তুরস্ক

তুরস্ক দেশটি প্রসঙ্গে অবস্থান, সীমা, জনসংখ্যা, ঐতিহাসিক দিক, ভৌগোলিক দিক, অর্থনৈতিক দিক, রাজনৈতিক দিক, ভাষা, ধর্ম সম্পর্কে জানবো।

স্বাধীন দেশ তুরস্ক

দেশতুরস্ক
রাজধানীআঙ্কারা
ভাষাতুর্কি
রাষ্ট্রপতিরেজেপ তাইয়িপ এরদোয়ান
বৃহত্তম নগরীইস্তাম্বুল
তুরস্ক

ভূমিকা :- পশ্চিম এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের একটি রাষ্ট্র তুরস্ক বা প্রজাতন্ত্রী তুরস্ক। তুরস্কের প্রায় পুরোটাই এশীয় অংশে, পর্বতময় আনাতোলিয়া বা এশিয়া মাইনর উপদ্বীপে পড়েছে।

তুরস্কের অবস্থান

এই দেশের ভৌগলিক অবস্থান ৩৯°৫৫′ উত্তর ৩২°৫০′ পূর্ব। মূলত ইউরোপ ও এশিয়া মহাদেশে।

তুরস্কের সীমা

এই দেশের পশ্চিমে এজিয়ান সাগর, গ্রিস ও বুলগেরিয়া; উত্তর-পূর্বে জর্জিয়া, আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানি নাখচিভান স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র; পূর্বে ইরান; দক্ষিণে ইরাক, সিরিয়া ও ভূমধ্যসাগর, সাইপ্রাস দক্ষিণ উপকূলে অবস্থিত।

তুরস্কের নামকরণ

বাংলা তুরস্ক নামটি সংস্কৃত তুরুষ্ক শব্দ থেকে এসেছে। এই সংস্কৃত শব্দটি আরবি তুর্কিয়া থেকে এসেছে। ভারত উপমহাদেশে তুরুষ্ক শব্দটি তুর্কি-পাঠান মুসলিম শাসকদের দেশকে বোঝাতে ব্যবহৃত হত। এটি মূলত মধ্য এশিয়ার তুর্কোমেনিয়া বা বর্তমান তুর্কমেনিস্তানকে নির্দেশ করত।

তুরস্কের আয়তন ও তুরস্কের জনসংখ্যা

তুরস্ক দেশটির আয়তন ৮ লক্ষ বর্গকিমিরও বেশি। বর্তমানে তুরস্কের জনসংখ্যা ৮ কোটিরও অধিক। প্রতি বর্গকিলোমিটারে এই দেশের জনসংখ্যা ১০০ জনের বেশি।

তুরস্কের ভূমিরূপ

এই দেশের উপকূল দেশটির সীমান্তের তিন-চতুর্থাংশ গঠন করেছে। তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিমে রয়েছে উর্বর সমভূমি। পশ্চিমে রয়েছে উঁচু, অনুর্বর মালভূমি এবং পূর্বে রয়েছে সুউচ্চ পর্বতমালা।

তুরস্কের জলবায়ু

তুরস্ক দেশের অভ্যন্তরের জলবায়ু চরমভাবাপন্ন হলেও ভূমধ্যসাগরের উপকূলীয় অঞ্চলের জলবায়ু মৃদু।

তুরস্কের রাজধানী ও তুরস্কের বৃহত্তম শহর

এই দেশের রাজধানী আঙ্কারা আনাতোলিয়াতে অবস্থিত। তুরস্কের বাকী অংশের নাম পূর্ব বা তুর্কীয় থ্রাস। এটি ইউরোপের দক্ষিণ-পূর্ব কোনায় অবস্থিত। এই অঞ্চলটি উর্বর উঁচু নিচু টিলাপাহাড় নিয়ে গঠিত। এখানে তুরস্কের বৃহত্তম শহর ইস্তাম্বুল অবস্থিত।

তুরস্কের জলপথ

সামরিক কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিনটি জলপথ – মার্মারা সাগর, বসফরাস প্রণালী ও দার্দানেলেস প্রণালী এশীয় ও ইউরোপীয় তুরস্ককে পৃথক করেছে। এই তিনটি জলপথ একত্রে কৃষ্ণ সাগর থেকে এজিয়ান সাগরে যাবার পথ তৈরি করেছে।

এশিয়া ও ইউরোপের সেতু বন্ধনে তুরস্কের ভূমিকা

ইউরোপ সঙ্গমস্থলে অবস্থিত হওয়ায় তুরস্কের ইতিহাস ও সংস্কৃতির বিবর্তনে বিভিন্ন ধরনের প্রভাব পড়েছে। পুরো মানবসভ্যতার ইতিহাস জুড়েই তুরস্ক এশিয়া ও ইউরোপের মানুষদের চলাচলের সেতু হিসেবে কাজ করেছে।

তুরস্কের ঐতিহাসিক দিক

  • (১) তুরস্ক দেশটির ইতিহাস দীর্ঘ ও ঘটনাবহুল। প্রাচীনকাল থেকেই বহু বিচিত্র জাতি ও সংস্কৃতির লোক অঞ্চলটি দখল করেছে। এখানে ১৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে হিটাইটদের বাস ছিল। তাদের সময়েই এখানে প্রথম বড় শহর গড়ে ওঠে। এরপর এখানে ফ্রিজীয়, গ্রিক, পারসিক, রোমান এবং আরবদের আগমন হয়।
  • (২) মধ্য এশিয়ার যাযাবর তুর্কি জাতির লোকেরা একাদশ শতকে এই দেশটি দখল করে এবং এখানে সেলজুক রাজবংশের পত্তন করে। তাদের শাসনের মাধ্যমেই এই অঞ্চলের জনগণ তুর্কি ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে মিশে যায়।
  • (৩) ত্রয়োদশ শতকে মোঙ্গলদের আক্রমণে সেলজুক রাজবংশের পতন ঘটে। ত্রয়োদশ শতকের শেষ দিকে এখানে উসমানীয় সাম্রাজ্যের পত্তন হয়। এরা ৬০০ বছর তুরস্ক শাসন করে এবং আনাতোলিয়া ছাড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব ইউরোপ এবং উত্তর আফ্রিকার এক বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃতি লাভ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ -এর পর এই সাম্রাজ্যটির পতন ঘটে।

তুরস্ক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা

১৯২৩ সালে উসমানীয় সাম্রাজ্যের তুর্কি ভাষী এলাকা আনাতোলিয়া ও পূর্ব থ্রাস নিয়ে মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক পাশা -এর নেতৃত্বে আধুনিক তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের তথা তুর্কি জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৩৮ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত কামাল আতাতুর্ক তুরস্কের রাষ্ট্রপতি ছিলেন।

তুরস্কের অতীত ঐতিহ্য

নানা বিচিত্র প্রভাবের থেকে তুরস্কের একটি নিজস্ব পরিচয়ের সৃষ্টি হয়েছে এবং এই সমৃদ্ধ সংস্কৃতির প্রভাব পড়েছে এখানকার স্থাপত্য, চারুকলা, সঙ্গীত ও সাহিত্যে। গ্রামীণ অঞ্চলে এখনও অনেক অতীত ঐতিহ্য ও রীতিনীতি ধরে রাখা আছে।

তুরস্কের অর্থনৈতিক দিক

বহু শতাব্দী ধরেই তুরস্ক ছিল মূলত কৃষিপ্রধান দেশ। বর্তমানে কৃষিখামার তুরস্কের অর্থনীতির একটি বড় অংশ এবং দেশের শ্রমশক্তির ৩৪% এই কাজে নিয়োজিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ -এর পর থেকে তুরস্কে শিল্প ও সেবাখাতের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে, বিশেষত অর্থসংস্থান, পরিবহন, এবং পেশাদারী ও সরকারি সেবায়। অধুনা কৃষির ভূমিকা হ্রাস পেয়েছে। টেক্সটাইল ও বস্ত্র শিল্প দেশের রপ্তানির প্রধান উৎস। ইউক্রেন এবং রাশিয়া উভয়ের সঙ্গেই তুরস্কের অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীর।

তুরস্কের রাজনৈতিক দিক

এই দেশের রাজনীতি একটি বহুদলীয় রাষ্ট্রপতি-শাসিত গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কাঠামোয় পরিচালিত হয়। রাষ্ট্রের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত থাকে। আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির উপর ন্যাস্ত। তুরস্কে ৫৫০ আসনের একটি সংসদ আছে, যার সদস্যরা ৫ বছরের জন্য জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন। ২০১৭ সালের পর থেকে রাষ্ট্রপতিও জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন।

তুরস্কের প্রশাসনিক অঞ্চল

প্রশাসনিক সুবিধার্থে তুরস্ককে ৮১টি প্রদেশে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রতিটি প্রদেশ কয়েকটি করে জেলায় বিভক্ত। প্রতিটি প্রদেশের নামই সেই প্রদেশের রাজধানীর নাম। সবচেয়ে বড় শহর ইস্তাম্বুল। এটি তুরস্কের বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রবিন্দু।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের তুরস্কের অবস্থান

জাতিসংঘ -এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তুরস্ক এবং জি-২০ -এর সদস্য। ২০০৮ সালের ১৭ অক্টোবর তুরস্ক ১৫১টি দেশের সমর্থন পেয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হয়। পশ্চিমাদের সাথে সম্পর্ক, বিশেষ করে ইউরোপের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখাই হল তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতির মূল কাজ।

তুরস্কের ভাষা

এই দেশের সরকারি ভাষা তুর্কি। এখানকার প্রায় ৯০% লোক তুর্কি ভাষায় কথা বলেন। এছাড়াও এখানে আদিগে, আরবি, আর্মেনীয়, আজারবাইজানি, জর্জীয়, কুর্দি এবং রোমানি ভাষা উল্লেখযোগ্য। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইংরেজি ব্যবহার করা হয়।

তুরস্কের ধর্ম

বর্তমানে তুরস্ক একটি সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষ দেশ, যার কোনো রাষ্ট্রধর্ম নেই। তুরস্কের ৯৬.৫ শতাংশ লোক ইসলাম ধর্মাবলম্বী, ০.৩ শতাংশ খ্রিস্টান ও ৩.২ শতাংশ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্রে রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে তুরস্কে ধর্মকে রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে পৃথক করা হয়।

তুরস্কের সংস্কৃতি

তুরস্ক দেশটির সংস্কৃতি বৈচিত্র্যময়। গ্রিক, রোমান, ইসলামিক ও পশ্চিমা সংস্কৃতির মিশ্রণে তাদের সংকর সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। অটোমান সম্রাটদের সময় তুরস্কে পশ্চিমা সংস্কৃতি মিশতে থাকে, যা আজও দেশটিতে অব্যাহত আছে।

তুরস্কের সাহিত্য

তুর্কি ভাষার সাহিত্য ও অন্যান্য রচনায় ইসলামি বিশ্বের ছাপ স্পষ্ট। তুর্কি সাহিত্যে পারসিক ও আরব সাহিত্যের প্রভাব লক্ষ করা যায়। তুর্কি লোকসাহিত্যে ইউরোপীয় সাহিত্যের প্রভাব ধীরে ধীরে কমে গেছে।

তুরস্কের খেলাধুলা

তুরস্কের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হল ফুটবল। ফুটবলে ২০০২ সালে জাপান-দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বকাপে তৃতীয় স্থান অর্জন করে। তুরস্ক ২০০৮ সালের ইউরো কাপের সেমিফাইনালে উঠতে সক্ষম হয়। অন্যান্য খেলার মধ্যে বাস্কেটবল ও ভলিবল খেলা খুবই জনপ্রিয়।

উপসংহার :- ১৯৪৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তুরস্ক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয়। যুদ্ধের পর দেশটি জাতিসংঘ ও ন্যাটোতে যোগ দেয়। এই সময় থেকে তুরস্কে বহুদলীয় রাজনীতির প্রবর্তন হয়। ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করে। বর্তমানে তুরস্কে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা বিরাজ করছে।

(FAQ) তুরস্ক দেশ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ইউরোপের রুগ্ন মানুষ কাকে বলা হয়?

তুরস্ক।

২. তুরস্কের রাজধানী কোথায়?

আঙ্কারা।

৩. তুরস্কের বৃহত্তম নগরী কোনটি?

ইস্তাম্বুল।

৪. তুরস্কের প্রধান ভাষা কি?

তুর্কি।

৫. তুরস্কের বর্তমান রাষ্ট্রপতি কে?

রেজেপ তাইয়িপ এরদোয়ান।

Leave a Comment