রামায়ণের রচনাকাল

রামায়ণের রচনাকাল সম্পর্কে ঐতিহাসিক ও গবেষকদের মত, ইয়াকোবি ও ম্যাকডোনেলের মত, কীথের মত, ভিন্টারনিৎস ও বুলকের মত, রামায়ণের রচনাকাল সম্পর্কে বিভিন্ন যুক্তি হিসেবে রূপক রাজ্য, যবন কথার ব্যবহার, পাটলিপুত্র নগরীর প্রতিষ্ঠা, কোশলের রাজধানীর উল্লেখ, বৈশালী নগরীর অনুল্লেখ, মহাভারতে রামোপাখ্যানের উল্লেখ, ত্রিপিটকের নাম অনুল্লেখ ও পাণিনির সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুসরণ না করা সম্পর্কে জানবো।

রামায়ণের রচনাকাল প্রসঙ্গে বাল্মীকি রচিত রামায়ণ, রামায়ণের স্রষ্টা, রামায়ণ উপখ্যানের পটভূমি ত্রেতাযুগ নামে পরিচিত পৌরাণিক সময়কাল, রামায়ণের রচনাকাল সম্পর্কে আলোচনা, রামায়ণের রচনাকাল নিয়ে বিতর্ক, রামায়ণের রচনাকাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী, সংস্কৃত মহাকাব্য রামায়ণের রচনাকাল সম্পর্কে বিভিন্ন পণ্ডিতের মতামত, পাণিনির গ্ৰন্থের পর রামায়ণ রচনা, বর্তমান রামায়ণের কিছু অংশ প্রাচীন ও কিছু অংশ নবীন, রামায়ণের রচনাকাল নিয়ে নান যুক্তি সম্পর্কে জানব।

রামায়ণের রচনাকাল

বিষয়রামায়ণের রচনাকাল
রামায়ণের রচয়িতাবাল্মীকি
কাণ্ড৭ টি
সর্গ৬৩৫
শ্লোক২৪০০০
রামায়ণের রচনাকাল

ভূমিকা:- ভারতবর্ষ-এর প্রধান মহাকাব্যদ্বয়ের মধ্যে মহর্ষি বাল্মীকি রচিত, ‘রামায়ণ‘ সাহিত্যের এক অনুপম সৃষ্টি ও বিষয় বৈচিত্র্যে অতুলনীয়। ভারতবর্ষের যুগসঞ্চিত হৃদয়াবেগের, ধর্ম ও দর্শনের, সভ্যতার ও সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটেছে এই মহাকাব্যে।

রামায়ণের রচনাকাল

তবে কোন্ সুদূর অতীতে রামায়ণ রচিত হয়েছিল, তা নির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করা কঠিন। এর কারণ,

  • (১) বর্তমানে প্রাপ্ত রামায়ণ কোনো একজন কবির রচিত সুসংবদ্ধ একটি গ্রন্থ নয়।। বর্তমানে যে আকারের রামায়ণ পাওয়া যায়, তার মধ্যে প্রথম ও সপ্তম কাভ যে প্রক্ষিপ্ত তার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে।
  • (২) এমতাবস্থায় মূল অংশের সঙ্গে প্রক্ষিপ্ত অংশের কালের ব্যবধান থাকাই স্বাভাবিক। এই সব মিলিয়েই রামায়ণের জন্য একটি বিস্তৃত কাল নির্ধারণ করাই যুক্তিযুক্ত।

রামায়ণের রচনাকাল সম্পর্কে ঐতিহাসিক ও গবেষকদের মত

বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও গবেষক রামায়ণের রচনাকাল সম্পর্কে নানা ধরনের মত ব্যক্ত করেছেন। যেমন –

  • (১) ইয়াকোবি (Jacobi) ও ম্যাকডোনেল (Macdonell) :- ঐতিহাসিক ইয়াকোবি ও ম্যাকডোনেল -এর মতে রামায়ণ প্রাকবুদ্ধ যুগে রচিত এবং এর রচনাকাল ৮০০ থেকে ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
  • (২) কীথ (Keith) এর মত :- রামায়ণ খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে রচিত বলে ঐতিহাসিক কীথ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
  • (৩) ভিন্টারনিৎস (Winternitz) এবং বুলকে (Bulcka)-এর মত :- খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকেই রামায়ণ রচিত হয়েছিল বলে তারা মনে করেন।

রামায়ণের রচনাকাল সম্পর্কে নানা যুক্তি

কিছু যুক্তি সহকারে রামায়ণের রচনাকাল নির্ণয়ের চেষ্টা করা হয়। যেমন –

(১) রূপক রাজ্য

প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রামায়ণ রূপক। এই রূপকের রাজ্যে একমাত্র ঐতিহাসিক সত্যতা হল এক সময়ে আর্যসভ্যতা দক্ষিণে, বিশেষত Ceylon অভিমুখে প্রসার লাভ করেছিল।

(২) যবন শব্দের উল্লেখ

রামায়ণে ‘যবন’ শব্দের দু-বার ব্যবহার আছে। এটা যে গ্রিকদেরই বুঝিয়েছে এমন নয়। বরং উত্তর পশ্চিম ভারতে এক সময়ে যত বৈদেশিক জাতি আক্রমণ করেছিল তাদের সবাইকেই বুঝিয়েছে। এর থেকে বলা যায় যে, ৩২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারতবর্ষে গ্রিক আক্রমণের আগেই রামায়ণ রচিত হয়েছিল।

(৩) পাটলিপুত্র নগরীর প্রতিষ্ঠা

খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে পাটলিপুত্র নগরী নির্মিত হয় এবং ৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তা এক বিশাল সাম্রাজ্য-এর রাজধানীতে পরিণত হয়। রামায়ণে এই প্রসিদ্ধ নগরীর কোনো উল্লেখ নেই। তাই এর থেকে অনুমান করা যায় যে, পাটলিপুত্র নগরী প্রতিষ্ঠার আগেই রামায়ণ রচিত হয়েছিল।

(৪) কোশলের রাজধানীর উল্লেখ

রামায়ণে কোশল -এর রাজধানীর নাম অযোধ্যা। বৌদ্ধ ও জৈন যুগে এর নাম হয়েছিল ‘সাকেত। তাই রামায়ণে ‘সাকেত’ নামটি উল্লিখিত না হওয়ায় বোঝা যায় যে, বৌদ্ধযুগের (খ্রিস্টপূর্ব ৩০০- খ্রিস্টপূর্ব ২০০) অনেক আগেই রামায়ণ রচিত হয়েছিল।

(৫) বৈশালী নগরীর অনুল্লেখ

রামায়ণে দেখা যায় যে, ‘মিথিলা’ ও ‘বিশালা’ নামে দুটি পৃথক নগরী ছিল। গৌতম বুদ্ধ -এর সময়ে এই দুটি নগরী একই শাসনতন্ত্রের অধীনে এসেছিল এবং তাদের মিলিত নাম হয় ‘বৈশালী’। কিন্তু বৈশালী নামটি রামায়ণে না থাকায় অনুমান করা যায় যে, রামায়ণের রচনাকাল বৌদ্ধযুগের আগেই।

(৬) মহাভারতে রামোপাখ্যানের উল্লেখ

গবেষকগণ রামায়ণের কাল নির্ণয়ে আরও কিছু তথ্য দেখিয়েছেন। মহাভারতের বনপর্ব, দ্রোণপর্ব ও শান্তিপর্ব এবং হরিবংশে রামোপাখ্যানের সংক্ষিপ্ত উল্লেখ আছে। যেসব পর্বে রামোপাখ্যানের উল্লেখ আছে তা মহাভারতের প্রামাণিক অংশের মধ্যেই পড়ে। মহাভারতের এই অংশের রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দী। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, মূল রামায়ণের রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকের পূর্ববর্তী।

(৭) ত্রিপিটকের নাম অনুল্লেখ

রামায়ণে বৌদ্ধ ধর্ম গ্ৰন্থ ত্রিপিটক বা প্রাচীন পালি গ্রন্থের উল্লেখ না থাকায় প্রমাণিত হয় যে, রামায়ণ বৌদ্ধযুগের আগে রচিত।

(৮) পাণিনির সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুসরণ নয়

বাল্মীকির ভাষা পাণিনির সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুসরণ করেনি, তাই বাল্মীকি পাণিনি (খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক) র পূর্ববর্তী।

উপসংহার:- ঐতিহাসিক ও গবেষকদের দেওয়া এই সব তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায় যে, রামায়ণের মূল অংশ খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকের আগেই রচিত হয়েছিল। তবে সংযোজিত অংশগুলি এর পরবর্তীকালের হলেও অবশ্যই খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের পরে নয় একথা বলাই যায়।

(FAQ) রামায়ণের রচনাকাল সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ভারতের দুটি মহাকাব্যের নাম কি ছিল?

রামায়ণ ও মহাভারত।

২. ভারতবর্ষের আদিকাব্য কাকে বলা হয়?

রামায়ণ।

৩. রামায়ণ কে রচনা করেন?

মহর্ষি বাল্মীকি।

৪. রামায়ণের শ্লোক সংখ্যা কত?

২৪০০০

৫. কটি কাণ্ডে রামায়ণ সমাপ্ত হয়েছে?

৭ টি।

Leave a Comment