জেবউন্নিসা

ভারতের মোঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের কন্যা জেবউন্নিসা প্রসঙ্গে জেবউন্নিসার জন্ম, জেবউন্নিসার মাতা, জেবউন্নিসার শৈশব, ঔরঙ্গজেবের অন্দরমহলে জেবউন্নিসার জীবন, জেবউন্নিসার ব্যক্তিগত জীবন, জেবউন্নিসার রাজনৈতিক জীবন ও জেবউন্নিসার মৃত্যু সম্পর্কে জানব।

ঔরঙ্গজেব কন্যা জেবউন্নিসা

ঐতিহাসিক চরিত্রজেবউন্নিসা
পরিচিতিঔরঙ্গজেব তনয়া
মাতাদিলরাস বানু
জন্মস্থানদৌলতাবাদ
খ্যাতিকবি ও পন্ডিত
পরিণতিবন্দীত্ব
জেবউন্নিসা

পিতা ঔরঙ্গজেব তখন দৌলতাবাদে। তার হারেমও আছে তার সঙ্গে। আছেন অন্ততমা প্রিয় মহিষী দিলরাস বানু। এখানেই জন্ম হল তার গর্ভে ঔরঙ্গজেবের সুখ্যাত কন্যা জেবউন্নিসার ৷ জন্মের পরই তিনি লালিতপালিত হতে লাগলেন এমন একজন অভিভাবিকার কাছে যিনি ছিলেন একজন বিদূষী মহিলা। হাফিজা মরিয়মের কাছে মানুষ হয়েছিলেন বলেই তার মধ্যে একটি কবিপ্রাণ বিদ্যালিপ্সু সত্তার আবির্ভাব ঘটেছিল।

মোগল হারেমের মেয়েদের সঙ্গে ঔরঙ্গজেবও লক্ষ্য করলেন এই ছোট্ট মেয়েটি কেমন করে তার অতি শৈশব থেকেই গভীর পাঠানুরাগ প্রকাশ করে চলেছিল। বিস্মিত হতেন সবাই ছোট্ট ফুটফুটে এই সম্রাট-কন্যার অভূতপুর্ব স্মরণশক্তি দেখে। প্রতিদিন হাফিজা মরিয়ম, কোন্‌ সেই ছোট বেলা থেকে, মুখস্থ করাতেন কোর্‌আনের প্রতিটি সূরা। তাই কৈশোরে পা দিতে না দিতেই জেবের কণ্ঠস্থ হয়ে-গিয়েছিল সমগ্র কোর্‌আন-শরীফ। একদিন তার পরীক্ষাও দিয়ে দিলেন তার শাহনশাহ সম্ৰাট পিতার কাছে। ঔরঙ্গজেব বিস্মিত, ঔরঙ্গজেব মুগ্ধ। বিস্মিত আনন্দে আর পরম স্নেহে কন্যাকে করলেন সানন্দ পুরস্কারে ভূষিত। হাতে তুলে দিলেন তিরিশ হাজার আশরফির মঞ্জুষা।

শুধু পাঠ নয়, লিখনশৈলীর সৌকর্যেও নিজেকে স্বয়ংশিক্ষিত করে তুলেছিলেন জেবউন্নিসা। ফার্সি স্বাক্ষরের তিনটি ছাঁদ – নস্তালিক, নসখ আর শিকাস্তা। তিনটি ছাঁদকেই তিনি আয়ত্ত করেছিলেন পরম যত্নে আর নিষ্ঠায়। তার মুক্তাক্ষর ছিল তার পিতার গর্বের বিষয়। আর ধর্মনিষ্ঠ পিতার কন্যা বলেই হয়তো কৈশোরেই জেবের মধ্যে প্রকাশিত হতে আরম্ভ করেছিল একটি ধর্মনিষ্ঠ সত্তা। সেজন্য কোরআন পাঠের সঙ্গে সঙ্গে আয়ত্ত করতে শুরু করেছিলেন আরবী ধর্মতত্বের সুগভীর পাঠ। এমন জ্ঞানস্পৃহা বাস্তবিকই সুদুর্লভ, বিশেষত হারেমে বন্দিনী কোনো ললনার কাছে – যার কাছে বিলাসিতার নিত্য প্রলোভন নিত্য হাতছানি দিয়ে চলেছে। এই ধর্মনিষ্ঠাই এই কন্যাটিকে ঔরঙ্গজেবের ঘনিষ্ঠ প্রিয়পাত্রী করে তুলেছিল।

কন্যার সঙ্গে ধর্মের আলোচনা করে এই পরমবিষয়ী, আপাতনিষ্ঠুর মানুষটি খুবই আনন্দ পেতেন, শান্তি পেতেন। একটি চিঠিতে ঔরঙ্গজেব প্রসঙ্গক্রমে লিখেছেন (ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদ) –

ভগবানকে বন্দনা করিয়া ও প্রেরিত পুরুষকে প্ৰণিপাত করিয়া (লিখিতেছি)। খোদার আশীর্বাদ তোমার উপর বর্ষিত হউক। পুণ্যমাস রমজান আসিয়াছে। পরমেশ্বর তোমার উপর উপহার স্বরূপ কর্তব্যের ভার অর্পণ করিয়াছেন। এই মাসে স্বর্গদ্বার উদ্ঘাটিত ও নরকদ্বার রুদ্ধ হয়, বিপ্লবকারী শয়তানেরা কারানিবদ্ধ থাকে। রমজানের ধর্ম নিয়মাদি প্রতিপালনের জন্য আমরা উভয়েই যেন ভগবানের আশীর্বাদ লাভ করিতে সমর্থ হই।

এই ধর্মপ্রাণতা জেবউন্নিসাকে ক্রমশ বিলাস যাপন থেকে বহুদূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে জ্ঞানরাজ্যে স্থায়ী ভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। জ্ঞানের অমরাবতীতে জেবের ছিল নিত্য বিচরণ। সেজন্য ক্রমাগত সংগ্রহ করে চলেছিলেন নানা ধৰ্মপুস্তক। ফলে গড়ে উঠেছিল একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার। নানা দুষ্প্রাপ্য ও দুরমূল্য পুথিতে গ্রন্থাগারটি মোগল আমলের শ্রেষ্ঠ পুস্তকাগারে পরিণত হয়েছিল। জেবউন্নিসার যেটি বড়ো গুণ ছিল তা হল নিজেই জ্ঞানের অমিয়া পান করে তিনি তুষ্ট থাকতেন না। যতক্ষণ পৰ্যন্ত না অপরের জ্ঞানতৃষ্ণ বর্ধিত ও নিবারিত না হয় ততক্ষণ যেন তার স্বস্তি ঘটত না।

কতো দুঃস্থ ও গুণী লেখক যে তার পোষকতা পেতেন তারও ইয়ত্ত ছিল না। পণ্ডিত ও গুণী মৌলবীদের জন্য তার দ্বার ছিল সদা-উন্মুক্ত। তারা জেবউন্নিসার জন্য় কখনও লিখে চলেছেন নতুন নতুন বই, কখনও বা নকল করে চলেছেন কোন দুষ্প্রাপ্য পুথি। এঁদের মধ্যে অনেকেই সে সময়ে খ্যাতির শিখরে উঠেছিলেন। যেমন, নাশির আলি, সায়াব, শামসোয়ালিউল্লা, বেরাজ প্রমুখরা। অবশ্য মোল্লা সফীউদ্দীন আর্দবেলীর খ্যাতির কাছে এঁরা নিস্প্রভ ছিলেন। আর্দবেলী থাকতেন কাশ্মীরে। তিনিই কোরানের আরবী মহাভাষ্য ফার্সিতে অনুবাদ করেন। শিষ্য়া জেবউন্নিসার প্রতি প্রবল স্নেহবশত এই অনুবাদ তিনি তার নামেই প্রচারিত করে নাম দেন ‘জেব-উৎ-তফাসির’। এমনি করে অনেকেই জেবের নামের সঙ্গে তাদের সৃষ্টিকে সংযুক্ত করে দিয়েছিলেন ৷ ফলে জেবউন্নিসার নামে বেশ কয়েকটি বই প্রচারিত থাকলেও তিনি সে সবের লেখিকা ছিলেন না। কিন্তু এ থেকে তাঁর গুণগ্রাহিতা এবং অধিকার দুই-ই নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়ে যায়।

জেবের এই গুণগ্রাহিতা কোনো রাজকীয় বিলাস ছিল না। ছিল অন্তরের মণিকোঠার সম্পদবিশেষ। সেই মণিকোঠায় বাস করতো একটি কবিমানসী। কোন্‌ দূর বাল্যকালেই কোরান শরীফের সূরা আবৃত্তি করে যার কান অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল ছন্দে – কৈশোর-যৌবনের সন্ধিক্ষণে সেই অন্তরেই বাজতে শুরু করেছিল বীণাপাণির সঙ্গীত বীণাটির ঝংকার ধ্বনি। বাইরের রূপের অজস্ৰ দীপমালার স্নিগ্ধ কমনীয় উজ্জলতার সঙ্গে মিতালী পাতিয়েছিল তার অন্তরতম সেই কবিমানসী।

খুব ছোট্ট থেকেই কবিতা পড়তে, ভাবতে আর লিখতে ভালবাসতেন জেবউন্নিসা, ঔরঙ্গজেবের এই দুহিতাটি। ঔরঙ্গজেব আদৌ পছন্দ করতেন না কবিদের। অথচ তার অন্দরমহলেই নিত্যই জন্ম নিচ্ছে কবিতা, জেবের কলম থেকে। ঔরঙ্গজেব যেন প্লেটো, কবিদের নিজ রাজ্য থেকে নির্বাসন দণ্ড দিয়েই যেন খুশী। অথচ অন্দরমহলের চার দেওয়ালের মধ্যে নিজেকে বন্দিনী আর সংগুপ্ত রেখে জেব রচনা করে চলেছেন কতশত মখফী।

যে সমস্ত কবি গুপ্তভাবে কবিতা লিখে তা ছদ্মভাবেই প্রচার করেন, তাদের ফার্সী ছদ্মনাম হল মখ্ফী। জেবউন্নিসার নামেও প্রচারিত আছে নানা মখ্‌ফীর সংকলন ‘দিওয়ান-ই-মখ্‌কী’। কবিতা রচনা করতে তিনি শিখেছিলেন তার শিক্ষক শাহরুস্তম গাজীর কাছে। তারপর থেকেই দীর্ঘদিন ধরে চলেছিল কাব্যচর্চার একনিষ্ঠ প্রেম। তাই প্রসাধন কলায় যৌবনেই দেখা দিয়েছিল একটা বিস্ময়কর অনাগ্রহ। মোগল হারেমে মেয়ে বৌরা সাজসজ্জা করে না, এ তো বড়ো একটা দেখা যায় না, শোনা যায় না। ভিতরের সৌন্দর্ধে মগ্ন জেবউন্নিসা সাজতে-গুজতে তেমন ভালই বাসতেন না। অবশ্য মাঝে মাঝে তাঁকে দেখা যেতো অন্যান্য অন্তঃপুরিকার সঙ্গে চৌপর খেলায় নিমগ্ন। কিন্ত তাদের মতো পোলো খেলায় আগ্রহ দেখান নি কখনও এই কোমলাঙ্গী যৌবনবতী।

মখফী কবিতা তো লিখতেন আকবর-এর পত্নী স্বয়ং সলীমা সুলতান বেগম, লিখতেন নূরজাহানও। কিন্তু জেবের মখ্‌ফীতে বেদনার যে সুর-মূর্ছনা তা অন্যত্র দুৰ্লভ। জেবউন্নিসার মৃত্যুর পঁয়ত্রিশ বছর পর যখন তার ছদ্মনামা কবিতাগুলি সংগৃহীত হল, তখন তার হৃদয়ের গোপনতম কাহিনীগুলি যেন আমরা কবিতায় মুখরিত হতে দেখলাম। সেলিমগড়ের দুর্গে বন্দিনী জেবউন্নিসা একটি কবিতায় লিখেছেন –

‘কঠিন নিগড়ে বদ্ধ, যতদিন চরণযুগল, বন্ধু সবে বৈরী তোর, আর পর আত্বীয়-সকল। সুনাম রাখিতে তুই করীবি কি, সব হবে মিছে, অপমান করিবারে বন্ধু যে গো ফেরে পিছে পিছে। এ বিষাদ-কারা হতে মুক্তি-তরে বৃথা চেষ্টা তোর, ওরে মখফী, রাজচক্ৰ নিদারুণ, বিরূপ কঠোর ; জেনে রাখ বন্দী তুই, শেষ দিন না আসিলে আর, নাই নাই, আশা নাই, খুলিবে না লৌহ-কারাগার। নিগড় নিবদ্ধ পদে কী সুদীর্ঘ একাল যাপন সখা যত, শত্ৰু আজি – আগন্তক আত্মপরিজন।’

– কি হয়েছিল, তাই জেবউন্নিসার এতো দুঃখ, এতো বিলাপ, এতো বেদনামথিত হতাশ্বাস ! সেও এক ভালোবাসার ইতিহাস।

ঔরঙ্গজেবের এক পুত্র মহম্মদ আকবর, জেবউন্নিসার ছোট ভাই, গর্ভধারিণী দিলরাস বানুর কনিষ্ঠ সন্তান। খুব ভালবাসতেন জেব তার থেকে উনিশ বছরের ছোট এই ভাইটিকে। মনের যা কিছু কথা, সংবাদ, প্রার্থনা অসংকোচে নিবেদন করতেন এই সহোদরটিকে। দুজনের প্রতি দুজনের অগাধ বিশ্বাস। শতেক চিঠিতে ধরা আছে এই ভাইবোনের স্নেহভালবাসার শতেক অভিজ্ঞান।

এই আকবরই একবার বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন পিতা ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে। মোগল ইতিহাসে এ কোনো নতুন কথা নয়। নতুন কথা নয় পিতার কঠিন হাতে পুত্রের গভীরতম শাস্তির সংবাদও। তাই নিষ্ঠুর ঔরঙ্গজেব – তিন তিনটি ভাই আর পিতা এমনকি কনিষ্ঠা ভগিনীও যার হৃদয়হীনতার নিষ্ঠুর শিকার, এবার পুত্র আকবরও সেই নিষ্ঠুরতার
শিকার হলেন।

খবর পেয়ে সসৈন্যে পুত্রের পশ্চাদ্‌ধাবন করলেন ঔরঙ্গজেব। ১৬৮১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জানুয়ারী। ঔরঙ্গজেবের সৈন্যরা দখল করে নিল আকবরের পরিত্যক্ত শিবির। সেখানে পাওয়া গেল ভাই আকবরকে লেখা দিদি
জেবউন্নিসার বেশ কয়েকখানি চিঠি। ও হো, তার অন্দরমহল (ঔরঙ্গজেবের অন্দরমহল) থেকে তারই কন্যা তারই পুত্রকে জোগাচ্ছে পিতৃদ্রোহের ইন্ধন ! সরষের মধ্যেই তাহলে ভূত ! ঔরঙ্গজেবের স্বভাবের মধ্যে অন্য কি ঔদার্য ছিল জানি না, তবে ‘ক্ষমা’ শব্দটিকে যেন তার ব্যক্তিগত অভিধান থেকে তিনি বাদ দিয়েছিলেন।

অতএব কন্যার প্রতি প্রবল বিরাগে তাকে চরম শাস্তি দিতে এগিয়ে এলেন ভারত-এর তৎকালীন ভাগ্যবিধাতা শাহনশাহ ঔরঙ্গজেব পাদশাহ। কন্যার যাবতীয় সম্পত্তি রাজসরকারে বাজেয়াপ্ত বলে ঘোষণা করা হল। সম্পত্তির মূল্যও তো কম ছিল না – ৬৩ মোহর – ৫৬৬৮৬৬ টাকা – পাঁচ লাখেরও বেশি। এসব অর্থ দিয়েই জেবউন্নিসা কতো বিধবাকে দিয়েছেন আশ্রয়, কতো আতুরকে করেছেন অন্নদান, কতো দুখীর জীবনে ফুটিয়েছেন প্রত্যাশার আনন্দময় পুষ্প। সব বাজেয়াপ্ত হল ৷ সেই সঙ্গে বন্ধ হল বার্ষিক চার লক্ষ টাকার বৃত্তি। আর তার পরেই উন্মুক্ত হয়ে চিরতরে বন্ধ হল দিল্লীর সলীমগড়ের লৌহকারাগারের ভারী দরজার পাল্লা দুটো।

বাইশটি বছরের দুঃসহ নিঃসঙ্গতার মধ্যে জেবউন্নিসার যৌবন, প্রৌড়ত্ব অতিক্রান্ত হল। কারাগারেই উদ্‌যাপিত হল বাণপ্রস্থের ব্রত। তারপর ৭ দিন একটানা রোগভোগ ৷ তারপর ‘নাই নাই আশা নাই, খুলিবে না লৌহ-কারাগার’ বলে যে আক্ষেপ ক্রমাগত করে চলেছিলেন বন্দিনী জেবউন্নিসা তারও একদিন অবসান হল।

মোঘল সম্রাটের অন্দরমহল-এ কতো বিচিত্র ঘটনাই না ঘটে যায়; ঘটে গিয়েছিলও। ঐ কারাগারের দরজাও একদিন খুলে গেল। সেদিনটা ছিল ২৬ মে ১৭০২ খ্রিষ্টাব্দ জেবউন্নিসা তখন সবে চৌষট্টি অতিক্রম করেছেন ৷ মৃত্যু এসে ঐ ভারী পাল্লার দুর্গ-দরজা খুলে দিয়ে জেবউন্নিসার চিরমুক্তি ঘটাল। তারপরেও অন্দরমহলে বহির্মহলে ঘটনা ঘটে। অন্ত্যেষ্ঠিক্ৰিয়া হল। দানখয়রাতি হল। জাহানারার দেওয়া ‘ত্রিশ হাজারী’ উদ্যানে তাকে সমাধিস্থ করা হল। তাও আজ আর নেই ৷

অথচ এমনিভাবে লোকচক্ষুর অন্তরালে একটা কবি জীবন শেষ হয়ে যাবে – এ তো প্রার্থনার বিষয় ছিল না। তারও অন্তরে প্রেম ছিল, ছিল আর পাঁচটি বিবাহিত নারীর মতো বেঁচে থাকার, সংসার রচনার স্বপ্ন। কিছুই হল না। দারাশুকোর পুত্র সোলেমানশুকোর বাগদত্তা হয়েও নীড় রচনার স্বপ্ন তার সার্থক হয় নি। কাফের দারার ছেলের সঙ্গে ধর্মিষ্ঠ ঔরঙ্গজেবের কন্যার বিবাহ পিতার প্রবল আপত্তির কারণে সম্ভব হয় নি।

তা যদি নাই বা হল ইরানের দ্বিতীয় শাহ আব্বাসের পুত্র মির্জা ফারুখের সঙ্গে কেন বিবাহ হল না তার ! সে তো ভালবাসতেই চেয়েছিল জেবকে। না, জেবের আত্মসন্মান, আত্মমর্যাদা ফারুকের প্রেমকে অবহেলা দেখিয়েছিল। মিৰ্জা ফারুক চেয়েছিলেন জেবউন্নিসার কাছে ‘মিষ্টান্ন অর্থাৎ চুম্বন। জেবউন্নিসা বুঝেও তাকে বলেছিলেন, ‘মিষ্টান’ পাকশালায় সন্ধান করতে। এও তো জেবের কম অহঙ্কারের কথা নয়। যে নারী স্বাধীনভাবে বিচরণের স্বাধীনতা পেয়েছিল, সে কেন এমনভাবে ভালবাসার অমৰ্যাদা করল ? তবে কি জ্যাঠা দারাশুকোর স্নেহপ্রেমে মুগ্ধা জেব তার জীবনে ঐ সোলেমানকে ছাড়া আর কাউকে ভাবতে পারেন নি। হয়তো তাই। তাতেই বুঝি শিবাজিকেও তিনি গ্রহণ করতে পারেন নি। হয়তো ধর্মনিষ্ঠার কারণেও তিনি দূরবর্তিনী হয়েছিলেন।

অথচ মোগল অন্দরমহলে অন্য একটি বিষয়ের অবাধ যাতায়াত ছিল। তা হল মিথ্যা কলঙ্কের। অবশ্য যেখানেই যত বন্ধন, সেখানেই ঘটে তত শিথিলতার প্ৰশ্ৰয়। তাই বুঝি জেবউন্নিসার পবিত্র হৃদয়ের চারপাশে অকারণ কলঙ্কের কালিমা তার প্রেম সুরভিত জীবনটিকে কালিতে কলঙ্ক লিপ্ত করতে চেয়েছিল। কিংবদন্তি বলে ঔরঙ্গজেব তখন দারুণ অসুস্থ। সেই সুযোগে স্বাধীনা জেব তাঁর উজীর পুত্র আকিল খাঁর প্রেমে মগ্ন হন। অসামান্য রূপবান এবং অসীম বীরত্বপূর্ণ আকিল খাঁ একদা যখন সকালে প্রাসাদ শিখরে জেবউন্নিসাকে দেখে লিখলেন এ যেন ‘প্রাসাদ শিরে রক্তিম স্বপ্নপ্রতিমার প্রকাশ’। জেব জানালেন কবিতায় ‘জোর জবরদস্তি বা স্বর্ণমুদ্রা কিছুর দ্বারাই এই প্রতিমা লভ্য হবার নয়’। শেষে আকিল খাঁ অন্দরে প্রবেশ করল এক রাজমজুরের বেশে। তখনও না। শেষে উভয়ে পরস্পরের সন্নিকটে এলেন। ঔরঙ্গজেব সুস্থ হয়ে সব শুনলেন। তারপর স্বয়ংবরা কন্যার মনের ইচ্ছা জানতে পেরে একদিন গরম জল ঢেলে আকিল খাঁকে মেরে ফেললেন। এ জন্যই কি জেবউন্নিসা কবিতা লিখেছিলেন ‘জগতের শ্রেষ্ঠ তৃপ্তি হল আত্মবলিদান ?’ কিছুই জানি না।

অথবা কারাগারে লৌহবেষ্টনীতে বসে যখন তিনি মখফী লেখেন ‘শেষ আশা’ –

‘পারি না সহিতে আমি আর তোমার বিচ্ছেদ আর তিক্ত এই মর্মগ্লানিভার ; নিপীড়িতা আমি প্রভু, মুক্ত কর আমার আত্মায়; ক্লান্ত, ক্ষিন্ন, ভগ্নবুকে মগ্ন আমি, হের, হতাশায় !’

তখন কি বুঝতে পারি কার উদ্দেশ্যে তিনি এই কবিতা রচনা করেছেন – সোলেমান না আকিল খাঁ? অথবা যার প্রতি প্রেম ধাবিত হলে আর কাউকে ভালবাসার প্রয়োজন হয় না – সেই ঈশ্বরকে ?

(FAQ) জেবউন্নিসা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য

১। জেবউন্নিসা কে ছিলেন?

ভারতের মোঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের কন্যা।

২। জেবউন্নিসার জন্ম কোথায় হয়?

দৌলতাবাদে

৩। জেবউন্নিসার গর্ভধারিণী মায়ের নাম কী?

দিলরাস বানু।

৪। জেবউন্নিসা কী করনে বিখ্যাত?

বিদুষী নারী ও কবি হিসেবে।

৫। জেবউন্নিসাকে অন্দরমহলে বন্দী করেন কে?

পিতা ঔরঙ্গজেব।

Leave a Comment