১৮১৭-১৮ খ্রিস্টাব্দের তৃতীয় ইঙ্গ মারাঠা যুদ্ধ -এর সময়কাল, বিবাদমান পক্ষ, মারাঠা সামন্তদের ক্ষোভ, পেশোয়ার মন্ত্রীকে আটক, পিণ্ডারীদের দমন, লর্ড ময়রার আগমন, পুণার চুক্তি, ভোঁসলে ও সিন্ধিয়াকে সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য করা, যুদ্ধ শুরু, যুদ্ধের অবসান ও তৃতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে জানবো।
১৮১৭-১৮ খ্রিস্টাব্দের তৃতীয় ইঙ্গ মারাঠা যুদ্ধ
সময়কাল | ১৮১৭-১৮ খ্রিস্টাব্দ |
বিবাদমান পক্ষ | ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও মারাঠা |
ফলাফল | মারাঠাদের পরাজয় ও পতন |
ভূমিকা :- পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও দ্বিতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ -এর পূর্বে বেসিনের সন্ধি স্বাক্ষর করে ইংরেজদের অধীনতা মেনে নিলেও ইংরেজদের ক্রমবর্ধমান প্রভুত্ব তাঁর কাছে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। এ থেকে মুক্তি পাবার জন্য তিনি সচেষ্ট ছিলেন।
তৃতীয় ইঙ্গ মারাঠা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মারাঠা সামন্তদের ক্ষোভ
মারাঠা সামন্তগণও ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রবল ক্ষুব্ধ হয়ে অস্ত্রধারণের জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। তবে পেশোয়া ও মারাঠা নেতৃবৃন্দের কার্যকলাপ সম্পর্কে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ অবহিত ছিলেন।
মারাঠা পেশোয়ার মন্ত্রীকে গ্রেপ্তার
এই সময় পেশোয়ার বিশ্বস্ত মন্ত্রী ত্রিম্বকজি ডিংলে কে ব্রিটিশ রেসিডেন্ট এলফিনস্টোন একটি মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তার করলে পেশোয়া ক্রুদ্ধ হন।
ইংরেজদের দ্বারা পিণ্ডারীদের দমন
সিন্ধিয়া, হোলকার প্রভৃতি সামন্ত রাজাদের সঙ্গে পিণ্ডারী দস্যুদের যোগ ছিল। কোম্পানি পিণ্ডারীদের দমনে উদ্যোগী হলে মারাঠা সামন্ত রাজারা কোম্পানির বিরুদ্ধে পেশোয়ার সঙ্গে যোগ দেন।
লর্ড ময়রার ভারতে আগমন
এই সময় ভারত -এর গর্ভনর জেনারেল ছিলেন লর্ড হেস্টিংস বা লর্ড ময়রা (১৮১৩-২৩ খ্রিঃ)। তিনি ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তার নীতির পক্ষপাতী ছিলেন।
ইংরেজ ও মারাঠাদের মধ্যে পুণার সন্ধি স্বাক্ষর
১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে গভর্নর জেনারেল লর্ড ময়রা পেশোয়াকে অপমানজনক পুণার সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য করান। বলা বাহুল্য, এই সন্ধি পেশোয়ার কাছে মৃত্যুশেলের সমান ছিল।
ইংরেজ ও মারাঠাদের মধ্যে পুণার সন্ধির শর্ত
এই সন্ধির শর্ত অনুসারে,
- (১) পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও মারাঠা সাম্রাজ্যের নেতৃপদ ত্যাগ করেন।
- (২) রাজ্যের একাংশ ইংরেজদের ছেড়ে দেন এবং
- (৩) ইংরেজদের বিনা অনুমতিতে কোনও বহিঃশক্তির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে বিরত হতে বাধ্য হন।
ভোঁসলে ও সিন্ধিয়াকে সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য করা
কেবলমাত্র পেশোয়াই নন-ভোঁসলে ও সিন্ধিয়াকেও অনুরূপ অপমানজনক চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়।
তৃতীয় ইঙ্গ মারাঠা যুদ্ধ শুরু
মারাঠা নেতৃবৃন্দের পক্ষে এই অপমানজনক চুক্তি মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। পেশোয়া বিদ্রোহ ঘোষণা করলে সিন্ধিয়া, হোলকার ও ভোঁসলে তাঁর সঙ্গে যোগ দেন। ইংরেজ বাহিনী পুণা দখল করলে বাজিরাও পলায়ন করেন।
তৃতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধের অবসান
১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে ভোঁসলে ও হোলকার যথাক্রমে সীতাবলদি ও মাহিদপুরের যুদ্ধে পরাজিত হন। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে পেশোয়া কোরেগাঁও ও অস্টির যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করলে তৃতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধের অবসান ঘটে।
তৃতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধের ফলাফল
ভারতের ইতিহাসে তৃতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধের ফলাফল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। যেমন –
(১) পেশোয়া পদ লোপ
পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাওকে গদিচ্যুত করা হয়। তিনি কোম্পানির বৃত্তিভোগীতে পরিণত হন এবং পেশোয়া পদ লুপ্ত করে তাঁর রাজ্য কোম্পানির সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। তাঁর রাজ্যের কিছু অংশ শিবাজির এক বংশধরকে দেওয়া হয়।
(২) মারাঠা সামন্তদের অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি গ্রহণ
হোলকার অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তিতে আবদ্ধ হন এবং ভোঁসলের রাজ্য ইংরেজ সাম্রাজ্যভূত হয়। সিন্ধিয়ার প্রভাবাধীন রাজপুত রাজ্যগুলি ইংরেজদের সঙ্গে অধীনতামূলক মিত্রতা নীতিতে আবদ্ধ হওয়ায় রাজপুতানায় ব্রিটিশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
(৩) অপ্রতিহত ইংরেজ শক্তি
এইভাবে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পাঞ্জাব ও সিন্ধু ছাড়া সমগ্র ভারতে ব্রিটিশ আধিপত্য স্থাপিত হয়। মারাঠা সাম্রাজ্যের পতন-এর ফলে ভারতে ইংরেজদের সবচেয়ে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীর পতন ঘটে এবং ইংরেজরা ভারতে অপ্রতিহত হয়ে ওঠে।
(৪) অর্থনৈতিক গুরুত্ব
কেবল রাজনৈতিক দিক থেকেই নয়—অর্থনৈতিক দিক থেকেও ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ অতি গুরুত্বপূর্ণ। মারাঠাদের পতনের ফলে ইংরেজ বাণিজ্যকেন্দ্র বোম্বাইয়ের গুরুত্ব যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায় এবং অচিরেই তা পশ্চিম ভারতের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়। রেল যোগাযোগ স্থাপিত হলে এই গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায়।
(৫) বস্ত্র শিল্পের কেন্দ্র রূপে বোম্বাইয়ের উত্থান
পারসি ও গুজরাটি বণিকরা দলে দলে বোম্বাই শহরে বসতি স্থাপন করে এবং অচিরেই বোম্বাই বস্ত্রশিল্পের এক বিখ্যাত কেন্দ্রে পরিণত হয়।
(৬) মারাঠা শক্তির পতন
এক কথায়, তৃতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধে মারাঠা শক্তির পতন হয় এবং ইংরেজ শক্তি ভারতে অপ্রতিহত হয়ে ওঠে।
উপসংহার :- ডঃ পার্সিভাল স্পিয়ার ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দকে ‘জলবিভাজিকা‘ (‘watershed’) বলে অভিহিত করেছেন।তাঁর মতে, “ঐ বৎসর (১৮১৮ খ্রিঃ) ভারতে স্থাপিত ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভারতের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। বলা বাহুল্য, ডঃ স্পিয়ার -এর এই বক্তব্য যথার্থ নয়। কারণ, শিখদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সংগ্রাম তখনও শুরু হয়নি।
(FAQ) তৃতীয় ইঙ্গ মারাঠা যুদ্ধ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৮০৩-১৮০৫ খ্রিস্টাব্দ।
লর্ড হেস্টিংস বা লর্ড ময়রা।
দ্বিতীয় বাজিরাও।
দ্বিতীয় বাজিরাও।