অশোকের রাজ্য জয়

মৌর্য সম্রাট অশোকের রাজ্য জয় প্রসঙ্গে কলিঙ্গ যুদ্ধ, কলিঙ্গ যুদ্ধের কারণ, কলিঙ্গের পরাজয়, কলিঙ্গ যুদ্ধের ফলাফল, ধর্ম বিজয় নীতি, জনকল্যাণ, ধর্মমহামাত্র নিয়োগ, কূপ খনন, পশুবলি নিষিদ্ধ ও ধর্মযাত্রা সম্পর্কে জানবো।

অশোকের রাজ্য জয়

ঐতিহাসিক ঘটনাসম্রাট অশোকের রাজ্য জয়
যুদ্ধকলিঙ্গ যুদ্ধ
উপাধিমহর্ষি
পিতাবিন্দুসার
পিতামহচন্দ্রগুপ্ত মৌর্য
অশোকের রাজ্য জয়

ভূমিকা :- চন্দ্রগুপ্ত ও বিন্দুসারের পথ ধরে অশোক তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তারের কাজ চালিয়ে যান। তার রাজত্বের প্রথম তের বছর তার নীতি ছিল স্বদেশে রাজ্য বিস্তার ও বিদেশে গ্রীক রাজাদের সঙ্গে মিত্রতা।

অশোকের কলিঙ্গ যুদ্ধ

সম্রাট অশোকের অভিষেকের পর তাঁর রাজত্বের অষ্টম বছরে (মতান্তরে নবম) অর্থাৎ ২৬০ খ্রি পূর্বে (মতান্তরে ২৬১ খ্রিস্ট পূর্বে) তিনি কলিঙ্গ যুদ্ধে ব্যাপৃত হন। তাঁর রাজত্বের সর্বপ্রধান ঘটনা ছিল কলিঙ্গ যুদ্ধ।

কলিঙ্গ যুদ্ধের কারণ

কলিঙ্গ বলতে উড়িষ্যা ও গঞ্জাম জেলার কিছু অংশ বুঝায়। অশোক কেন কলিঙ্গ আক্রমণ করেন তার সঠিক কারণ তার শিলালিপিতে পাওয়া যায় নি। ঐতিহাসিকরা পারিপার্শ্বিক প্রমাণ থেকে কারণ আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন। যেমন –

  • (১) রাজনৈতিক কারণ হিসেবে জানা যায় যে, নন্দ রাজাদের আমলে কলিঙ্গ মগধ -এর অধীনে ছিল। পরে চন্দ্রগুপ্তের আমলে সম্ভবত কলিঙ্গ স্বাধীনতা ঘোষণা করে। প্লিনির বিবরণ থেকে জানা যায় যে, চন্দ্রগুপ্তের আমলে কলিঙ্গ স্বাধীন রাজ্য ছিল।
  • (২) ডঃ ভাণ্ডারকরের মতে, বিন্দুসারের আমলে কলিঙ্গ দক্ষিণের চোল ও পাণ্ড্য রাজাদের সঙ্গে জোট বেঁধে তাঁর বিরুদ্ধে বাধা দেয়। অশোক দেখেন যে, মগধের অধীনস্থ অন্ধ্র উত্তরে কলিঙ্গ ও দক্ষিণে চোল ও পাণ্ড্যদের দ্বারা বেড়াজালে পড়ে গেছে। এই কারণে তিনি কলিঙ্গ আক্রমণ করেন।
  • (৩) কলিঙ্গ রাজ্য দিন দিন তার সামরিক শক্তি বাড়িয়ে চলেছিল। প্লিনির বিবরণ থেকে জানা যায় যে, কলিঙ্গের সেনাবাহিনীতে ৬০ হাজার পদাতিক, ১ হাজার অশ্বারোহী ও ৭ শত রণহস্তী ছিল। এরূপ একটা শক্তিকে প্রতিবেশী হিসাবে সহ্য করা অশোকের পক্ষে কঠিন ছিল।
  • (৪) তিব্বতীয় বিবরণ থেকে জানা যায় যে, অশোক দক্ষিণ ভারত -এ যাওয়ার স্থল ও জলকে নিরঙ্কুশ করার জন্য কলিঙ্গ জয় করেন। রোমিলা থাপার এই বিষয়টিকে কলিঙ্গ যুদ্ধের আসল কারণ বলে মনে করেন। মগধের সঙ্গে দক্ষিণের যোগাযোগের পথে কলিঙ্গ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
  • (৫) মগধ-এর বাণিজ্য তখন তাম্রলিপ্ত হয়ে বঙ্গোপসাগরের পথে ব্রহ্ম, সুমাত্রা, জাভা পর্যন্ত চলত। কলিঙ্গ, মগধের এই সামুদ্রিক বাণিজ্যের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ায়। এই সকল কারণে অশোক কলিঙ্গ অভিযান করেন।

কলিঙ্গের পরাজয়

ত্রয়োদশ শিলালিপিতে অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহ ক্ষয়-ক্ষতির বিবরণ দিয়েছেন। কলিঙ্গবাসীরা প্রবল বিক্রমে বাধা দিয়ে পরাজয় বরণ করে।

কলিঙ্গ যুদ্ধের ফলাফল

  • (১) এই যুদ্ধে কলিঙ্গের ১ লক্ষ লোক নিহত হয়, ১ লক্ষের বেশি লোক বন্দী বা বিতাড়িত হয়, আরও বহুলোক নানাভাবে প্রাণ দেয়। কেউ কেউ বলেন যে, প্লিনি কলিঙ্গের সৈন্য সংখ্যার যে বিবরণ দিয়েছেন, অশোকের দেওয়া সংখ্যা তার থেকে অনেক বেশী।
  • (২) ডা ভাণ্ডারকর বলেন যে, হয়ত কলিঙ্গবাসীদের পক্ষ নিয়ে চোল ও পাণ্ড্যবাসীরও যুদ্ধ করে, তাই এত লোক হতাহত হয়। ডঃ রায়চৌধুরীর মতে, এই যুদ্ধে শুধুমাত্র কলিঙ্গের যোদ্ধারাই নিহত হয় নি। কলিঙ্গের সাধারণ অধিবাসীরাও নিহত হয়। তাই অশোকের দেওয়া নিহত-আহতের সংখ্যা এত বেশী।
  • (৩) যাই হোক, এই যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে কলিঙ্গ মৌর্য সাম্রাজ্য -এর অন্তর্ভুক্ত হয়। কলিঙ্গ যুদ্ধ ছিল মগধের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। “বিম্বিসার অঙ্গরাজ্য জয় করে মগধের রাজ্য বিস্তারের যে সূচনা করেন, অশোকের কলিঙ্গ জয়ের দ্বারা তার সমাপ্তি ঘোষিত হয়।” এর পর মৌর্য সম্রাটরা আর রাজ্য বিস্তারের নীতি অনুসরণ করেননি।

অশোকের ধর্মবিজয় নীতি

  • (১) কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশোক রাজ্য জয় নীতি ছেড়ে ধর্মবিজয় নীতি নেন। ধর্মবিজয় নীতির মূলে ছিল কলিঙ্গ যুদ্ধে অসংখ্য লোকের প্রাণহানি। এত লোকের প্রাণহানিতে অশোক অনুতাপে জর্জরিত হন। তাঁর ত্রয়োদশ শিলালিপিতে অশোক তার অনুতাপের কথা বলেছেন।
  • (২) অশোক তাঁর মানসিক শান্তি লাভের জন্য ভগবান তথাগত বা গৌতম বুদ্ধ -এর ধর্মমতে আশ্রয় নেন। বৌদ্ধ ধর্ম -এর অহিংসা মন্ত্র তাঁর তাপিত চিত্তে শান্তি এনে দেয়। বৌদ্ধধর্মের অহিংসাকে তিনি সার করে রাজ্যজয় নীতি ত্যাগ করে ধর্মবিজয় নীতি নেন। বিহারযাত্রা ছেড়ে ধর্মযাত্রার ব্যবস্থা করেন।
  • (৩) তিনি”ভেরীঘোষকে অর্থাৎ যুদ্ধের দামামাকে ‘ধম্মঘোষে’ বা ধর্ম প্রচারের দামামায় পরিণত করেন। তিনি তার বংশধরদের সতর্ক করে দেন যে, তারা যেন ধর্ম বিজয়ের পথ না ছাড়ে। এভাবে মৌর্য সাম্রাজ্য কলিঙ্গ যুদ্ধের পর একটি শান্তিবাদী অহিংস রাষ্ট্রে পরিণত হয়।

অশোকের জনকল্যাণ

  • (১) কলিঙ্গ যুদ্ধ অশোকের রাজাশাসন নীতির ওপরেও গভীর প্রভাব ফেলে। এর পর তিনি জনকল্যাণমূলক শাসননীতিকে অনুসরণ করেন। ষষ্ঠ শিলালিপিতে তিনি বলেন যে, “সমগ্র মানবজাতির কল্যাণ সাধন করা অপেক্ষা মহৎ কিছু নেই। যা সামানা চেষ্টা আমি এজন্য করছি তার উদ্দেশ্য হল জীবজগতের কাছে আমার ঋণ পরিশোধ করা।”
  • (২) তিনি বলেন যে, “সবে মুনিষে পজা মম” – সকল মানুষ আমার সন্তান। কৌটিল্য -এর অর্থশাস্ত্র -এও চন্দ্রগুপ্তের আমলে মগধের রাজা ছিলেন সর্বময় শক্তির আধার। তার ক্ষমতা ছিল নিরঙ্কুশ। অর্থশাস্ত্রের মতে রাজার কারও কাছে কোন দায় ছিল না। সেই মগধে চন্দ্রগুপ্তের পৌত্র অশোক যখন নিজেকে প্রজাদের কাছে ঋণগ্রস্ত বলে মনে করেন, তা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর ছিল।
  • (৩) এই চিন্তাধারার মধ্যে এক বিশেষ দায়িত্ব বোধ প্রকাশিত হয়। কোশাম্বির মতে, অশোক এই চিন্তাধারার দ্বারা Contract theory বা চুক্তি তত্ত্ব অর্থাৎ রাজার পদ প্রজার কল্যাণের কাজের জন্য এই চুক্তির ওপরেই প্রতিষ্ঠিত এইরূপ তত্ত্ব প্রচারিত হয়।

অশোকের ধর্মমহামাত্র নিয়োগ

সম্রাট অশোক তাঁর রাজ্য শাসন নীতির পরিবর্তনকে সফল করার জন্য কয়েকটি শাসনতান্ত্রিক সংস্কার করেন। তিনি ধর্ম মহামাত্র নামে এক নতুন কর্মচারীশ্রেণী নিয়োগ করেন, যাদের কাজ ছিল প্রজাদের আধ্যাত্মিক ও পারলৌকিক মঙ্গলের জন্যে কাজ করা। তিনি রাজুক, যুত মহামাত্র প্রভৃতি কর্মচারীদের তিন ও পাঁচ বছর অন্তর অনুসংযান বা পরিক্রমায় বেরোতে নির্দেশ দেন।

অশোকের কূপ খনন

সম্রাট অশোক রাষ্ট্রের সকল বিভাগকে জন-কল্যাণের কাজে লাগিয়ে দেন। তিনি পথের ধারে কুপ খনন, বৃক্ষরোপণ, জনসাধারণের দুঃখকষ্ট দূর করার জন্য চেষ্টা করেন। তিনি মনুষ্য ও পশুর জন্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন।

অশোক কর্তৃক পশুবলি নিষিদ্ধ

তিনি অনুজ্ঞা দেন যে, জীবহত্যা ও প্রাণী হত্যা নির্বিচারে করা চলবে না। রাজপ্রাসাদে দেবতার উদ্দেশ্যে পশুবলি নিষিদ্ধ হয়। সমাজে বা এক ধরনের অনুষ্ঠান যেখানে পান-ভোজন, নৃত্য-গীত হত তা তিনি খারাপ কাজ বলে ঘোষণা করেন। রাজপ্রাসাদের রন্ধনশালায় বহু প্রাণী হত্যা না করে দুইটি বন্য কুক্কুট ও একটি হরিণ বধ করার আদেশ দেওয়া হয়।

অশোকের ধর্মযাত্রা

তিনি বিহারযাত্রা বা শিকার যাত্রাকে ‘ধর্মযাত্রায়’ পরিণত করেন এবং যুদ্ধের ভেরীর ঘোষ বা নিনাদকে ধর্ম প্রচারের ভেরীতে পরিণত করেন।

উপসংহার :- কলিঙ্গ যুদ্ধের পর মৌর্য সাম্রাজ্যের অধীনে উত্তর থেকে দক্ষিণের অনেকটা অংশ ঐক্যবদ্ধ হয়। তখন আর যুদ্ধের দরকার ছিল না। এই কারণে অশোক যুদ্ধনীতি ছেড়ে জনকল্যাণ ও সংগঠন নীতি গ্রহণ করেন।

(FAQ) অশোকের রাজ্য জয় সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. মৌর্য সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সম্রাট কে?

অশোক।

২. তৃতীয় বৌদ্ধ সংগীতি কার আমলে আয়োজিত হয়?

মৌর্য সম্রাট অশোক।

৩. কলিঙ্গ যুদ্ধ কখন হয়?

২৬০ মতান্তরে ২৬১ খ্রিস্ট পূর্বে।

৪. সম্রাট অশোকের পিতা ও পিতামহ কারা ছিলেন?

পিতা বিন্দুসার ও পিতামহ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য।

Leave a Comment