পশ্চিমবঙ্গ

আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ প্রসঙ্গে নামকরণ, অবস্থান, সীমা, আয়তন ও জনসংখ্যা, রাজধানী, প্রধান জাতি, বাংলার নবজাগরণ, বঙ্গভঙ্গ, সরকার ব্যবস্থা, অর্থনীতি, প্রশাসনিক অঞ্চল, সাহিত্য, ভাষা, ধর্ম, উৎসব সম্পর্কে জানবো।

ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গ প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের নামকরণ, পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান , পশ্চিমবঙ্গের সীমা, পশ্চিমবঙ্গের আয়তন ও জনসংখ্যা, পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী, পশ্চিমবঙ্গের প্রধান জাতি, প্রাচীন বাংলা, মগধ সাম্রাজ্য, রাজা শশাঙ্ক, বাংলাদেশে মাৎস্যন্যায়, বাংলায় পাল ও সেন রাজত্ব, বাংলায় ইসলামের প্রসার, মোঘল আমলে বাংলা, বাংলায় কোম্পানির আধিপত্য, বাংলায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, বাংলার নবজাগরণ, বাংলায় মহাবিদ্রোহ, বঙ্গভঙ্গ, স্বাধীনতা আন্দোলনের কেন্দ্র বাংলা, বাংলার স্বাধীনতা সংগ্ৰামী সুভাষচন্দ্র বসু, দ্বিখণ্ডিত বাংলা, পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘমেয়াদি কমিউনিস্ট সরকার, পশ্চিমবঙ্গের সরকার ব্যবস্থা, পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি, পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনিক অঞ্চল, পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ু, পশ্চিমবঙ্গের জীবজগৎ, পশ্চিমবঙ্গের ধর্ম, পশ্চিমবঙ্গের খেলাধুলা, পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য, বাংলা চলচ্চিত্র, পশ্চিমবঙ্গের উৎসব, পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন কেন্দ্র, পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যপাল।

অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গ

ঐতিহাসিক স্থানপশ্চিমবঙ্গ
রাজধানীকলকাতা
প্রধান ভাষাবাংলা
বৃহত্তম উৎসবদুর্গাপূজা
রাজ্যপালসিভি আনন্দ বোস
মুখ্যমন্ত্রীমমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
পশ্চিমবঙ্গ

ভূমিকা :- পূর্ব ভারত -এ বঙ্গোপসাগরের উত্তর দিকে বাংলাদেশ -এর সীমান্তে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গ ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য। আমাদের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রাচীন কালে বঙ্গ প্রদেশের অন্তর্গত ছিল।

পশ্চিমবঙ্গের নামকরণ

  • (১) ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসিত ভারতের বাংলা প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চল স্বাধীন ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত হলে এই রাজ্যের নামকরণ পশ্চিমবঙ্গ করা হয়েছিল। ইংরেজিতে West Bengal (ওয়েস্ট বেঙ্গল) নামটিই সরকারিভাবে প্রচলিত। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার রাজ্যের ইংরেজি নামটি পালটে Paschimbanga রাখার প্রস্তাব দেয়।
  • (২) ২০১৬ সালের আগস্টে পশ্চিমবঙ্গের নাম বদলে নতুন নাম রাখার প্রস্তাব করা হয় বাংলা, ইংরেজিতে বেঙ্গল আর হিন্দিতে বঙ্গাল। রাজ্য বিধানসভায় নাম পরিবর্তনের এই প্রস্তাব বিপুল ভোটের ব্যবধানে পাস হয়। পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তন নিয়ে রাজ্য মন্ত্রিসভায় ২ আগস্ট ২০১৬ তারিখে দুটি প্রস্তাব গৃহীত হয়- বাংলা অথবা বঙ্গ।
  • (৩) ভারত সরকার তিনটির পরিবর্তে একটি মাত্র নাম নির্ধারণের পক্ষে পরামর্শ প্রদান করে। এই পরামর্শ অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় ২০১৮ সালের ২৬ জুলাই ‘বাংলা’ নামটিই সর্বসম্মতভাবে পাশ হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং বিধানসভার অধিবেশনে রাজ্যের নাম বদলের প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে নামবদলের প্রস্তাব রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকর হবে।

পশ্চিমবঙ্গ নামের পূর্বে বঙ্গ অঞ্চল

বঙ্গ বা বাংলা নামের সঠিক উৎস অজ্ঞাত। একটি মত অনুসারে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দে এই অঞ্চলে বসবাসকারী দ্রাবিড় উপজাতির ভাষা থেকে এই নাম এসেছে। সংস্কৃত সাহিত্যে বঙ্গ নামটি অনেক জায়গাতেই পাওয়া যায়। কিন্তু এই অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায় নি।

পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান

পূর্ব ভারতে হিমালয়ের দক্ষিণে ও বঙ্গোপসাগরের উত্তরে এক সংকীর্ণ অংশে পশ্চিমবঙ্গ অবস্থিত। ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ একমাত্র রাজ্য যেটি উত্তরে হিমালয় এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরকে স্পর্শ করেছে।

পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা ও আয়তন

আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা ১০ কোটিরও বেশি। জনসংখ্যার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ ভারতের চতুর্থ সর্বাধিক জনবহুল রাজ্য (প্রথম উত্তর প্রদেশ, দ্বিতীয় মহারাষ্ট্র, তৃতীয় বিহার )। এই রাজ্যের আয়তন ৮৮৭৫২ বর্গ কি. মি.।

পশ্চিমবঙ্গের সীমা

বাংলাভাষী বাঙালি জাতি অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গ অবিভক্ত বাংলার একটি অংশ। এই রাজ্যের পূর্ব দিকে বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং উত্তর দিকে নেপালভুটান রাষ্ট্র অবস্থিত। ভারতের ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, বিহার, সিকিম ও অসম রাজ্যও পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী।

পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী

আমাদের রাজ্যের রাজধানী কলকাতা। কলকাতা শহরটি হল ভারতের সপ্তম বৃহত্তম মহানগরী৷

পশ্চিমবঙ্গের প্রধান জাতি

বাঙালিরাই এই রাজ্যের প্রধান জাতিগোষ্ঠী এবং রাজ্যের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই বাঙালি হিন্দু।

প্রাচীন বাংলা

একাধিক প্রধান জনপদের কেন্দ্রস্থল ছিল প্রাচীন বাংলা। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে সম্রাট অশোক এই অঞ্চলটি জয় করেন। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে এই অঞ্চল গুপ্ত সাম্রাজ্য -এর অন্তর্ভুক্ত হয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীর পর থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ শাসনের সূচনালগ্ন পর্যন্ত একাধিক সুলতান, শক্তিশালী হিন্দু রাজন্যবর্গ ও বারো ভুঁইয়া এবং সামন্ত জমিদারেরা এই অঞ্চল শাসন করেন।

মগধ সাম্রাজ্য

খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতকে বাংলা ও বিহার অঞ্চল নিয়ে গড়ে ওঠে মগধ রাজ্য। এই মগধ রাজ্য ছিল মহাবীরগৌতম বুদ্ধ -এর সমসাময়িক ভারতের চারটি প্রধান রাজ্যের অন্যতম। মৌর্য রাজবংশের রাজত্বকালে প্রায় সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া মগধ সাম্রাজ্য -এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে এই সাম্রাজ্য -এর সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতি মহামতি অশোকের রাজত্বকালে আফগানিস্তান ও পারস্যের কিছু অংশও অন্তর্ভুক্ত হয়।

বঙ্গ দেশের শশাঙ্ক

খ্রিষ্টীয় তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে মগধ রাজ্য ছিল গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রধান কেন্দ্র। শশাঙ্ক ছিলেন বঙ্গের প্রথম সার্বভৌম রাজা। খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতকের প্রথম ভাগে তিনি একাধিক ছোটো ছোটো রাজ্যে বিভক্ত সমগ্র বঙ্গ অঞ্চলটিকে একত্রিত করে একটি সুসংহত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তার রাজধানী ছিল অধুনা মুর্শিদাবাদ -এর কর্ণসুবর্ণ।

বঙ্গ দেশে মাৎস্যন্যায়

শশাঙ্কের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে বঙ্গের ইতিহাসে এক নৈরাজ্যের অবস্থা সৃষ্টি হয়। ইতিহাসে এই সময়কাল ‘মাৎস্যন্যায়‘ নামে পরিচিত। এরপর চারশো বছর বৌদ্ধ পাল রাজবংশ এবং তারপর কিছুকাল হিন্দু সেন রাজবংশ এই অঞ্চল শাসন করেন।

বঙ্গ দেশে পাল ও সেন বংশের রাজত্ব

পাল সাম্রাজ্য -এর রাজধানী ছিল পাটলিপুত্র (অধুনা পাটনা, বিহার) এবং পরবর্তীতে গৌড় (মালদহ জেলা)। সেন বংশ -এর রাজধানী ছিল নবদ্বীপ (নদীয়া জেলা)।

বঙ্গ দেশে ইসলামের প্রসার

পরবর্তীতে ভারতে ইসলামের আবির্ভাব ঘটলে বঙ্গ অঞ্চলেও ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটে। বখতিয়ার খলজি নামে দিল্লি সুলতানির এক তুর্কি সেনানায়ক সর্বশেষ সেন রাজা লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে বঙ্গের একটি বিরাট অঞ্চল অধিকার করে নেন।

মোঘল আমলে বাংলা

ষোড়শ শতাব্দীতে মোঘল সেনানায়ক ইসলাম খাঁ বঙ্গ অধিকার করেন। যদিও মোঘল সাম্রাজ্যের রাজদরবার সুবা বাংলার শাসকদের শাসনকার্যের ব্যাপারে আধা-স্বাধীনতা প্রদান করেছিলেন। এই অঞ্চলের শাসনভার ন্যস্ত হয়েছিল মুর্শিদাবাদের নবাবদের হাতে। এই নবাবরা দিল্লির মুঘল সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন

বাংলায় কোম্পানির আধিপত্য

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ -এ সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই অঞ্চলের উপর নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে। এরপর দীর্ঘকাল কলকাতা ছিল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী।

বাংলায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তর

১৭৬৫ সালে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি স্থাপিত হয়। ১৭৭০ সালে (১১৭৬ বঙ্গাব্দ) ছিয়াত্তরের মন্বন্তর -এ লক্ষাধিক সাধারণ মানুষের মৃত্যু ঘটে। ১৭৭২ সালে কলকাতা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ঘোষিত হয়। ১৯৪৩ সালে পঞ্চাশের মন্বন্তর -এ বাংলায় ৩০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়।

বাংলার নবজাগরণ

দীর্ঘকাল ব্রিটিশ প্রশাসনের কেন্দ্রস্থলে থাকার সুবাদে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি এবং ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারের সূচনা ঘটে। এই ঘটনা পরবর্তীকালে বাংলার নবজাগরণ নামে পরিচিত হয়। বাংলার নবজাগরণব্রাহ্মসমাজ-কেন্দ্রিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংস্কার আন্দোলন বাংলার সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে।

বাংলায় মহাবিদ্রোহ

১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ -এর সূচনা কলকাতার অদূরেই হয়েছিল। এই বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হলেও এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের শাসনভার কোম্পানির হাত থেকে ব্রিটিশ রাজশক্তি নিজ হস্তে গ্রহণ করে।

বঙ্গভঙ্গ

ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতে ১৯০৫ সালে প্রথম পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতীয় বঙ্গ অঞ্চলটিকে পূর্ববঙ্গ থেকে পৃথক করা হয়। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলন -এর ফলে বঙ্গবিভাগের এই প্রয়াস শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় এবং ১৯১১ সালে বঙ্গপ্রদেশকে পুনরায় একত্রিত করা হয়।

স্বাধীনতা আন্দোলনের কেন্দ্র বাংলা

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বাংলা এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। অনুশীলন সমিতিযুগান্তর দল -এর মতো বিপ্লবী দলগুলি এখানে অতিসক্রিয় হয়ে ওঠে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে বাংলা ছিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র।

বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামী সুভাষচন্দ্র বসু

বাংলায় ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় তখন সুভাষচন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অবতীর্ণ হন।

দ্বিখণ্ডিত বাংলা

১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর ধর্মের ভিত্তিতে এই অঞ্চল দ্বিখণ্ডিত হয়। বাংলার পূর্ব ভূখণ্ড নিয়ে গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশ, যা অধুনা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র। অন্যদিকে পশ্চিম ভূখণ্ড নিয়ে গঠিত হয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য। রাজ্যের রাজধানী হয় কলকাতা।

পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘস্থায়ী কমিউনিস্ট সরকার

১৯৭৭ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত কমিউনিস্ট সরকার পশ্চিমবঙ্গ শাসন করেছিল। বিশ্বের ইতিহাসে এই সরকারই ছিল সর্বাপেক্ষা দীর্ঘস্থায়ী নির্বাচিত কমিউনিস্ট সরকার।

পশ্চিমবঙ্গের সরকার ব্যবস্থা

পশ্চিমবঙ্গ প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের সংসদীয় পদ্ধতিতে শাসিত হয়। রাজ্যের সকল নাগরিকের জন্য সার্বজনীন ভোটাধিকার স্বীকৃত। পশ্চিমবঙ্গের আইনসভা বিধানসভা নামে পরিচিত। কলকাতা হাইকোর্ট ও অন্যান্য নিম্ন আদালত নিয়ে রাজ্যের বিচারবিভাগ গঠিত। শাসনবিভাগের কর্তৃত্বভার ন্যস্ত রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার উপর। রাজ্যপাল রাজ্যের আনুষ্ঠানিক প্রধান হলেও, প্রকৃত ক্ষমতা সরকারপ্রধান মুখ্যমন্ত্রীর হাতেই ন্যস্ত থাকে। রাজ্যপালকে নিয়োগ করেন ভারতের রাষ্ট্রপতি

পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি

এই পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ মানুষ কৃষিজীবী। রাজ্যের প্রধান খাদ্যফসল ধান। এছাড়াও ডাল, তৈলবীজ, গম, তামাক, আখ ও আলু বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এখানকার প্রধান পণ্যফসল হল পাট। উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং ও অন্যান্য উচ্চ মানের চায়ের জন্য বিখ্যাত।

পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিতে ধনতান্ত্রিক পন্থা

চীন -এর দৃষ্টান্ত থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কমিউনিস্ট পদ্ধতির পরিবর্তে ধনতান্ত্রিক পন্থায় রাজ্যের উচ্চাকাঙ্ক্ষী অর্থনৈতিক সংস্কারের পথ গ্রহণ করেছিলেন।

পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনিক অঞ্চল

প্রশাসনিক কাজের সুবিধার জন্য পশ্চিমবঙ্গকে পাঁচটি বিভাগ ও ২৩টি জেলায় বিভক্ত করা হয়েছে। যথা –

(১) বর্ধমান বিভাগ

পূর্ব বর্ধমান জেলা, পশ্চিম বর্ধমান জেলা, বীরভূম জেলা, হুগলি জেলা।

(২) মালদা বিভাগ

উত্তর দিনাজপুর জেলা, মালদা জেলা, মুর্শিদাবাদ জেলা, দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা।

(৩) জলপাইগুড়ি বিভাগ

আলিপুরদুয়ার জেলা, কালিম্পং জেলা, কোচবিহার জেলা, জলপাইগুড়ি জেলা, দার্জিলিং জেলা।

(৪) প্রেসিডেন্সি বিভাগ

উত্তর ২৪ পরগণা জেলা, কলকাতা জেলা, দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা, নদিয়া জেলা, হাওড়া জেলা।

(৫) মেদিনীপুর বিভাগ

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা, পুরুলিয়া জেলা, পূর্ব মেদিনীপুর জেলা, বাঁকুড়া জেলা, ঝাড়গ্রাম জেলা।

পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ু

পশ্চিমবঙ্গ গ্রীষ্মপ্রধান উষ্ণ জলবায়ু অঞ্চলের অন্তর্গত। এই রাজ্যের প্রধান ঋতু চারটি – শুষ্ক গ্রীষ্মকাল, বর্ষাকাল, শরৎকাল ও শীতকাল। বদ্বীপ অঞ্চলের গ্রীষ্মকাল আর্দ্র হলেও, পশ্চিমের উচ্চভূমি অঞ্চলে উত্তর ভারতের মতো শুষ্ক গ্রীষ্মকাল।

পশ্চিমবঙ্গের জীবজগৎ

পশ্চিমবঙ্গ জৈব বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। এর প্রধান কারণ হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল থেকে উপকূলীয় সমভূমি পর্যন্ত সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ভূপৃষ্ঠের উচ্চতার তারতম্য। রাজ্যের ভৌগোলিক এলাকার মাত্র ১৪ শতাংশ বনভূমি। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবনের একটি অংশ পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত।

পশ্চিমবঙ্গের জাতীয় উদ্যান

সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের জন্য বিখ্যাত। রাজ্যে মোট ছয়টি জাতীয় উদ্যান আছে। সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান, বক্সা জাতীয় উদ্যান, গোরুমারা জাতীয় উদ্যান, নেওড়া উপত্যকা জাতীয় উদ্যান, সিঙ্গালীলা জাতীয় উদ্যান ও জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যান। রাজ্যের অন্যান্য বন্যপ্রাণীর মধ্যে ভারতীয় গণ্ডার, এশীয় হাতি, হরিণ, বাইসন, চিতাবাঘ ও কুমির উল্লেখযোগ্য। রাজ্যের পক্ষীজগৎও বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। পরিযায়ী পাখিদের শীতকালে এই রাজ্যে আসতে দেখা যায়।

পশ্চিমবঙ্গের খেলাধূলা

খেলাধূলার ক্ষেত্রে ভারতের অন্যান্য রাজ্যের পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে। এই রাজ্যের মানুষের মধ্যে জাতীয় স্তরে বিশেষ জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট ছাড়াও ফুটবলের প্রতিও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।

পশ্চিমবঙ্গের ধর্ম

এই পশ্চিমবঙ্গের প্রধান ধর্ম হল হিন্দুধর্মে। ইসলাম দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মবিশ্বাস এবং বৃহত্তম সংখ্যালঘু ধর্ম। শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ধর্ম, জৈন ধর্ম অবলম্বীরা জনসংখ্যার অবশিষ্ট অংশ। সংখ্যালঘুসঙ্কুল জেলাগুলি হল মুর্শিদাবাদ জেলা, উত্তর দিনাজপুর জেলা ও মালদহ জেলা৷

পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য

  • (১) বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্য যথেষ্ট সমৃদ্ধ ও প্রাচীন ঐতিহ্যের বাহক। বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ। বাংলা সাহিত্যের দ্বিতীয় প্রাচীনতম নিদর্শন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাস অধুনা বাঁকুড়া জেলার ছাতনার বাসিন্দা। চণ্ডীমঙ্গল ধারার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ছিলেন বর্ধমান জেলার দামুন্যা গ্রামের অধিবাসী।
  • (২) ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে বাংলা সাহিত্যের আধুনিকীকরণ সম্পন্ন হয় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সৈয়দ মুজতবা আলি, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাশ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মীর মোশাররফ হোসেন, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মহাশ্বেতা দেবী, আশাপূর্ণা দেবী প্রমুখ সাহিত্যিকের হাত ধরে।
  • (৩) মহাশ্বেতা দেবী, শ্রী অরবিন্দ, হরি মোহন ব্যানার্জি, সঞ্জীব চৌধুরী ও নলিনী কুমার মুখার্জি প্রমুখ সাহিত্যিক সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন। অন্যদিকে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সরোজিনী চট্টোপাধ্যায় ও কাজী নজরুল ইসলামকে বিশ্ব ইতিহাসের সেরা কবিদের মধ্যে গণ্য করা হয়।

বাংলা চলচ্চিত্র

বাংলা চলচ্চিত্রের প্রধান কেন্দ্র কলকাতার টালিগঞ্জ অঞ্চলে অবস্থিত। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তপন সিংহ, ঋত্বিক ঘটক প্রমুখ বিশিষ্ট পরিচালকের চলচ্চিত্র বিশ্ববন্দিত। সমসাময়িককালের বিশিষ্ট পরিচালকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, গৌতম ঘোষ, অপর্ণা সেন ও ঋতুপর্ণ ঘোষ। সত্যজিৎ রায় তার পথের পাচালি, দেবী, কাঞ্চনজঙ্ঘা এসব চলচ্চিত্রের জন্য বিশ্বজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। তিনি ১৯৯২ সালে সম্মানসূচক অস্কার পান। তার প্রধান দুই অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও শর্মিলা ঠাকুর তাদের অনবদ্য অভিনয়ের জন্য সমগ্র বিশ্বে বন্দিত।

পশ্চিমবঙ্গের উৎসব

  • (১) পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তম উৎসব দুর্গাপূজা। পশ্চিমবঙ্গের অপর বহুপ্রচলিত হিন্দু উৎসব হল কালীপূজা, পয়লা বৈশাখ, অক্ষয় তৃতীয়া, দশহরা, রথযাত্রা, ঝুলনযাত্রা, জন্মাষ্টমী, বিশ্বকর্মা পূজা, মহালয়া, কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা, রাসযাত্রা, ভাইফোঁটা, নবান্ন, জগদ্ধাত্রী পূজা, সরস্বতী পূজা, দোলযাত্রা, শিবরাত্রি ও চড়ক-গাজন।
  • (২) মকর সংক্রান্তির দিন বীরভূম জেলার কেন্দুলিতে জয়দেব মেলা উপলক্ষে বাউল সমাগম ঘটে। প্রতি বছর মকর সংক্রান্তির দিন এখানে বীরভূমপুত্র জয়দেব -এর উদ্দেশ্যে জয়দেব-কেন্দুলি মেলা হয়ে থাকে। পৌষ সংক্রান্তির দিন হুগলি নদীর মোহনার কাছে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার গঙ্গাসাগর -এ আয়োজিত গঙ্গাসাগর মেলায় সারা ভারত থেকেই পুণ্যার্থী সমাগম হয়।
  • (৩) ৪ ঠা মাঘ বাঁকুড়ার কেঞ্জেকুড়া গ্রামে দ্বারকেশ্বর নদীর তীরে এক বিশাল মুড়ি মেলা হয়। শিবরাত্রি উপলক্ষে জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ির নিকটে প্রাচীন জল্পেশ্বর শিবমন্দিরকে কেন্দ্র করে আয়োজিত হয় বিখ্যাত জল্পেশ্বর মেলা।
  • (৪) শ্রাবণ সংক্রান্তির সর্পদেবী মনসা পূজা উপলক্ষে রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে আয়োজিত হয় ঝাঁপান উৎসব। বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর -এর ঝাঁপান উৎসব সবচেয়ে বিখ্যাত। বাঁকুড়া জেলার রাইপুর ব্লকের অন্তর্গত মটগোদা গ্রামে ধর্মরাজ পুজো উপলক্ষে মাঘ মাসের শেষ শনিবারে অনুষ্ঠিত হয় শনিমেলা। কোচবিহার শহরের মদনমোহন মন্দিরকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত রাসমেলা পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম বৃহত্তম মেলা।
  • (৫) ইসলামি উৎসব মধ্যে ঈদুল আজহা, ঈদলফিতর, মিলাদ-উন-নবি, শবেবরাত ও মহরম বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে পালিত হয়। খ্রিষ্টান উৎসব বড়দিন ও গুড ফ্রাইডে; বৌদ্ধ উৎসব বুদ্ধপূর্ণিমা; জৈন উৎসব মহাবীর জয়ন্তী এবং শিখ উৎসব গুরু নানক জয়ন্তীও মহাধুমধামের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয়।
  • (৬) পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক উৎসবগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস, পঁচিশে বৈশাখ, নেতাজি জয়ন্তী ইত্যাদি। প্রতি বছর পৌষ মাসে শান্তিনিকেতন -এ বিখ্যাত পৌষমেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। বইমেলা পশ্চিমবঙ্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক উৎসব। আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তকমেলা রাজ্যে একমাত্র তথা বৃহত্তম আন্তর্জাতিক বইমেলা।

পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন কেন্দ্র

এই পশ্চিমবঙ্গের উল্লেখযোগ্য পর্যটনকেন্দ্র হল নবদ্বীপ, হাজার দুয়ারি রাজপ্রাসাদ, মালদহ টাউন, বহরমপুর ও কাশেমবাজার নবাবী প্রাসাদ, কোটিবর্ষ প্রত্নস্থল, দক্ষিণ দিনাজপুর শোভাবাজার রাজবাড়ি, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, কুমোরটুলি, মার্বেল প্যালেস, চন্দননগর, চুঁচুড়া, নাখোদা মসজিদ, বেলুড় মঠ, দক্ষিণেশ্বর, কালীঘাট, বিষ্ণুপুর মন্দির শহর, বর্ধমান কার্জন গেট (বিজয় তোরন), বর্ধমান ১০৮ শিব মন্দির, দীঘা সমুদ্রসৈকত, মন্দারমণি সমুদ্রসৈকত, উদয়পুর সমুদ্রসৈকত, শঙ্করপুর সমুদ্রসৈকত, তাজপুর সমুদ্রসৈকত, বকখালি, জুনপুট, সাগরদ্বীপ কপিলমুনি আশ্রম, সজনেখালি-ধামাখালি, সুন্দরবন অভয়ারণ্য, ভগবতপুর অভয়ারণ্য প্রভৃতি।

উপসংহার :- লোকসংস্কৃতির বৈচিত্র্য, সাহিত্য, সংগীত, নাটক, চলচ্চিত্র, শিল্পকলা ও উৎসব-অনুষ্ঠান পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। নোবেল পুরস্কার জয়ী বাঙালি সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিকর্ম এই রাজ্যে বিশেষ সমাদৃত ও জনপ্রিয়। কলকাতাকে ‘ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী’ বলেও অভিহিত করা হয়।

(FAQ) পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের রাজধানীর নাম কি?

কলকাতা।

২. পশ্চিমবঙ্গের প্রধান ভাষা কি?

বাংলা।

৩. পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজ্যপালের নাম কি?

সিভি আনন্দ বোস।

৪. পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী কে?

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থানগুলি

Leave a Comment