হর্ষবর্ধনের রাজ্য জয়

হর্ষবর্ধনের রাজ্য জয় প্রসঙ্গে শশাঙ্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, হর্ষবর্ধনের সীমিত সাফল্য, ভাস্কর বর্মনের সাথে মিত্রতা, মগধ ও বাংলা জয়, বলভী জয়, সিন্ধু, নেপাল ও কাশ্মীর, দ্বিতীয় পুলকেশির সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও নর্মদা যুদ্ধ সম্পর্কে জানবো।

হর্ষবর্ধনের রাজ্য জয়

ঐতিহাসিক ঘটনাহর্ষবর্ধনের রাজ্য জয়
রাজাহর্ষবর্ধন
রাজধানীথানেশ্বর, কনৌজ
বংশপুষ্যভূতি বংশ
উপাধিশিলাদিত্য
হর্ষবর্ধনের রাজ্য জয়

ভূমিকা :- হর্ষবর্ধন ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে পৈত্রিক রাজ্য থানেশ্বরের সিংহাসনে বসেন। এর পর তিনি ভগিনী রাজ্যশ্রীর পক্ষে তাঁর মৃত স্বামীর রাজ্য কনৌজ অধিকার করেন। কনৌজকে নিজ রাজ্যের সঙ্গে সংযুক্ত করে হর্ষবর্ধন তাঁর রাজ্য বিস্তার নীতির সূত্রপাত করেন।

শশাঙ্কের বিরুদ্ধে হর্ষবর্ধনের যুদ্ধ

  • (১) সিংহাসনে বসার সঙ্গে সঙ্গে তাকে তাঁর প্রধান শত্রু গৌড়রাজ শশাঙ্ক -এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করতে হয়। বাণভট্ট হর্ষচরিতে কেবলমাত্র উল্লেখ করেছেন যে, হর্ষ শশাঙ্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করেন। এই যুদ্ধের ফল কি হয় সে সম্পর্কে তিনি নীরব থাকেন।
  • (২) এক্ষেত্রে আধুনিক ঐতিহাসিকরা কয়েকটি অনুমান করে থাকেন। ডঃ ত্রিপাঠী বলেছেন যে, হর্ষবর্ধনের আসার খবর পেয়ে শশাঙ্ক কনৌজ ছেড়ে পিছু হটে যান। কিন্তু ডঃ আর সি মজুমদারের মতে, শশাঙ্ক কনৌজের সিংহাসনে গ্রহবর্মনের কনিষ্ঠ ভ্রাতা শূরসেনকে বসিয়ে তবে কনৌজ ছাড়েন। হর্ষবর্ধন শূরসেনকে পরাস্ত করে তবে কনৌজ দখল করেন।

হর্ষবর্ধনের সীমিত সাফল্য

  • (১) শশাঙ্ক কনৌজ হতে পিছু হঠলেও হর্ষবর্ধনের সঙ্গে তাঁর বিরোধ চলতে থাকে। তবে এই যুদ্ধে হর্ষবর্ধন কতটা সফল হন সে সম্পর্কে কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায় নি। বাভট্টণ বলেছেন যে, হর্ষবর্ধন প্রথমে তাঁর বিপন্না ভগিনী রাজ্যশ্রীকে উদ্ধারের কাজে হাত দেন।
  • (২) রাজ্যশ্রীকে কনৌজের কারাগার থেকে শত্রুপক্ষ মুক্ত করে দেয়। হর্ষবর্ধন অনেক খুঁজে রাজ্যশ্রীকে বিন্ধ্যপর্বতের জঙ্গল থেকে উদ্ধার করেন এবং তাকে কনৌজে ফিরিয়ে আনেন। এর পর তিনি শশাঙ্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন।
  • (৩) আর্যমঞ্জুশ্রী মূলকল্প নামে বৌদ্ধ গ্রন্থের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ দখল করে হর্ষবর্ধন শশাঙ্ককে তার রাজ্যের বাইরে যেতে নিষেধ করেন। ডঃ আর সি. মজুমদার আর্য মঞ্জুশ্রী মূলকল্পের বিবরণ নির্ভরযোগ্য নয় বলে মনে করেন। কারণ, এটি মধ্যযুগের রচনা। হর্ষের বহু পরে এই গ্রন্থ লিখিত হয়।
  • (৪) বৌদ্ধ গ্রন্থগুলিতে শশাঙ্ক সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য প্রায় করা হয়ে থাকে। শশাঙ্কের শিলালিপিগুলি থেকে দেখা যায় যে, তিনি গৌড়ে পূর্ণ গৌরবে অন্তত ৬১১ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত এমনকি তার পরেও রাজত্ব করেন। সুতরাং ডঃ মজুমদারের মতে, “স্থায়ী ফলের দিক হতে, শশাঙ্কের বিরুদ্ধে হর্ষবর্ধনের অভিযান নিম্ফলা ছিল বলা চলে।”

ভাস্করবর্মনের সাথে হর্ষবর্ধনের মিত্রতা

  • (১) ডঃ আর. জি. বসাক প্রমুখ পণ্ডিতের মতে, শশাঙ্কের রাজত্বের শেষ দিকে হর্ষবর্ধন এবং কামরূপ রাজ্য -এর রাজা ভাস্করবর্মন তার রাজ্য অধিকার করেন। বাণভট্ট বলেছেন যে, ভাস্করবর্মন, শশাঙ্কের বিরুদ্ধে হর্ষবর্ধনের মিত্রতা প্রার্থনা করেন। উভয়ের শত্রু ছিলেন শশাঙ্ক। সুতরাং মিত্রতা স্থাপিত হতে দেরী হয়নি।
  • (২) ৬১১-২৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তাদের হাতে শশাঙ্ক পরাস্ত হন। এই কারণে ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুর লিপিতে শশাঙ্ক “মহারাজাধিরাজ” উপাধি ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এই সময়ের শশাঙ্কের স্বর্ণমুদ্রাগুলিও ছিল নিম্নমানের। এই সময় গঞ্জামের ওপর শশাঙ্কের অধিকার সম্ভবত আর বহাল ছিল না। ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে শশাঙ্কের মৃত্যু হয়।

ডঃ মজুমদারের অভিমত

উপরের মতের তীব্র বিরোধিতা করে ডঃ মজুমদার বলেছেন যে,

  • (১) শশাঙ্ক ৬১৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গঞ্জামে পূর্ণ অধিকার বহাল রেখেছিলেন, এটা গঞ্জাম লিপি থেকে দেখা যায়।
  • (২) ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে হিউয়েন সাঙ যখন বোধগয়ায় আসেন তখন তিনি জানতে পাবেন যে, সম্প্রতি শশাঙ্ক গয়ার বোধিবৃক্ষ ছেদন করেছেন। যাই হোক, এ কথা বোধ হয় বলা চলে যে, ৬১১ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে শশাঙ্কের ক্ষমতা কমতে থাকে। পূর্বে ভাস্করবর্মন ও পশ্চিমে হর্ষবর্ধনের চাপে তিনি দুর্বল হয়ে পড়েন।

হর্ষবর্ধনের মগধ ও উড়িষ্যা দখল

চীন -এর লেখক মা-তোয়ান-লিনের রচনা থেকে জানা যায় যে, শশাঙ্কের মৃত্যুর পর ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে হর্ষবর্ধন মগধ অধিকার করেন। ৬৪৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি উড়িষ্যা ও কঙ্গদ বা গঞ্জাম অধিকার করেন। হয়ত এর আগেই তিনি এ সকল স্থান অধিকার করেছিলেন।

হর্ষবর্ধনের বাংলা জয়

শশাঙ্কের মৃত্যুর পর (৬৩৭ খ্রিস্টাব্দ) হর্ষবর্ধন পশ্চিম বাংলা অধিকার করেন। অর্থাৎ ভাগীরথী ও পদ্মার পূর্ব পারের অঞ্চল ভাস্কর পান। উড়িষ্যা দখলের পর হর্ষবর্ধন উড়িষ্যায় একটি বৌদ্ধ মহাসম্মেলন আহ্বান করেন।

হর্ষবর্ধনের বলভী জয়

  • (১) হর্ষবর্ধন কেবলমাত্র পূর্ব ভারত -এ রাজ্য বিস্তার করেন নি। পশ্চিম ভারতে সৌরাষ্ট্রের বলভী রাজ্যকে তিনি অধিকার করার চেষ্টা করেন। গুজরাটের গুর্জর ও রাজপুতানার মালবদের সঙ্গে তাঁর বৈরীতা ছিল। এই শক্তিগুলি চালুক্য বংশ -এর রাজা দ্বিতীয় পুলকেশীর সাহায্যে তাকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করে।
  • (২) হর্ষবর্ধন এদের দুদিক থেকে বেষ্টন করার জন্য বলভীরাজ ধ্রুবসেনকে তাঁর প্রতি বশ্যতা স্বীকারে আহ্বান জানান। বলভীরাজ ধ্রুবসেন যুদ্ধে পরাস্ত হন। তবে তিনি গুর্জররাজ দ্বিতীয় দদ্দের সাহায্যে নিজ ক্ষমতা পুনঃ-প্রতিষ্ঠিত করেন।

হর্ষবর্ধনের সিন্ধু, নেপাল ও কাশ্মীর অভিযান

  • (১) হর্ষবর্ধন সিন্ধুদেশের বিরুদ্ধে অভিযান করেন বলে বাণভট্ট হর্ষচরিতে বলেছেন। তবে ডঃ মজুমদারের মতে, এই অভিযানের কোনো ফল হয়নি। বাণভট্ট বলেছেন যে, হর্ষবর্ধন তুষার শৈলে অভিযান করেন। বূহলার প্রমুখ পণ্ডিতেরা এর থেকে অনুমান করেছেন যে, হর্ষ কাশ্মীর ও নেপাল অভিযান করেছিলেন।
  • (২) কিন্তু ডঃ সিলভ্যাঁ লেভি এই মত খণ্ডন করে বলেছেন যে, হর্ষ কখনও নেপাল অভিযান করেননি। হিউয়েন সাঙের বিবরণ হতে জানা যায় যে, হর্ষবর্ধন কাশ্মীর অভিযান করে কাশ্মীরের রাজার কাছ থেকে একটি গৌতম বুদ্ধ -এর মূর্তি উদ্ধার করেন। কিন্তু এই সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো প্রমাণ না থাকায় হর্ষবর্ধন কাশ্মীর অধিকার করেন কিনা তা সঠিক জানা যায় না।

দ্বিতীয় পুলকেশীর সঙ্গে হর্ষবর্ধনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা

  • (১) হর্ষবর্ধন যখন উত্তর ভারতে তার একচ্ছত্র অধিকার স্থাপনে ব্যস্ত ছিলেন, সেই সময় দক্ষিণে চালুক্য রাজ দ্বিতীয় পুলকেশীও তুঙ্গভদ্রার উত্তর তীরে সমগ্র দাক্ষিণাত্যে আপন অধিকার স্থাপনে ব্যস্ত ছিলেন।
  • (২) ডঃ মজুমদারের মতে, লাট বা গুজরাট, মালব বা রাজপুতানা অঞ্চলের শাসকরা হর্ষবর্ধনের আক্রমণের ভয়ে স্বেচ্ছায় দ্বিতীয় পুলকেশীর প্রতি বশ্যতা জানায়। এর ফলে নর্মদার উত্তরে রাজপুতানা ও গুজরাটে পুলকেশীর প্রভাব বিস্তৃত হয়।
  • (৩) এক্ষেত্রে হর্ষবর্ধনের পক্ষে পুলকেশীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ছাড়া রাস্তা ছিল না। এছাড়া শশাঙ্কের মৃত্যুর পর গঞ্জাম পর্যন্ত হর্ষবর্ধনের রাজ্য বিস্তৃত হলে তার রাজ্যসীমা পুলকেশীর সীমান্তকে স্পর্শ করে।

দ্বিতীয় পুলকেশীর সঙ্গে হর্ষবর্ধনের নর্মদা যুদ্ধ

  • (১) বাণভট্টের মতে, হর্ষবর্ধন ‘পঞ্চ ভারত’ হতে সেনা সংগ্রহ করে, নিজে পুলকেশীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে এগিয়ে যান। স্মিথের মতে, হর্ষবর্ধন নর্মদা পার হয়ে দক্ষিণে পুলকেশীর রাজ্যে ঢুকে পড়লে তবে যুদ্ধ বাধে।
  • (২) ডঃ মজুমদার এই মত খণ্ডন করে বলেছেন যে, নর্মদার উত্তরে কোনো স্থানে এই যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে দক্ষিণী বল্লমধারী সেনারা হর্ষবর্ধনকে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত করে। ডঃ এস চ্যাটার্জীর মতে, এর পরে গঞ্জাম হতে হর্ষবর্ধন পুলকেশীর পার্শ্বদেশ ভেদ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি।

উপসংহার :- এই ভাবে হর্ষবর্ধন উত্তর ভারতের পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবাংলা, উড়িষ্যা, গঞ্জাম নিয়ে এক বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করেন।

(FAQ) হর্ষবর্ধনের রাজ্য জয় সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. হর্ষবর্ধন কখন সিংহাসনে আরোহণ করেন?

৬০৬ খ্রিস্টাব্দে।

২. কে কখন হর্ষসম্বৎ প্রচলন করেন?

হর্ষবর্ধন ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে।

৩. হর্ষবর্ধনের রাজধানী কোথায় ছিল?

থানেশ্বর ও কনৌজ।

৪. সকলোত্তরপথনাথ কে ছিলেন?

হর্ষবর্ধন।

Leave a Comment