্রামক। কাজেই বার্নেট অত্যন্ত সতর্ক হয়েই কাজে নামলেন। কেননা, সামান্য অমনোযোগী হলেই হতে হবে ভাইরাসের শিকার।

সিটাকোসিস রোগ নিয়ে ফ্রান্সিস বার্নেটের গবেষণা

  • (১) প্রথমে তিনি কাজ শুরু করলেন সিটাকোসিস নামে একটি রোগ নিয়ে। ল্যাটিন শব্দ সিটাকাস, যার অর্থ টিয়া জাতীয় পাখি, তা থেকেই এসেছে সিটাকোসিস। অস্ট্রেলিয়ায় এই পাখি Love Bird নামে পরিচিত এবং সচরাচর দৃষ্ট। এদের মধ্যে এক ধরনের জ্বর দেখা যায়, যার আক্রমণে ঝাঁকে ঝাঁকে এদের মৃত্যু ঘটে। তাই রোগটির নাম হল সিটাকোসিস বা টিয়া-জ্বর।
  • (২) যে ভাইরাসের কারণে এই রোগের উৎপত্তি, মানুষের মধ্যে তাদের আক্রমণ ঘটলে ফল খুবই মারাত্মক হয়। এই ভাইরাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, শ্বাসযন্ত্রে সংক্রমণ। এই সংক্রামক ভাইরাস কেবল যে অস্ট্রেলিয়ার টিয়াদের মধ্যেই থাকে তা নয়। অন্যান্য পাখিদের দ্বারাও এরা বাহিত হয় এবং মানুষের দেহে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। ওর্নিথো অর্থাৎ পাখি দ্বারা বাহিত বলে সিটাকোসিসের অন্য নাম ওর্নিথোসিস।
  • (৩) এই ভাইরাস নিয়ে কাজ করে সিটাকোসিস রোগ প্রতিরোধের পথ বার করে ফেললেন বার্নেট। তাঁর এই আবিষ্কারের ফল হল সুদূরপ্রসারী। পরবর্তীকালে তাঁর পথ ও পদ্ধতি অনুসরণ করেই শিশু পক্ষাঘাত বা পোলিও মায়েলাইটিস ও হাপিজের রোগ জীবাণু আবিষ্কার ও পৃথক করা সম্ভব হয় এবং তা থেকেই হয় ভ্যাক্সিন আবিষ্কার।
  • (৪) বার্নেটের আবিষ্কারটি হল এই রকম। সিটাকোসিস ভাইরাসকে পৃথক করে তাজা মুরগির ভ্রূণে ইনজেকশন করে সেখানে তাদের বংশ বিস্তার ঘটানো হয়। কিছুদিন পরে দেখা যাবে মুরগির দেহে ফুটে উঠেছে টিয়া-জ্বরের লক্ষণ। এইভাবে মুরগির ভ্রূণে ভাইরাসটির কালচার তৈরি করার পর কিছু রাসায়নিক প্রয়োগ করলেই দেখা যাবে কালচারের ভাইরাস নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। পরবর্তী কাজ হল ওই ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করিয়ে অ্যান্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করা।
  • (৫) বার্নেটের এই গবেষণার পথ ধরেই পরবর্তীকালে ভাইরাসঘটিত বিভিন্ন ভয়ঙ্কর রোগের ভ্যাক্সিন বা টিকা আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে। এই গবেষণার সূত্রেই বিশ্বের বিজ্ঞানী মহলে বার্নেটের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়ে থাকে। ভাইরাস বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম পথপ্রদর্শক রূপে চিহ্নিত হন তিনি।

ফ্রান্সিস বার্নেটের গবেষণা প্রবন্ধ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন অন্তিম লগ্নে, ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে ডাঃ বার্নেট এলিজাবেথ হল ইনসটিটিউট অব মেডিকেল রিসার্চ-এর সর্বেসর্বা হলেন। নতুন এই দায়িত্ব লাভের তিন বছরের মাথায়ই বার্নেটের একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হলে জীবাণু বিজ্ঞানীদের মধ্যে সাড়া পড়ে যায়। তাঁর এই প্রবন্ধের বিষয় ছিল লাইসোমেনেসিস। মূল ল্যাটিন শব্দটি হল লাইসোজেনি। কোনও একটা ব্যাকটেরিয়ার জিনের গঠনে যখন ভাইরাসের আকস্মিক উৎপত্তি ঘটে অর্থাৎ ফাজ তৈরি হয়, তখন তা তার আশ্রয়দাত্রী ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে। এই জৈবরাসায়নিক ঘটনাকেই বলে লাইসোজেনেসিস। অর্থাৎ ব্যাকটেরিয়ার মধ্যেই তার নিজের ধ্বংসের বীজটিও লুকানো থাকে।

প্রো-ভাইরাস

ল্যাবরেটরিতে দেখা গেছে, ব্যাকটেরিয়ার ফালচারে ভাইরাসের আকস্মিক জন্ম ও বংশ বিস্তার ঘটতে থাকে। ব্যাকটেরিয়ার স্বাভাবিক জিনের গঠনের পরিবর্তন ঘটিয়েই কান্ডটি ঘটে। এই ঘটনাই হল প্রো-ভাইরাস। ভাইরাসের এই আকস্মিক আবির্ভাবই ব্যাকটেরিয়াদের নির্বংশ করে। বার্নেটের এই আবিষ্কার জীবাণু গবেষণায় এক নতুন পথ নির্দেশ করল।

ইনফ্লুয়েঞ্জা নিয়ে ফ্রান্সিস বার্নেটের গবেষণা

  • (১) এরপর বার্নেট তাঁর গবেষণার বিষয় করলেন ইনফ্লুয়েঞ্জা। সাধারণতঃ ইনফ্লুয়েঞ্জা বলতে আমরা সর্দি জ্বর মাথা ধরা ইত্যাদি উপসর্গের সপ্তাহখানেক ভোগান্তির অসুখ বলেই বুঝে থাকি। অথচ এই আপাতঃ সাধারণ রোগটিই বহুবার পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মারাত্মক মহামারি ডেকে এনেছিল। এই রোগের কবলে পড়ে সারা পৃথিবীর লোক মৃত্যুভয়ে আতঙ্কিত হয়েছিল ১৯১৮-১৯ খ্রিস্টাব্দে। তাই রোগটিকে নিতান্ত সাধারণ বলে মনে করা চলে না।
  • (২) বার্নেট তাই এই রোগের বিষয়ে নতুন করে আলোকপাত ঘটাবার উদ্দেশ্যে শুরু করলেন গভীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা। কিছুদিনের চেষ্টাতেই তিনি ইনফ্লুয়েঞ্জার ভাইরাসকে সনাক্ত করার কাজটি সম্পূর্ণ করে ফেললেন। প্রধানত তিন প্রকারের ভাইরাস থেকে ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগ মহামারীর আকার ধারণ করে থাকে। হুবহু এক রকমের দেখতে হলেও তিন রকম ভাইরাসের পার্থক্য বোঝা যায় তাদের কাজ থেকে।
  • (৩) বার্নেট লক্ষ্য করলেন এসব ভাইরাস রক্তে ঢোকার পরেই রক্ত জমাট বেঁধে ওঠে। এই ব্যাপারটিকে বলা হয় ব্লাড ক্লটিং। রক্ত জমাট বাঁধার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বার্নেট রক্তের মধ্যে খুঁজে পান এক ধরনের জৈব অনুঘটক বা এনজাইম। এই অনুঘটক ইনফ্লুয়েঞ্জার ভাইরাস ঘটিত আক্রমণকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা রাখে। এ এক অসাধারণ প্রাপ্তি।
  • (৪) নবলব্ধ এই এনজাইম নিয়ে ইনফ্লুয়েঞ্জা দমনের রাসায়নিক আবিষ্কারের কাজে আত্মনিয়োগ করলেন বার্নেট। সেইকালে ইনফ্লুয়েঞ্জার ভ্যাকসিন নিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এক মস্ত ধাঁধাঁয় পড়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা বুঝতে পারছিলেন না, কোনও এক ঋতুতে যে ভ্যাক্সিন ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রতিরোধ করতে সক্ষম, সেই একই ভ্যাক্সিন পরের ঋতুগুলোতে তাদের কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রতিরোধ করতে পারে না।

ফ্রান্সিস বার্নেটের দ্য ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস প্রবন্ধ

  • (১) বার্নেট কয়েক বছরের মধ্যেই এই রহস্য সম্পর্কে একটা ধারণা লাভ করলেন এবং তাঁর গবেষণালব্ধ অভিজ্ঞতা বাক্ত করলেন একটি প্রবন্ধে। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত এই গবেষণা নিবন্ধটির তিনি নাম দেন দ্য ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস। এই প্রবন্ধে তিনি জানান যে, কোনও এক ঋতুতে যে ভাইরাসের আক্রমণে শরীরে ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগ দেখা দেয়, ঋতুবদলের সঙ্গে সঙ্গে সেই ভাইরাসের সম্পূর্ণ চেহারা ও ধরন আমূল পাল্টে যায়।
  • (২) ফলে যে এন্টিবডি ভাইরাসটিকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা রাখতো, সেই এন্টিবডিই পরবর্তী ঋতুতে নতুন আকার প্রাপ্ত ভাইরাসকে আর ঠেকাতে অসমর্থ হয়। ফলে পরের ঋতুতে ভ্যাক্সিন নেওয়া সত্ত্বেও শরীরে ইনফ্লুয়েঞ্জার আক্রমণ ঘটে। বার্নেটের এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের ফলে ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রতিরোধের সমস্যাটির সমাধান আর অসম্ভব হয় না। বার্নেটও সেই সঙ্গে বিশ্ববিজ্ঞান ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হন মহাবিজ্ঞানী রূপে।

স্যার ফ্রান্সিস বার্নেটের প্রতি সম্মাননা

এরপরে সাধনার সাফলের স্বীকৃতি ও সম্মানের পালা। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে বার্নেট হলেন নাইট। পরের বছর তাঁকে সম্মান জানান হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য সংস্থার অ্যালবার্ট অ্যান্ড মেরি লাস্কার পুরস্কার দিয়ে। সর্বশ্রেষ্ঠ স্বীকৃতি এল আরও কয়েক বছর পরে। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে চিকিৎসাশাস্ত্র ও শারীরবিদ্যায় উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য বানের্ট পেলেন নোবেল পুরস্কার।

ফ্রান্সিস বার্নেটের অনাড়ম্বর জীবন

সম্মান ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েও বার্নেটের নিরলস সাধনা রইল আগের মতোই অব্যাহত, জীবনযাত্রায় ঘটল না কোনও রূপান্তর। আগাগোড়া অনাড়ম্বর জীবনেই অভ্যস্ত ছিলেন বিজ্ঞানতাপস বার্নেট। তাঁর পারিবারিক জীবনও ছিল সুখের। এক পুত্র দুই কন্যা ও স্ত্রীকে নিয়ে তাঁর ঘরোয়া জীবনে ছিল শান্তির পরিবেশ।

বাইরের জগত নিয়ে ফ্রান্সিস বার্নেটের চিন্তা ভাবনা

বিজ্ঞানের গবেষণা নিয়ে সদাব্যস্ত জীবন সত্ত্বেও বাইরের জগতের নানা বিষয় নিয়েও ভাবনা চিন্তা পড়াশুনা করতেন বার্নেট। তার পরিচয় পাওয়া যেত, যখন তিনি কোন সভাসমিতিতে বক্তৃতা দিতেন। তাঁর বলার ভঙ্গি ও ভাষা ছিল এমনই হৃদয়গ্রাহী যে শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর বক্তব্য শুনতো।

চিত্রকর ফ্রান্সিস বার্নেট

চিত্রশিল্পেও বার্নেটের হাত ছিল একজন দক্ষ চিত্রকরের মতো। কাজের অবকাশে খোলা প্রকৃতির কোলে বসে তিনি প্রকৃতির মনোরম শোভা নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলতেন ক্যানভাসে।

ফ্রান্সিস বার্নেটের গ্রন্থ

সারাজীবনের জীবণুগবেষণার অভিজ্ঞতা নিয়ে বার্নেট ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে একটি বই লেখেন। বইয়ের নাম সংক্রামক রোগের প্রাকৃতিক ইতিহাস। জীবাণু গবেষণার ক্ষেত্রে বার্নেটের এই বই এক নিশ্চিত দিগদর্শন স্বরূপ।

স্যার ফ্রান্সিস বার্নেটের শেষ জীবন

শেষজীবনে বার্নেট কাজ করে গেছেন স্ট্যাফাইলোকক্কাস নিয়ে। রিকেট ঘটিত ভাইরাস নিয়েও তাঁর কাজ উল্লেখের দাবি রাখে। বার্নেটের গবেষণার ফলাফল আগামী দিনের ভাইরাস বিজ্ঞানীদের সামনে আলোকবর্তিকার কাজ করছে।

ফ্রান্সিস বার্নেটের মৃত্যু

৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে প্রখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার ফ্রান্সিস ম্যাকফারনল বার্নেট পরলোক গমন করেন।

উপসংহার :- স্যার ফ্রান্সিস ম্যাকফারনল বার্নেট ছিলেন একাধিক ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী একজন বিজ্ঞানী, যার গবেষণা ভাইরোলজি এবং সংক্রামক রোগ নিয়ে আমাদের বোঝাপড়া গভীর করেছে। তার কাজ শুধুমাত্র ভাইরাসের গঠন এবং বিবর্তন সম্পর্কেই নয়, বরং এর সংক্রমণ প্রক্রিয়া এবং মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব নিয়েও আলো ফেলেছে। নোবেল পুরস্কার বিজয়ের মাধ্যমে তার বৈজ্ঞানিক কৃতিত্বের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, যা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে গবেষণার ভিত্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তার অবদান ভবিষ্যতের বিজ্ঞানীদের জন্য একটি দৃষ্টান্ত এবং প্রেরণার উৎস।

(FAQ) স্যার ফ্রান্সিস ম্যাকফারনল বার্নেট সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. স্যার ফ্রান্সিস বার্নেট কোন বিষয়ে নোবেল পুরস্কার পান?

তিনি ভাইরাসবিদ্যায় বিশেষ অবদানের জন্য, বিশেষ করে পীতজ্বর ভাইরাস নিয়ে গবেষণার কারণে, ১৯৬০ সালে নোবেল পুরস্কার পান।

২. স্যার ফ্রান্সিস বার্নেটের গবেষণার মূল বিষয় কী ছিল?

স্যার ফ্রান্সিস বার্নেটের গবেষণা মূলত ভাইরাসের বিবর্তন, সংক্রমণ প্রক্রিয়া, এবং মশাবাহিত ভাইরাস নিয়ে ছিল।

৩. স্যার ফ্রান্সিস বার্নেট কোন গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বের উপর কাজ করেছিলেন?

স্যার ফ্রান্সিস বার্নেট ভাইরাসের বিবর্তন এবং তার সংক্রমণ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন দিক নিয়ে কাজ করেছেন যা জীববিজ্ঞান ও সংক্রামক রোগের গবেষণায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এনে দেয়।

৪. স্যার ফ্রান্সিস বার্নেটের অবদান কীভাবে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে সাহায্য করেছে?

তার গবেষণা ভাইরাস এবং তাদের বিবর্তন সম্পর্কে গভীর জ্ঞান প্রদান করেছে, যা রোগ নিরাময় এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

Leave a Comment