ইয়াল্টা সম্মেলন

১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়ার ইয়াল্টা প্রদেশে অনুষ্ঠিত ইয়াল্টা সম্মেলন প্রসঙ্গে আলোচ্য বিষয়, ইয়াল্টা চুক্তি, আন্তর্জাতিক সংস্থা, জাতিপুঞ্জ গঠন, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ, জার্মানি সম্পর্কে প্রস্তাব, পোল্যান্ড সম্পর্কে প্রস্তাব, দূর প্রাচ্য সম্পর্কিত গোপন শর্ত ও সম্মেলনের গুরুত্ব সম্পর্কে জানবো।

রাশিয়ার ইয়াল্টা প্রদেশে অনুষ্ঠিত ইয়াল্টা সম্মেলন

ঐতিহাসিক ঘটনাইয়াল্টা সম্মেলন
সময়কালফেব্রুয়ারি, ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ
স্থানইয়াল্টা প্রদেশ
প্রধান ব্যক্তিত্বরুজভেল্ট, চার্চিল ও স্ট্যালিন
উদ্দেশ্যবিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা
ইয়াল্টা সম্মেলন

ভূমিকা:- ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে জার্মানির পরাজয় যখন সুনিশ্চিত তখন মিত্রপক্ষের তিন রাষ্ট্রপ্রধান – রুজভেল্ট, চার্চিল ও স্ট্যালিন রাশিয়ায় কৃষ্ণসাগরের তীরে ক্রিমিয়ার ইয়াল্টা প্রদেশে এক বৈঠকে মিলিত হন।

ইয়াল্টা সম্মেলনের আলোচ্য বিষয়

এই বৈঠকে মূলত তিনটি বিষয় প্রাধান্য পায়। সেগুলি হল –

  • (১) বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করা,
  • (২) জার্মানির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা এবং
  • (৩) পোল্যান্ড -এর ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত প্রশ্নের সমাধান করা।

ইয়াল্টা চুক্তি কি

এইসব বিষয় সম্পর্কে আলোচনার শেষে নেতৃবৃন্দ একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন, যা ইয়াল্টা চুক্তি নামে খ্যাত।

ইয়াল্টা সম্মেলনে আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ

আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের উদ্দেশ্যে এই সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা (সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ) প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

ইয়াল্টা সম্মেলনে জাতিপুঞ্জ গঠনের প্রস্তাব

আন্তর্জাতিক সংস্থা তথা সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ গঠনের ক্ষেত্রে স্থির হয় যে, 

  • (১) প্রস্তাবিত জাতিপুঞ্জের সনদ তৈরির জন্য ২৫শে এপ্রিল সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ আমেরিকার সানফ্রান্সিসকো শহরে একটি সম্মেলন আহুত হবে এবং গঠনের প্রস্তাব অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সব রাষ্ট্রকেই তাতে আমন্ত্রণ জানানো হবে।
  • (২) ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত রাশিয়া ও চীন -এই পাঁচটি রাষ্ট্র ‘নিরাপত্তা পরিষদ’-এর স্থায়ী সদস্যপদ লাভ করবে এবং এদের প্রত্যেকের ‘ভেটো’ প্রয়োগের অধিকার থাকবে।
  • (৩) আসন্ন জাতিপুঞ্জের সম্মেলনের আগেই নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য অছি রাষ্ট্রগুলি সম্পর্কে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা সম্পন্ন করবে।

ইয়াল্টা সম্মেলনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ

বলা বাহুল্য, রাষ্ট্রসঙ্ঘ বা সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ গঠনের পথে ইয়াল্টা সম্মেলন একটি অতি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।

ইয়াল্টা সম্মেলনে জার্মানি সম্পর্কিত প্রস্তাব

জার্মানির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এই বৈঠকে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। যেমন –

  • (১) জার্মানি থেকে নাৎসি প্রভাব সম্পূর্ণভাবে দূর করা হবে। জার্মান জনগণের উপর কোনোরকম প্রতিশোধ গ্রহণ করা হবে না, তবে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দেওয়া হবে।
  • (২) জার্মানিকে ইংল্যান্ড, রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে তিনভাগে বিভক্ত করা হয়।
  • (৩) স্থির হয় যে, ইংল্যান্ড ও আমেরিকার জার্মানি-সম্পর্কিত অধীনস্থ এলাকা থেকে একটি পৃথক অংশ তৈরি করে তা ফ্রান্সকে দেওয়া হবে।
  • (৪) এই চার শক্তির অধিকৃত চারটি অংশে একই ধরনের আইন-কানুন ও শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হবে।
  • (৫) রাজধানী বার্লিনের শাসনভার থাকবে এই চারটি শক্তি নিয়ে গঠিত একটি ‘যৌথ নিয়ন্ত্রণ পরিষদ’ (Allied Control Council)-এর হাতে।
  • (৬) জার্মানিতে উদারনৈতিক সংস্কার প্রবর্তিত হবে।
  • (৭) জার্মান অর্থনীতির উপর মিত্রপক্ষের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে।
  • (৮) জার্মানিকে ক্ষতিপূরণ দানে বাধ্য করা হবে এবং এই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে সামগ্রীর মাধ্যমে। মস্কোতে অনুষ্ঠিত ক্ষতিপূরণ কমিশনের বৈঠকে ক্ষতিপুরণের পরিমাণ নির্ধারিত হবে।

ইয়াল্টা সম্মেলনে পোল্যান্ড-সম্পর্কিত প্রস্তাব

পোল্যান্ড সম্পর্কে এই সম্মেলনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। যেমন –

  • (১) জার্মানির পতনের পর স্বাধীন পোল্যান্ড রাজ্য গঠন করা হবে।
  • (২) পোল্যান্ডের পূর্ব সীমানা কার্জন লাইন বরাবর স্থির করা হয়। এর ফলে পোল্যান্ডের প্রায় ৪৭% এলাকা রাশিয়ার হাতে চলে যায়।
  • (৩) এর ক্ষতিপূরণ হিসেবে জার্মানির বেশ কিছু অংশ পোল্যান্ডকে দেওয়া হবে।
  • (৪) জার্মানি পোল্যান্ড দখল করলে পোল সরকার লন্ডনে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল।
  • (৫) স্থির হয় যে, লন্ডনে অবস্থিত পোল সরকার ও পোল্যান্ডে কর্মরত পোল সরকারের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি অস্থায়ী পোল সরকার গঠিত হবে এবং এই অস্থায়ী সরকারের তত্ত্বাবধানে সর্বসাধারণের গোপন ভোটে সাধারণ নির্বাচনের পর পোল্যান্ডে একটি স্থায়ী সরকার গঠিত হবে।

ইয়াল্টা সম্মেলনে দূরপ্রাচ্য-সম্পর্কিত গোপন শর্ত

এক গোপন চুক্তির মাধ্যমে সুদূর প্রাচ্যে রাশিয়ার বিশেষ স্বার্থ স্বীকার করে নেওয়া হয়। স্থির হয় যে, জার্মানির পতনের পর রাশিয়া মিত্রশক্তির পক্ষে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে। এর বিনিময়ে

  • (১) রাশিয়া শাখালিন বন্দর ও তৎসংলগ্ন দ্বীপপুঞ্জ, কিউরাইল দ্বীপপুঞ্জ ও পোর্ট আর্থার পাবে।
  • (২) বহির্মঙ্গোলিয়ায় রুশ প্রাধান্য স্বীকৃত হবে এবং রাশিয়া মাঞ্চুরিয়ায় চিনের সার্বভৌমত্ব মেনে নেবে ও সেখানে রাশিয়ার বিশেষ স্বার্থ স্বীকৃত হবে।

ইয়াল্টা সম্মেলনের গুরুত্ব

মিত্রপক্ষের যুদ্ধকালীন সম্মেলনগুলির মধ্যে ইয়াল্টা সম্মেলন অতি গুরুত্বপূর্ণ। এই সম্মেলনের সিদ্ধান্তগুলি পরবর্তীকালের আস্তর্জাতিক সম্পর্ককে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। যেমন –

  • (১) ইয়াল্টা সম্মেলন থেকে ফিরে এসে মার্কিন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট ঘোষণা করেন, “ক্রিমিয়ার সম্মেলন থেকে আমরা শাস্তিস্থাপনের পথে শুভযাত্রা শুরু করেছি।”
  • (২) বস্তুত এই সম্মেলনেই সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ গঠনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং এর সাংগঠনিক নানা বিষয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যুদ্ধোত্তর বিশ্বে আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় এই প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
  • (৩) মার্কিন ঐতিহাসিক রবার্ট শেরউড বলেন, “জার্মানি ও জাপান -এর পরাজয়ের ফলে যে সব সমস্যা দেখা দেয়, তার অধিকাংশই ইয়াল্টা চুক্তির ফল।”
  • (৪) জার্মানির পরাজয়ের পর চারটি অংশে জার্মানির বিভাজন এবং এর মধ্যে একটি অংশে সোভিয়েত রাশিয়ার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ফলে রাশিয়া মধ্য ইউরোপ -এ সর্বপ্রথম রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সুযোগ পায়।

উপসংহার:- ইয়াল্টা সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুসারে রাশিয়া সুদূর প্রাচ্যে প্রতিপত্তি বৃদ্ধির সুযোগ পায় এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হয়।

(FAQ) ইয়াল্টা সম্মেলন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কখন কোথায় ইয়াল্টা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়?

১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়ার ইয়াল্টা প্রদেশে।

২. ইয়াল্টা সম্মেলনে প্রধান ব্যক্তিত্ব কারা ছিলেন?

রুজভেল্ট, চার্চিল ও স্ট্যালিন।

৩. ইয়াল্টা সম্মেলনের উদ্দেশ্য কি ছিল?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ -উত্তর কালে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রতিষ্ঠা।

Leave a Comment